You are currently viewing বর্ণাশ্রম থেকে অভিশপ্ত জাতিভেদ- কতটা ঠিক কতটা ভুল? চার বর্ণের কে বড় কে ছোট?

বর্ণাশ্রম থেকে অভিশপ্ত জাতিভেদ- কতটা ঠিক কতটা ভুল? চার বর্ণের কে বড় কে ছোট?

সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় অমানবিক ও আত্মঘাতী সংস্কৃতি কি?  আপনি নিশ্চই একমত হবেন যে ভারতবর্ষের বুকে সবচেয়ে যন্ত্রনাদায়ক যে শুল বিদ্ধ হয়ে আছে তা হল জাতিভেদ।  স্মরণাতীত কাল থেকে কে ব্রাহ্মন, কে ক্ষত্রিয়, কে বৈশ্য এবং কে শুদ্র এ নিয়ে চলছে ঘৃনা, বঞ্চনা ও অত্যাচারের সংস্কৃতি। আজকের হিন্দু সমাজ তা থেকে কিছুটা পরিত্রান পেলেও ভারতের বহু জায়গায় এই প্রথা সগৌরবে ধ্বংস করে চলেছে পবিত্র এই ভুমির পবিত্রতা ও  অখন্ডতা। সনাতন সমাজে বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথা কারণে হিন্দুদেরকে ধ্বংসের শেষ সীমান্তের এনে দাঁড় করিয়েছে। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কঠিন পর্বতের মত, আর ছড়িয়েছে মহামারীর মত। এ মহামারী শুধু ঘৃনা ও বঞ্চনা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি, এর ফল গড়িয়েছে ধর্মান্তর পর্যন্ত যা আমাদের জন্য এক মহা দুর্যোগের অশনিসংকেতও বটে।  কিন্তু আসলেই কি সনাতন ধর্মগ্রহ্নথগুলোতে জন্মের ভিত্তিতে জাতিভেদ করা হয়েছে? তাছাড়া বর্তমানে প্রচলিত জাতিগুলোর মধ্যে কি কোন প্রকার বঞ্চনা বা ঘৃনা ছড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে? জানতে চাই আমরাও, ব্রাহ্মনের ঘরে জন্ম নিলেই কি ব্রাহ্মন? নাকি শুদ্রের ঘরে জন্ম নিলেই সে শুদ্র? তাছাড়া শাস্ত্রে কি ব্রাহ্মণকে সবচেয়ে বড় এবং শুদ্রকে সবচেয়ে ছোট বলা হয়েছে?  আসুন আমরাও সত্য উন্মোচন করি, সত্যকে জানতে চেষ্টা করি আর দুর করি আমাদের সবচেয়ে বর্বর ও অভিশপ্ত সংস্কৃতিকে। আশা করব আমাদের সমাজের বৃহত্তর সংস্কারের স্বার্থে সম্পুর্ন ভিডিওটি মনোযোগ সহকারে দেখবেন।

হিন্দু ধর্মের জাতিপ্রথা, জাতিভেদ বা বর্নাশ্রম পদ্ধতির নিগুঢ় তত্ব জানতে হলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে চারটি জাতি, তাদের কর্ম এবং বেদ, গীতা ও মনুসংহিতার আলোকে তাদের বৈশিষ্ট্য সমুহ।

প্রথমেই আসি ব্রাহ্মণ কে সেই প্রসঙ্গে

ঋগ্বেদের ৭ম মন্ডলের ১০৩ নং সুক্তের ৮নং শ্লোকে বলা হচ্ছে , যে ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, অহিংস, সৎ, নিষ্ঠাবান, সুশৃঙ্খল, বেদ প্রচারকারী, বেদ জ্ঞানী সেই ব্রাক্ষ্মণ।

মনুসংহিতার ১ম অধ্যায়ের ৮৮নং পঙক্তিতে বলা হচ্ছে “ব্রাক্ষ্মনরা নিজ স্বার্থত্যগ করে কাজ করবে, বেদ পড়বে এবং তা অপরকে শেখাবে”

