মন্দির প্রাঙ্গণে ও গৃহাঙ্গনে পবিত্র তুলসী বৃক্ষ রাখা, তাঁর পূজা-পরিক্রমা করা, কন্ঠে তুলসীকাষ্ঠের মালা ধারণ করা সনাতন হিন্দুদের প্রাচীন সংস্কৃতি। কিন্তু কেন বৃক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তুলসীকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়, এ বিষয়টি অনেকেরই অজানা। তাই এই ভিডিওতে তুলসীর কী পরিচয়? ভূমন্ডলে তুলসীর আবির্ভাব কীভাবে হলো? তুলসী কীভাবে বৃক্ষে পরিণত হলো? তুলসী কেন বৃক্ষ হয়েও জগৎপূজিতা হল? তুলসী কাষ্ঠের মালা কন্ঠেধারণের কী আবশ্যকতা? ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রইল আপনার জন্য।
সাধারণ বিচারে তুলসী একটি সুগন্ধি ও ঔষধি উদ্ভিদ। অনাদি কাল থেকে ধরে প্রায় প্রতিটি হিন্দু গৃহে পবিত্র বৃক্ষরূপে পূজিত হয়ে আসছে এই তুলসী। মূলত, তুলসী হলেন লক্ষীদেবীর তথা শ্রীমতি রাধারাণীর অংশস্বরূপা সখী ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী। গোলোক বৃন্দাবনে গোপিকা বৃন্দাদেবীরূপে তুলসী রাধাকৃষ্ণের নিত্য সেবিকা এবং তাদের বিচিত্র দিব্য লীলা সম্পাদনের মূল পরিচালিকা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের দূতী, কুঞ্জাদি সংস্কারে অভিজ্ঞা ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পন্ডিতা। তিনি সমস্ত দেবীগণের মধ্যে পবিত্ররূপা এবং সমুদয় বিশ্বের মধ্যে তাঁর তুলনা নেই বলে তিনি তুলসী নামে কীর্তিতা
আর কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনী বলে তাকে ভক্তিদেবী বা ভক্তিজননী বলেও সম্বোধন করা হয়। বৃন্দাদেবীর আজ্ঞাক্রমেই বৃন্দাবনে পত্র, পুষ্প, ফল, ভ্রমর, মৃগ, ময়ূর, শুক-শারী ইত্যাদি পশুপাখিরাও শ্রীকৃষ্ণের কেলিকুঞ্জে পরম রমণীয় শোভা ধারণ করে। সৃষ্টির প্রারম্ভে স্বায়ম্ভূব মন্বন্তরের প্রথম পাদে তিনি কেদার রাজার কন্যারূপে বৃন্দাদেবী নামে যজ্ঞকুন্ড থেকে আবির্ভূত হন। তিনি যে বনে তপস্যা করেছিলেন সেই বন জগত বৃন্দাবন নামে প্রসিদ্ধ হয়। শ্রীল কবিকর্ণপুর গোস্বামীকৃত ‘গৌরগণোদ্দেশ দীপিকা’ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যলীলায় বৃন্দাদেবী মুকুন্দ দাসরূপে আবির্ভূত হন।
আবার, এই বৃন্দাদেবীই অন্য এক স্বরূপে অভিরামশক্তি শ্রীমতি মালিনীদেবী রূপে আবির্ভূত হন। গৌড়ীয় আচার্যশ্রেষ্ঠ শ্রীল রূপ গৌস্বামীপাদ ‘শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণগণোদ্দেশ দীপিকা’ গ্রন্থে বৃন্দাদেবীর পরিচয় প্রসঙ্গে লিখেছেন- “শ্রীমতি বৃন্দাদেবীর দেহকান্তি মনোহর ও তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়; নীল বসন পরিধানে মুক্ত ও পুষ্প দ্বারা বিভূষিতা। তাঁর পিতার নাম চন্দ্রভানু, মাতা ফুল্লরা, পতির নাম মহীপাল ও ভগিনী মঞ্জরী। শ্রীমতি বৃন্দাদেবী বৃন্দাবনে সর্বদাই বাস করেন। শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের নানাবিধ লীলার দূতী এবং লীলারসে সর্বদাই সমুৎস্যুক, উভয়ের মিলনকার্যে প্রেমে পরিপূর্ণা থাকেন এই বৃন্দাদেবী।” বৃন্দাদেবীর প্রতি অনুগত্য ও তাঁর কৃপা ভিন্ন বৃন্দাবনে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের নিত্যসেবাধিকার কদাপি কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাই, বিশেষত গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের নিকট তুলসী পরম আদরণীয়া, শ্রদ্ধেয় ও পূজনীয়া।
রাধাকৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া ও সেবিকা তুলসী মহারাণী তথা বৃন্দাদেবী জগজ্জীবের কল্যাণার্থে ভিন্ন ভিন্ন কল্পে ও মন্বন্তরে ভিন্ন ভিন্নভাবে এজগতে আবির্ভূত হন। তাই জগতে তুলসীর আবির্ভাব সম্পর্কে পুরাণে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। একই তুলসীদেবী কখনো জলন্ধরের পত্নী, কখনো শঙ্খচূড়ের পত্নী, আবার, কখনো বা ধর্মদেবের পত্নী, কখনো ধর্মধ্বজ কন্যা, কখনো চন্দ্রভানু কন্যা, আবার কখনো কেদাররাজের কন্যারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে, এই প্রত্যেক কন্যাই এক বৃন্দাদেবী এবং প্রত্যেক জন্মেই তিনি কৃষ্ণভক্তিপরায়ণা ছিলেন।
সময় স্বল্পতার কারনে বৃন্দাদেবীর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করা সম্ভবপর নয় বিধায় দর্শকদের জন্য প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক বর্ণনা এ ভিডিওতে তুলে ধরা হলো।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ আছে যে, শ্রীকৃষ্ণের পিতা নন্দমহারাজের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, হে ব্রজরাজ, সৃষ্টির প্রারম্ভে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরের প্রথম পাদে স্বয়ম্ভুব মনু ও শতরূপার দুইপুত্র হয়-প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ। উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব। ধ্রুব মহারাজের পুত্র নন্দসাবর্ণি, তাঁর পুত্র কেদার রাজ। তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব ও সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি। একসময় কেদার রাজার যজ্ঞকুন্ড থেকে লক্ষীদেবীর অংশরূপে এক কন্যা আবির্ভূত হন এবং সে কন্যা কেদার রাজ ও তাঁর পত্নীকে তাঁর পিতা-মাতারূপে গ্রহণ করেন। পিতামাতাকে অবগত করে সেই কন্যা তপস্যার উদ্দেশ্যে যমুনার তীরবর্তী রমণীয় পূণ্য বনে গমন করেন। ঐ কেদারকন্যার নাম ছিল বৃন্দা। তাই, তার তপোবন বলে সেই বন জগত বৃন্দাবন নামে প্রসিদ্ধ হয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার মানসে দীর্ঘকাল তপস্যার পর ব্রহ্মার নিকট থেকে তিনি শীঘ্রই শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার বর প্রাপ্ত হন। এরপর বৃন্দাকে পরীক্ষা করার জন্য ব্রহ্মা মনোহর বেশে ধর্মকে তাঁর নিকট প্রেরণ করেন। কন্দর্পসম সুপুরুষ ধর্মকে প্রণাম ও সেবাদি করেন এবং তাঁর নিকটেও একই বর প্রার্থনা করেন বৃন্দা । কৃষ্ণপ্রাপ্তি সুদর্লভ বলে ধর্ম বৃন্দাকে নিরুৎসাহিত করে তাঁকেই পতিরূপে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। এতে বৃন্দা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিনবার ‘তোমার ক্ষয় হোক’ বলে ধর্মকে অভিশম্পাত করেন।
এরপর সূর্যদেবের নির্দেশে বৃন্দা পুনঃঅভিশাপ প্রদানে নিরত হন এবং সমস্ত দেবতা বৃন্দাকে ধর্মের পুনঃজীবন দান করার নির্দেশ দেন। ধর্মপত্নী মুর্তিদেবীও তখন সেখানে উপস্থিত হন। তার অনুরোধে ভগবান শ্রীবিষ্ণু বৃন্দাদেবীকে বলেন, “হে বৃন্দে, তুমি তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মার ন্যায় যে আয়ু লাভ করেছ তা এখন ধর্মকে অর্পণ করে গোলোকধামে গমন করো। তোমার এই তপস্যার দ্বারা তুমি পরে আমাকে অবশ্যই লাভ করবে। বরাহ কল্পে তুমি গোলোক হতে গোকুলে এসে জন্মলাভ করবে। রাসমন্ডলে রাধিকা ও গোপীগণের সাথে আমাকে প্রাপ্ত হবে।” বিষ্ণুনির্দেশে বৃন্দাদেবীর কৃপায় ধর্ম পুনরুত্থিত হলেন। ততক্ষণে গোলোক হতে এক দিব্য রথ এল এবং এভাবে বৃন্দাদেবী তাঁর নিত্য ধাম প্রাপ্ত হলেন এবং অন্যান্য দেবতারা স্ব-স্ব স্থানে প্রাস্থান করলেন।
এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক, তুলসী কীভাবে বৃক্ষে পরিণত হলো?
