You are currently viewing অষ্টাবক্র মুনিঃ মাতৃগর্ভেই অভিশপ্ত , আশির্বাদে মুক্তি। Astavakra Muni

অষ্টাবক্র মুনিঃ মাতৃগর্ভেই অভিশপ্ত , আশির্বাদে মুক্তি। Astavakra Muni

ভাবতে পারেন একজন মুনি তার মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায়ই নিজের পিতার দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছিলেন? তাও আবার যেন তেন অভিশাপ নয়। তাঁর পিতার অভিশাপ ছিল জন্মের সময় তাঁর আটটি অঙ্গই হবে বাঁকা এবং নাম হবে অষ্টাবক্র।  আজ্ঞে হ্যাঁ পুরাকালে এমনই এক নির্মম ঘটনার মধ্য দিয়ে জন্মেছিলেন অষ্টাবক্র মুনি। তবে এখানেই এই ঘটনার শেষ নয়। এই মুনি নিজের মেধা, প্রজ্ঞা ও তপস্যার দ্বারা মুক্তিও পেয়েছিলেন সেই বিকলাঙ্গতার অভিশাপ থেকে। শুধু তাই নয়, তাঁর হাতেই রচিত হয়েছিল অষ্টাবক্র গীতা। এছাড়াও সুর্যবংশীয় রাজা ভগীরথকে নতুন জীবন দান করে তাকে নির্বংশ হওয়ার হাত থেকেও বাচিয়েছিলেন এই মুনি। পরবর্তীকালে সেই বংশেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র। আবার বক্রেশ্বর শিব ও সতীপীঠের সাথেও জড়িয়ে আছে এই মহাজ্ঞানী মুনির নাম। প্রিয় দর্শক, আজ আমরা জানব সেই অষ্টাবক্র মুনির কথা। তাঁর জন্ম, পিতা কর্তৃক প্রদত্ব অভিশাপ, শাপমোচন, রাজা ভগীরথ, বক্রেশ্বর সহ তাঁর জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য থাকছে আজকের আলোচনায়।

ঋষি অরুণীর / আরুণীর কাহিনী

আপনারা নিশ্চই ঋষি অরুণীর কথা শুনে থাকবেন। সে যুগে  শিক্ষার্থীদের গুরুগৃহে অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহন করার একটা রীতি ছিল। তাই ছেলেবেলায় অরুণী, উপমণ্যু এবং বেদ নামের তিন শিষ্য তাদের গুরু অয়োদ ধৌম্য ঋষির আলয়ে বিদ্যাশিক্ষা করতে গিয়েছিলেন। তখন বর্ষাকাল, একদিন জলের তোড়ে ঋষি ধৌমের জমির আল ভেঙে গিয়েছিল। তখন তিনি তাঁর শিষ্য অরুণীকে ডেকে আল বেঁধে আসার নির্দেশ দিলেন। গুরুর আজ্ঞা পালনের জন্য অরুণী আল মেরামতের জন্য মাঠে পৌঁছালেন। কিন্তু জলের তীব্র বেগের কারনে তিনি কিছুতেই আল বাঁধতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। অন্যদিকে আল না বাঁধতে পারলে তা গুরুর আদেশ অমান্য করা হবে ভেবে তিনি নিজেই ভাঙা আলের স্থানে শুয়ে পড়ে জলের গতি রোধ করলেন। এদিকে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। ঋষি ধৌম্যের অন্য শিষ্যরা গুরুগৃহে ফিরে এলেও অরুণীর দেখা নেই। চিন্তিত ঋষি অপর দুই শিষ্য উপমন্যু ও বেদকে সঙ্গে নিয়ে আল ভাঙা জমি অভিমুখে রওনা হলেন। গুরু ডাকলেন “বৎস অরুণী কোথায় আছ, ফিরে এস।” কিছুক্ষণ পর অরুণী গুরুর সম্মুখে এসে করজোড়ে নিবেদন করল, “ক্ষমা করবেন গুরুবর, জলের স্রোত এত বেশী ছিল যে আমি মাটি দিয়ে জলপ্রবাহ রোধ করতে পারিনি, আবার আপনার আদেশও অমান্য করতে পারি নি। তাই আমি নিজের শরীর দিয়ে জলপ্রবাহ রোধ করার চেষ্টা করছিলাম। এখন আপনার আদেশে উঠে এলাম। আজ্ঞা করুন গুরুদেব, এখন কি করতে হবে।” নিজের শিষ্য অরুণীর এমন অতুলনীয় কর্মনিষ্ঠা ও গুরুভক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ঋষি ধৌম্যের মুখমন্ডল। বললেন, ” হে অরুণী, তুমি কেদারখণ্ড বিদারণ করে উঠে এসেছ সেইজন্য তোমার নাম হবে উদ্দালক । আর আমার আজ্ঞা অতি শ্রদ্ধাভরে পালন করেছ সেজন্য তুমি শ্রেয়োলাভ করবে এবং সমস্ত বেদ ও ধর্মশাস্ত্র তোমার অন্তরে প্রকাশিত থাকবে।” কেদারখণ্ড অর্থাৎ জমির আল ভেদ করে ওঠার জন্য আরুণির নাম হয় উদ্দালক।

পরবর্তীকালে এই অরুণী তথা উদ্দালক  হয়ে ওঠেন একজন মহাজ্ঞানী ও বেদজ্ঞ ঋষি । কালের পরিক্রমায় তাঁর আশ্রমও ভরে ওঠে শিষ্যদের আনাগোনায়। উদ্দালকের পুত্রের নাম ছিল শ্বেতকেতু এবং কন্যার নাম ছিল সুজাতা। তাঁর আশ্রমে কহোড় নামক একজন শিষ্য ছিলেন যাকে উদ্দালক খুবই ভালোবাসতেন। একসময়, সেই কহোড়ের হাতেই নিজ কন্যা সুজাতাকে সমপর্ন করলেন তিনি। কহোড় মুনি ও তাঁর স্ত্রী খুব সহজ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন। প্রতিদিন প্রাতে কহোড় মুনি সুজাতাকে বেদ পাঠ করে শোনাতেন। মাতৃগর্ভ থেকে এই বেদপাঠ শ্রবণ ও শিক্ষা করতেন তাদের অনাগত সন্তান। এই শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই বেদ শাস্ত্র এতটাই নির্ভুলভাবে আয়ত্ব করেছিলেন যে, একদিন সেই শিশু তাঁর পিতার ভুল ধরিয়ে দেন। ঘটনাটি হচ্ছে, একদিন কহোড় মুনি যথারীতি তাঁর স্ত্রী সুজাতাকে বেদ পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। এমন সময় সুজাতার গর্ভ থেকেই তাদের সন্তান বলে উঠল, হে পিতা, আমি দীর্ঘদিন যাবৎ আপনার কন্ঠে বেদ শ্রবণ করেছি এবং হৃদয়াঙ্গম করেছি। কিন্তু আজ আপনি অন্যমনস্ক হয়ে ভুল পাঠ করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  রহস্যময় কোণার্ক সূর্য মন্দিরের ইতিহাস || History of Mysterious Konark Surya Mandir ||

অনাগত সন্তানের এমন অপমানজনক বাক্য শুনে রাগে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলেন মহামুনি কহোড়। বললেন — “কি স্পর্ধা! আমার সন্তান হয়ে আমার বেদপাঠের ভুল ধরছে! তাও মায়ের গর্ভে থেকেই!” মহামুনি কহোড়ের এই ক্রোধ জন্ম দিল অভিশাপের। তিনি বলে উঠলেন — “এই পাপে তুই যখন জন্মাবি, তোর শরীরের আট জায়গা বাঁকা থাকবে — লোকে তোকে বলবে — ‘অষ্টাবক্র’।যাইহোক, এর কিছুদিন পরের কথা। একদিন রাজর্ষি জনক ঘোষনা করলেন, যিনি তাঁর সভায় শাস্ত্রযুক্তিতে তাঁর সভাপণ্ডিত বন্দীকে পরাজিত করতে পারবেন, তাঁর আর কোন অভাব থাকবে না। ঘোষণাটি পৌছাল মহামুনি কহোড়ের কাছে। মুনির সংসারে তখন দারুন অভাব। তাই তিনি ভাবলেন রাজসভায় গিয়ে বন্দীকে পরাজিত করে কিছু ধন দৌলত নিয়ে আসবেন। কিন্তু কহোড় মুনির ভাগ্য ছিল এর বিপরীত। রাজপণ্ডিত বন্দীর কাছে তর্কযুদ্ধে দারুনভাবে পরাজিত হলেন তিনি। আর সেই তর্কযুদ্ধের শর্ত অনুযায়ী জলে ডুবিয়ে দেওয়া হল কহোড়কে।

অষ্টাবক্র মুনির জন্ম

এর কিছুদিন পরেই জন্ম নিলেন অষ্টাবক্র মুনি। জন্মের পর থেকেই তাঁর শরীরে ছিল আটটি বাঁক। যে কারনে অন্য স্বাভাবিক শিশুদের মত তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেলা করতে পারতেন না। এদিকে সুজাতার পিতা তথা অষ্টাবক্রের মাতামহ উদ্দালকের নির্দেশ ছিল, অষ্টাবক্র যেন কোনভাবেই তাঁর পিতার করুণ দশা না জানতে পারে। তাই ছেলেবেলা থেকেই অষ্টাবক্র তাঁর মাতামহ উদ্দালককে তাঁর পিতা ও মাতুল শ্বতকেতুকে তাঁর ভ্রাতা বলে জানতেন।এভাবেই দিন কাটতে থাকল অষ্টাবক্রের। দিনে দিনে বড় হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু কথায় বলে সত্য কখনো চাপা থাকে না, অষ্টাবক্রের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। তাঁর মাতা, মাতামহ ও মাতুলের অসংলগ্ন কথাবার্তার জেরে একসময় তিনি তাঁর মাতার মুখ থেকে বের করে আনলেন আসল সত্য। অর্থাৎ তিনি জানতে পারলেন তাঁর পিতাকে জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে বন্দী নামক এক মহাপন্ডিতের সাথে তর্কযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কারনে। অষ্টাবক্র সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিও  তর্কযুদ্ধ করবেন পণ্ডিত বন্দীর সাথে। তাঁর মাতা ও মাতামহ তাকে বাধা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলেন। অবশেষে অষ্টাবক্র ও তাঁর মামা শ্বেতকেতু রওনা হলেন রাজর্ষি জনকের সভার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য, শ্বেতকেতু সম্পর্কে অষ্টাবক্রের মামা হলেও তাদের বয়সের ব্যাবধান ছিল খুবই কম। তাই তারা দুজনেই ছিলেন নিতান্তই বালক।

সে যুগে বলা হত ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রের মতো ব্রাহ্মণের হাতিয়ার হচ্ছে তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি। যাইহোক অষ্টাবক্র ও শ্বেতকেতু  জনকরাজার প্রাসাদে তো গেলেন কিন্তু দ্বাররক্ষী তাদের ঢুকতেই দিলেন না। বললেন — ‘তোমরা নিতান্তই ছেলেমানুষ। জনকরাজার সভায় কেবল জ্ঞানীরাই প্রবেশ করতে পারেন।’ এ কথা শুনে অষ্টাবক্র বললেন — ‘আমরা সমস্ত বেদ ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছি, তাই বয়স কম হলেও আমরা জ্ঞানী। অত‌এব ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিন। দেখি জনকরাজার সভায় কত বড়ো তার্কিক পণ্ডিত আছেন।’ দ্বারপাল বললেন — ‘না না! তোমরা বড্ড ছেলেমানুষ। এ কাজ আমি করতেই পারি না।’ অষ্টাবক্র বললো —কে জ্ঞানী সেটা বয়স দিয়ে বিচার করবেন না? ভেবে দেখুন অনেকের বয়সের ভার বাড়লেও বুদ্ধিতে তাঁরা হাল্কাই থেকে যান। যেমন তুলো গাছের ফল পেকে গেলেও হাল্কাই থেকে যায়।’ অষ্টাবক্রের কথায় দ্বারপাল মুগ্ধ হলেন এবং ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

রাজসভায় প্রবেশ করেই অষ্টাবক্র বললেন যে তাঁরা সভার শ্রেষ্ঠ তার্কিক পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামতে চান। জনকরাজা বললেন — ‘বেশ তো তার আগে আমার এই সামান্য ধাঁধার উত্তরটা দাও দেখি!’ বলো তো কি যাতে বারোটা ভাগে তিরিশটা টুকরো আছে, আবার চব্বিশটা ভাগে তিনশো ষাটটা টুকরো আছে?

আরও পড়ুনঃ  মহাদেবের কৈলাসের ৯ অমীমাংসিত রহস্য || 9 Unsolved Mysteries of Kailash Mountain of Shiva

অষ্টাবক্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন —একটা বছর। যা বারো মাসের ভাগে আর প্রতিটি মাস তিরিশ দিনের টুকরোয় ভাঙা। এটাই আবার তিনশো ষাট দিনে বারোটি পূর্ণিমা আর বারোটি অমাবস্যায় ভাঙা যায়।’

অষ্টাবক্রের উত্তর শুনে রাজা রীতিমতো বিস্মিত হলেন। তারপর বললেন — ‘বলো দেখি — কোন প্রাণী ঘুমোলেও চোখ বোঝে না? কে জন্মানোর পরেও স্পন্দিত হয় না? কোন বস্তু বেগে বৃদ্ধি পায়?’

