You are currently viewing দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডব কিভাবে দেহত্যাগ করেন? How did Draupadi and Pancha Pandavas Die?

দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডব কিভাবে দেহত্যাগ করেন? How did Draupadi and Pancha Pandavas Die?

মহাভারতের কথা গাহে ভাগ্যবান,

যে শোনে, যে মানে, সেই পুণ্যবান।

আমরা অনেকেই মহাভারতের কথা শ্রবণ ও বর্ণনা করলেও তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু মহাভারতের ১৮টি পর্বের শেষ দুইটি পর্ব তথা মহাপ্রস্থানিকপর্ব ও স্বর্গারোহন পর্ব সম্পর্কে আমাদের তেমন কোন ধারনা নেই বললেই চলে। অথচ এই শেষ দুই পর্বেই রয়েছে মহাভারতের সারাংশ ও পান্ডবদের শেষ পরিনতির কথা। পান্ডবগন চেয়েছিলেন সশরীরে স্বর্গে যেতে। কিন্তু তারা কি পেরেছিলেন সেটা? না, এক যুধিষ্ঠির ব্যাতীত অন্য কেউই তা পারেন নি। কিন্তু কেন? এবং কি কারনে পারেননি তা আজ আমাদের জানার বিষয়। আশা করি ভিডিওটির শেষ অব্দি দর্শন ও শ্রবন করে এই দুর্লভ জ্ঞান আহরণ করবেন সকলেই।

কুরুক্ষেত্রের মহারণ শেষ হওয়ার পর বিজয় আসে পান্ডব শিবিরে অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর শত পুত্রের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পরাজিত হন কৌরবগন। এরপর পঞ্চপান্ডব মিলে হস্তিনাপুরে ৩৬ বছরেরো বেশী সময় ধরে শাসন করেন। কিন্তু যদুকুলের শিরোমনি শ্রীকৃষ্ণের দেহাবসানের পর পান্ডবগন ভেঙে পড়েন। মৌষলপর্বে অৰ্জ্জুনের কাছে যদুকুল ধ্বংসের বিবরণ শুনে যুধিষ্ঠিরের মনে একটা বৈরাগ্য এল, অৰ্জ্জুনেরও কৃষ্ণের বিরহে কষ্ট এবং মর্মান্তিক যাতনা হল। যুধিষ্ঠির বললেন ‘কাল’ আমাকে আকর্ষণ করছে। আমি আর সংসারে থাকব না।’ অৰ্জ্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব ও দ্ৰৌপদীরও মনে একই রকম বৈকল্য ও ঔদাসীন্যের উদয় হল; সকলেই সংসার ছেড়ে যেতে চাইলেন।

তখন পান্ডবগন মহর্ষি কৃষ্ণদৈপায়ন বেদব্যাসের মুখোমুখী হন। ঋষি বেদব্যাস অর্জুন ও তাঁর ভাইদের রাজ্য ত্যাগ করে প্রস্থান করতে বলেন কারণ তাঁরা যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছিলেন তা পূর্ণ হয়েছে । তিনি পান্ডবদেরকে সিংহাসন ত্যাগ করে বানপ্রস্থের পথ অবলম্বন করার পরামর্শ দেন। বানপ্রস্থ হচ্ছে সাংসারিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আধ্মাত্যিক পথে অগ্রসর হওয়ার বৈদিক প্রক্রিয়া। যজ্ঞ করে, অগ্নিকৃত্য শেষ করে, ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে, সব সম্পত্তি ব্রাহ্মণদের দান করে, বনবাসীর বেশ ধারণ করে তারা পরিব্রাজ্য নিলেন। এসময় অভিমণ্যূ পুত্র পরীক্ষিৎ  ছিলেন নাবালক, তার শিক্ষার ভার কৃপাচার্যকে দিয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, এর পুত্র রাজা হবেন। ততদিন ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসজাত সন্তান যুযুৎসুকে রাজত্ব করতে বললেন তিনি। এরপর সকলে সমবেত প্রজাদের নিষেধ ও রোদন উপেক্ষা করে তারা বেরিয়ে পড়লেন । এসময় একটি কুকুরও পথ থেকে তাদের সঙ্গ নিল।

আরও পড়ুনঃ  জীবিত শিবলিঙ্গ ! রহস্যজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর || Matangashwar Living Shivlinga

তাঁরা বহু দেশ ঘুরে লোহিত সাগরের তীরে উপস্থিত হলেন। অর্জুন আসক্তিবশত গাণ্ডীব ধনু ও অক্ষয় তূণ যুগল সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। এতে অগ্নি মূর্তিমান হয়ে সেগুলো বরুণ দেবকে ফেরত দিতে বলেন । অর্জুন তাই ধনু ও তূণ লৌহিত্য সাগরের জলে নিক্ষেপ করলেন । পৃথিবী প্রদক্ষিণের ইচ্ছায় তাঁরা প্রথমে দক্ষিণে গেলেন এরপর লবণসমুদ্রের উত্তর তীর দিয়ে পশ্চিম দিকে গিয়ে সাগর প্লাবিত দ্বারকা নগরী দেখে উত্তর দিকে চললেন । পাণ্ডবগণ বালুকার্ণব ও মেরুপর্বত দর্শন করে যোগযুক্ত হয়ে দ্রুত চলতে লাগলেন ।  পান্ডবরা বিশ্বাস করতেন যে তারা ছিলেন আদর্শ শাসক, সত্যের ধারক, ধর্মযোদ্ধা, পিতা মাতার আদর্শ সন্তান, নিষ্ঠার সাথে ধর্মের পথ অনুসরণকারী, এবং তাদের উপর অর্পিত দায়ীত্বের যথাযথভাবে পালনকারী। তাই তারা সশরীরে স্বর্গে যেতে পারবেন এমন ধারনা তাদের মনে স্থান পেয়েছিল দৃঢ়ভাবে।

কিন্তু মেরু পর্বৎ আরোহন করার সময় সহসা দ্রৌপদী যোগভ্রষ্টা হয়ে ভূপতিত হন । দ্রৌপদীর এহেন হঠাৎ দেহাবসানের ফলে পান্ডবগন অত্যান্ত হতাশ হয়ে পড়লেন। যেহেতু পঞ্চপান্ডবের মধ্যে যুধিষ্ঠির জ্ঞান ও ধর্মের প্রতিভূ ছিলেন তাই ভগ্নহৃদয় ভীম যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন দ্রৌপদীর এহেন অন্তর্ধানের কারন কি?

যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন, দ্রৌপদী পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে সবাইকে সমান প্রেম প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি মনে মনে অর্জুণের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলেন এবং অর্জুনের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা এবং বেশী। এই কারনে তিনি সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত নন।

দ্রৌপদীর মৃত্যুশোক কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন পঞ্চপান্ডবগন। কিন্তু আবার বিপত্তি। এবার কনিষ্ঠ পান্ডব সহদেব মাটিতে পড়ে গেলেন এবং দেহ ত্যাগ করলেন। ভীম আবারও প্রশ্ন করলেন তাদের জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে, সহদেবের মৃত্যুর কারন কি?

উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন সহদেব ভাবতেন তাঁর চেয়ে বিজ্ঞ আর কেউ নেই । তিনি তার জ্ঞান নিয়ে খুবই গর্বিত ছিলেন। এবং কেউই তার মনে গর্ব বা অহংকার নিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারে না।  এরপর কিছুক্ষন পর নকুলও পড়ে যান। ভীমের প্রশ্নে আবারও উত্তর দিলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। বললেন, নকুল তার রূপ নিয়ে খুবই গর্ব করতেন। তিনি মনে করতেন তাঁর তুল্য রূপবান আর কেউ নেই । তার এই গর্বের কারনে সহদেবের মত তাকেও স্বর্গলাভ থেকে বঞ্চিত হতে হল।

আরও পড়ুনঃ  দেবব্রত ভীষ্মঃ অস্টবসুর এক অভিশপ্ত বসুদেবতা || Devavrata Bhishma -The Cursed Vasu of the Asta Vasus

নকুলের মৃত্যুর পর বাকী রইল মাত্র তিনজন পান্ডব। পথের ক্লান্তি, ও ভ্রাতৃবিয়গের যন্ত্রনা সহ্য করতে করতে একসময় শোকার্ত অর্জুনও পড়ে গেলেন । অর্জুনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে যুধিষ্ঠির বলেন অর্জুন একদিনেই সকল শত্রু নাশ করার গর্ব করতেন যা তিনি পারেন নি; তাছাড়া তিনি অন্যান্য ধনুর্বিদদের অবজ্ঞা করতেন । এই কারনে তার ভাগ্যেও সশরীরে স্বর্গবাস নেই।  সবার শেষে ভীম নিজেও ভূপাতিত হলেন। তিনি তাঁর আসন্ন মৃত্যুর কারণ শেষবারের মত জিজ্ঞাসা করলেন ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের কাছে।  যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, ভীম, তুমি অত্যন্ত ভোজন করতে এবং ভোজনের সময় শুধুমাত্র নিজের ক্ষুধানিবৃত্তির কথাই ভাবতে। অন্য কারও ক্ষুধা তোমার কখনই দৃষ্টিগোচর হয়নি। এছাড়াও তুমি অন্যের বল না জেনেই নিজ বলের গর্ব করতে। নিজে অধিক বলশালী হওয়ার সত্বেও অন্যের সামর্থ্যকে সন্মান করা আমাদের কর্তব্য।

এভাবে চার পান্ডব ও দ্রৌপদীর দেহাবসানের পর যুধিষ্ঠির একাই এগিয়ে চললেন। তার সঙ্গে চলল সেই কুকুরটিও। কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর তিনি দেখতে পেলেন, দেবরাজ ঈন্দ্র তার দিব্য রথ নিয়ে যুধিষ্ঠিরের জন্য অপেক্ষা করছেন। এরপর ইন্দ্র রথে চেপে যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে তাঁকে রথে উঠতে বলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির তাঁর স্ত্রী ও চার ভ্রাতাকে ফেলে স্বর্গে যেতে রাজি হন নি । ইন্দ্র বলেন তাঁরা দেহত্যাগ করে আগেই স্বর্গে গেছেন । এতে যুধিষ্ঠির তাঁর সাথে আসা কুকুরকেও সঙ্গে নিতে প্রস্তাব করেন। কিন্তু ইন্দ্র বলেন যাঁর সাথে কুকুর থাকে তিনি স্বর্গে যেতে পারেন না। এসময় যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন শরণাগতকে ভয় দেখানো, স্ত্রীবধ, ব্রহ্মস্বহরণ ও মিত্রবধ এই চার কার্যে যে পাপ হয় ভক্তকে ত্যাগ করলেও সেই পাপ হয় তাই তিনি ভক্তকে ত্যাগ করবেন না। তখন কুকুরটি হঠাৎ ধর্ম রূপে আবির্ভূত হলেন, বললেন, যুধিষ্ঠির তোমার তুল্য কেউ নেই, কেউ হতে পারে না। ধর্ম তাকে আশির্বাদ করলেন তিনি স্বশরীরে স্বর্গারোহণ করে অক্ষয়লোক লাভ করবেন।

আরও পড়ুনঃ  অসুরগুরু শুক্রাচার্য কিভাবে তাঁর প্রধান শত্রু দেবরাজ ইন্দ্রের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন?

স্বৰ্গে পৌঁছে যুধিষ্ঠির ভাইদের ও দ্ৰৌপদীকে দেখতে চাইলেন। কিন্তু তিনি প্রথমে দেখতে পেলেন কৌরব বীরদের। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তর দিয়ে নারদ বললেন যাদের পাপ বেশি পুণ্য কম, তারা আগে স্বৰ্গ ভোগ করে নরকে যায়। পুণ্যবান আগে নরকে যায়, তাই যুধিষ্ঠির নরকে যাতনাক্লিষ্ট ভাইদের ও দ্রৌপদীকে দেখতে পেলেন। নরকের দুঃসহ যন্ত্রণা, উৎকট পুতিগন্ধ, নানা রকম উৎপীড়নের কাতরোক্তি এ সব দেখে কাতর হলেন যুধিষ্ঠির। এর পর দেবতারা এসে যুধিষ্ঠিরকে স্বৰ্গে নিয়ে গেলেন। দেখলেন, তার ভ্রাতারা এবং দ্রৌপদীও ইতিমধ্যে নরকবাস শেষ করে স্বর্গে পৌছেছেন।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply