সনাতন বিশ্বাস মতে অধিকাংশ দেব দেবীকে তাদের স্বীয় মুর্তিতে পূজা করা হলেও, দেবাদিদেব মহাদেব তার একেবারেই ব্যাতিক্রম। মুর্তিতে তিনি রুদ্ররুপে অবস্থান করার কারণে ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে তাকে সকলেই ভয় পায়। আর তাই রুদ্রের শান্ত রুপকেই তথা লিঙ্গ রূপেই সকলে তার পূজা করে থাকেন। শিবের এই লিঙ্গরূপকেই বলাহয় শিবলিঙ্গ। খেয়াল করে দেখবেন, সারাদেশের সমস্ত মন্দিরের ভগবান শিবের প্রতীক হিসেবে যে শীলাখন্ডের পূজা করা হয় সেগুলোকে শিবলিঙ্গ নামে ডাকা হয়। অন্যদিকে সমগ্র ভারতবর্ষে মাত্র ১২ টি মন্দিরে শিবলিঙ্গকে জ্যোতির্লিঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু কেন? শিবলিঙ্গ আসলে কি, এবং শিবলিঙ্গ ও জ্যোতির্লিংগের মধ্যে পার্থক্যটা কি? সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজনে শিবতত্বের এই গুরুত্বপুর্ণ আলোচনা রইল আপনার জন্য।
সংস্কৃতে লিঙ্গ শব্দের অর্থ ‘চিহ্ন বা প্রতীক’। তাই শিবলিঙ্গের অর্থ হচ্ছে শিবের প্রতীক বা চিহ্ন। অনেকেই শিবলিঙ্গকে পুরুষের জনেন্দ্রিয় বলে মনে করে থাকেন, কিন্তু শিবলিঙ্গ কখনই সেরকম কিছু নয়। একটা উদাহরন দিয়ে বিষয়টা আরও পরিষ্কার করা যাক। আমরা সবাই ব্যাকরণ বইয়ে পুরুষলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গ পড়েছি। এখানে লিঙ্গ শব্দটি যদি পুরুষ প্রজনেন্দ্রিয় বোঝাত, তাহলে লিঙ্গ শব্দটির আগে পুরুষ শব্দটি বসত না। আবার লিঙ্গ শব্দটি যদি পুরুষের শিশ্ন বোঝাত, তাহলে তার আগে স্ত্রী শব্দটি বসার কথা নয়। আসলে এখানেও লিঙ্গ শব্দটি প্রতীক বা চিহ্নকেই বুঝিয়েছে। যেমন ধরুন পুরুষলিঙ্গ বলতে আমরা কোন মানুষের শরীরের সেই বিশেষ চিহ্ন বা প্রতীককে মনে করি যা দ্বারা কোন মানুষকে পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আবার একইভাবে স্ত্রীলিঙ্গ বলতে মানুষের শরীরের এমন কোন প্রতীক বা চিহ্নকে বোঝানো হয় দ্বারা সেই মানুষটিকে স্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করে যায়। সুতারাং যারা শিবলিঙ্গকে নিয়ে এতদিন বিকৃত ধারনা পোষন করেছেন বা অস্পস্টতায় ভুগছিলেন তারা নিশ্চই একটা স্পষ্ট ধারনা লাভ করতে সামর্থ্য হয়েছেন বলে আশা করা যায়।
সনাতন ধর্মের ১৮টি অতি প্রাচীন পুরাণ রয়েছে যেগুলোকে মহাপুরাণ বলা হয়ে থাকে। এবার আসুন এই মহাপুরাণগুলোর মধ্যে অন্যতম লিঙ্গপুরাণ অনুসারে শিবলিঙ্গের ধারনা আহরন করা যাক। লিঙ্গপুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ের একেবারে প্রথমেই এই শিবলিঙ্গের বর্ণনা আছে এইভাবে-
“জ্ঞানীগণ নির্গুণ ব্রহ্মকেই লিঙ্গ বলে। মহাদেব সেই নির্গুণ ব্রহ্ম, তার থেকেই অব্যক্ত আবির্ভূত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ লিঙ্গ প্রধান ও প্রকৃতি নামে প্রসিদ্ধ। রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দ বর্জিত পরমেশ্বর শিবই অলিঙ্গ তথা চিহ্নহীন। আবার তিনি নিজেই পঞ্চভূত তথা জল বা তরলের প্রতীক, বায়ু বা বায়বীয় পদার্থের প্রতীক, পৃথিবী বা কঠিন পদার্থের প্রতীক,অগ্নি বা শক্তির প্রতীক, আকাশ বা অন্তরীক্ষ ও শূন্যস্থানের প্রতীক। এছাড়াও তিনি পঞ্চতন্মাত্র অর্থাৎ, রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ এ সকল গুণ ভূষিত লিঙ্গ রূপ উৎপন্ন হয়েছেন। এবং তার থেকেই সৃষ্টির কারণ শিবস্বরূপ প্রধান দেবত্রয় তথা সৃষ্টিকর্তা-ব্রহ্মা, পালনকর্তা-বিষ্ণু ও সংহারকর্তা-শিব আবির্ভূত হয়েছেন।”
যেহেতু শিবলিঙ্গ শিবের প্রতীক বা চিহ্নস্বরূপ তাই এটি সাধারনত মনুষ্য নির্মিত হয়ে থাকে। সারা ভারতবর্ষের মন্দিরগুলোতে পুজিত শিবের প্রতীকস্বরূপ শীলাখন্ডগুলো তাই শিবলিঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
এতো গেল সাধারন শিবলিঙ্গের ব্যাপার। এবার সেই ১২ টি মন্দিরের নাম জেনে নেওয়া যাক যেখানে শিবলিঙ্গকে জ্যোতির্লিঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
প্রথমেই আছে সোমনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ : এই জ্যোতির্লিঙ্গকে ভগবান শিবের প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে বলা হয়। গুজরাট রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের বেরাবলের নিকটস্থ প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দক্ষ প্রজাপতি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে চন্দ্র প্রভাস তীর্থে শিবের আরাধনা করলে, শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এই কারণে চন্দ্র সোমনাথে শিবের একটি স্বর্ণমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্য ও কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠ দ্বারা মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
২) মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ : এটি অন্ধ্রপ্রদেশে অবস্থিত এবং একমাত্র জ্যোতির্লিঙ্গ যা ভগবান শিব এবং তাঁর স্ত্রী দেবী পার্বতী উভয়েরই প্রতীক। এটি ‘দক্ষিণ ভারতের কৈলাস’ নামেও পরিচিত।
৩) মহাকলেশ্বর : এই জ্যোতির্লিঙ্গটি অবস্থিত মধ্য প্রদেশের উজ্জয়িনী জেলায়। প্রাচীনকালে এটি অবন্তিকা নামেও পরিচিত ছিল।
৪) ওঁকারেশ্বর : এই জ্যোতির্লিঙ্গটিও মধ্য প্রদেশের খাণ্ডোয়া জেলার নর্মদা নদীর তীরে অবস্থিত। হিন্দুশাস্ত্র মতে বিন্ধ্যাচল পর্বতমালার রক্ষক শূর বিন্ধ্য নিজ পাপ স্খলনের জন্য মহাদেবকে প্রসন্ন করেন৷ তিনি পবিত্র জ্যামিতিক নকশার মাধ্যমে বালি ও পলির মিশ্রণে একটি শিবলিঙ্গ তৈরী করেন৷ ভগবান শিব তার তপস্যায় প্রসন্ন হন এবং দুটি রূপে তার সামনে প্রকাশিত হন৷ মনে করা হয় ঐ দুটি রূপই যথাক্রমে ওঙ্কারেশ্বর এবং অমরেশ্বর।
৫) কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ : এটি ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গাড়োয়াল হিমালয় পর্বতশ্রেণীতে অবস্থিত কেদারনাথ শহরে মন্দাকিনী নদীর তীরে স্থাপিত একটি শিব মন্দির। খোদ মহাভারতেও এই কেদারনাথ মন্দিরের উল্লেখ আছে। বলা হয় পাণ্ডবরা এখানে তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করেন।
৬) ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ : মহারাষ্ট্রের পুনে থেকে প্রায় ১৫ কিঃমিঃ দূরে জঙ্গল সমাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় এবং ভীমা নদীর তীরে বিরাজ করছেন বাবা ভীমশঙ্কর।
৭) কাশী বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ : এটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বারাণসীতে গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত অবস্থিত একটি শৈব মহাতীর্থ। এ মন্দিরের প্রধান দেবতা শিব “বিশ্বনাথ” বা “বিশ্বেশ্বর” নামে পূজিত হন। বারাণসী শহরের অপর নাম “কাশী” এই কারণে মন্দিরটি “কাশী বিশ্বনাথ মন্দির” নামে পরিচিত। মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। তাই মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে।
৮) ত্র্যম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ : এটি শিবের অষ্টম জ্যোতির্লিঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রের নাসিকের গোদাবরী নদীর কাছে অবস্থিত মহাপবিত্র শৈব পীঠস্থান।
৯) বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ : এই মন্দিরটি ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দেওঘর জেলার দেওঘর শহরে অবস্থিত। বৈদ্যনাথ মন্দির চত্বরে মূল বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির ছাড়াও আরো ২১টি মন্দির আছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, রাবণ এখানে শিবকে খুশি করার জন্য তপস্যা করেছিলেন। তিনি তার দশটি মাথা একটি একটি করে কেটে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিচ্ছিলেন। এতে শিব সন্তুষ্ট হয়ে আহত রাবণকে সুস্থ করে তুলতে আসেন। শিব যেহেতু এখানে বৈদ্য বা চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাই এখানে শিবকে বলা হয় বৈদ্যনাথ।
১০) নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ : নাগেশ্বর মন্দির ভারতএর গুজরাট রাজ্যে অবস্থিত হিন্দুদের এক অন্যতম ধর্মীয় পীঠস্থান। গুজরাটের জামনগরের গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দিরের শিবলিংগকে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত দ্বাদশ জ্যোতির্লিংগের অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যানে এই মন্দির ঐতিহাসিক কাল থেকে ভক্তদের জন্য আকর্ষণের স্থল হয়ে আসছে। শিব উপাসকরা নাগেশ্বর মন্দিরের জ্যোতির্লিংগ দর্শন পরম পবিত্র বলে গণ্য করে।
১১) রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ : ভারতীয় হিন্দু তীর্থগুলির মধ্যে রামেশ্বরম ধাম অন্যতম। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের শেষ প্রান্তভূমি পক প্রণালীতে একটি দ্বীপের আকারে গড়ে উঠেছে রামেশ্বরম। সীতাদেবীর বালুকা দ্বারা নির্মিত মূর্তি ও রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ স্থাপিত রয়েছে এই মন্দিরে। অন্যদিকে চারধামের একধাম হল এই রামেশ্বরম মন্দির। দক্ষিণ ভারতে এই মন্দিরকে ‘দক্ষিণের বেনারস’ বলে মান্য করা হয়।
১২) ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ : এই জ্যোতির্লিঙ্গটি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গাবাদ থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং দৌলতাবাদ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ইলোরা গুহার কাছে অবস্থিত। শিবপুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতার ৩২ ও ৩৩তম অধ্যায়ে এই জ্যোতির্লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এবার দেখা যাক, জ্যোতির্লিঙ্গ কি?
যে সমস্ত শিবলিঙ্গ স্বয়ম্ভূ-অর্থাত্ নিজেই স্বয়ং শিবলিঙ্গরূপে অধিষ্ঠিত হয়েছেন সেই সব শিবলিঙ্গকে বলা হয় জ্যোতির্লিঙ্গ। শিব পুরাণ অনুসারে, যেখানেই ভগবান শিব আলোর আকারে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর ভক্তদের দ্বারা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তিনি সেখানেই নিজেকে জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। পুর্বে বর্ণিত ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির সেই সকল মহাপবিত্র স্থান যেখানে জ্যোতি তথা আলোকরূপে স্বয়ং ভগবান শিব অধিষ্ঠান করেছিলেন। বলা হয় এই ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ ১২টি রাশিকেও চালিত করে।
শিব পুরাণ অনুসারে, একসময় মহাবিশ্বের স্রষ্টা ভগবান ব্রহ্মা এবং মহাবিশ্বের পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর বিতর্ক হয়েছিল যে তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কে। এই বিতর্ক খুব শীঘ্রই বিবাদে রূপ নিয়েছিলে যা অন্যান্য দেবতাদেরকেও চিন্তিত করেছিল। তাই ভগবান ব্রহ্মা এবং ভগবান বিষ্ণুর মধ্যে এই বাদানুবাদ বন্ধ করার জন্য, অন্যান্য দেবতারা শিবের শরনাপন্ন হন। তখন, ভগবান শিব তাদের সামনে অন্তহীন এক জ্যোতির্ময় আলোক স্তম্ভ আকারে প্রকট হন। ভগবান বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা সেই জ্যোতি বা আলোক স্তম্ভ দ্বারা বিস্মিত হন কিন্তু আলোর উৎস এবং আলোর শেষও খুঁজে পাননি। তখন উভয়েই সিদ্ধান্ত নেন যে, যিনি প্রথমে এই জ্যোতির্ময় আলোক স্তম্ভের উভয় প্রান্তে পৌঁছবেন তিনিই হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু অনেক চেস্টা করেও তারা কেউই এই আলোর আদি এবং অন্ত খুঁজে পেতে সফল হননি। এইসময় ভগবান শিব তাঁর আসল রূপে এসে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ত্রয়ী অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ কেউই একে অপরের চেয়ে বড় নন। তবে একসাথে, ত্রয়ীর সম্মিলিত শক্তি তাদেরকে সর্বোত্তম করে তোলে।সেই জ্যোতি স্তম্ভই পরবর্তীতে ‘জ্যোতির্লিঙ্গ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।