সন্ধ্যাপুজা থেকে শুরু করে যে কোন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান বা পুজা পার্বন, উলুধ্বনি ছাড়া কোন কিছুই সম্পন্ন হয় না সনাতন বাঙালী সমাজে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ সহ ভারতবর্ষের প্রায় সব স্থানেই এই সনাতন সংস্কৃতির দর্শন মেলে যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে। খেয়াল করে দেখবেন এই উলুধ্বনি শুধুমাত্র মেয়েরাই করে থাকে, কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষদেরকে শঙ্খ বাজাতে শোনা গেলেও, উলু দিতে দেখা যায় না। আপনি নিজেও এসকল দৃশ্যের সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন কেন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানগুলোতে এই উলুধ্বনি করা হয়? কেন শুধু মেয়েরাই করে থাকে উলুধ্বনি? অনেকে মনে করে থাকেন, উলুধ্বনি হয়ত শুধুই একটি বাঙালী হিন্দুদের সংস্কার মাত্র। আবার অনেক আধুনিক মেয়েরা উলুধ্বনি তো করতে পারেনই না বরং শুনলেও বিব্রত হন। এমনই বেহাল দশা আমাদের সনাতনের সংস্কৃতির। তবে এর পেছনের মুল কারন হচ্ছে আমাদের অজ্ঞতা। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষার অনুস্পস্থিতিই আমাদেরকে আমাদের শিকড়ের সাথে ক্রমে ক্রমে সম্পর্কহীন করে তুলছে। যাইহোক, জানার কোন সীমা নেই, বয়সও নেই। তাই আসুন আমরাও জানতে চেষ্টা করি কেন দেওয়া হয় উলুধ্বনি? আর কেনই বা উলুধ্বনি ছাড়া সম্পন্ন হয় না সনাতনী দের কোন কার্যক্রম। আশা করি ভিডিওটির শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন।
যে কোন পুজা পার্বনেই ঢাক ঢোলের বাদ্য, শঙ্খনাদ, করতাল-মৃদঙ্গের বাদ্যের পাশাপাশি যে শব্দটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে তা হল মহিলাদের সমবেত উলুধ্বনি। এটি আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করে সমগ্র পরিবেশে এক দৈবিক মাহল তোইরি করে যা দ্বারা দেবতার সন্তুষ্টির পাশাপাশি আশে পাশের পরিবেশ প্রকৃতিকেও সংশ্লিষ্ট যজ্ঞ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত করে দেয়। এই নাদকে সাধারন দৃষ্টি কোন থেকে সামাজিক বিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করা হয়। তবে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সনাতন মতে এই উলুধবনির দুটি প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথম ব্যাখাটি হল-
উলুধ্বনি হল ওঁ কার ধ্বনি। “অ” তে সৃষ্টি, “উ” তে স্থিতি, “ম” তে লয়। এই নাদ ধ্বনি ব্রম্মতরঙ্গ অ,উ,ম কে স্বরল হরিতে উচ্চারন করেই উলুধ্বনি করা হয়। এই উলুধ্বনি মহাচৈতন্য শক্তির জাগরন জয়ধ্বনি। তাই এই ওঁ কার জয়ধ্বনি উলুধনি রূপে মাঙ্গলিক কাজে উচ্চারন করা হয়।
এখানে ওঁ শব্দটি সংস্কৃত ‘অব’ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যা একাধারে ১৯টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রযোজ্য। এই বুৎপত্তি অনুযায়ী ওঁ-কার এমন এক শক্তি যা সর্বজ্ঞ, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা, অমঙ্গল থেকে রক্ষাকর্তা, ভক্তবাঞ্ছাপূর্ণকারী, অজ্ঞাননাশক ও জ্ঞানপ্রদাতা।এছাড়াও ওঁ-কারকে ত্র্যক্ষরও বলা হয়, কারণ ওঁ তিনটি মাত্রাযুক্ত – ‘অ-কার’, ‘উ-কার’ ও ‘ম-কার’। ‘অ-কার’ ‘আপ্তি’ বা ‘আদিমত্ত্ব’ অর্থাৎ প্রারম্ভের প্রতীক। ‘উ-কার’ ‘উৎকর্ষ’ বা ‘অভেদত্ব’-এর প্রতীক। ‘ম-কার’ ‘মিতি’ বা ‘অপীতি’ অর্থাৎ লয়ের প্রতীক। অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সংঘটনকারী ঈশ্বরের প্রতীকও বটে। ওঁ বা ওম আসলে অ , উ ও ম -এর একটি সংমিশ্রণ।এই তিনটি শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী যথাকরমে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু এবং ধংসকর্তা শিব। এই ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট হয় যে হিন্দু সংকৃতিতে যে কোন পুজা পার্বন বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব এই তিন মহাশক্তিকে স্মরন করে বা আবাহন করে তবেই তা শুরু করা হয়। কারন তারাই এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মঙ্গলের বাহক, সমস্ত কারনের কারন।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় ব্যখ্যাটি বৈষ্ণবদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বৈষ্ণবমতে উলু শব্দটি মুলত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার হ্লাদিনী শক্তি রাধার নামের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে উ শব্দের অর্থ রাধা ও লু শব্দের অর্থ কৃষ্ণ। এই মতে, যে কোন শুভ কাজ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে উলু ধবনি করার অর্থ হল, জগতের প্রতিপালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতী রাধারানীকে আবাহন করে সেই শুভ কর্মের সফলতা কামনা করা।
এবার আসুন আমরা জানতে চেষ্টা করি, কিভাবে এই উলু ধবনির প্রচলন ঘটল মর্ত্যধামে এবং কেনইবা শুধুমাত্র মেয়েরাই উলুধ্বনি করতে পারে? বৈষ্ণব সমাজে প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী, কোন এক সময়ে এক বনে, একজন ব্রাহ্মন ও তার কন্যা বসবাস করতেন। ব্রাহ্মন ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। প্রতিদিন শুদ্ধ মনে তিনি শ্রী নারায়নের শাল্গ্রাম শীলাটিকে পুজা অর্চনা করতেন অত্যন্ত ভক্তি ভরে। তার কন্যা ছোটবেলা থেকেই তার পিতাকে নারায়ন ভক্তি করতে দেখে, তিনিও নারায়নের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পিতার সঙ্গে তিনিও নারায়নের পদপাদ্মে নিজেকে সমর্পন করেছিলেন সম্পুর্নভাবে। এভাবেই কাটতে থাকে তাদের সময়। সারাদিনের ভিক্ষা করা সামান্য অন্ন ভোজন করে এবং শাল্গ্রাম শীলার পুজা অর্চনা করেই কেটে যেত পিতা ও কন্যার ঘরকন্না। ক্রমে ক্রমে কন্যাটি বালিকা থেকে যুবতীতে পরিনত হলেন। ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় রুপে ও গুনেও তিনি অনন্যা হয়ে উঠলেন। কিন্তু অকস্মাৎ একদিন তাদের ভাগ্যাকাশে দেখা দিল ঘন কালো মেঘের ছটা। কোন এক কারনে ওই বনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সেই সুন্দরী কন্যার দিকে কুদৃষ্টি পড়ল এক রাক্ষস বংশীয় রাজার। সাথে সাথে তিনি জোর পুর্বক সেই কন্যাকে অপহরন করে নিয়ে গেলেন তার রাজপ্রাসাদে এবং বিবাহও করে ফেললেন। রাজার শর্ত ছিল, ব্রাহ্মন কন্য এখন রাক্ষস বংশের অধীনস্ত মহারানী, সুতারাং সেখানে কোন দেবতার পুজা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ব্রাহ্মন কন্যা অত্যান্ত ব্যাথিত চিত্তে সারাদিন নারায়ন শীলার সামনে অশ্রু বিসর্জন করতেন এবং নিজের ভাগ্যের উপর কটাক্ষ করতেন। এরই মধ্যে একদইন রাক্ষসরাজ ঘোষনা দিলেন, তিনি কিছুদিনের জন্য রাজ্যের বাহিরে যাবেন এবং রানীকে তিনি আগে থেকেই সতর্ক করলেন যে, তার অনুস্পস্থিতিতে কোন দেব দেবীর উপাসনা যেন এই মহলে অনুষ্ঠিত না হয়। এটা ছিল রানীর জন্য অত্যান্ত সুখের সংবাদ। তো যেই মাত্র রাজা মহলের বাইরে চলে গেলেন, অমনি তিনি তার নারায়ন শীলাটিকে বাইরে বের করে তিলক চন্দন অর্পন করে পুজা শুরু করলেন। নারায়ন মন্ত্রে গুঞ্জরিত হল চারিদিক। কিন্তু ফের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিছুদুর না যেতেই ফিরে এলেন রাক্ষসরাজ এবং ফিরে এসে রানীকে নারায়নের পুজা করতে দেখে অত্যান্ত ক্রুদ্ধ হলেন। আদেশ করলেন, এই মুহুর্তেই যেন নারায়ন শীলাকে গঙ্গায় বিসর্জন করা হয়। অগত্যা, কোন উপায় না দেখে রানী মাথায় করে শীলাটিকে নিয়ে গঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করলেন। তবে তার মনে ছিল অন্য অভিসন্ধি। মনে মনে তিনি নারায়নের কাছে ক্ষমা প্ররার্থনা করে দেবী গঙ্গাকে নারায়ন শীলার পাশাপাশি তাকেও গঙ্গায় বিসর্জিত হওয়ার কামনা করতে লাগলেন। অর্থাৎ, তাকে যদি নারায়নকে বিসর্জইন দিতেই হয় তবে তার সাথে তিনি নিজের প্রান ও বিসর্জন দেবেন। এভাবেই, গঙ্গায় নেমে, রানী হাটু জল থেকে কোমর জল, কোমর জল থেকে আকন্ঠ জলে যখন নামলেন, তখন দূর থেকে দৈববাণী হল “ হে কন্যা, তোমাকে তোমার প্রান বিসর্জন দিতে হবে না। তুমি এই শীলাটিকে ফের তোমার গৃহে বহন করে নিয়ে যাও। তুমি যদি আমাকে পুজা নিবেন করতেই চাও, তাহলে তোমাকে কোন মন্ত্র উচ্চারন করতে হবে না। তুমি যখনি আমাকে পুজা করতে চাইবে তখন শুধুমাত্র তোমার মুখ দিয়ে কয়েকবার উলুধ্বনি করো তাহলেই আমি তোমার সমর্পন গ্রহন করব। শুধু তুমিই নও, এই উলুধ্বনি করার অধিকার আমি বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত নারীকে প্রদান করলাম। যে কোন নারী একবার উলুধ্বনি করলেই আমি তার সপমর্পন গ্রহন করব।“ এর পর ব্রাহ্মন কন্যা তথা রাক্ষসরানী সানন্দে তার গৃহে পদার্পন করলেন এবং বাকী জীবনটা তিনি শুধুমাত্র উলুধবনির মাধ্যমে নারায়ণকে পুজা করলেন। তার জীবনাবসানের পর ঠাই পেলেন স্বয়ং নারায়নের পদপাদ্মে।