শ্রী শ্রী গীতার ১৮তম অধ্যায়ের ৪২ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, ১) মন নিগ্রহ করা, ২) ইন্দ্রিয়কে বশে রাখা, ৩) ধর্মপালনের জন্য কষ্ট স্বীকার করা, ৪) বাহ্যান্তর শুচি রাখা, ৫) অপরের অপরাধ ক্ষমা করা, ৬) কায়-মনো-বাক্যে সরল থাকা, ৭) বেদ-শাস্ত্রাদিতে জ্ঞান সম্পাদন করা, ৮) যজ্ঞবিধি অনুভব করা, ৯) পরমাত্মা, বেদ ইত্যাদিতে বিশ্বাস রাখা— এই সবই হল ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম বা লক্ষণ।।

 

তাহলে ক্ষত্রিয় কে—

ঋগ্বেদের, ১০ম মন্ডলের ৬৬ নং সুক্তের ৮নং শ্লোকে বলা হচ্ছে,

যে দৃঢ়ভাবে আচার পালনকারী, সৎ কর্ম দ্বারা শুদ্ধ, রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন, অহিংস, ঈশ্বর সাধক, সত্যের ধারক, ন্যায়পরায়ণ ,বিদ্বেষমুক্ত ধর্মযোদ্ধা,অসৎ এর বিনাশকারী সে ক্ষত্রিয়।

মনুসংহিতার ১ম অধ্যায়ের ৮৯নং পঙক্তিতে বলা হচ্ছে “ক্ষত্রিয়রা বেদ পড়বে, লোকরক্ষা ও রাজ্য পরিচালনায় নিযুক্ত থাকবে।“

শ্রী শ্রী গীতার ১৮তম অধ্যায়ের ৪৩ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, ১) শৌর্য, ২) তেজ বা বীর্য, ৩) ধৈর্য, ৪) প্রজা প্রতিপালনের দক্ষতা, ৫) যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ না করা, ৬) মুক্ত হস্তে দান করা, ৭) শাসন করার ক্ষমতা—এগুলি হল ক্ষত্রিয়ের স্বাভাবিক কর্ম।।

 

আসুন দেখা যাক বৈশ্য কে—

অথর্ববেদের ৩য় মন্ডলের ১৫ নং সুক্তের ১নং শ্লোকে বলা হচ্ছে , যে দক্ষ ব্যবসায়ী, দানশীল, চাকুরীরত এবং চাকুরী প্রদানকারী সেই বৈশ্য।

মনুসংহিতার ১ম অধ্যায়ের ৯০ নং পঙক্তিতে বলা হচ্ছে “বৈশ্যরা বেদ পড়বে, ব্যবসা ও কৃষিকর্মে নিজেদের নিযুক্ত থাকবে।”

শ্রী শ্রী গীতার ১৮তম অধ্যায়ের ৪৪ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, ১) চাষ করা, ২) গো-রক্ষা করা, ৩) ব্যবসা-বাণিজ্য ও সত্য ব্যবহার করা—এগুলি হল বৈশ্যদের স্বাভাবিক কর্ম।

 

সবশেষে আসুন শূদ্র কে তা দেখা যাক—

ঋগ্বেদের, ১০ম মন্ডলের ৯৪ নং সুক্তের ১১নং শ্লোকে বলা হচ্ছে,

আরও পড়ুনঃ  হিংলাজ মন্দিরঃ দেবী সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পতিত হয়েছিল যেখানে।

যে অদম্য,পরিশ্রমী, অক্লান্ত, জরা যাকে সহজে গ্রাস করতে পারেনা, লোভমুক্ত এবং কষ্টসহিষ্ণু সেই শূদ্র।

মনুসংহিতার ১ম অধ্যায়ের ৯১ নং পঙক্তিতে বলা হচ্ছে “শুদ্ররা বেদ পড়বে, এবং সেবা মুলক কর্মকান্ডে নিযুক্ত থাকবে।”

শ্রী শ্রী গীতার ১৮তম অধ্যায়ের ৪৪ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে বৈশ্যদের স্বভাবজাত কর্ম এবং সর্ব চার বর্ণের সেবা করাই হল শূদ্রদের স্বাভাবিক কর্ম।

 

