সনাতন ধর্মের পৌরাণিক গ্রন্থগুলোতে অভিশাপ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একইভাবে, অভিশাপ ও অভিশপ্ত চরিত্রগুলোকে নিয়ে বার বার আবর্তিত হয়েছে মহাভারতের কাহিনীও। এই গ্রন্থে এমন সব অভিশাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা সমগ্র মহাভারতের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে বারবার। এমনকি এই অভিশাপের প্রকোপ থেকে বাঁচতে পারেননি স্বয়ং যমরাজ, মহারাজ পাণ্ডু, অঙ্গরাজ কর্ণ, পাণ্ডুপুত্র অর্জুন, মাতা কুন্তী, রুদ্রাংশ অশ্বত্থামা, মহারাজ পরিক্ষীত বা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণও। প্রিয় দর্শক, আজ আমরা আপনাদের সামনে মহাভারতের সেই ১০টি ভয়ংকর অভিশাপের কথা তুলে ধরতে চলেছি যেগুলো অভিশপ্তদের জন্য যেগুলো ডেকে এনেছিল ভয়ংকর করুন পরিণতি।
ঋষি মাণ্ডব্য কর্তৃক যমরাজকে অভিশাপ
একদা ঋষি মাণ্ডব্য তার নিজের আশ্রমে উর্দ্ধবাহু হয়ে তপস্যায় রত ছিলেন। এসময় একদল চোর রাজবাড়ি থেকে মূল্যবান ধনরত্ন চুরি করে পালচ্ছিলেন। রাজবাড়িতে চোরের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজবাড়ির সিপাহিরা চোরের দলটিকে পেছন থেকে তাড়া করে। আর চোরের দল অগত্যা কোন উপায় না পেয়ে পার্শ্ববর্তী মাণ্ডব্য মুনির আশ্রমে আত্মগোপন করে। মাণ্ডব্য মুনি তপস্যারত ছিলেন বিধায় তিনি চোরের দলটিকে তার আশ্রমে আত্মগোপন করতে দেখেও কোন কথা বললেন না। এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যে রাজার সিপাহীরা এসে হাজির হলেন মাণ্ডব্য মুনির আশ্রমে। তারা মুনিকে জিজ্ঞাসা করলেন তার আশ্রমে কোন চোরের দল আশ্রয় নিয়েছে কি না। মাণ্ডব্য মুনি পড়লেন উভয় সংকটে একদিকে সিপাহীদেরকে চোরদের কথা বলে দিলে শরণাগত রক্ষা পায় না অন্যদিকে মিথ্যা বলা মহাপাপ। সুতারাং মাণ্ডব্য মুনি মৌনব্রত পালন করলেন। অর্থাৎ, তিনি সিপাহিদের প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। আর মুনির কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে রাজার সিপাহীরা মুনির আশ্রম তল্লাশি করে খুজে বের করলেন চোরের দলকে। এবং মাণ্ডব্য মুনি নিজেও এই চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত ভেবে সিপাহীরা তাকেও বন্দী করে নিয়ে চললেন রাজসভায়। যথারীতি রাজার বিচারে শূলে গ্রথিত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয় চোরের দল ও মাণ্ডব্য ঋষির। তবে শূলে চড়ানোর ফলে চোরের দলের মৃত্যু হলেও মৃত্যু হল না মাণ্ডব্য ঋষির। শূলে চড়ানোর পরেও ঋষির মৃত্যু হয়নি দেখে রাজা বুঝতে পারলেন এ কোন সাধারণ মানুষ নন এবং তিনি এই চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িতও নন। তাই রাজা মাণ্ডব্য ঋষির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাকে শূল থেকে নামিয়ে মুক্তি দিলেন। তবে মুনিকে যে শূল দ্বারা বিদ্ধ করা হয়েছিল সেই শূলের অগ্রভাগ বিঁধে রইল মুনির শরীরে। আর শূলের অগ্রভাগকে যেহেতু অণি বলা হয় তাই মাণ্ডব্য ঋষির নতুন নাম হল অণি মাণ্ডব্য।
তবে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়েও সন্তুষ্ট হননি ঋষি মাণ্ডব্য। বিনা দোষে কেন তাকে এই যন্ত্রনা সহ্য করতে হল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি হাজির হলেন যমালয়ে। তিনি যমরাজকে প্রশ্ন করলেন, হে ন্যায় বিচারক আমি জ্ঞানত কোন অন্যায় বা পাপ করিনি তবে কোন অপরাধে আমাকে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মত যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি দেওয়া হল? উত্তরে যমরাজ বললেন, “হে মুনিবর, আপনি বাল্যকালে একটি তীক্ষ্ণ ঘাসের ডগা দ্বারা একটি পতঙ্গকে বিদ্ধ করেছিলেন। সেই অপরাধে আপনার জন্য এই শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে।” যমরাজের উত্তর শুনে আরও ক্রুদ্ধ হলেন ঋষি মাণ্ডব্য। তিনি যমরাজকে বললেন, “শাস্ত্রে কথিত আছে, ১২ বৎসর বয়স পর্যন্ত বালক অবোধ থাকে। সেই অবস্থায় সে যদি ভয়ানক পাপও করে, তাও ক্ষমার যোগ্য। আর বাল্যবয়সের চপলতায় কৃত একটি অপরাধের ফলে আপনি আমার জন্য লঘুপাপে গুরুদণ্ড নির্ধারণ করেছেন, অথচ শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণহত্যা অন্য সকল প্রাণীহত্যার অপেক্ষা গুরুতর পাপ। অতএব, আজ আমি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি এই অপরাধের জন্য আপনি আপনি পৃথিবীলোকে এক শুদ্র মাতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন।” প্রিয় দর্শক, জানেন কি যমরাজের এই পার্থিব অবতারটির নাম কি? আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনি বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীদের দাসীর গর্ভে জন্ম নেওয়া মহামতি বিদুর।
পাণ্ডুকে প্রদত্ব কিন্দম মুনির অভিশাপ
কিন্দম ঋষি কর্তৃক মহারাজ পাণ্ডুকে প্রদত্ব অভিশাপ মহাভারতে প্রবর্তন করেছিল এক অভিনব ধারা। মহাভারতের আদি পর্ব থেকে জানা যায়, মহারাজ পাণ্ডু একদা মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী একটি জঙ্গলে। এসময় তিনি একটি সঙ্গমরত হরিণ যুগলের উপরে বাণ বর্ষণ করে হরিণ দুটিকে বিদ্ধ করেছিলেন। তবে সঙ্গমরত হরিণযুগল কোন সাধারণ হরিণ বা হরিণী ছিল না। মূলত ঋষি কিন্দম ও তার স্ত্রীই হরিণ ও হরিণীর রূপ ধারন করে সম্ভোগক্রিয়ায় রত ছিলেন। আর তাই মহারাজ পাণ্ডু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তার নিক্ষেপিত বাণ হরিণ ও হরিণীরূপী দুজন মানুষকে বিদ্ধ করবে। বাণবিদ্ধ হওয়ার পরে হরিণটি ফিরে এল তার স্বরূপে তথা ঋষি কিন্দমের রূপে। তিনি মহারাজ পাণ্ডুকে তার এই নৃসংশ কৃতকর্মের জন্য ধিক্কার জানালেন এবং তিরস্কার করলেন। সেইসাথে তিনি তাকে অভিশাপ দিলেন, “ হে মহারাজ পাণ্ডু, সামান্য চিত্ত বিনোদনের জন্য তুমি মৃগয়া নামক যে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছ তা ক্ষমার অযোগ্য। কারণ মৃগয়া করতে এসে পশু শিকার করতে গিয়ে তুমি এক ব্রাহ্মণকে হত্যা করলে। তবে তুমি যেহেতু মৃগ ভেবে আমার উপর শরনিক্ষেপ করেছ, এজন্য তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ হবে না। কিন্তু মনে রেখে, সঙ্গমকালে আমাকে বধ করাতে তোমার যে পাপ হয়েছে, তাহার ফল অবশ্যই তোমাকে ভোগ করতে হবে। আমি ঋষি কিন্দম তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, যে মুহুর্তে তুমি স্ত্রীসম্ভোগে রত হবে ঠিক সেই মুহুর্তেই তোমার মৃত্যু হবে। এবং তুমি যে পত্নীর সাথে সংসর্গ করে কালগ্রাসে পতিত হবে, সেই স্ত্রীই ভক্তিভাবে তোমার সহগামিনী হবেন। হে রাজন! তুমি যেমন সুখের সময়ে আমাকে দুঃখ দিলে, সেইরূপ তোমাকেও সুখকালে দুঃখ পেতে হবে।
কিন্দম ঋষির এই অভিশাপের পর থেকে মহারাজ পাণ্ডুর দুই স্ত্রী কুন্তী এবং মাদ্রী স্বামী-সংসর্গ থেকে বঞ্চিত হন। এবং যেহেতু পাণ্ডুর পক্ষে জৈবিকভাবে সন্তান উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না তাই দুর্বাসার দেওয়া মন্ত্র দ্বারা ধর্মরাজ, পবনদেব ও ইন্দ্রদেবের আশির্বাদে কুন্তী জন্ম দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনকে। অন্যদিকে সেই একই মন্ত্র ব্যবহার করে এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ঔরসে মাদ্রী জন্ম দিয়েছিলেন নকুল ও সহদেবকে। তবে এভাবেও শেষ রক্ষা হয়নি মহারাজ পাণ্ডুর। বসন্ত বিরাজিত এক পরিবেশে একদা পাণ্ডু তার ২য় স্ত্রী মাদ্রীকে দেখে বিমোহিত হন। এরপর মাদ্রীর নিষেধ অগ্রাহ্য করে এবং অভিশাপের কথা ভুলে গিয়ে তিনি তার সাথে সঙ্গমে রত হয়েছিলেন। ফলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন মহারাজ পাণ্ডু। তার স্ত্রী মাদ্রীও এই মর্মান্তিক ঘটনার পিছনে নিজেকে দায়ী করেন। অতঃপর কিন্দম মুনির সেই অভিশাপ অনুসারে নকুল ও সহদেবকে কুন্তীর হাতে সমর্পণ করে স্বামীর সাথে সহমরণে গিয়েছিলেন তিনি।
কর্ণকে পরশুরামের অভিশাপ
মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ংকরতম অভিশাপ ছিল অঙ্গরাজ কর্ণকে প্রদত্ব ভগবান পরশুরামের অভিশাপ। ভগবান পরশুরাম ব্রাহ্মণকুলে জন্ম নেওয়ার সত্ত্বেও আচার আচরণে এবং কর্মে তিনি ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ক্ষত্রিয়। কুরু-পাণ্ডবদের পিতামহ ভীষ্মকেও অস্ত্রশিক্ষা দান করেছিলেন তিনি। একদা কাশিরাজের কন্যা অম্বাকে কেন্দ্র করে ভীষ্মের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন তিনি। তবে ২৩ দিন ধরে লাগাতার যুদ্ধের পরেও নিজের শিষ্য ভীষ্মকে পরাজিত করতে পারেননি তিনি। আর এই ঘটনার পর থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি আর কখনোই কোন ক্ষত্রিয়কে অস্ত্রশিক্ষা দেবেন না।
অন্যদিকে সূর্যপুত্র কর্ণ ক্ষত্রিয়ের সন্তান হয়েও লালিত পালিত হয়েছিলেন শুদ্রের ঘরে। তিনি চেয়েছিলেন ভগবান পরশুরামের কাছ থেকে অস্ত্র শিক্ষা করতে। তবে সেযুগে শুদ্রদের অস্ত্রবিদ্যা লাভের সুযোগ ছিল না। আবার কোন ক্ষত্রিয়কে পরশুরাম অস্ত্রশিক্ষা দেবেন না। অগত্যা নিজেকে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়ে ভগবান পরশুরামের শিষ্যত্ব লাভ করেন তিনি। অস্ত্রবিদ্যা লাভ করার সময় কোন একদিন কর্ণের কোলে মাথা রেখে নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়েছিলেন পরশুরাম। এসময় একটি জংলী পতঙ্গ এসে কর্ণকে তীব্রভাবে দংশন করে। কিন্তু পরশুরামের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কর্ণ নীরবে সেই ব্যাথা-যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘুম ভাঙল পরশুরামের। তিনি খেয়াল করলেন একটি বিষাক্ত পতঙ্গ কর্ণের শরীরকে ছেদন করতে করতে ভিতরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ কর্ণকে বলে উঠলেন, “তুমি ব্রাহ্মণ হতে পার না। শাস্ত্র এবং বিদ্যাশিক্ষায় নিয়োজিত কোন ব্রাহ্মণ কোনভাবেই এই তীব্র দংশন মুখ বুজে সহ্য করতে পারে না। তুমি নিশ্চয়ই কোনো ক্ষত্রিয় হবে। এবং আমার সাথে এরূপ ছলনা করার জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দেব।”
পরশুরামের এই অগ্নিমূর্তি দেখে কর্ণ পরশুরামের চরণতলে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। তিনি বললেন, “গুরুদেব, আমি ব্রাহ্মন নই সত্য, তবে আমি ক্ষত্রিয়ও নই। আমি একজন সূতপুত্র। আমি আপনার সাথে অর্ধেক সত্য বলেছি। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন।” তবে কর্ণ নিজে না জানলেও পরশুরাম ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন কর্ণ কোন সূতপুত্র নয়, ক্ষত্রিয়ের সন্তান। আর তাই তিনি কর্ণের অনুরোধে কর্ণপাত না করে তাকে অভিশাপ দিলেন, “তুমি যেমন আমার কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা অর্জন করার জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছ, তেমনি তোমার এই অস্ত্রবিদ্যাও একদিন তোমার সাথে নিষ্ঠুরভাবে ছলনা করবে। কোন একদিন তোমার এমন এক সময় আসবে যখন তীব্র প্রয়োজন সত্বেও তুমি আমার কাছ থেকে শেখা অস্ত্রজ্ঞান ভুলে যাবে।” আর পরশুরামের দেওয়া সেই অভিশাপ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যকার যুদ্ধে। সেদিন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ব্রহ্মাস্ত্রকে আহবান করার বিদ্যা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে অর্জুনের নিক্ষেপিত অঞ্জলিকাস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল মহাবীর কর্ণকে।
অর্জুনকে অপ্সরা উর্বশীর অভিশাপ
সমগ্র মহাভারত জুড়ে যে ভয়ংকর সব অভিশাপের কথা বলা হয় সেখানে অর্জুনকে উর্বশী যে অভিশাপ দিয়েছিলেন তা কিছুটা হলেও ব্যাতিক্রমী। পাণ্ডবদের বনবাসকালীন সময়ে যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অর্জুন দিব্যরথে চড়ে তার পিতা দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে অর্থাৎ ইন্দ্রলোকে গমন করেন। সেখানে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে তিনি লাভ করেছিলেন পশুপাতাস্ত্র। আবার দেবরাজ ইন্দ্রের চিরশত্রু কালকেয়ও ও নিপাত কবচকে নিধন করে সমস্ত দেবতাগণকে সন্তুষ্ট করেছিলেন অর্জুন। এর ফলে স্বর্গের দেবতাগণ অর্জুনকে উপহার হিসেবে দান করেছিলেন বিবিধ প্রকার অস্ত্রশস্ত্র এবং দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান। এমনকি দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে ইন্দ্রসখা চিত্রসেন অর্জুনকে গীত ও নৃত্যে পারদর্শী করে তুলেছিলেন।
তো চিত্রসেনের কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষে অর্জুনকে নৃত্যে পারদর্শী করার জন্যে আগমন ঘটে শ্রেষ্ঠতমা অপ্সরা ঊর্বশীর। তাঁর অপূর্ব নৃত্যে অর্জুনের আঁখিপল্লব যখন স্থির এবং অপলক তাঁর দৃষ্টিপাত, এসময় চিত্রসেন অর্জুনের এমন অবস্থা দেখে ভাবলেন অর্জুন বোধহয় ঊর্বশীর প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়েছেন। বস্তুত কুরু-পাণ্ডবদের পুর্বপুরুষ পুরূরবার স্ত্রী ছিলেন এই উর্বশী। সেকারনে অর্জুন উর্বশীকে মাতৃরূপে শ্রদ্ধা করতেন। এবং সেই শ্রদ্ধাবোধ থেকেই অর্জুন উর্বশীর প্রতি নিক্ষেপ করেছিলেন তার অপলক দৃষ্টিপাত। তবে চিত্রসেন বুঝলেন এর ঠিক উল্টো। আর চিত্রসেনের কাছ থেকে উর্বশীর প্রতি অর্জুনের আসক্তির কথা জানতে পেরে ইন্দ্রদেব উর্বশীকে পাঠালেন অর্জুনের নিকট।
ইন্দ্রদেবের আদেশ পেয়ে, অর্জুনের নিকট যাওয়ার পূর্বে ঊর্বশী এমনভাবে শৃঙ্গার এবং পূর্বরাগে নিজেকে প্রস্তুত করলেন, যেন অর্জুন তাঁকে অবলোকন করা মাত্রই সাথে কামোদ্দীপক হয়ে ওঠেন। তো ঊর্বশী কামমোহিনী বেশে সজ্জিতা হয়ে অর্জুনের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন- “হে অর্জুন, তোমার পিতৃদেব দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশানুসারে আমি আজ তোমার নিকট উপস্থিত হয়েছি অভিসারিকা বেশে। ” অপ্সরা উর্বশীর মুখে এই কথা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে গেলেন অর্জুন। তিনি লজ্জায়-সংকোচে কুন্ঠিত কণ্ঠে বললেন – ‘আপনি যে কথা ব্যক্ত করলেন, সেকথা শ্রবণ করাও ভয়ঙ্কর পাপ !’ উত্তরে ঊর্বশী বললেন- “হে কৌন্তেয়, আমি এখন তোমার অভিসারিকা। তোমার মতো সুপুরুষের সাথে আমি প্রেমসাগরে অবগাহন করতে চাই।”
এবার অর্জুন হাত জোড় করে ততধিক কুন্ঠিত হয়ে বললেন- “হে দেবী ঊর্বশী, আপনি পিতামহ নৃপতি পুরূরবা’র পত্নী। আমি সেই বংশেরই অধস্থন। এবং সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আপনি আমার পিতামহী, আমি কিভাবে আপনাকে আমার শয্যায় স্থান দিতে পারি ! শচী ,কুন্তী এদের মতো আপনিও আমার মাতৃস্থানীয়।” অর্জুনের এহেন আচরণে বিব্রতা, ক্রোধাদ্দীপ্তা ঊর্বশী বললেন – “এসব যুক্তি প্রহেলিকা মাত্র। কামোদ্দীপক শব্দবাণের পরিবর্তে আমায় প্রত্যাখ্যান করে তুমি নপুংসকতার পরিচয় দিয়েছো। তোমার এই কার্য্য পুরুষহীনতার সমান। আর তাই আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি- পুরুষের অভিমান তোমার থাকবে না, নারীজাতির মাঝেই তুমি বিচরণ করবে। দেবলোক, মর্ত্যলোক ও পাতাললোক অবলোকন করবে যে, তুমি পুরুষ নও, তুমি ষণ্ঢ ; তোমার বীর্যের নিষ্ফলতা এবং পৌরুষেয় বীজহীনতা তোমার মধ্যে প্রগাঢ় হবে।”
তবে পরবর্তীতে দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে এই অভিশাপ কিছুটা প্রশমিত করেছিলেন উর্বশী। তিনি এই অভিশাপের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করেছিলেন মাত্র এক বছর এবং সেই এক বছর সময়কাল অর্জুনের ইচ্ছানুসারে হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে বিরাট রাজার দেশে পঞ্চপাণ্ডব যখন অজ্ঞাতবাস করছিলেন তখনই অর্জুন উর্বশীর সেই অভিশাপ নিজের উপরে ফলিয়েছিলেন। সেখানে বৃহন্নলা রূপ ধারণ করে তৃতীয়া প্রকৃতির মানুষ হিসেবে এক বৎসরকাল অতিবাহিত করেছিলেন অর্জুন। তার এই তৃতীয়া প্রকৃতির মধ্যে কখনও ছিল পুরুষ ভাবের আধিক্য, কখনও আবার নারী ভাবের আধিক্য। আর চিত্রসেনের কাছে শিক্ষা পাওয়া নৃত্যগীত তিনি শিখিয়েছিলেন বিরাট রাজার কন্যা উত্তরাকে।
গো-হত্যা করার কারনে কর্ণকে প্রদত্ত্ব এক ব্রাহ্মনের অভিশাপ
জন্মসূত্রে দেবী কুন্তীর জেষ্ঠ্য সন্তান হওয়ার সত্ত্বেও কর্ণের কপালে জোটেনি পুত্রের স্বীকৃতি। আর তাই পালক পিতার পরিচয়ে তাকে পরিচিত হতে হয়েছিল সূতপুত্র হিবে। তবে যার ধমনিতে বইছে ক্ষত্রিয়ের রক্ত তাকে কি সূতপুত্রের তকমা দিয়ে আটকে রাখা যায়? ছোটবেলা থেকে কর্ণ ছিলে ধনুর্বিদ্যার প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী ও পারদর্শী। স্বীয় প্রচেষ্টায় তিনি রপ্ত করেছিলেন ধনুর্বিদ্যার অনেক খুঁটিনাটি কৌশল। তবে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধারী হওয়ার বাসনায় তিনি শরাণাপন্ন হয়েছিলেন ভার্গব বংশীয় মহাবীর পরশুরামের কাছে। সেখানে ছলনার আশ্রয় নিয়ে পরশুরামের কাছে তিনি শিক্ষা করতে শুরু করেছিলেন তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত ধনুর্বিদ্যা। তো কোন একদিন ভগবান পরশুরামের অনুপস্থিতিতে কর্ণ একাই ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করছিলেন। তাঁর সেদিনকার অনুশীলন ছিল লক্ষ্যভেদ কেন্দ্রিক। কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললেও দুর্ভাগ্য যেন কর্ণের সঙ্গ ছাড়ছিল না কিছুতেই।
সেদিনও কর্ণের কপালে নেমে এল আরও এক দুর্ভাগ্য। লক্ষ্যভেদ অনুশীলন করতে করতে হঠাৎ লক্ষভ্রষ্ট হয় কর্ণের নিক্ষেপিত একটি বাণ। লক্ষ্যভ্রষ্ট বাণটি গোচারণভূমির দিকে গিয়ে বিদ্ধ করেছিল এক ব্রাহ্মণের হোমধেনুকে। বাণবিদ্ধ গাভীটি তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুমুখে পতিত হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই। ইতিমধ্যে গাভীটির আর্তচিৎকারে ছুটে এসেছিলেন গাভীটির প্রতিপালক ব্রাহ্মণও। তিনি নিজের চোখের সামনে তারই হোমধেনুর এরকম অসহায় ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন কর্ণের উপরে। আর সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি কর্ণকে অভিশাপ দিলেন, “হে বালক, যেরকম অসহায় অবস্থায় তুমি এই নিরীহ জীবটিকে হত্যা করেছ, তোমার মৃত্যুও হবে সেরকম অসহায় নিরস্ত্র অবস্থায়। এই গাভীর মত তোমার মৃত্যুও ঘটবে তীব্র যন্ত্রণার সাথে।”
বলাই বাহুল্য দরিদ্র সেই ব্রাহ্মণের অভিশাপ ফলে গিয়েছিল অক্ষরে অক্ষরে। অর্জুনের সাথে যুদ্ধের সময় যখন কর্ণের মৃত্যু হয় তখন তাঁর রথের চাকা ছিল মাটিতে বসা, কর্ণ ছিলেন নিরস্ত্র এবং কর্ণের চোখেমুখে ছিল চরম অসহায়ত্বের ছাপ।
ধরিত্রী কর্তৃক কর্ণকে অভিশাপ
সমগ্র মহাভারত জুড়ে কর্ণই সম্ভবত সবচেয়ে বেশীবার মারাত্মক অভিশাপের সম্মুখীন হয়েছিলেন। স্বয়ং সূর্যদেবের পুত্র হওয়ার সত্ত্বেও এক অভিশপ্ত জীবন যাপন করেছিলেন কর্ণ। তাঁর উপরে তিন তিনটি মারাত্মক অভিশাপও তিনি প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাঁর যাপিত জীবনে। ভগবান পরশুরাম তাকে দিয়েছিলেন প্রথম অভিশাপ, হোমধেনু বধ করার কারনে দরিদ্র ব্রাহ্মণ দিয়েছিলেন দ্বিতীয় অভিশাপ এবং তৃতীয় অভিশাপটি তিনি প্রাপ্ত হয়েছিলেন মাতা ধরিত্রী কর্তৃক।
তো একদা কর্ণের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে একটি ক্রন্দনরত কন্যাশিশুর সাথে। শিশুটি এত তীব্রভাবে ক্রন্দন করছিল যে তাঁর প্রতি করুণা হয় কর্ণের। তিনি শিশুটির কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন তাঁর কান্নার কারন কি? শিশুটি তখন মাটির দিকে নির্দেশ করে বলল, “আমি একটি মৃৎ পাত্রে কিছু দুধ নিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মাটিতে হোঁচট খেয়ে পাত্রের সবটুকু দুধই এখানে মাটিতে পড়ে গিয়েছে। এই দুধটুকুই ছিল আমার দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের জন্য ক্ষুধা নিবারণের একমাত্র সম্বল। এখন আমি আমার গৃহে দুধ না নিয়ে গেলে আমাদের সবাইকে অনাহারে থাকতে হবে।” সামান্য একটু দুধের জন্য শিশুটির কান্না দেখে কর্ণ তাকে অন্যত্র থেকে কিছু দুধের ব্যাবস্থা করে দিতে চাইলেন। কিন্তু শিশুটি তাতেও রাজি নয়। কারণ সে বিনামূল্যে অন্যের কোন বস্তু গ্রহণ করতে চায় না। সুতারাং শিশুটিকে সাহায্য করতে হলে মাটিতে ফেলে দেওয়া দুধই আবার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই অনেক ভেবে কর্ণ সেই স্থানে একটি শক্তিশালী বাণ নিক্ষেপ করে মাটি নিংরে শিশুটির পাত্র আবার দুধে পরিপূর্ণ করে দিলেন। শিশুটিও খুশি মনে ফিরে গেল আপন গৃহে। তবে নিষ্ঠুরভাবে বাণ নিক্ষেপ করে মাটি নিংরে দুধ বের করার সময় অত্যন্ত ব্যাথিতা হন মাতা ধরিত্রী। এবং যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তিনি কর্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, “হে কর্ণ, সামান্য একটু গোদুগ্ধের জন্য তুমি আমাকে নিষ্ঠুরভাবে কষ্ট দিয়েছ। তাই আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, তোমার জীবনেও এমন একদিন আসবে যেদিন তীর নিক্ষেপের কারনে সৃষ্ট ধরিত্রীর বুকের গর্তই তোমার মৃত্যু হবে। ” এবং পরের ঘটনা আপনাদের সবার জানা। অর্জুনের সাথে যুদ্ধের সময় কর্ণের চাকা বসে গিয়েছিল মাটিতে। আর সেই সুযোগে নিরস্ত্র কর্ণকে অঞ্জলিকাস্ত্র প্রয়োগ করে বধ করেছিলেন তারই সহোদর অর্জুন।
কুন্তীকে যুধিষ্ঠিরের অভিশাপ
আপনি জেনে অবাক হবেন যে, মহাভারতের যুদ্ধের পর মাতা কুন্তীসহ সমগ্র নারীজাতিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির? কি আশ্চর্য লাগছে? কিভাবে যুধিষ্ঠিরের মত পরম মাতৃভক্ত পুত্র নিজের মাতাকে কেন এমন অভিশাপ দিতে পারেন? আজ্ঞে হ্যাঁ, যুধিষ্ঠির কর্তৃক মাতা কুন্তীকে প্রদত্ব এই অভিশাপের পিছনে লুকিয়ে আছে কর্ণের জীবনের প্রসঙ্গ। আপনারা জানেন ঋষি দুর্বাসা প্রদত্ব মন্ত্রবলে কুমারী অবস্থাতেই সূর্যদেবকে আহবান করেছিলেন রাজকুমারী কুন্তী। আর সূর্যদেবের আশির্বাদ হিসেবে তিনি লাভ করেছিলেন সূর্যকবচ সম্বলিত এক তেজস্বী পুত্র। তবে লোকলজ্জার ভয়ে কুমারী কুন্তী সেই পুত্রকে ত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীতে কর্ণ তার পালক পিতামাতার গৃহে লালিত-পালিত হলেও মাতা কুন্তী ঠিকই কর্ণকে চিনতে পেরেছিলেন নিজের পুত্র হিসেবে। তবে তখনও তিনি তার পঞ্চপুত্রকে কর্ণের কথা জানাতে পারেননি।
তবে অর্জুনের পরম শত্রু কর্ণের মৃত্যুর পর যখন মাতা কুন্তী আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে করুণভাবে রোদন করতে শুরু করলেন তখনই প্রকাশ পেল আসল সত্য। আর তাই যুধিষ্ঠির যখন জানতে পারলেন মহাবীর কর্ণ তাঁদেরই সহোদর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তখন তীব্র পরিতাপে পর্যবসিত হলেন তিনি। তিনি উপলব্ধি করলেন, মাতা কুন্তী যদি এই সত্য আগে প্রকাশ করতেন তাহলে কর্ণের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রশ্নই উঠত না তাদের। তাঁরা মহানন্দে কর্ণকে জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতার আসনে বসিয়ে রাজপদে অভিসিক্ত করতে পারতেন। তাছাড়া, কর্ণ ও অর্জুনের মত দুই মহারথী ধণুর্ধর যদি পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করতেন তাহলে দুর্যোধন কখনোই যুদ্ধ করার সাহস পেতেন না। ফলে ১৮ দিনের রক্তাক্ত ধারায় সিক্ত হত না কুরুক্ষেত্রের ময়দান, আর্যাবর্ত জুড়ে শোনা যেত না কোন পিতৃহারা সন্তানের আর্তনাদ বা স্বামীহারা কোন গৃহবধুর করুণ রোদন। তাই যুধিষ্ঠির তাঁর মাতা কুন্তী সহ সমগ্র নারী জাতিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, নারীজাতি তাঁদের হৃদয়ে কোন কথা গোপন করে রাখতে পারবেন না। এমনকি অতি সাংঘাতিক গুপ্ত কথাও তাঁরা প্রকাশ করতে বাধ্য হবেন। বলা হয় যুধিষ্ঠিরের এই অভিশাপের কারনে, নারীগনের কাছ থেকে অতি গোপন কথাও কোন না কোনদিন প্রকাশ হয়েই থাকে।
কৃষ্ণ কর্তৃক অশ্বত্থামাকে অভিশাপ
মহাভারতের যুদ্ধের অন্যতম ভয়ংকর অভিশাপ ছিল অশ্বত্থমাকে দেওয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপ। আপনারা জানেন রুদ্রাংশ অশ্বত্থামা জন্মেছিলেন গুরু দ্রোণাচার্যের ঔরসে এবং মাতা কৃপীর গর্ভে। গুরু দ্রোণাচার্য ভগবান শিবের তপস্যা করে লাভ করেছিলেন রুদ্রাংশ অশ্বত্থামাকে। একারণে জন্মগতভাবে অশ্বত্থামা তাঁর কপালে লাভ করেছিলেন এক অমূল্য রত্ন। এবং এই রত্নের প্রভাবে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি বা যন্ত্রনার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রেও অশ্বত্থামা ছিলেন রুদ্রের মত অপ্রতিরোধ্য এবং পাণ্ডবপক্ষের অর্জুন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া অন্য কেউই তাকে পরাজিত বা বধ করতে সামর্থ্য ছিলেন না। তবে এত বড় যোদ্ধা হওয়ার সত্ত্বেও চারিত্রিকভাবে তিনি ছিলেন উগ্র, হিংসুক, ধর্মজ্ঞানহীন এবং পাষণ্ড এক নরাধম। পাণ্ডবদের বিপক্ষে তিনি একাই যে ধ্বংসযজ্ঞ রচনা করেছিলেন তা কৌরবপক্ষের অন্য কোন যোদ্ধাই করতে পারেননি। তাঁর অস্ত্রভাণ্ডারে থাকা দিব্য ও ঐশী অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি পাণ্ডবপক্ষের প্রায় ৩ অক্ষৌহিণী সেনা একাই বধ করেছিলেন। অগ্নিযাত্রা, নারায়ণাস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ করে তিনি চরম নৃশংসতা প্রদর্শন করেছিলেন পাণ্ডবদের বিপক্ষে। কিন্তু অশ্বত্থামার সমস্ত ধৃষ্টতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল মহাভারতের যুদ্ধের শেষ দিনে। এদিনে তিনি তাঁর মিত্র দুর্যোধনকে মৃত্যুশয্যায় রেখে তিনি পণ করেছিলেন যে পাণ্ডবপক্ষের সমস্ত জীবিত ব্যক্তিগণসহ আসন্ন উত্তরসূরীদেরকেও তিনি বিনাশ করবেন। এবং তাঁর এই পরিকল্পনা থেকে তিনি সেদিন রাতে সংগোপনে প্রবেশ করেছিলেন পাণ্ডব শিবিরে। সেখানে অবস্থানরত উপপাণ্ডবগণ তথা পঞ্চপাণ্ডবের ঔরসজাত দ্রৌপদীর পাঁচ সন্তান, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীসহ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক যোদ্ধাকে অন্যায়ভাবে এবং নিরস্ত্র অবস্থায় বধ করেছিলেন তিনি। তবে এই ঘৃণ্য অপকর্ম করেও ক্ষ্যান্ত হন নি তিনি। তিনি চেয়েছিলেন পাণ্ডবদের আগামী প্রজন্মকেও বধ করতে। তাই তিনি ব্রহ্মাস্ত্র আহবান করে তা নিক্ষেপ করেছিলেন অর্জুনের পুত্রবধু তথা অভিমন্যু পত্নী উত্তরার গর্ভে। কারণ অশ্বত্থামা জানতেন অভিমন্যু পত্নী উত্তরা ছিলেন গর্ভবতী। তাই উপপাণ্ডবদের হলেও উত্তরার গর্ভস্থ পুত্র ভবিষ্যতের সম্রাট হতে পারে।
অশ্বত্থামার এসকল নজিরবিহীন অপকর্ম এবং নৃসংশতা অবলোকন করে স্তম্ভিত হয়ে যান স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণও। তবে অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার আগে তিনি তাঁর দিব্যশক্তি প্রয়োগ করে উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানকে পুনরায় জীবন দান করেন। এরপর এলো অশ্বত্থামাকে শাস্তি দেওয়ার পালা। তবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন, অশ্বত্থামা মৃত্যুকে ভয় পায় না। সুতারাং তাকে এমন শাস্তি দিতে হবে যেন সে প্রতিনিয়ত নিজের মৃত্যু ভিক্ষা করে কিন্তু তাঁর মৃত্যু না হয়। একারনে তিনি প্রথমে অশ্বত্থামার কপাল থেকে জন্মগতভাবে প্রাপ্ত মণিটি উপড়ে ফেলেন এবং তাকে অমরত্বের অভিশাপ দেন। শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপে অশ্বত্থামা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন এবং লোকালয় থেকে দূরে গিয়ে নির্জনে কষ্ট ভোগ করতে থাকেন। বলা হয় সময়ের অন্ত পর্যন্ত অশ্বত্থামা তাঁর এই তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে বেচে থাকবেন, কোন জনমানুষের সংস্পর্শে থাকতে পারবেন না এবং মৃত্যুর জন্য করুণভাবে রোদন করলেও তাঁর মৃত্যু হবে না। একারণে অশ্বত্থামা পৌরাণিক ৮ জন চিরঞ্জীবীর মধ্যে অন্যতম এবং ধারণা করা হয় তিনি আজও বেঁচে আছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
শ্রীকৃষ্ণকে গান্ধারীর অভিশাপ
সদ্যই সমাপ্ত হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। যুদ্ধে পণ্ডবপক্ষ জয়লাভ করেছে বৈকি, তবে দুপক্ষেরই হতাহত যোদ্ধার সংখ্যা অগণিত। কুরুক্ষেত্রের রক্তাক্ত সেই প্রান্তরে ছুটে এসেছেন যুদ্ধে নিহত অগণিত মানুষের পবিরাবার পরিজন। তাদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে এসেছে সেখানকার আকাশ বাতাস। সেই রোদনরত মানুষের ভিড়ে উপস্থিত ছিলেন শত কৌরবের মাতা গান্ধারী এবং কৌরব ভ্রাতাদের স্ত্রী সন্তানেরা। তাঁরা উচ্চস্বরে বিলাপ করছিলেন নিহত যোদ্ধাদের জন্য। অন্যদিকে পঞ্চপাণ্ডব, মাতা কুন্তী এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণও সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন নিহতদের স্মরণ করতে এবং নিহতদের পরিবারবর্গকে সান্ত্বনা প্রদান করতে।
এসময় বিলাপরত গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিতে এলেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি গান্ধারীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতাদের কৃত পাপকর্ম, হিংসা, শঠতা এবং অহংকারের ফলেই আজ কুরু বংশের বিনাশ হয়েছে। তাঁদের ছলনার কারণে নিহত হয়েছেন পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য এবং কর্ণের মত মহারথী যোদ্ধারা। এমনকি দুর্যোধনের দম্ভের কারনে পাণ্ডবদেরকেও হারাতে হয়েছে উপপাণ্ডব, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু সহ অসংখ্য বীর যোদ্ধাদেরকে। ভ্রাতা দুর্যোধন যদি সংঘাতের পথ বেছে না নিতেন তাহলে আজ হস্তিনাপুর বিধবাদের নগরীতে পরিণত হত না।
কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই সান্ত্বনাবানী গান্ধারীর মনকে শান্ত করার পরিবর্তে যেন আরও উত্তেজিত করে তুলল। তিনি কিছুতেই শ্রীকৃষ্ণের এই বক্তব্যকে সত্য হিসেবে মানতে পারলেন না। তিনি বললেন, “হে কৃষ্ণ, এই বিরাট যুদ্ধের আয়োজন একমাত্র তোমার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। তুমিই কুরু-পাণ্ডবদেরকে যুদ্ধের ময়দানে দাড় করিয়েছ একে অপরের বিপক্ষে। এবং তুমি চাইলেই এই মর্মান্তিক রক্তপাত বন্ধ করতে পারতে। এবং আজ আমার এই শতপুত্রের শোকগাথা তুমিই রচনা করেছ। ”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বহুবার কৌরবপক্ষকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বৈকি, তবে সেকথা তিনি আর পুনরায় গান্ধারীর সামনে উপস্থাপন করেননি। বরং গান্ধারীর প্রতি অতুল সম্মানের কারণে তিনি মাথা পেতে মেনে নিলেন গান্ধারীর দেওয়া এ সমস্ত অপবাদ। গান্ধারী ও শ্রীকৃষ্ণের এই কথোপকথনের এক পর্যায়ে পুত্র-শোকে কাতর গান্ধারী এক ভয়ংকর অভিশাপ দিয়ে বসলেন শ্রীকৃষ্ণকে। তিনি বললেন, “হে কৃষ্ণ, তোমার প্রণীত কূটকৌশলে যেমন আমার শতপুত্র তথা কুরুবংশের বিনাশ হয়েছে, তেমনি অল্প কিছুকালের মধ্যে অন্তর্কলহের কারনে তোমার যদুবংশেরও বিনাশ হবে। ” শ্রীকৃষ্ণ চাইলেই গান্ধারীর এই অভিশাপ ব্যার্থ করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি জানতেন যদুকুলের বিনাশ করার সাধ্য তৎকালীন কারোরই ছিল না। এবং যদুবংশের বিনাশ তিনিও ঠিক এভাবেই রচনা করেছিলেন। ফলে গান্ধারীর অভিশাপ তাঁর কাজ কিছুটা হলেও সহজ করে দিয়েছিল।
যাইহোক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কেটে গেছে ৩৬ বছর। গান্ধারীর অভিশাপ হাতে-নাতে ফলতে শুরু করেছে যদুকুলে। যাদবদের মধ্যে তখন সকলেই সুরাপান, ব্যাভিচারিতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ইত্যাদি পাপাচারে লিপ্ত। এর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব ঋষিদের অপমান করার ফলে একটি লৌহপিণ্ড প্রসব করেছিলেন। ঋষিগণ ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন এই লৌহপিণ্ডই যদুবংশ ধ্বংসের কারন হবে। এরপর রাজা উগ্রসেনের আদেশে লৌহপিণ্ডটিকে চূর্ণ করে নদীতে নিক্ষেপ করা হয় বটে তবে এক এক খণ্ড লোহাকে তাঁরা আর চূর্ণ করতে পারেননি। এসময় শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারেন যদু বংশের ধ্বংস আসন্ন। তাই তিনি সমস্ত যাদবদেরকে বিনাশ বাসনায় প্রভাসতীর্থে যাত্রা করতে বললেন। যাদবরা প্রভাস তীর্থে গিয়ে মদিরার নেশায় চূর হয়ে একে অপরকে হত্যা করে ইতি টানলেন যদুকুলের। এরপর বলরামের দেহ থেকে সর্পের রূপ ধারন করে বেরিয়ে গেল তাঁর প্রাণ। বাকী রইলেন শুধুমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনিও মর্ত্যলোক ত্যাগের বাসনায় মহাযোগ অবলম্বনপূর্বক ভূতলে শয়ন করলেন। অন্যদিকে যাদবরা লৌহপিণ্ডের যে অংশটি চূর্ণ করতে পারেননি, সেই টুকরোটি মাছের পেট থেকে পেয়ছিলেন জরা নামক একজন ব্যাধ। তিনি সেই লৌহপিণ্ড দিয়ে নির্মান করেছিলেন তাঁর শিকার করা তীরের ফলক। আর বনমধ্যে শায়িত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পদপাদ্মকে হরিণ ভেবে শরাঘাত করেছিলেন জরা। আর এতেই প্রাণ ত্যাগ করে পুনরায় বৈকুণ্ঠ ধামে ফিরে যান ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পূর্ণাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
শৃঙ্গী ঋষি কর্তৃক পরীক্ষিত মহারাজকে অভিশাপ
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ৩৬ বছর পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামসহ যদুকুলের বিনাশ ঘটলে, পার্থিবজীবনের প্রতি বৈরাগ্য দেখা দেয় পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর। তাঁরা অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিৎকে রাজ্যপদে অভিষিক্ত করে স্বর্গারোহণের উদ্দেশ্যে রাজ্যপাট ত্যাগ করেন। এরপর কেটে গেল আরও কিছুকাল। মহারাজ পরীক্ষিৎ ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ মহারাজ পাণ্ডুর মত মৃগয়াপ্রিয়। তো একদা তিনি এক গহীন জঙ্গলে মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। এসময় তিনি একটি বণ্য হরিণকে বাণ বিদ্ধ করেন। কিন্তু হরিণটি বাণবিদ্ধ অবস্থাতেই ছুটে পালাতে শুরু করল বনের মধ্যে। রাজা পরীক্ষিৎও হরিণটির পিছু পিছু পশ্চাদ্ধাবন করলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে হরিণটি তাঁর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। এদিকে পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধায় কাতর রাজা পরীক্ষিৎ খেয়াল করলেন পাশেই একজন মুনি মৌনভাবে তপস্যায় রত হয়ে আছেন। তাই তিনি মুনিকে বাণবিদ্ধ হরিণটির গতিবিধি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তবে মহারাজ পরীক্ষিৎ জানতেন না যে, এই মুনির নাম সমীক মুনি এবং তিনি মৌনব্রত পালন করছেন। তো কয়েকবার জিজ্ঞাসা করার পরেও যখন মুনিবর রাজার কথার কোন উত্তর দিলেন না, তখন রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে একটি মৃত সাপ মুনির গলায় ঝুলিয়ে দেন। এরপরেও সমীক মুনি রাজাকে কোন কথা বলেননি এবং রাজাও আর কোন প্রশ্ন না করে সেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন।
তবে সমস্যা শুরু হল যখন সমীক মুনির পুত্র শৃঙ্গী মুনি এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি জানতে পারেন। বাস্তবে শৃঙ্গী ঋষি ছিলেন প্রচণ্ড তেজস্বী এবং প্রতিশোধ-পরায়ণ। তিনি মৌনভাবে সমাধিমগ্ন পিতার প্রতি হওয়া অন্যায় ও অপমানের প্রতিবাদে এক ভয়ংকর অভিশাপ দিয়ে বসলেন মহারাজ পরীক্ষিৎকে। তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি আমার নিরপরাধ পিতার কাধে মৃত সাপ জড়িয়ে রেখেছিল , সেই দুষ্ট ব্যক্তিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তক্ষক নাগ তাঁর বিষাক্ত দংশন করে বধ করবে।”
কিন্তু সমীক মুনি যখন মহারাজ পরীক্ষিৎকে দেওয়া তাঁর পুত্র শৃঙ্গী মুনির অভিশাপ সম্পর্কে জানতে পারলেন, তখন তিনি মোটেও সন্তুষ্ট হলেন না। কারণ রাজা পরীক্ষিৎ প্রজাপালক হিসেবে ছিলেন উদার, দয়ালু এবং ধর্মাত্মা। তিনি যদি জানতেন যে সমীক মুনি মৌনসমাধি গ্রহণ করেছেন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর স্কন্ধে সাপ জড়িয়ে দিতেন না। কিন্ত ব্রাহ্মণের অভিশাপ তো বিফলে যাওয়ার নয় এমনকি তা ফিরিয়ে নেওয়ারও উপায় নেই। তবুও সমীক মুনি তাঁর শিষ্যদের দ্বারা অতি সত্ত্বর মহারাজ পরীক্ষিৎকে এই অভিশাপ সম্পর্কে জ্ঞাত করালেন।
শৃঙ্গী মুনির এই অভিশাপের কথা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল মহারাজ পরীক্ষিতের। হঠাৎ পাওয়া এই দুঃসংবাদে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন তিনি। তবুও প্রাণে বাঁচার জন্য চেষ্টা তো চালিয়ে যাওয়া চাই। তাই তিনি তাঁর মন্ত্রীদের সাথে মন্ত্রণা করে এক সুবিশাল এবং সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মান করলেন। এবং এই সুরক্ষা-বলয় বেষ্টিত প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল একটি মাত্র স্তম্ভের উপরে। তক্ষক নাগের বিষাক্ত ছোবল থেকে বাঁচতে রাজা পরীক্ষিৎ একাই সেই প্রাসাদে বসবাস করতে শুরু করলেন। সেখানে শুধুমাত্র মন্ত্রীগণ ব্যাতীত অন্য কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। তাছাড়া রাজবাড়ীতে প্রসিদ্ধ বিষচিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদেরকেও নিয়োগ করা হল যাতে তাঁরা রাজাকে তক্ষক নাগের বিষাক্ত দংশন থেকে বাঁচাতে পারেন।
এভাবে নিরাপদে কেটে গেল একে একে ছয় দিন। অন্যদিকে তক্ষক নাগের পক্ষেও রাজার এই সুরক্ষা-বলয় ভেদ করে তাকে দংশন করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। তো সপ্তম দিনে ব্রাহ্মণ বেশে তক্ষক বেরিয়ে পড়লেন রাজা পরীক্ষিতের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে তিনি দেখতে পেলেন কাশ্যপ নামক এক প্রসিদ্ধ বিষচিকিৎসক মহারাজ পরীক্ষিতের রাজপ্রাসাদের দিকে গমন করছেন। তাঁর উদ্দেশ্য নাগ-দংশন থেকে মহারাজকে বাঁচিয়ে কিছু অর্থের সংস্থান করা। তবে কাশ্যপ এতটাই দক্ষ বিষচিকিৎসক ছিলেন যে তাঁর উপস্থিতিতে রাজাকে বধ করা কোন নাগের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই অগত্যা ব্রাহ্মণরূপী তক্ষক তাকে বিপুল পরিমান অর্থ উৎকোচ হিসেবে প্রদান করে তাকে তাঁর নিজ গৃহে ফেরত পাঠালেন।
এরপর তক্ষকের পরিকল্পনা মোতাবেক তাঁর অনুসারী কিছু নাগ ব্রাহ্মণ বেশ ধারণ করে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে। তাঁরা মহারাজের দীর্ঘায়ু আশির্বাদ করার জন্য রাজার কক্ষে প্রবেশ করার অনুমতি পায় এবং রাজাকে আশির্বাদ করে কিছু ফল, কুশ ও জল দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেন তাঁরা। এরপর অমাত্যগণকে সাথে নিয়ে আশির্বাদ হিসেবে পাওয়া ফলগুলোকে ভক্ষণ করতে থাকেন রাজা পরীক্ষিৎ। কিন্তু একটি ফল খাওয়ার সময় তিনি খেয়াল করেন, ফলের মধ্যে থেকে একটি কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে সূর্যাস্তের সময়ও আসন্ন। এবং সূর্যাস্তের পরেই ব্রাহ্মণের আশির্বাদ বিফল হবে। তাই রাজা কিছুটা তামাশা করেই সেই কীটটিকে নিজের গলায় রাখলেন। তিনি বললেন, “ সূর্যাস্ত আর মাত্র কিছুক্ষণের ব্যাপার। সুতারাং আর আমার বিষের ভয় নেই, এখন এই পোকাই তক্ষকের পরিবর্তে আমাকে দংশন করুক! তাহলে আমার অভিশাপও কাটে আর ব্রাহ্মণের কথাও থাকে।”
কিন্তু হায়! সেই তাম্রবর্ণ কীটটিই ছিল স্বয়ং তক্ষক নাগ। তিনি ছদ্মবেশে ফলের মধ্যে অবস্থান করছিলেন মহারাজ পরীক্ষিতের সন্নিকটে আসার জন্য। আর তাই যেইমাত্র রাজা কীটটিকে নিজের গলায় রাখলেন, তৎক্ষণাৎ তক্ষক স্বরূপে ফিরে এসে স্বগর্জনে দংশন করলেন রাজা পরীক্ষিতকে। আর এভাবেই ব্রাহ্মণের অভিশাপ কাল হয়ে এসেছিল পাণ্ডবদের বংশধর পরীক্ষিতের জন্য।