নিজের জীবদ্দসায় ৫টি ভয়ংকর অভিশাপ দিয়েছিলেন মহাভারতের দ্রৌপদী। আর সেই অভিশাপের করুন পরিণতি আজও ভোগ করছে অভিশপ্তরা। আপনারা জানেন, যজ্ঞের জাজ্বল্যমান অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন অগ্নিকন্যা দ্রৌপদী। আর তাই তার মেজাজও ছিল অগ্নিগর্ভসম। সেকারনে বিভিন্ন সময়ে মেজাজ হারিয়ে দ্রৌপদী কর্তৃক প্রদত্ব ৫টি অভিশাপের ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়। সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজনে আমরা প্রথমে জানবো, যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর দেওয়া সেই মুখরোচক অভিশাপের ঘটনাগুলো।
এবং সবশেষে জানবো, দ্রৌপদীর অগ্নিগর্ভ মেজাজ ও প্রচলিত এসকল অভিশাপের ঘটনাগুলো বেদব্যাসের মূল মহাভারত অনুসারে কতটা সত্য।
১. কুকুর জাতিকে দেওয়া দ্রৌপদীর অভিশাপ
দ্রৌপদীর দেওয়া অভিশাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মুখরোচক কাহিনীটি হচ্ছে, কুকুর জাতিকে প্রদত্ব দ্রৌপদীর অভিশাপটি। আপনারা জানেন, মহারাজ দ্রুপদের আয়োজিত স্বয়ম্বর সভায় দুঃসাধ্য এক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দ্রৌপদীকে স্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত করেছিলেন মহাবীর অর্জুন। তবে মাতা কুন্তী কতৃক অসাবধানতাবশত প্রয়োগকৃত একটি বাক্যের জন্য পঞ্চপাণ্ডবের সবাইকেই একসাথে বিবাহ করতে হয়েছিলে দ্রৌপদীকে। এবং সমাজের বিজ্ঞজনদের পরামর্শমত প্রত্যেক পাণ্ডবের সাথে ক্রমান্বয়ে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতেন দ্রৌপদী।
নিয়ম ছিল, যে পাণ্ডব যে সময়ে দ্রৌপদীর দাম্পত্য সঙ্গ লাভ করবেন, সেসময় তিনি ব্যাতীত অন্য কোন পাণ্ডব দ্রৌপদীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। সেকারনে দ্রৌপদীর কক্ষে প্রবেশ করার সময় পাণ্ডবগণ নিজেদের পাদুকা গৃহসম্মুখে খুলে রেখে যেতেন। এতে অন্য পাণ্ডবগণ সহজেই বুঝতে পারতেন দ্রৌপদী তার কোণ একজন স্বামীর সাথে শয়নকক্ষে অবস্থান করছেন। তো একদা দ্রৌপদীর শয়নকক্ষে স্ত্রীসঙ্গ উপভোগ করছিলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির। ঠিক সে সময় একটি কুকুর এসে শয়নকক্ষের বাইরে রাখা যুধিষ্ঠিরের পাদুকাযুগল নিয়ে চলে যায়।
ইতিমধ্যে কোন এক কারনে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন দ্রৌপদীর কক্ষে প্রবেশ করার প্রয়োজন অনুভব করেন। এবং যেহেতু শয়নকক্ষের বাইরে কোন পাণ্ডবের পাদুকা রাখা ছিল না, তাই তিনি নির্দ্ধিধায় প্রবেশ করেছিলেন দ্রৌপদীর কক্ষে। ফলে এক চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল কক্ষে অবস্থানরত দ্রৌপদী, যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের মধ্যে। পরবর্তীতে দ্রৌপদী জানতে পারলেন, একটি কুকুর কর্তৃক যুধষ্ঠিরের পাদুকা অপসারনের জন্যি ঘটে গিয়েছে এই অনর্থ। তাই রাগে, দুঃখে ক্ষোভে তিনি সমগ্র কুকুর জাতিকে এক ভয়ংকর অভিশাপ দিয়ে বসেন।
আর তার দেওয়া সেই অভিশাপ ছিল, ঠিক যেভাবে স্বামীর সাথে বিহাররত অবস্থায় আমাকে চরমভাবে বিব্রত হতে হয়েছে ঠিক সেভাবে সমস্ত কুকুর জাতিকে বিব্রতকর সঙ্গগমের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন করতে হবে। আর দ্রৌপদীর সেই অভিশাপের ফল আজও ভোগ করে চলেছে সমগ্র কুকুর জাতি।
২. কীচককে দ্রৌপদীর অভিশাপ
আপনারা জানেন, পাশা খেলায় হেরে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাস ভোগ করতে হয়েছিল পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীকে। তো বনবাস শেষে অজ্ঞাতবাসের সময় পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন বিরাট রাজার রাজ্যে। সেখানে পাণ্ডবগণ ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন রাজপরিবারে মন্ত্রক, পাচক, নৃত্য-গীতের প্রশিক্ষক, গোরক্ষক ও অশ্বশালার রক্ষক হিসেবে। অপরদিকে সৈরন্ধ্রী নাম ধারণ করে রানী সুদেষ্ণার কেশসজ্জা ও রূপসজ্জায় সাহায্য করতেন দ্রৌপদী।
কিন্তু কর্মে পরিচারিকা হলেও, দেবকন্যার মত রূপবতী দ্রৌপদীকে দেখে চরমভাবে কামার্ত হয়েছিলেন বিরাটরাজের সেনাপতি কীচক। তিনি নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন দ্রৌপদীকে তার কুপ্রস্তাবে প্রলুব্ধ করার জন্য। কিন্তু দ্রৌপদী নিজেকে বিবাহিতা ও একজন গন্ধর্বের স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করে বারবার কীচকের কুপ্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন।
এক পর্যায়ে, দ্রৌপদীকে নিজের বশীভূত করতে না পেরে দ্রৌপদীর উপরে চড়াও হয়ে ওঠেন কীচক। তিনি দ্রৌপদীর কেশাকর্ষন করে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তীব্রভাবে পদাঘাত করেন ভরা রাজসভায়। এমনকি বিরাটরাজ স্বচক্ষে কীচকের এই অপকর্ম দর্শন করেও কোন সুবিচার করতে পারেন নি। অন্যদিকে, পাণ্ডবগণ ছদ্মবেশে থাকায়, চোখের সামনে দ্রৌপদীর অপমান দেখেও সরাসরি কোন প্রতিবাদ করতে পারেননি।
আর তাই ভরা রাজসভায় দ্রৌপদী আর্তনাদ করে অভিশাপ দিয়েছিলেন সেনাপতি কীচককে। তিনি বলেছিলেন, আমার গন্ধর্ব স্বামী শ্রীঘ্রই তোমার এই অপকর্মের শাস্তি হিসেবে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আর এই ঘটনার জেরেই পাচকরূপী ভীমের হাতে বধিত হয়েছিলেন কীচক। বলা হয়, এভাবেই হাতে নাতে ফলে গিয়েছিল দ্রৌপদীর অভিশাপ।
৩. কুরুবংশকে দেওয়া দ্রৌপদীর অভিশাপ
সমগ্র মহাভারতের সর্বাপেক্ষা অস্বস্তিকর দৃশ্যটি হচ্ছে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। ভরা রাজসভায় উপস্থিত এতসব জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞজনের সম্মুখে, তুচ্ছ পাশা খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় ইতিহাসের এক ঘৃণ্যতম এক অপরাধ। যেখানে দুর্যোধনের আদেশে পাষণ্ড দুঃশাসন বস্ত্রহরণ করার চেষ্টা করেছিলেন একবস্ত্রা ও রজস্বলা দ্রৌপদীর।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, শত শত সভাসদের মধ্যে একমাত্র যুযুৎসু এবং বিকর্ণ ব্যাতীত আর কেউই এই ঘোরতর অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি। যদিও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় সেযাত্রায় নিজের সম্ভ্রমহানির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন দ্রৌপদী, তবে পরিস্থিতির ভয়াবহতা কঠোরভাবে আঘাত করেছিল তার আত্মসম্মান ও নারীত্বে।
আর তাই তিনি রাজসভায় উপস্থিত সকল সভাসদকে সাক্ষী রেখে কঠোর এক অভিশাপে অভিশপ্ত করেছিলেন সমগ্র কুরুবংশ কে। কি ছিল সেই অভিশাপ? দ্রৌপদীর অভিশাপ ছিল, একজন নারীকে বস্ত্রহীন করে অপদস্ত করার কারনে সমস্ত কুরুবংশ ধ্বংস হবে। অর্থাৎ, বংশে বাতি দেওয়ার মত আর কেউই অবশিষ্ট থাকবে না সমস্ত কুরুবংশে। বলা হয়, দ্রৌপদীর এই অভিশাপের কারনেই কুরুক্ষেত্রের ময়দানে ১১ অক্ষৌহিনী সেনাসহ নিহত্ হয়েছিলেন এক শত কৌরব ভ্রাতা।
৪. চম্বল নদীকে দেওয়া দ্রৌপদীর অভিশাপ
মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে চম্বল নদীকে দেওয়া দ্রৌপদীর একটি অভিশাপের কাহিনী। জানা যায়, এই চম্বল নদীর তীরে অবস্থিত রাজসভাতেই ঘটেছিল দ্রোপদীর বস্ত্রহরণের অপচেষ্টা। একারনে কুরুবংশকে অভিশাপ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন পাশ দিয়ে বয়ে চলা চম্বল নদীকে।
তিনি চম্বল নদীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ভরা রাজসভায় আমকে বস্ত্রহীন করার অপচেষ্টা দেখেও তুমি যেভাবে নীরবে বয়ে চলেছ, ঠিক সেভাবে, সারাজীবন তোমাকে আমার এই অপমানের নীরব সাক্ষী হিসেবে বয়ে যেতে হবে। তুমি হবে পরিত্যাক্ত, তোমার জল হবে পানের অযোগ্য। যদি কোন ব্যক্তি তোমার জল পান করে, তাহলে সেই ব্যক্তি তার সারাজীবন অতৃপ্ত এক জীঘাংসা নিয়ে বেঁচে থাকবে।