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র – এই চার শ্রেণীর বর্ণ এই সমাজ ব্যবস্থাকে তারা নাম দিল ‘বর্ণাশ্রম ধর্ম’।তো প্রথমেই নামের বিষয়টা খেয়াল করা যাক। বর্নাশ্রম শব্দটি এসেছে বর্ণ ও আশ্রম শদগুলো থেকে। এখানে বর্ণে শব্দের অর্থ পছন্দ করা বা নির্বাচন করা এবং আশ্রম শব্দের অর্থ পেশা নির্ধারন। মুলত বর্নাশ্রম শব্দের অর্থ নিজের পছন্দ অনুযায়ী পেশা বা জীবিকার উপায় বেছে নেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে এখন একে জন্মসূত্রে বিবেচনা করা হয়। যেমন নামের পাশে ভট্ট্যাচার্য বা চট্ট্যোপাধ্যায় থাকলেই ব্রাক্ষ্মন অথবা দাস বা রায় থাকলেই শূদ্র এরকম হাস্যকর কিছু ধারনা প্রচলিত। চলুন দেখা যাক পবিত্র বেদে অলঙ্ঘনীয় এই ব্যাপারে কি বলে।

 

বর্ণ মানে নির্বাচন করা বা পছন্দ করা, আশ্রম মানে জীবিকা। বর্ণাশ্রম প্রথা মানুষকে তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা অনুসারে জীবিকা বেছে নেওয়ার অধিকার দিয়েছে। কেউ এক শ্রেনির ঘরে জন্ম হয়ে অন্য শ্রেনির জীবিকা বেছে নিতে পারে। জীবিকা যদি জন্ম দ্বারাই নির্ধারিত হত তবে বর্ণাশ্রম বা জীবিকা নির্বাচন কথাটা আসতোই কেন? হিন্দুরা দুটো ব্যাপার নিয়ে খুব গর্ববোধ করতেন। এক চতুরাশ্রম, দুই বর্ণাশ্রম। বর্ণশ্রম যদি অমানবিক প্রথাই হবে তবে তা নিয়ে এত গর্ববোধ করে বলার প্রশ্ন উঠত কি? পুত্র পিতার জীবিকা গ্রহণ করা সেকালের প্রেক্ষিতে খুব অবাক করার ব্যাপার বলে মনে মনে হয় না। বরং বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে মানুষ স্বভাব অনুসারে যোগ্যতার মর্যাদা দেওয়ার প্রচেষ্টা আসলে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে হিন্দুদের মানবিক পদক্ষেপ। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতকারীরা এটাকে নিয়ে কি করেছে ভাবুন।

 

শ্রমের বিভাজনে কোনো এক বর্ণের অধিকার হতে পারে না যদি ঋষি ভার্গবের পুত্র পরশুরাম পরশু উঠাতে পারেন আর ২১টি বার ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করতে পারেন, তবে চন্দ্রগুপ্তও রাজদণ্ড ধারণ করতে পারে। যদি রাজা বিশ্বমিত্র ব্রাহ্মণ হতে পারেন তবে চন্দ্রগুপ্তও ক্ষত্রিয় হতে পারেন। যদি রোমহর্ষণ সূত ব্যাস পদ পেতে পারেন, তবে কর্ণেরও শস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার অধিকার পাওয়া চাই। আচার্য আমার দৃষ্টিতে সব ব্যাক্তি অসীম সম্ভাবনার স্বামী। আর সেই সম্ভাবনার দ্বার খোলাই বর্ণব্যাবস্থার উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।

 

 

 

 

 

 

শ্রীমদ্ভগবতগীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১৩তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বাণীতে বলেছেনঃ—

চাতুর্ব্বর্ণ্যন ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।

তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধকর্তারমব্যয়ম্।।

অর্থাৎ, প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।

এই শ্লোকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র___এই বর্ণচতুষ্টয় গুণ এবং কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করেছি। জীবেদের গুণ এবং কর্ম অনুসারে আমি তাদের চার বর্ণের সৃষ্টি করি। কিন্তু এই সৃষ্টি-রচনা প্রভৃতির কর্মগুলি কর্তৃত্ব ও ফলেচ্ছা পরিত্যাগ করেই করি।।

 

শ্রীমদ্ভগবতগীতার ১৮ অধ্যায়ের ৪১তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বাণীতে বলেছেনঃ—

ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশং শূদ্রাণাঞ্চ পরন্তপ।

কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণেঃ।।

অর্থাৎ হে পরন্তপ! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য তথা শূদ্রদের কর্ম স্বভাবজাত গুণ–অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে।

এর বিশ্লেষণ হল— হে পরন্তপ! এই জগতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি বর্ণের বিভাগ মানুষের স্বভাবজাত গুণাদি অনুসারে করা হয়েছে। সুতরাং নিজ নিজ বর্ণনুসারে নিয়ত কর্ম বা স্বধর্ম অনুষ্ঠিত করাই হল এই গুণাদি থেকে মুক্ত হবার উপায়।।

এখানে গুণ বলতে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ৩টি গুণের কথা বলা হয়েছে। সত্ত্বপ্রধাণ গুণে ব্রাহ্মণ, সত্ত্বরজঃ প্রধান গুণে ক্ষত্রিয়, রজতমঃ প্রধান গুণে বৈশ্য এবং তমঃ প্রধান গুণে শুদ্র। অর্থাৎ ব্রাহ্মণের ছেলে হলেই ব্রাহ্মণ হবে এমন নয়। সত্ত্বগুণপ্রধান স্বভাব হলে শুদ্রের ছেলে হলেও ব্রাহ্মণ হবে এবং ব্রাহ্মণের ছেলের তমঃ গুণ প্রধাণ স্বভাব হলে সে শুদ্র হবে, এটাই ভগবদ্বাক্য হতে সহজ উপলব্ধি। এখানেই একটি বিষয়ে স্পষ্ট যে জাতি আছে কিন্তু জন্মের কারণে নয়, জন্সের পরে কৃত কর্মের উপর ভিত্তি করে।

আরও পড়ুনঃ  গুরু কে? গুরুজনদের চরন স্পর্শ করে প্রনাম করা হয় কেন?

 

প্রসঙ্গত ব্রাহ্মণ শব্দটা নিয়ে অনেক ভ্রান্তিতে রয়েছে এনং ব্রাহ্মণ শব্দের সত্য অর্থ কে না বোঝার কারণে বর্ণ বা জাতিবাদের আধিক্য ঘটেছে প্রতিনিয়ত।

ব্রাহ্মণ পবিত্র বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র অনুযায়ী ব্যক্তির গুণ ও তার কর্ম অনুযায়ী এই ব্রাহ্মণ তৈরি হয়। ব্রাহ্মণ হলো সেই সকল ব্যক্তি যারা জ্ঞানী পন্ডিত ও বেদ উপনিষদ অনুযায়ী সকলকে জ্ঞান দান করেন।

মনুসংহিতার ২য় মন্ডলের ২৮ নং সুক্তে বলা হচ্ছে,

পড়া -পড়ানোর দ্বারা, চিন্তন মনন করার দ্বারা, ব্রহ্মচর্য, অনুশাসন, সত্যভাষন আদি ব্রত পালন করার দ্বারা, পরোপকার,  আদি সৎকর্ম করার দ্বারা, বেদ, বিজ্ঞান আদি পড়ার দ্বারা, কর্ত্যবের পালন দ্বারা, দান করার দ্বারা এবং আদর্শের প্রতি সমর্পিত থাকার দ্বারা মানুষের এই শরীর ব্রাহ্মণের শরীরের পরিণত হয়।অর্থাৎ বর্ণের অর্থ চয়ন বা নির্ধারন এবং সামান্যতঃ শব্দ বরণেও এই অর্থ ব্যবহৃত হয়। ব্যক্তি নিজ রূচি, যোগ্যতা এবং কর্মরন অনুসারে ইহাকে স্বয়ং বরণ করে, এই জন্য ইহার নাম বর্ণ।  যেমন, কোনো ব্যক্তির যোগ্যতার নির্ধারণ শিক্ষা প্রাপ্তির পশ্চাতেই হয়। জন্মের আধারের উপর হয় না। কোনো ব্যক্তির গুণ, কর্ম এবং স্বভাবের আধারের উপরই তার বর্ণের নির্ধারণ হয়। যেমনভাবে এখনকার সময়ে ডিগ্রী প্রদান করা হয়, যজ্ঞোপবীত দেয়া হতো বৈদিক নিয়ম অনুসারে। তাছাড়া, আচরণবিধির সাথে অসম্মতি ঘটলে যজ্ঞোপবীত নিয়ে নেয়া হতো বর্ণগুলোর। ডাক্তারের ছেলে যেমন ডাক্তার হবেই এমন কোন কথা নেই। ডাক্তার এর ঘরে জন্ম নিলেই এম.বি.বি.এস এর সার্টিফিকেট যেমন পাওয়া যায়না ঠিক তেমন কোন নির্দিষ্ট বর্নের ঘরে জন্ম নিলেই সেই বর্ণ অর্জন করা যায় না। বৈদিক বর্নাশ্রম ও একই। বৈদিক ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে এই ধরনের।

 

ঋকবেদের ১ম মন্ডলের ১১৩ নং সুক্তের ৬ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে,

“একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে অর্থাৎ ব্রাক্ষ্মন, অপরজন বীরত্বের গৌরবে অর্থাৎ ক্ষত্রিয়, একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, অর্থাৎ পেশাভিত্তিক বৈশ্য, আরেকজন সেবার পরিশ্রমে তথা শূদ্র। সকলেই তার ইচ্ছামাফিক পেশায়, সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত।

ঋকবেদের ৯ম মন্ডলের ১১২ নং সুক্তের ১ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে,

একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাক্ষ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য কেউবা শূদ্র।

সনাতন ধর্মের তথা হিন্দুদের আইনশাস্ত্র মনুসংহিতাতে বলা হচ্ছে—

 

“চারযুগে তথা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, ও কলিতে দায়িত্বের

রকমভেদ রয়েছে কারন প্রতি যুগে মানুষের আয়ু

হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু মহাবিশ্বের ভারসাম্য রক্ষার্থে সবসময়ই চার ধরনের পেশা ভাগ করা হয়েছে।

 

আপনি হয়ত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন, কেউ কি তাঁর কর্ম অনুযায়ী তাঁর পিতার বর্ণ বা প্রথার বাইরে যেতে প্রেছেন? এর উত্তর কয়েকটি উদাহরনের মাধ্যমে দেওয়া যাক।

(১) সত্যকাম জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র যিনি পরে একজন ব্রাহ্মণ হন।

(২) প্রীষধ ছিলেন রাজা দক্ষের পুত্র যিনি পরে শূদ্র হন।পরবর্তীতে তিনি তপস্যা দ্বারা মোক্ষলাভ করেন।যদি তপস্যা শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হতো তাহলে প্রীষধ কিভাবে তা করল?

(৩) ধৃষ্ট ছিলেন নবগ নামক বৈশ্যের পুত্র কিন্তু পরে তিনি ব্রাহ্মণ হন এবং তার পুত্র হন ক্ষত্রিয়। আবার নবগ,ছিলেন রাজা নেদিস্থের পুত্র যিনি পরবর্তিতে পরিণত হন বৈশ্যে। তার অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। এছাড়াও তার পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণও হন।

(৬) ভাগবত অনুসারে অগ্নিবেশ্য ব্রাহ্মণ হন যদিও তিনি জন্মনেন এক রাজার ঘরে।

আরও পড়ুনঃ  সরস্বতী পূজায় শিশুদের হাতেখড়ি দেওয়া হয় কেন? Hate Khari Facts in Saraswati Puja ||

(৭) রাথোটর জন্ম নেন ক্ষত্রিয় পরিবারে এবং পরে ব্রাহ্মণ হন।

(৮) হরিৎ ব্রাহ্মণ হন ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও।

(৯) শৌনক ব্রাহ্মণ হন যদিও ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম হয়। এমন কি বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী শৌনক ঋষির পুত্রেরা সকল বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্রীতসমদ, বিতব্য ও বৃৎসমতির মধ্যে।

(১০) মাতঙ্গ ছিলেন চন্ডালের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন।

(১১) রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যেরঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।

(১২) প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন।

(১৩) ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন।

(১৪) বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।

(১৫) বিদুর ছিলেন এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী হন।

(১৬) কর্ণ ছিলেন সূর্য নারায়নের পুত্র তা স্বত্বেও তিনি তাঁর কর্মের দ্বারা শূদ্র হন। আবার তিনি যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছিলেন তখন তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয়।

(১৭) ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন দাস বা অপরাধীর পুত্র কিন্তু তিনি পরিণত হন শীর্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজন এবং লেখেন ঐতরেয়া ব্রাহ্মণ এবং ঐতরেয়াপোনিষদ। ঐতরেয়া ব্রাহ্মণকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয় ঋগবেদ বোঝার জন্য।

 

(১৮) ঋষি ঐলুশ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগবেদের উপর গবেষণা করেন এবং কিছু বিষয় আবিষ্কার করেন। তিনি শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না এমনকি আচার্য্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন।

 

“শূদ্র” শব্দটি বেদে দেখা গেছে প্রায় ২০ বারের মত কোথাও এটি অবমাননাকরভাবে ব্যবহৃত হয়নি। কোথাও বলা হয়নি শূদ্রেরা হলো অস্পর্শযোগ্য, জন্মগতভাবে এই অবস্থাণে, বেদ শিক্ষা হতে অনুনোমোদিত, অন্যান্য বর্ণের তুলনায় নিম্ন অবস্থাণের, যজ্ঞে অনুনোমোদিত।

 

বেদে বলা হয়েছে শূদ্র বলতে বোঝায় কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তি। একারণেই পুরুষ সুক্ত এদের ঘোষনা দিয়েছে মানব সভ্যতার কাঠামো হিসেবে।

এজন্যেই পবিত্র ঋকবেদের ৫ম মন্ডলের ৬০ নং সুক্তের ৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

কর্ম ও গুনভেদে কেউ ব্রাহ্মন, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য, কেউ শুদ্র। তাদের মধ্যে কেহ বড় নয় কেহ ছোট নয়। ইহারা ভাই ভাই। সৌভাগ্য লাভের জন্য ইহারা প্রযত্ন করে। ইহাদের পিতা তরুন শুভকর্ম ঈশ্বর এবং জননীরুপ প্রকৃতি। পুরুষার্থী সন্তানই সৌভাগ্য প্রাপ্ত হন।

তবে যে শ্লোকটির সবচেয়ে বড় অপব্যাখ্যা করা হয় তা হল,

ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীৎ

বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।

ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ

পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।।

‪ব্রহ্মপুরুষের মুখ হতে ব্রাহ্মণ, বাহু হতে ক্ষত্রিয়, ঊরু হতে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের উৎপত্তি। কিন্তু হে বিদ্বান,

নিজেদের দেবসন্তান বা বীর সন্তান কল্পনা করবার আগে একটু সুস্থভাবে এবং স্বাভাবিক ভেবে দেখুন। দেহের পক্ষে চতুর্বিধ অঙ্গ সমানভাবে অপরিহার্য্য। দেহের স্বাস্থ্য এবং শক্তি তথা ধী,বাহু,ধারণ,চলৎ এগুলোই হল বড় কথা, আমাদের মাথা বড়, না পা বড়- এটি মূর্খদের ছেলেমানুষি তর্ক মাত্র।

আবার দেহের পক্ষে যা সত্যি, সমাজদেহের পক্ষেও তা-ই সত্যি।যে কোনও সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চলতে হলে ধীশক্তি,বাহুশক্তি,ধারণশক্তি এবং চলৎশক্তি সমানভাবে প্রয়োজন।

এই চতুর্বিধ শক্তির বাস্তব প্রতিনিধিদের নাম হল ব্রহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য, শূদ্র। আমার পা যদি চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলে, সেক্ষেত্রে আমার বিশাল মস্তিষ্ক অবসাদগ্রস্ত হয়ে যাবে তখন আমার মস্তিষ্ক প্রসূত হাজারো বুদ্ধি কি-ভাবে বাস্তবায়িত হবে?

আমার দুই হাত যদি বাইরের বাধাবিপত্তি সরিয়ে দিতে না- পারে, তখন আমার মস্তিষ্কের উর্বরতা বা পায়ের সচলতা কি কাজে, কিভাবে লাগবে?

গুণ ও কর্মের এই বিভাগ অবশ্যম্ভাবী এবং অপরিহার্য্য।এই অনুযায়ী আমাদের চার বর্ণের অবস্থিতি। কিন্তু পরবর্তীকালে বংশানুক্রমিক জাতিভেদের প্রথার যে উৎপত্তি হল তা এই গুণকর্ম বিভাগেরই বিকৃত রূপ মাত্র।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply