যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য
তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥
গীতায় বর্ণিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই বানীর ভাবার্থ হল, হে ভরতবংশী, যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে, তখনই, পাপীদের ও দুষ্কৃতীকারীদের বিনাশ ও সাধুদের পরিত্রান করে ধর্মসংস্থাপন করার জন্য আমি আমার স্বীয় পরমাত্মাকে মায়া দ্বারা সৃজন করে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
শ্রীকৃষ্ণের এই অমৃতবানীর সত্যতা পাওয়া যায় বিষ্ণুর দশাবতারের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। গরুড় পুরাণ অনুসারে মৎস্য, কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বলরাম, ও কল্কি হলেন শ্রীবিষ্ণুর দশটি incarnation বা অবতার। সত্য যুগ থেকে শুরু করে কলি পর্যন্ত শ্রীনারায়নের নয়টি অবতার একে একে জন্ম নিয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে উদাহরন স্থাপন করেছেন। গরুড় পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুর দশম অবতার তথা কল্কি অবতার আরো ৪,২৭,০০০ বছর পর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে কলিকালের ঘোর পাপীদের বিনাশ করে মহাপ্রলয় সঙ্ঘঠিত করবেন।
এ তো গেল পুরাণের কথা কিন্তু বিজ্ঞানের এই স্বর্ণযুগে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করতে পারি না আমরা। বিজ্ঞান সবসময় জানার চেষ্টা করেছে জীবন কিভাবে শুরু হল? কিভাবে বিবর্তিত হল জীবজগত? ধর্ম ও বিজ্ঞান এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছে বিভিন্নভাবে। বিজ্ঞান বলে মানুষের উৎপত্তি বানর থেক্লে এবং ধর্ম বলে ঈশ্বর নিজে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। ১৯ শতাব্দীতে চার্লস ডারউইন নামের একজন বৃটিশ বিজ্ঞানী the Origin of Species গ্রন্থে দাবী করে বসেন বিবর্তনবাদের। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণি একই উৎস থেকে বিবর্তিত হতে হতে আজকের অবস্থানে পৌছেছে। ডারউইনের এই বিবর্তনবাদের তত্ব আমাদের সকলেরই কম বেশী জানা। তবে প্রশ্ন অন্য জায়গায়, দশাবতারেরে প্রসঙ্গ থেকে আবার বিবর্তনবাদের দিকে তীর ছোড়ার কারন কি? কারন আছে বৈকি। আসলে আমরা যে দশাবতারদের কাহিনীগুলো অধ্যয়ন করেছি তা প্রাচীন সংস্কৃত লিপি থেকে আক্ষরিক অনুবাদ মাত্র। হাজার হাজার বছর ধরে এর প্রকৃত অর্থ ও ইঙ্গিত না বুঝেই আমরা এগুলোর চর্চা করে এসেছি। কিন্তু একজন সনাতনী হিসেবে এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার যে ডারউইন যখন তার বিবর্তনবাদের তত্ব প্রদান করেছিলেন তার হাজার হাজার বছর আগে পুরাণ এর সুক্ষ্ম ইঙ্গিত দিয়েছে আমাদের ভারতবর্ষেই। বিষ্ণুর দশাবতারই আসলে ডারউইনের বিবর্তনবাদের আদি মতবাদ।
গড়ুর পুরাণ অনুসারে শ্রীবিষ্ণুর প্রথম অবতার হচ্ছেন মৎস্য অবতার। পৌরাণিক কথা বলছে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে দ্রাবিড় রাজ্যের বিষ্ণুভক্ত রাজা সত্যব্রত বা মনু রাজত্ব করতেন। তাঁর রাজত্বকালে হঠাৎ পৃথিবীতে নানারূপ অন্যায় – অত্যাচার দেখা দেয় । রাজা তখন জগতের কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের করুণা কামনা করেন । একদিন জলাশয়ে স্নানের সময় রাজা সত্যব্রতের নিকট একটি পুটি মাছ এসে প্রাণ ভিক্ষা চায় । রাজা কমণ্ডলুতে করে মাছটিকে বাড়ি নিয়ে এলেন । কিন্তু ধীরে ধীরে মাছটির আকার ভীষণভাবে বাড়তে থাকে । ক্রমে ক্রমে মাছটিকে পুকুর , সরোবর , নদী , যেখানেই রাখা হয় , সেখানেই আর ধরে না । রাজা বুঝতে পারলেন , ইনি স্বয়ং নারায়ণ তাই তার সামনেই নারায়নের স্তব করতে শুরু করলেন। তারপর মৎসরূপী নারায়ণ রাজাকে বললেন , সাতদিনের মধ্যেই জগতের প্রলয় হবে । সে সময় তোমার ঘাটে এসে একটি স্বর্ণতরী ভিড়বে । তুমি সকল বেদ, সব রকমের জীবদম্পতি , খাদ্য – শস্য ও বৃক্ষবীজ সংগ্রহ করে তাদের নিয়ে সেই নৌকায় উঠবে । আমি তখন শৃঙ্গধারী মৎস্যরূপে আবির্ভূত হব । তুমি তোমার নৌকাটি আমার শৃঙ্গের সঙ্গে বেঁধে রাখবে । যথারীতি মহাপ্রলয় শুরু হল । রাজা মৎসরূপী ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নির্দেশ মত কাজ করলেন । ধ্বংস থেকে অক্ষা পেল তার নৌকা । এভাবেই মৎস্য অবতাররূপে ভগবান শ্রীবিষ্ণু সৃষ্টিতে রক্ষা করলেন । রক্ষা পেল বেদ, সংরক্ষিত হল বৃক্ষ বীজ ও জীবজগৎ।
অন্যদিকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ব অনুযায়ী পৃথিবীতে জল ছাড়া কোন প্রানী বাচতে পারে না। তাই সৃষ্টির সুচনা জল দিয়ে এবং প্রানের সুচনা জল থেকেই। দশাবতারের মৎস্য অবতার সৃষ্টির সেই প্রারম্ভকেই নির্দেশ করে।
কুর্ম অবতার কথায় বলা হচ্ছে,
একদা ঋষি দুর্বাসা দেবরাজ ইন্দ্রকে দিব্য পুষ্পমালা উপহার দিয়েছিলেন । ইন্দ্র সেই মালা সাদরে গ্রহণ করে তার বাহন ঐরাবতের মাথায় রাখেন দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু ঐরাবত সেই মালা তার শুঁড়ে জড়িয়ে মাটিতে ফেলে নষ্ট করে দেয়। এতে ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে শ্রীহীন হবার অভিশাপ দেন। অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে দেবরাজ দারস্থ হন ব্রহ্মার। ব্রহ্মা তখন পুনরায় অমৃতপ্রাপ্তির জন্য অসুরদের সাহায্যে সমুদ্রমন্থনের পরামর্শ দেন । সমুদ্র মন্থন কালে মন্দর পর্বত ঢুকে যাচ্ছিল সমুদ্র গর্ভে তাই তখন ভগবান বিষ্ণু কূর্ম বা কচ্ছপের রূপ ধারণ করে মন্দর পর্বতকে তার পৃষ্ঠে ধারণ করেনএবং এভাবে পুনরায় অমৃত প্রাপ্তি হয়।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের দ্বিতীয় পর্যায়ে পৃথিবীতে স্থলভাগ জেগে ওঠে এবং জলে জন্মগ্রহণকারী প্রানী ঊঠে আসতে শুরু করে পৃথিবির স্থলভাগেও। এ পর্বে প্রানীরা এমনভাবে বিবর্তিত হয় যাতে তারা জল ও স্থল দুই স্থানেই বেঁচে থাকতে পারে। বিজ্ঞানের ভাষায় এই জাতীয় প্রানীর নাম amphibian বা উভচর। দশাবতারের দ্বিতীয় অবতার কুর্মই হল সেই উভচর প্রানী যা বিবর্তনবাদের তত্বে ঊঠে এসেছে।
শ্রীনারায়নের তৃতীয় আবির্ভাব বরাহ অবতার রূপে। পুরাণ বলে এই অবতারে বিষ্ণু শূকরের রূপ ধারণ করে হিরণ্যাক্ষ নামক রাক্ষসের হাত থেকে ভূদেবী পৃথিবীকে উদ্ধার করেন। হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীকে মহাজাগতিক সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিষ্ণু বরাহ- বেশ ধারণ করে এক হাজার বছর ধরে হিরণ্যাক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত ও নিহত করেন। এভাবে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা পায় পৃথিবী। শিল্পকলায় অঙ্কিত বরাহের চিত্রে চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম; এবং বরাহদন্তে ধরা থাকে পৃথিবী।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের তৃতীয় পর্যায়ে জীবকুল পৃথিবীর স্থলভাগে বসবাস করার জন্য সম্পুর্ণভাবে বিবর্তিত হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় ম্যামালস বা স্তন্যপায়ী প্রানীর। এই জাতীয় প্রানী মাতৃদুগ্ধ পান করে এবং প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত খাবার খেয়ে জীবন ধারন করে। দশাবতারের তৃতীয় অবতার বরাহ বা শুকর এই স্তন্যপায়ী প্রানীদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।
এদিকে বরাহ অবতার হিরণ্যাক্ষকে বধ করার কারনে হিরণ্যাক্ষের ভাই হিরণ্যকশিপুও প্রবল বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। দাদার হত্যার প্রতিশোধ নিতে তিনি বিষ্ণুকে হত্যা করার পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এই জাতীয় প্রবল ক্ষমতা প্রদানে সক্ষম। তিনি বহু বছর ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করে তার কাছ থেকে বর প্রার্থনা করেন,
হে প্রভু, হে শ্রেষ্ঠ বরদাতা, আপনি আমাকে এমন বর দিন যে বরে আপনার সৃষ্ট কোনো জীবের হস্তে আমার মৃত্যু ঘটবে না। আমাকে এমন বর দিন যে বরে আমার বাসস্থানের অন্দরে বা বাহিরে আমার মৃত্যু ঘটবে না; দিবসে বা রাত্রিতে, ভূমিতে বা আকাশে আমার মৃত্যু হবে না। আমাকে এমন বর দিন যে বরে শস্ত্রাঘাতে, মনুষ্য বা পশুর হাতে আমার মৃত্যু হবে না। আমাকে এমন বর দিন যে বরে কোনো জীবিত বা মৃত সত্তার হাতে আমার মৃত্যু হবে না; কোনো উপদেবতা, দৈত্য বা পাতালের মহানাগ আমাকে হত্যা করতে পারবে না; যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে কেউই হত্যা করতে পারবে না। হিরণ্যকশিপুর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন ব্রহ্মদেব। এদিকে নারদের প্রভাবে তার নিজের পুত্র প্রহ্লাদই হয়ে ওঠেন পরম বিষ্ণুভক্ত। নিজের সন্তানকে নিজের পরম শত্রুর ভক্ত হতে দেখে ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেলেন হিরণ্যকশিপু ।
কালক্রমে প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তিতে হিরণ্যকশিপু এতটাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন যে তিনি নিজ পুত্রকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যতবারই তিনি বালক প্রহ্লাদকে বধ করতে যান, ততবারই বিষ্ণুর মায়াবলে প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা পায়। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলেন তাকে ত্রিভুবনের অধিপতি রূপে স্বীকার করে নিতে। কিন্তু প্রহ্লাদ অস্বীকার করে বলেন একমাত্র বিষ্ণুই এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ প্রভু। ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু তখন একটি স্তম্ভ দেখিয়ে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেন যে ‘তার বিষ্ণু’ সেখানেও আছেন কিনা:
“ওরে হতভাগা প্রহ্লাদ, তুই সব সময়ই আমার থেকেও মহৎ এক পরম সত্তার কথা বলিস। এমন এক সত্তা যা সর্বত্র অধিষ্ঠিত, যা সকলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং যা সর্বত্রব্যাপী। কিন্তু সে কোথায়? সে যদি সর্বত্র থাকে তবে আমার সম্মুখের এই স্তম্ভটিতে কেন নেই?”
প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, তিনি এই স্তম্ভে আছেন, এমনকি ক্ষুদ্রতম সৃষ্টিতেও আছেন। হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে গদার আঘাতে ভেঙে ফেলেন স্তম্ভটি । তখনই সেই ভগ্ন স্তম্ভ থেকে প্রহ্লাদের সাহায্যার্থে নৃসিংহের মূর্তিতে আবির্ভূত হন বিষ্ণু। ব্রহ্মার বর যাতে বিফল না হয়, অথচ হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করা যায়, সেই কারণেই বিষ্ণু নরসিংহের বেশ ধারণ করেন: হিরণ্যকশিপু দেবতা, মানব বা পশুর মধ্য নন, তাই নৃসিংহ পরিপূর্ণ দেবতা, মানব বা পশু নন; হিরণ্যকশিপুকে দিবসে বা রাত্রিতে বধ করা যাবে না, তাই নৃসিংহ দিন ও রাত্রির সন্ধিস্থল গোধূলি সময়ে তাকে বধ করেন; হিরণ্যকশিপু ভূমিতে বা আকাশে কোনো শস্ত্রাঘাতে বধ্য নন, তাই নৃসিংহ তাকে নিজ জঙ্ঘার উপর স্থাপন করে নখরাঘাতে হত্যা করেন; হিরণ্যকশিপু নিজ গৃহ বা গৃহের বাইরে বধ্য ছিলেন না, তাই নৃসিংহ তাকে বধ করেন তারই গৃহদ্বারে।
অন্যদিকে বিবর্তনবাদের তত্ব অনুসারে এই পর্যায়ে অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক পশু সম্বলিত প্রানীর উদ্ভব ঘটে। মানব্জাতির বিবর্তন এই পর্যায় থেকেই শুরু হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। ডারউইনের মতে মানুষ ও পশুর বৈশিষ্ট্য সম্বলিত বানর প্রজাতির থেকেই আধুনিক মানুষের উৎপত্তি ঘটেছে। দর্শক, খেয়াল করবেন, বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার মানুষ ও পশু সম্বলিত সেই প্রজাতির প্রতিনিধি মাত্র।
মৎস্য পুরাণের মতে− অসুরদের দ্বারা দেবতারা পরাজিত হয়ে আশ্রয়হীন হলে, দেবমাতা অদিতি পুনরায় শক্তিশালী পুত্রের জন্য বিষ্ণুর আরাধনা করেন। আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে, বিষ্ণু ঋষি কশ্যপের ঔরসে অদিতির গর্ভে জন্মগ্রহণের অঙ্গীকার করেন। এরপর যথাসময়ে অদিতির গর্ভে খর্বকায় বামন রূপে বিষ্ণুর আবির্ভাব হলে, অসুরেরা ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
সেই সময়ের অসুর অধিপতি বলি একটি যজ্ঞের আয়োজন করলে, বামনরূপী বিষ্ণু উক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানে গিয়ে ত্রিপাদ-ভূমি বা তিন পা রাখার মতো ভূমি প্রার্থনা করেন। বলি সম্মত হয়ে ভূমি দান করলে, বিষ্ণু তখন তাঁর দেহকে বর্ধিত করে বিশাল আকার ধারণ করেন। এরপর তিনি স্বর্গে-মর্তে দুই পা রেখে নাভি থেকে তৃতীয় পা বের করেন। এই তৃতীয় পা কোথায় রাখবেন তা বলিকে জিজ্ঞাসা করলে, বলি তাঁর মাথা নত করে তৃতীয় পা রাখার অনুরোধ করেন। বলি তৃতীয় পদ বলির মাথায় রাখার সাথে সাথে বলি বিষ্ণুর স্তব করতে থাকেন। এমন সময় প্রহ্লাদ এসে বলির বন্ধন মুক্তির জন্য অনুরোধ করলে, বিষ্ণু বলিকে মুক্তি দেন এবং বলি সত্য রক্ষার জন্য বহুকষ্ট স্বীকার করেছেন বলে, বিষ্ণু দেবতাদের দুষ্প্রাপ্য রসাতলকে তাঁর বাসের জন্য দান করেন।
বিবর্তনবাদের এ পর্যায়ে, উদ্ভব ঘটে খর্বকায় ও অপরিনত মানুষের । এই বামনাকৃতির মানবগোষ্ঠীই আধুনিক মানুষের পুর্বসুরী। বিষ্ণুর বামন অবতারের মাধ্যমে এই পর্যায়ের অতি খর্বকায় মানুষের প্রতিফলন উঠে এসেছে পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালে।
ঋষি জমদগ্নি পাঁচ পুত্রের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ৷ পাপের ভারে পৃথিবীকে রসাতলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেই ভগবান বিষ্ণুর অংশ হিসেবে তিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন৷ পরবর্তীকালে ক্ষত্রিয় নিধনে তিনি হাতে কুঠার তুলে নেওয়ায় তাঁকে পরশুরাম বলা হয়৷ পৌরাণিক কথা অনুসারে একদিন তাঁর মা জল আনতে গঙ্গাতীরে গিয়ে গন্ধর্বরাজকে তার স্ত্রীসহ জলবিহার করতে দেখে তিনি এতটাই বিভোর হয়ে যান যে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলার সময় চলে যাওয়াও বিস্মৃত হয়ে যান তিনি৷ ঋষি তপোবলে বিষয়টি জেনে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে মাতৃহত্যার আদেশ দেন ছেলেদের৷ প্রথম চার ছেলে তা অস্বীকার করলেও পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং ভাইদেরকে কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। তার পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে, সেই বরে তিনি আবার তার মা ও ভ্রাতাদের প্রাণ ফিরিয়ে আনেন । কিন্তু মাতৃহত্যা করার ফলে সেই কুঠার যুক্ত হয়ে গেল পরশুরামের হাতের সঙ্গে ৷ তিনি এই পাপমুক্তির উপায় জানতে চান পিতার কাছে৷ জমদগ্নি বলেন, তীর্থে যেতে হবে তাঁকে, এবং কোনও এক তীর্থস্থানের জলের স্পর্শেই এই কুঠার তাঁর হাত থেকে নেমে যাবে৷ সেই মতো পরশুরাম ঘুরতে ঘুরতে একসময় ব্রহ্মকুণ্ডের হাজির হন৷ আর তার জল তাঁর হাতে স্পর্শ হওয়া মাত্রই কুঠার পড়ে যায় হাত থেকে৷তবে এখানেই থেমে থাকেননি তিনি৷ এই পবিত্র জলকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি সেই কুঠারকে লাঙলে রুপান্তরিত করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যে তথা সমভূমিতে নিয়ে আসেন সেই জলধারা৷
ডারউইনের বিবর্তনবাদের এই স্তরে আদিম মানুষের উদ্ভব ঘটে। তারা লাঙ্গল বা কুঠার জাতীয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে পশু শিকারের মাধ্যমে জীবন ধারনে অভস্ত্য হয়ে ওঠে। অলৌকিকভাবে এই তত্বও মিলে যায় বিষ্ণুর পরশুরাম অবতারের সাথে। পরশুরামের ব্যাবহৃত কুঠার ও লাঙ্গল এই স্তরের মানব সভ্যতাকে নির্দেশ করে।
রাম অবতারের কথা আমাদের সবারই জানা। রামের জীবনকথাকে হিন্দুরা ধর্মনিষ্ঠার আদর্শ হিসেবে মান্য করেন। পিতার সম্মানরক্ষার্থে তিনি সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাস মেনে নিয়েছিলেন। বনবাসকালে লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় যায় নিজ প্রাসাদে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর রাম হনুমানের মাধ্যমে জানতে পারেন যে সীতা অত্যাচারী রাবনের রাজপ্রাসাদে বন্দী জীবন যাপন করছেন। রাম তখন বানর সেনা দিয়ে লঙ্কায় যাওয়ার জন্য সেতু নির্মাণ করেন এবং রাবণের বিরাট রাক্ষস বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত ও নিহত করেন।
বিবর্তন তত্বে এ পর্যায়ে মানুষ বাহ্যিক শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে দলবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে বসবাস শুরু করেন। এ সময়ে মানবগোষ্ঠী বহিঃশত্রুর আক্রমন প্রতিহত করতে দলগতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। রাম অবতারের মাধ্যমে সেই বিশেষ সময়কালকে প্রতিফলিত করা হয়েছে পৌরাণিক কাহিনির ভঙ্গিমায়।
শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় ভগবান বিষ্ণুর পুর্ণাবতার। তিনি আবির্ভুত হয়েছিলেন এক যুগসন্ধিক্ষনে। তার অন্তর্ধানের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল পাপীষ্ঠ কলি যুগ। অবতার ধারন করে পুতনা, কালীয় ও কংস নামক রাক্ষস ও অসুরদের বধ করে তিনি পৃথিবীর ভারসম্য রক্ষা করেছিলেন। এর পাশাপাশি মহাভারতের যুদ্ধে তার ভুমিকা ছিল অগ্রগণ্য। পাণ্ডবদের পক্ষে অবস্থান করে তিনি অস্ত্র ধারন না করেও পরোক্ষভাবে সম্পুর্ণ কুরু বংশের বিনাশ রচনা করেছিলেন। শ্রীবিষ্ণুর সমস্ত অবতারের চেয়ে শ্রীকৃষ্ণের লীলা অনেক বেশী প্রসারিত ও সমৃদ্ধ। এই অবতার কথায় উঠে এসেছে তার ছেলেবেলার দুরন্তপনা, পশুপালন ও জ্ঞানের স্তরে মানুষের প্রবেশের অনেক কাহিনী।
বিবর্তনবাদ অনুসারে এই যুগে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে এবং গবাদিপশু ও কৃষিকাজের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। এছারাও এই যুগেই মানুষ জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করে। বিবর্তনবাদের তত্ব অনুযায়ী এই যুগের সব বৈশিষ্ট্যই মিলে যায় শ্রীকৃষ্ণযুগের সাথে। আশ্চর্জনক হলেও সত্যিই যে পুরাণ রূপক অর্থে যে কথা হাজার বছর আগেই বলে দিয়েছে, ডারউইন তা বাস্তবতার নিরিখে অনুবাদ করেছেন মাত্র।
শ্রীহরি বিষ্ণুর শেষ নাগের অবতার হলেন বলরাম । অত্যাচারী কংসের কারাগারে বন্দী বসুদেব ও দেবকীর সপ্তম গর্ভে বলরাম আসেন, কিন্তু কংসের হাত থেকে সেই শিশুকে বাঁচানোর জন্য শ্রীহরির আদেশে দেবী যোগমায়া দেবকীর সপ্তম গর্ভের ভ্রূণ সেখান থেকে নন্দগৃহে রোহিণীর গর্ভে স্থাপিত করেন । ফলে দেবকীর সপ্তম গর্ভ মৃত সন্তান জন্ম দেয় এবং রোহিণীর গর্ভে বলরামের জন্ম হয় । বল মানে শক্তি । শক্তি ও আধ্যাত্মিকতার মিলন হয়েছে বলে তার নাম বলরাম রাখা হয় । তিনি ভ্রাতা শ্রীকৃষ্ণের সহিত অনেক অসুর বধ করেন ও ভাইয়ের সাথে এক মধুর সম্পর্কের আদর্শ স্থাপন করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বলরাম কোনও পক্ষ অবলম্বন করেননি। একজন আদর্শ ভ্রাতা হিসেবে বলরাম তুলনাহীন। বহু বিপদে কৃষ্ণকে আগলে রেখেছেন তিনি। বলরামের অস্ত্র এক বিশাল লাঙল। তিনি এ কারণে ‘হলধারী’ নামেও পরিচিত। তিনি সর্বদা নীলাম্বরধারী।
যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম সমসাময়িক ছিলেন তাই শ্রীকৃষ্ণযুগে বিবর্তনবাদের যে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল তা বলরামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ভগবান শ্রীবিষ্ণুর দশম ও শেষ অবতার হচ্ছেন কল্কি। ভাগবতপুরাণে বলা হয়েছে, “অতঃপর দুইযুগের তথা কলিযুগ এবং সত্যযুগের সন্ধিক্ষণে ভগবান কল্কি অবতার রুপে বিষ্ণুযশ নামক ব্যক্তির পুত্র হিসেবে জন্ম গ্রহণ করবেন। ঐ সময় পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শাসক অধঃপতিত হয়ে লুটেরা ও ডাকাতের পর্যায়ে নেমে যাবে।
এর অর্থ হল ভগবান এই কলিযুগের শেষের দিকে কল্কি অবতার হিসেবে আবির্ভুত হবেন। তিনি অসাধু লোকদের বিনাশ করে দায়িত্ব শেষ করার পর খুব কম সংখ্যক লোক বেঁচে থাকবে, যারা সৎ এবং ধার্মিক। কল্কি অবতারের পর এই পৃথিবীতে আবার সত্যযুগ শুরু হবে। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী কলি যুগের সময়কাল হল ৪,৩২,০০০ বছর, যা পন্ডিতদের গবেষণা অনুযায়ী খৃষ্টপূর্ব ৩,১০২ সাল থেকে শুরু হয়েছে। এখন কেবল ৫,০০০ বছর চলছে।
বিবর্তনবাদের ধারা অনুসারে এ যুগ অত্যাধুনিক মানুষের যুগ। মানুষের হাতে সঞ্চিত হয়েছে মারাত্মক ধ্বংসাত্মক শক্তি যা দিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে প্রকৃতিকে। কলিযুগে পৃথিবী ধবংস হুবে বলে যে সংকেত পুরান দিয়েছে তা আসলে এই ধবংসাত্নক শক্তিশালী মানব্জাতিকেই নির্দেশ করে।