মহাভারতের সেই চম্বল নদীটি আজও নীরবে বয়ে যাচ্ছে মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের বুক চিরে। তবে দ্রৌপদীর সেই অভিশাপের কারনে কেউই এই নদীর জল পান বা অন্য কোন কার্যে ব্যবহার করেন না।
৫. ঘটৎকচকে দেওয়া দ্রৌপদীর অভিশাপ
দ্রৌপদী কর্তৃক প্রদত্ব অভিশাপগুলোর মধ্যে ঘটৎকচকে দেওয়া তার অভিশাপটি বহুলভাবে চর্চিত। আপনারা জানেন, দ্রৌপদীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগেই রাক্ষসী হিড়িম্বাকে বিবাহ করেছিলেন ভীম। আর রাক্ষসী হিড়িম্বা ও ভীমের সন্তান ছিলেন মহাবলি ঘটৎকচ। তো পরবর্তীকে বিশেষ পরিস্থতির শিকার হয়ে ভীম যখন দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন, তখন তা স্বাভাবিকভাবে স্বীকার করেননি হিড়িম্বা।
হয়ত একারনে তার সন্তান ঘটৎকচও দ্রৌপদী সম্পর্কে খুব ভালো মনোভাব পোষন করতেন না। যাইহোক, ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মিত হওয়ার পরে মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে চক্রবর্তী রাজা ঘোষনা করার জন্য রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন পাণ্ডবগন। সেই যজ্ঞে আর্যাবর্তের বহু ব্রাহ্মণ, ঋষি, এবং রাজন্যবর্গের পাশাপাশি আমন্ত্রন করা হয়েছিল দূর-দূরান্তের আত্মীয়দেরকেও। আর সেই আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে ভীমপুত্র ঘটৎকচ এসেছিলেন পিতা-পিতৃব্যদের রাজসূয় যজ্ঞে।
তবে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার পরে তিনি সকল গুরুজনদেরকে সমাদর ও সম্মান করেছিলেন বৈকি তবে দ্রৌপদীর প্রতি প্রদর্শন করেছিলেন অনীহা এবং উপেক্ষা। আর ঘটৎকচের এই অনীহা ও উপেক্ষা উপলব্ধি করে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন সম্রাজ্ঞী দ্রৌপদী। তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন, মাতৃস্থানীয়া দ্রৌপদীকে তার প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে উপেক্ষা ও অনীহা প্রদর্শন করার জন্য সীমিত জীবনকালের অধিকারী হবেন ঘটৎকচ।
পরবর্তীতে, রাক্ষসী হিড়িম্বা যখন দ্রৌপদীর এই অভিশাপ সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তিনিও দ্রৌপদীর সন্তানদেরকে স্বলপায়ু হওয়ার অভিশাপ দেন। ফলতঃ কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দ্রৌপদীর গর্ভজাত পাচজন উপপাণ্ডব ও হিড়িম্বার পুত্র ঘটৎকচ সকলেই প্রাণ হারিয়েছিলেন।
প্রিয় দর্শক, এই ছিল প্রচলিত কাহিনী বা উপকথা থেকে প্রাপ্ত দ্রৌপদীর ৫টি অভিশাপের ঘটনা। তবে এখানেই শেষ নয়, এখন সময় কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলার।
কুকুর জাতিকে প্রদত্ব দ্রৌপদীর অভিশাপের কাহিনী মহাভারতের কাহিনী হিসেবে প্রচলিত হলেও মূল মহাভারতে এটির কোন অস্তিত্ব নেই। আবার বিরাট রাজার রাজসভায় দ্রৌপদী কীচককে যে অভিশাপ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়, মূল মহাভারতে এরকম কোন অভিশাপের কথা উল্লেখ নেই। ঠিক একইভাবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় তিনি কুরুবংশকে অভিশাপ দিয়েছিলেন বলে যে কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, মূল মহাভারতে এরকম কোন আনুষ্ঠানিক অভিশাপের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
আবার চম্বল নদীকে দ্রৌপদীর দেওয়া অভিশাপটি মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানে স্থানীয় লোককথা হিসেবে প্রচলিত হলেও বেদব্যাসের মূল মহাভারতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে দ্রৌপদী কর্তৃক ঘটৎকচকে অভিশাপ দেওয়া বা হিড়িম্বা কর্তৃক উপপাণ্ডবদের অভিশাপ দেওয়ার ঘটনা মূল মহাভারতে না পাওয়া গেলেও উড়িষ্যার সরল মহাভারতে এই ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে।