কি হয় কামাখ্যা মন্দিরে?
এদেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতার কাছে আবহমান কাল ধরেই কামরূপ কামাখ্যা মন্দির এক অনাবিল রসহ্যমন্ডিত স্থান। ভারতবর্ষের প্রতিটি কোনায় কোনায় এ মন্দিরের নাম ছড়িয়ে আছে সতীর মৃতদেহের ৫১ খন্ডের অংশ হিসেবে। এখনে পতিত দেবী সতীর মাতৃযোনী, প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের মন্দির, অম্বাবুচী মেলা, নরবলি, প্রভৃতি বিষয়গুলোর কারনে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত কামরূপ কামাখ্যা । বলাই বাহুল্য, এই মন্দিরটি আরও বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে, জাদু টোনা, অশরিরী আত্মা ও ভুত, প্রেত চালনা, কাল জাদু ও বশীকরণ, তন্ত্র সাধনা ইত্যাদির আতুরঘর হিসেবে। তাই পুরাণ, ইতিহাস ও বর্তমান সময়ের সংমিশ্রনে গঠিত আসামের এই শক্তিপীঠের আকর্ষন উপেক্ষা করতে পারেন না ভারতবর্ষের বাইরের পর্যটকরাও। পৌরাণিক এই মন্দিরকে ঘিরে যেমন অজস্র রহস্য, রোমাঞ্চ ও চমৎকারের কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়, তেমনি এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায় প্রায়শই। এখানকার রীতি রেওয়াজের অপব্যাখ্যা বা নেতিবাচক কাহিনীও নেহায়েত কম শোনা যায় না।
বলা হয় একসময় এ জায়গায় কেউ গেলে আর ফিরে আসত না। এখনো জাদুবিদ্যা সাধনার জন্য বেছে নেওয়া হয় কামাখ্যা মন্দিরকেই। কামরূপ কামাখ্যার আশপাশের অরণ্য আর নির্জন পথে নাকি ঘুরে বেড়ায় ভালো-মন্দ আত্মারা। ছোট্ট দুটি শব্দ ‘কামরূপ কামাখ্যা’। আর এই দুটি শব্দের মধ্যেই লুকানো তাবৎ রহস্য, রোমাঞ্চ আর গল্পগাথা।
সেই ছোটবেলা থেকেই কামরূপ কামাখ্যার রহস্যেভরা আখ্যানের কথা শুনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই উপমহাদেশ তো বটেই সমগ্র বিশ্বে কামরূপ কামাখ্যার আশ্চর্যে ভরা আখ্যানের রয়েছে আলাদা কদর। কামরূপ কামাখ্যাকে বলা হয় জাদুটোনা, তন্ত্র-মন্ত্রের দেশ। আসামের গুয়াহাটি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কামরূপ কামাখ্যা। এখানে রয়েছে সারি সারি পর্বতমালা। এর ঠিক পাশেই ভক্তদের আগ্রহের কেন্দ্রে মা কামাখ্যার মন্দির। মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ ভক্তদের নৃত্যগীত। তবে সবকিছু ছাপিয়ে কামাখ্যার জাদুবিদ্যা আর সাধকদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার গল্পই সবার মুখে মুখে।
সত্যি কি জাদুটোনার দেশ এই কামরূপ কামাখ্যা? নাকি যুগের পর যুগ মানুষের সরল বিশ্বাসে গল্পের পসরা সেজেছে কেবল? সত্যিই কি পৌরাণিক কোন ঘটনার সাথে সম্পর্কিত এই মন্দির? কামরূপ কামাখ্যা নিয়ে যতসব গল্পকথা শোনা যায় তার সবই কি সত্যি? চলুন দর্শক আমরাও ঘুরে আসি কামাখ্যা মায়ের দুয়ার থেকে, জেনে আসি এ মাতৃপীঠের পৌরানিক ইতিহাস, দেখে আসি মাতা কামাখ্যার আশ্চর্য ক্ষমতার নিদর্শন।
ভয়ংকর জায়গা কামরূপ কামাখ্যা ৷ ওখানে পৌঁছালে আর নাকি ফিরে আসা যায় না। বলা হয় জাদুটোনা, ও তন্ত্র-মন্ত্রের রহস্যঘেরা দেশ এটি৷ শুধু কামরূপ কামাখ্যা নয়, ওখানের আশেপাশে অরণ্যে আর নির্জন পথেও নাকি দেখা মেলে ভূত-পেত্নী আর ডাকিনী-যোগিনীর।। কামরূপ-কামাখ্যা নারী শাসিত পাহাড়ী ভূ-খন্ড। সেখানকার নারীরা ছলাকলা ও কামকলায় ভীষণ পারদর্শী। কামরূপ-কামাখ্যার ডাকিনী নারীরা পুরুষদের মন্ত্রবলে ভেড়া বানিয়ে রাখে । কামরূপ কামাখ্যা নিয়ে এরকম অনেক মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে।
ইতিহাস ঘেটে যতটুকু জানা জায় তা হল কামরূপ রাজত্ব ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং তৎসংলগ্ন এলাকার সমন্বয়ে গঠিত ছিল। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষ। বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্য এবং বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ এর অংশ ছিল এটি। যদিও এই ঐতিহাসিক রাজ্যের সময়কাল চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে ছিল কিন্তু বহুপর পর্যন্ত এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে ঐতিহাসিকগণ কামরূপ নামেই এর উল্লেখ করেছেন। বর্মণ বংশ, ম্লেচ্ছা বংশ এবং পাল বংশ রাজ্যটি দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে ।সুতরাং কামরূপ রাজ্যের অস্তিত্ব পাল রাজাদের পতনের সাথে সাথে দ্বাদশ শতাব্দীতেই শেষ হয়ে যায়।
মহাভারত এবং রামায়ণে এই অঞ্চলকে প্রাগজ্যোতিষ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। কামরূপের প্রথম মহাকাব্যিক উল্লেখ পাওয়া যায় ৪র্থ শতাব্দীর সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদের অভিলিখন হতে, যা এক ঐতিহাসিক সময়কালের সুচনাপাতের নির্দেশক। চৈনিক পর্যটক সুয়ানচাং ৭ম শতাব্দীর দিকে ভাস্করবর্মণের শাসনকালে এই রাজ্য ভ্রমণ করেন। কামরূপের রাজাদের বিশেষ করে ভাস্করবর্মণের বিভিন্ন অভিলিখন হতে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়।
কলিকা পুরাণ এবং চৈনিক পর্যচক সুয়ানচাং-এর মতে কামরূপের পশ্চিম সীমানায় ঐতিহাসিক করোতয়া নদী এবং পূর্ব সীমায় তামেশ্বরী দেবীর মন্দির এবং দক্ষিণ সীমানা ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলার মধ্যবর্তী এলাকায়। ফলে এটি সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নিয়ে গঠিত ছিল এবং সময়ে সময়ে বর্তমান সময়ের ভুটান এবং বাংলাদেশের কিছু অংশও এর অধীন ছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় এই অঞ্চলে প্রাপ্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলাদি হতে।
এই আসামেরই কামরুপ জেলার নীলকন্ঠ পাহাড়ের চূড়ায় সন্ধান মেলে এক প্রাচীন মন্দিরের । এই প্রাচীন মন্দিরটিই কামাক্ষা দেবীর মন্দির নামে পরিচিত। গুয়াহাটি স্টেশন থেকে পাহাড়ি রাস্তা কামাক্ষা মন্দিরের দিকে।পথের এক দিকে রেলিং, অন্য দিকটা পাথুরে আর কখনও ঝোপঝাড়ে ভরা।
পুরোহিতদের কথামতো মন্দিরে পুজো পর্ব সম্পাদন করা । প্রধান মন্দিরের বাইরের কুণ্ড থেকে মাথায় জলের ছিটে দিয়ে শুরু করা হয় পুজো পর্ব। সেখানে অসমিয়া ভাষায় লেখা রয়েছে, ‘যখনই মুখ খুলিবেন, মা কামাক্ষার নাম বলিবেন।’ দেশের অন্যান্য বড় মন্দিরের মতোই নগদমূল্যে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন। অনেকেই বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে পূজা সারেন। এই মন্দিরে দেবীর কাছে নানান রকম প্রার্থনা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ভক্ত ও পুর্ণার্থীর দল। মনস্কামনা পুর্ণ করার উদ্দেশ্যে মানত করেন এবং মনস্কামনা পূর্ণ হলে ঘন্টাও বেধে রেখে যান তারা। কামাখ্যা মন্দিরের চুড়ো সপ্তরথ আকৃতির। তার গড়নে পাওয়া যায় মৌচাকের আদল। সাতটি ডিম্বাকৃতি গম্বুজের প্রতিটির ওপর তিনখানা স্বর্ণকলস বসানো আছে। মন্দিরের বহিরাংশে গণেশ ও অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিকৃতি ও পুরাণ কাহিনীর নানা খণ্ডচিত্র খোদাই করা প্যানেলের সারি।
মন্দিরের ভেতরে তিনটি প্রকোষ্ঠ। সবচেয়ে বড় পশ্চিম প্রকোষ্ঠটি আয়তাকার। এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
মাঝের কক্ষটি বর্গাকার। এখানে দেবী কামাখ্যার ছোট মূর্তি রয়েছে। দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা শিলালিপি, মহারাজ নরনারায়ণ এবং অন্য হিন্দু দেবতার মূর্তি দেখা যায়। এই প্রকোষ্ঠর পরেই গুহা সংবলিত গর্ভগৃহ শুরু হয়েছে। গুহার দেওয়ালে কোনও ছবি বা খোদাইয়ের কাজ নেই। সরু সিঁড়ির ধাপের শেষে যোনি আকৃতির পাথরের ফাটল থেকে ঝরে পড়ছে প্রাকৃতিক ঝরণাধারা। জলের ধারা সৃিষ্ট করেছে একরত্তি জলাশয় যার ধারে অবিরাম পূজার্চনা চলে। ধারার উৎসমুখ ঢাকা এক টুকরো লাল কাপড়ে।
এই কামাক্ষা মন্দিরটিকে নিয়ে রয়েছে এক পৌরানিক কাহিনী। মূলত পৌরাণিক এই কাহিনীটি জানলেই জানা যাবে জায়গাটির নাম কমরূপ হলো কেন? কেনইবা দেবীর নামহলো কামাক্ষা? আর পাহাড়টার নামইবা নীলকণ্ঠ বা নীলাচল কেন?
সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রজাপতি দক্ষের কন্যা দেবী সতী তার পিতার অমতেই বিবাহ করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। কিন্তু, জটাজুটধারী, শ্মশানচারী ও আত্মভোলা এই প্রলয়ের দেবতাকে নিজের জামাতা হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি দক্ষ। তাই শিবকে অপমান করার উদ্দেশ্যে রাজা দক্ষ এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন যেখানে শিব ও সতী ব্যাতিরেক ত্রিভুবনের সকলেই নিমন্ত্রিত ছিলেন। পিতার এরূপ যজ্ঞের সংবাদ পেয়ে দেবি সতীও স্বামীর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হাজির হলেন পিতার যজ্ঞভূমিতে। ঠিক এমনটাই যেন চেয়েছিলেন রাজা দক্ষ। তিনিও সতীর উপস্থিতিতে ও সমস্ত নিমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে তুমুলভাবে দেবাদিদেব মহাদেবের নিন্দা করতে লাগলেন। দেবী সতী নিজ পিতা কর্তৃক নিজের স্বামীর এরূপ নিন্দা ও অপমান সহ্য করতে না পেরে সেই যজ্ঞের অগ্নিতেই আত্মহূতি দিলেন । এদিকে সতীর আত্মহননের সংবাদে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেলেন শিব। তিনি দক্ষযজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যজ্ঞের বিনাশ সাধন করলেন এবং দেবী সতীর দেহ কাঁধে বহন করে উদ্দাম নৃত্য করে চললেন। তার সেই প্রলয়নৃত্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল চারিদিক থেকে। সমগ্র সৃষ্টি যখন এভাবে ধ্বংস হওয়ার যোগাড়, তখন দর্পহারি নারায়ন তার সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবী সতীর দেহকে ৫১টি খন্ডে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। মাতৃশরীরের এই ৫১টি খন্ড পতিত হয় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এবং পরিচিতি পায় ৫১ সতিপীঠ বা শক্তিপীঠ নামে। তবে মতান্তরে সতীপীঠের সংখ্যা ১০৮ টি এবং এ ছাড়াও আরও ২৬টি উপপীঠ রয়েছে
কামরূপে মায়ের মাতৃ যোনি পতিত হয়েছিল বিধায় এই স্থানটি ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম প্রধান এবং গুরুত্বপুর্ণ শক্তিপীঠ। যে স্থানে দেবীর যোনি পতিত হয়েছিল সেই স্থান হচ্ছে তীর্থচূড়ামণি। তীর্থচূড়ামনির অর্থ হলো সব তীর্থের মধ্যে সেরা তীর্থ স্থান। যেখানে সতীর যোনি মন্ডল পতিত হয়েছিল সেই জায়গাটাকে বলে কুব্জিকাপীঠ। কথিত আছে যোনিরূপ যে প্রস্তরখণ্ডে মা কামাক্ষা অবস্থান করছেন, সেই শিলা স্পর্শ করলে মানুষ মুক্তিলাভ করে। কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে মহামায়া সতীর যোনি অঙ্গ পতিত হওয়ার পর এই উচ্চ পর্বত মহামায়ার যোনি মন্ডলের ভার সহ্য করতে না পেরে কেঁপে উঠলো এবং ক্রমশঃ পাতালে প্রবেশ করতে লাগলো। তখন দেবতাদের অনুকম্পায় এই পর্বত পাতালে প্রবেশ থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু মতৃ যোনি পতিত হওয়ার ফলে পর্বতের রং নীল বর্ণ ধারণ করেছিল তাই পর্বতের নাম হলো নীলকণ্ঠ বা নীলচল পর্বত।
এদিকে, স্ত্রী বিরহে মহাবৈরাগ্যের উদয় হলো মহাযোগী মহাদেবের মনে। ফলশ্রুতিতে তিনি হিমালয়ের দুর্গম স্থানে গিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। সেই মহাযোগীর ধ্যান ভঙ্গ করে কার সাধ্য।
অন্যদিকে দক্ষযজ্ঞে সতীদেবী প্রাণত্যাগ করার পর গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে মেনকার গর্ভে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করলেন। ফুটফুটে শিশু কন্যাটির নামকরন হল গিরিজা, পার্বতী প্রভৃতি নামে। এভাবেই আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলেন গিরিরাজ কন্যা পার্বতী। এর কিছুকাল পর তারকসুর নামের এক অসুররাজের কঠোর তপস্যায় সুপ্রসন্ন হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা তাকে এক বিপদজনক বর দিয়ে বসেন। বরটি ছিল এমন শিবের ঔরাসজাত সন্তান ভিন্ন কেউই তারকাসুরকে বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মার বরে বলীয়ান তারকাসুর তখন তার স্বরূপে আবির্ভুত হয়ে শুরু করলেন ত্রিলোক নিধন। এমনকি স্বর্গরাজ্য জয় করে দেবতাদেরও বিতাড়িত করলেন তিনি। চিন্তায় পড়লেন দেবতারা। তারকাসুরকে শুধুমাত্র শিবের পুত্রই বধ করতে পারবেন, কিন্তু পুত্র তো দূরে থাক, মহাদেব নিজেই সংসার বৈরাগী হয়ে মহা তপস্যায় বসেছেন। তার তপস্যা ভাঙানোর দুঃসাহসও কারো নেই।
তাই দেবী পার্বতীকে পাঠানো হল মহাদেবের পূজা আর সেবা করার জন্য। পার্বতীও মহা আনন্দে সখীদের নিয়ে প্রত্যহ শিবের পূজা শুরু করলেন। সতীর মুখের ছায়া পার্বতীর মুখ মন্ডলে।একবার শিবের ধ্যানভঙ্গ হলে তিনি যদি পার্বতীকে দেখেন তাহলে পার্বতীকে পাওয়ার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠবেন। কিন্তু কোনভাবেই শিবের ধ্যান ভাঙানো গেল না। বাধ্য হয়ে দেবতারা শিবের ধ্যান ভঙ্গ করার অন্য উপায় খুঁজে বের করলেন। এবার ডাক পরলো কাম দেবের। বুঝিয়ে দেওয়া হলো তার কাজ। যথা সময়ে কামদেব স্ত্রী রতিকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন হিমালয়ের শিখরে। এরপর ফুল শর নিক্ষেপ করে ধ্যানভঙ্গ করলেন মহাদেবের । কিন্তু ধ্যানভঙ্গ হওয়ার পরই মহাদেবের রোষানলে পরলেন মদন কামদেব। তার তৃতীয় নয়নের অগ্নিবর্ষণে ভষ্মে পরিণত হলেন কামদেব । মূর্ছা গেলেন কামদেবের স্ত্রী রতি। দেবতারা পরলেন মহা বিপদে। এক বিপদ যায়, আর এক বিপদ এসে উপস্থিত হয়। কামদেব ভষ্মীভূত হওয়ার পর শিবের উগ্রভাব কিছুটা স্তিমিত হলো। এরপর পার্বতীর দিকে চোখ পড়তেই তিনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন। খুব চেনা চেনা মুখ। তারপরেই আবার গম্ভীর হয়ে নিজের যোগাসন থেকে উঠে সেই স্থান পরিত্যাগ করলেন।পার্বতীও ছাড়বার পাত্র নয়। শিবকে পাওয়ার জন্য তিনিও তপস্যায় ব্রতী হলেন। শেষমেশ, দেবী পার্বতী ও শিবের বিবাহ সুসম্পন্ন হল এবং তাদের সন্তান দেবসেনাপতি কার্ত্তিকের হাতে নিহত হন তারকাসুর।
যাইহোক নিজ স্বামীকে হারিয়ে রতি শিবের কাছে কাকুতি মিনতি করতে শুরু করলেন। তার প্রার্থনা তার স্বামী কামদেবকে পুনঃ জীবিত করা হোক। কৃপা করলেন দেবাদিদেব, প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন কামদেবের। রতিও ফিরে পেলেন তার স্বামীকে। কিন্তু পুনঃজন্মপ্রাপ্ত কামদেবের রূপের একি বিপর্যয়! কোথায় গেল কামদেবের সেই কাম রূপ স্বরূপ-কান্তি? উত্তর দিলেন স্বয়ং মহাদেব, বললেন, ভারতবর্ষের ঈশানকোনে এক পর্বত রয়েছে। সেখানে সতীদেহের একান্নটা খন্ডের এখনো একটা খন্ড অনাবিষ্কৃত রয়েছে। সেটি মহামায়ার মহামুদ্রা। সেখানে গিয়ে দেবীর মহিমা প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা করলে তুমি তোমার আগের রূপ আবার ফিরে পাবে। কামদেব নীলাচলে এসে মহামায়ার সেই মহামুদ্রা প্রস্তরখন্ড রূপে খুঁজে পেলেন এবং ভক্তি সহকারে পূজা পাঠ করলেন। মহামায়া কামদেব এবং রতির প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে তার আগের রূপ প্রদান করলেন। এই যে কামদেব এখানে এসে তাঁর আগের রূপ ফিরে পেলেন তাই জায়গার নাম হলো কামরূপ। তাঁর স্বীয় রূপ ফিরে পাবার পর বিশ্বকর্মার শরনাপন্ন হলেন কামদেব। তারপর তার ইচ্ছায় দেব বিশ্বকর্মা মহামায়ার জন্য নির্মান করেছিলেন এই মন্দির। এছাড়াও মন্দিরের গায়ে চৌষট্টি যোগিনী, আর আঠারোটা ভৈরব-মূর্তি খোদাই করলেন বিশ্বকর্মা। পরবর্তীতে কামদেবের নিজ রূপ ফিরে পাওয়ার কারনে এই স্থানের নাম হয় কামরূপ আর শিব পত্নী সতীর আরেক নাম কামাখ্যা। দুজনের নাম মিলে তখন হয়ে যায় কামরূপ কামাখ্যা।কথিত আছে যে সকল সাধক এই মন্দিরে স্থাপিত কামাখ্যা দেবীর সাধন ও ভজন করেন তাঁরা জগতের তিনটি ঋন তথা পিত্রঋন, ঋষিঋন এবং দেবীঋন থেকে মুক্তি লাভ করেন।
ইতিহাস বলছে, অতীতে কামরূপে বহু হিন্দু রাজা রাজত্ব করেছেন। কিন্তু তাদের ধারাবাহিক ইতিহাস বিলুপ্ত। অনেক ধর্মবিপ্লব এবং যুগবিপ্লবের সাক্ষী কামদেব প্রতিষ্ঠিত মন্দির কামরূপ কামাখ্যা। কালের অতলে একদিন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল এই মন্দির। ঘন জঙ্গলে ভরে গেল নীলাচল পর্বতের মহাপবিত্র ওই স্থান । শক্তিময়ী মাতা কামাখ্যার কথা ভুলেই গেল সকলে। এরপর ১১৫০ সালে পালবংশের রাজা ধর্মপাল আবার কামাক্ষা দেবীকে নীলাচল পর্বতে খুঁজে বার করেন এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মপালই মায়ের যথাবিধি পূজার্চনার জন্য কান্যকুব্জ থেকে অনেক সদব্রাহ্মণকে কামরূপে নিয়ে আসেন। এরা বাসত্তরীয় ব্রাহ্মণ নামে খ্যাত। এঁরাই কামাক্ষা দেবীর মন্দিরের আদি পূজারী। পালবংশের শাসনের পর মন্দিরের আবার অবলুপ্তি ঘটে। মা কামাক্ষা হারিয়ে যান নীলাচলের গহীণ অরণ্যে।
পরে ১৪৯০ সালে রাজা বিশ্বসিংহ এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন। তবে তার পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে তথা ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। পরে অহোম রাজ্যের রাজারা এই মন্দিরটিকে আরও বড়ো করে তোলেন।
পৌরাণিক এই মন্দিরটি ৫১টি সতীপীঠের অন্যতম প্রধান পীঠস্থান। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও বিদ্যমান। দশমহাবিদ্যা তথা ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী এবং কমলা এই দশ দেবীর মন্দির রয়েছে কামাখ্যা মন্দির চত্বরেই। তার মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী এবং কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন এবং দশমহাবিদ্যার অন্যান্য দেবীদের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক মন্দির। সাধারন ভক্ত, পুর্ণার্থী ও পর্যটকদের ছাড়াও তন্ত্রসাধকদের কাছেও এই মন্দির একটি মহা পবিত্র তীর্থ।
অনূমিত হয় মূল কামাখ্যার মন্দিরটি নাগারা স্থাপত্যশৈলীর মন্দির ছিল। বর্তমান কামাখ্যা মন্দিরে গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ সম্বলিত চারটি কক্ষ রয়েছে যেগুলোর স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন এবং নাটমন্দির। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অন্যগুলির স্থাপত্যগুলি তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। সেগুলিতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে। অসমের বিশেষ করে গুয়াহাটির বহু মন্দিরে এই ধরনের চূড়া দেখা যায়।
কামাখ্যা মন্দীর একটি বিশেষ কারনে জগত খ্যাত।আর এই বিশেষ কারনটি হল এখানে প্রতি বছর বর্ষাকালে আম্বুবাচী মেলার আয়োজন করা হয় এখানে। বর্ষাকালে কামাখ্যা মন্দিরের মুল বেদী হতে নিরন্তর জলের প্রবাহ বইতে থাকে। তিন দিনের জন্য এই জল ধারা লাল বর্ণ ধারন করেন। কথিত আছে এই লাল বর্ণ কামাখ্যা মায়ের ঋতুশ্রাব। এই তিন দিনের জন্য মন্দীরের মূল ফটক বন্ধ থাকে। তখন সকলের জন্যই মন্দিরে ঢোকা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। একবার এক পুরোহিত নিয়ম অমান্য করে মন্দিরে ঢুকলে সাথে সাথে তাঁর দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ঋতুশ্রাব অবস্থায় মাতা কামাখ্যা কারো সাথে দেখা করেন না।তবে মূল ফটকের বাইরে আম্বুবাচী মেলার উৎসব ও অন্যান্য পূজা আর্চনা চলতে থাকে।
তবে পুরাণ, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদিকে ছাড়িয়ে এখানকার যে বিষয়টি মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে তা হল, কালো জাদু, ভুত-প্রেত ও অশরিরী আত্মা, বশীকরণ ইত্যাদি। বলা হয় এখানকার সাধকরা এ সমস্ত কাজে সিদ্ধহস্ত। তবে তাদের এসকল অতিপ্রাকৃত শক্তিতে আপনার বিশ্বাস থাক বা না থাক, সুযোগ পেলে এ মহাপবিত্র পীঠস্থান অন্তত একবার দর্শন করার অনুরোধ রইল।