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে, প্রকৃতিখন্ডে, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, দেবর্ষি নারদের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীনারায়ণ তাঁর নিকট তুলসীর বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন। নারয়ণের বর্ণনানুসারে, একসময় দক্ষসাবর্ণি নামক মনুর বংশোদ্ভুত রাজা ধর্মধ্বজ লক্ষীদেবীর উপাসনা করেছিলেন। লক্ষীদেবী তাঁর প্রতি প্রসন্ন হয়ে তাঁকে বরদান করেন। ফলে, ধর্মধ্বজরাজের পত্নী মাধবী লক্ষীর অংশরূপিণী মনোহরা এক পদ্মিনী কন্যা প্রসব করেন।
চম্পকবর্ণা সুকেশী মনোহরা অপূর্ব সুন্দরীকন্যাকে দর্শন করে নরনারীগণ তাঁর তুলনা দিতে অক্ষম হয়েছিলেন বলে পুরাবিদ পন্ডিতগণ তাঁকে ‘তুলসী’ নামে অভিহিত করেন। পরবর্তীকালে তুলসী যোগ্যা স্ত্রীর ন্যায় তপস্যার জন্য বদরিকাশ্রমে গমন করেন। সেখানে “মম নারায়ণঃ স্বামী ভবিতেতি” অর্থাৎ “নারায়ণ আমার স্বামী হোন” এরূপ সংকল্পপূর্বক দৈবপরিমাণে লক্ষ বছর ধরে কঠোর তপস্যায় রত থকেন।
তখন ব্রহ্মা তাঁকে বর প্রার্থনা করার নির্দেশ দিলে তুলসী ব্রহ্মাকে বলেন, “আমি গোলোকধামে গোপী রূপে শ্রীকৃষ্ণের অংশস্বরূপা এবং তাঁর প্রিয়া ও সখী। রাসেশ্বরী শ্রীমতি রাধারাণীর অভিলাষে ও শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে আমি মর্ত্যে মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করেছি। শ্রীকৃষ্ণ আমাকে ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণপূর্বক তাঁরই অংশস্বরূপ চতুর্ভুজ নারায়ণকে আমার পতিরূপে প্রাপ্ত হওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করার নির্দেশ দেন।
দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণে আমার যেরূপ অভিলাষ, চতুর্ভূজ নারায়ণে সেরূপ নেই। তথাপি কৃষ্ণসন্তুষ্টিহেতু আমাকে এই বর দিন, যেন আমি নারায়ণকে পতিরূপে লাভ করতে পারি এবং রাধারাণীরও প্রিয়া হতে পারি।” ব্রহ্মা তুলসীকে রাধার মন্ত্র, স্তোত্র, কবচ, পূজাবিধানসহ তাঁর মনোপূত বর প্রদান করেন। তবে, নারায়ণ প্রাপ্তির পূর্বে ব্রহ্মা তাঁকে শঙ্খচূড়ের পত্নীরূপে কিছুকাল অতিবাহিত করার নির্দেশ প্রদান করে অন্তর্হিত হন।
শঙ্খচূড় গোলোকবৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই অংশপ্রকাশ সুদামাসখারূপে নিত্য বিদ্যমান। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় রাধারাণীর অভিশাপে তিনি শঙ্খচূড় রূপে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেন। শঙ্খচূড় শিবের কাছ থেকে বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, যতদিন তার পত্নী তুলসীর সতীত্ব বজায় থাকবে, ততদিন তাকে কেউ বধ করতে পারবে না। এরপর দেবতাদের সাথে অজেয় শঙ্খচূড়ের যুদ্ধ শুরু হয়। তখন দেবতাদের প্রার্থনায় কৃষ্ণাংশ ভগবান শ্রীবিষ্ণু শঙ্খচূড়ের ছদ্মবেশে তুলসীকে তার পূর্বকৃত তপস্যার ফলদান তথা পতিসঙ্গ দান করেন; ফলে শঙ্খচূড় নিহত হন। তুলসী যদিও পূর্বে ভগবানকে পতিরূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন, তবুও সেসময় তার বর্তমান পতিবিয়োগ ও বিষ্ণুর এ আপাত ছলনা সইতে না পেরে তিনি তখন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। ক্রোধ সংবরন করতে না পেরে তিনি বিষ্ণুর এ আচরণকে পাষাণ হৃদয় বিবেচনা করে তাঁকে পাষাণ হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন এবং তৎক্ষণাৎ দেহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। আজ আমরা যে নারায়ন শীলার পূজা করে থাকি তা বৃন্দাদেবীর অভিশাপের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল। পরে তুলসী তার ভুল বুঝতে পারেন যে, তিনি ভগবানের প্রতি অভিশম্পাত করছেন।
তখন ভগবানও তুলসীকে বরদান করেন। শ্রীবিষ্ণুর বরে সাধ্বি তুলসী দেহত্যাগের পর দিব্যদেহ ধারণপূর্বক গোলোকে শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে প্রাপ্ত হন; তাঁর শরীর ভারতে গন্ডকী নামে প্রসিদ্ধা, মনুষ্যগণের পুণ্যপ্রদা পবিত্রা নদীরূপে পরিণত হয় এবং তাঁর কেশকলাপ তুলসী কেশসম্ভুতা বলে তুলসী নামে বিখ্যাত পবিত্র বৃক্ষরূপ ধারণ করে। এই গণ্ডকী নদী এখনো নেপালে বহমান এবং নারায়ন শীলা শুধু্মাত্র এই নদীর গর্ভেই পাওয়া যায়। অচিন্ত্য শক্তিধর নটোবর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেরূপ আপন ভগবত্ত্বা বলে রাসলীলায় নিজেকে অসংখ্যরূপে বিস্তার করেছিলেন, তথাপি তিনি এক, তদ্রুপ বৃন্দাদেবীও পরবর্তীকালে ভগবানের অচিন্ত্য শক্তিবলে এক হয়েও সুন্দরী, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল, বৈকুন্ঠ ও আমার সন্নিধানে তুলসীবৃক্ষ সমুদয় পুষ্প হতে শ্রেষ্ঠ হবে। তুলসী তরুমূলে সমূদয় তীর্থের অধিষ্ঠান থাকবে।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তুলসী কেন বৃক্ষ হয়েও জগৎপূজিতা?
আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন তুলসী কোনো সাধারণ বৃক্ষ নয়। মূলত, তিনি এ জড়জগতের উর্ধ্বে অবস্থিত চিন্ময় গোলোকবৃন্দাবন ধামে নিত্য বাসরতা কৃষ্ণপ্রেয়সী এবং রাধাকৃষ্ণের নিত্য সেবিকা। তবুও বদ্ধজীবের প্রতি কৃপা করতে, বিশেষ কিছু ঘটনাকে নিমিত্ত করে তিনি এজগতে বৃক্ষরূপে প্রকটিত হয়েছেন। মূর্তিমান দেবী হয়েও গঙ্গা-স্বরস্বতী যেরূপ যুগপৎ নদীরূপে বিদ্যমান, তদ্রুপ তুলসী গোলোক নিবাসী গোপিকা হয়েও যুগপৎ বৃক্ষরূপে বিদ্যমান।
তাই তাঁর পূজাকে যদি কেউ সাধারণ বৃক্ষপূজা বলে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন, তা নেহাৎ অজ্ঞতা। তুলসী ভক্তিদেবী বিধায় তাঁর নিত্য পূজার ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অবশ্যই ভক্তি লাভ হয়। ব্যবহারিক অনুশীলন না করলে কখনোই তা কারো অনুভূত হবে না, ঠিক যেমন মধুর বোতল লেহন করলে কখনো মধুর স্বাদ পাওয়া যায় না। তাই জীবশিক্ষার নিমিত্তে ভগবান শ্রীনারায়ণ স্বয়ং এ তুলসী পূজা প্রচলন করেন। তুলসী পূজা প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বহু প্রমাণ রয়েছে, এর মধ্যে
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে, একসময় দেবী তুলসী অভিমান বশত অন্তর্হিত হলে তুলসীবনে গমনপূর্বক শ্রীহরি তুলসীর পূজা ও স্তব করেন। তখন দেবী তুলসী বৃহ্ম হতে আবির্ভূতা হন এবং শ্রীহরির পাদপদ্মে শরণ নেন। সেখানে এও বলা হয়েছে, যে মানব হরিপ্রণীত মন্ত্ররাজ পাঠ করত ঘৃতপ্রদীপ, ধূপ, সিঁদুর, চন্দন, পুষ্প, নৈবেদ্য ও অন্যান্য উপহার দ্বারা যথাবিধি তুলসীর পূজা করবেন, তিনি সর্বসিদ্ধি লাভ করবেন।
পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডে মহাদেব নারদমুনিকে সম্বোধন করে বলেন-তুলসী সম্বন্ধীয় পত্র, পুষ্প, ফল, মূল, শাখা, ত্বক, স্কন্ধ এবং মৃত্তিকাদি সমস্তই পবিত্র। যে গৃহে তুলসী-বৃক্ষ অবস্থিত, তার দর্শন-স্পর্শনেই ব্রহ্মহত্যাদি পাপ বিলয়প্রাপ্ত হয়। যে যে গ্রহে, গ্রামে বা বনে তুলসী বৃক্ষ বিরাজ করে, জগৎপতি শ্রীহরি প্রীতচিত্তে সেই সেই ক্ষেত্রে বাস করেন। পদ্মপুরাণ,সৃষ্টিখন্ডে বলা হয়েছে সমস্ত পত্র পুষ্প মধ্যে মঙ্গলময়ী তুলসীই সাধুতমা, তা সর্বমঙ্গলপ্রদা, শুদ্ধা, বৈষ্ণবী, বিষ্ণুপ্রিয়া, ভক্তিমুক্তিপ্রদা, মুখ্যা এবং সর্বলোক মধ্যে পরম শুভা। অতএব, তুলসী দেবীকে সর্বদাই পূজা করবে। পদ্মপুরাণ, সৃষ্টিখন্ডে বলা হয়েছে তুলসী নামোচ্চারণমাত্রই মুরারি হরি প্রীতি লাভ করেন, পাপসকল বিলয় প্রাপ্ত হয় এবং অক্ষয় পূণ্য লাভ হয়ে থাকে- এমন তূলসীকে লোকে কেন পূজা-বন্দনা করবে না?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তুলসী সেবা কীভাবে করবেন?
শ্রীল রূপ গোস্বামী স্কন্দপুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে নানা প্রকার তুলসীসেবার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে-“যাঁর দর্শনে পাপ ও রোগ নাশ হয়, স্পর্শের ফলে শরীর শুদ্ধ হয়, জল সিঞ্চন করার ফলে ভয় দূর হয়, রোপণ করার ফলে ভগবদ্ভক্তি লাভ হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্পণ করার ফলে পূর্ণ ভগবৎপ্রেম লাভ করা যায় সেই তুলসীদেবীর চরণে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।” আরো বলা হয়েছে, “তুলসী সর্বমঙ্গলময়ী। তাঁকে দর্শন করলে, স্পর্শ করলে, স্তবন করলে, বন্দনা করলে, তাঁর মহিমা শ্রবন করলে অথবা রোপণ করলে সবরকমের কল্যাণ লাভ করা যায়। এই প্রকার বিধির মাধ্যমে তুলসীদেবীর সেবা করলে নিত্যকাল বৈকুণ্ঠজগতে বাস করা যায়।” তুলসীদেবীর কৃপা লাভের আরেকটি বিশেষ পন্থা হলো তুলসী প্রদক্ষিণ। প্রদক্ষিণের এ পদ্ধতি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। তাই বিভিন্ন ধর্মে প্রদক্ষিণের রীতি দেখা যায়। মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক নিষ্ঠাসহকারে তুলসী প্রদক্ষিণ কালে ব্যক্তির চিত্ত ভক্তিজননী তুলসীদেবীর প্রতি নিবিষ্ট হয়। শ্রদ্ধা ও ভগবদ্ভক্তি নিশ্চিতরূপে বর্ধিত হয় এবং চিত্ত স্থির হওয়ার ফলে আধ্যাত্মিক মার্গে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যায়।