অষ্টাবক্র হেসে উত্তর দিলেন —মাছ ঘুমোলেও চোখ বোঝে না। ডিম জন্মেও স্পন্দিত হয় না। আর নদী বেগের দ্বারা বৃদ্ধি পায়।’

উত্তরগুলো শুনেই জনকরাজা বুঝলেন এ বালক হয়েও সত্যিই জ্ঞানী। তিনি বললেন — ‘অসাধারণ তোমার বুদ্ধি! তুমি অবশ্যই সভায় আসতে পারো। কিন্তু মনে রেখো সেখানে আছেন সর্বশ্রেষ্ঠ তার্কিক পণ্ডিত বন্দি। তাকে কেউ কোনোদিন তর্কে পরাজিত করতে পারেনি। আর তিনি যখন কাউকে তর্কে পরাজিত করেন, তখনই তাকে জলে ডুবিয়ে দেন।

অষ্টাবক্র বললেন — ‘ হে রাজন আপনি ভয় পাবেন না। উনি কখনো সেরকম কোনো পণ্ডিতের সামনে আসেন নি বলে এমন মিথ্যে ধারণা হয়েছে। আমার সঙ্গে তর্ক বিদ্যায় ওনার সব দর্প চূর্ণ হবে।

যাইহোক এবার রাজা জনকের সভায় অষ্টাবক্র আর বন্দি মুখোমুখি হলেন। শুরু হোলো এক প্রবল তর্কযুদ্ধ।

বন্দি বললেন — ‘আমি যা বলবো দেখি তুমি ঠিক তার পরেরটা মিলিয়ে বলতে পারো কিনা। যেমন ধরো — সূর্য যদি এক হয় দুই বলতে কি বোঝো?’

অষ্টাবক্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন — ‘জগতে সূর্য একটি আর রথের চাকা দুটি।’

বন্দি বললেন — ‘তিন বলতে বোঝায় তিন ভুবন — স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল।

অষ্টাবক্র হেসে বললো — পণ্ডিত আপনি তিনে যদি বলেন ভুবন, চারে তাহলে দিক/ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, আমার কথা ঠিক।’

বন্দি বললেন — ‘আমাদের শরীরে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়।’

“এবার অষ্টাবক্র উত্তর দিলেন — ‘পাঁচে ইন্দ্রিয় ছয়ে ঋতু / উত্তর দিলাম এই হেতু।’

এভাবে অষ্টাবক্র যখন একে একে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন তখন বন্দি তখন একটু রেগে গিয়েই বললেন — ‘সাত বলতে বোঝায় সাত ঋষি অর্থাৎ সপ্তর্ষি। তাহলে আট বলতে কি বোঝো?’

অষ্টাবক্র হেসে বললেন — ‘সপ্তর্ষি যদি হয় অষ্টবসু কেন নয়?’ এই ভাবে তর্ক আগাতে লাগল কঠিন থেকে কঠিনতর পর্যায়ে। অবশেষে একসময় পণ্ডিত বন্দি নিজেই আটকে গেলেন নিজের কথায়। যেটা সম্পূর্ণ করলেন অষ্টাবক্র। অর্থাৎ তর্ক যুদ্ধে বন্দি পরাজিত হলেন।

তখন জনকরাজা বললেন — ‘অষ্টাবক্র। তুমি বালক হলেও সত্যিই জ্ঞানী। তাই বন্দিকে তুমি পরাজিত করতে পেরেছো। এখন সে তোমার অধীন। তুমি বন্দিকে এখন যেমন ভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারো।’ অষ্টাবক্র তার উত্তরে বললেন — ‘এই বন্দিকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং আমার ইচ্ছা ও যেভাবে সবাইকে তর্ক যুদ্ধে হারিয়ে জলে ডুবিয়ে দিয়েছেন, ঠিক তেমনি ওকেও এক্ষুনি জলে ডুবিয়ে দেওয়া হোক। এটাই ওর উপযুক্ত শাস্তি।’

বন্দি বললো — ‘জ্ঞানী অষ্টাবক্র। আপনার আদেশের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনার কথায় আমায় জলে ডুবিয়ে দিলে আমার মঙ্গল হবে। আমার পিতা স্বয়ং বরুণদেব। তিনি জলের দেবতা। তাই জলের নীচে গেলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আপনার কথাতেই আমি জলের নীচে গিয়ে আমার পিতার কাছে পৌঁছাতে পারবো। তিনি আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। আর হ্যাঁ। এর আগে যাদের আমি তর্ক যুদ্ধে পরাজিত করেছি, তাদের সবাইকে জলের নীচে পাঠিয়েছি বটে, কিন্তু কা‌উকে হত্যা করিনি। ওনাদের সবাইকেই পাঠিয়েছি আমার পিতা বরুণদেবের কাছে। কারন তাঁর বিশেষ যজ্ঞের জন্য কিছু জ্ঞানী ব্রাহ্মণের প্রয়োজন ছিল । ওনাদের সবাই এবার ফিরে আসবেন। আর জ্ঞানী অষ্টাবক্র, আপনার পিতা কহোড় মুনির সঙ্গে এবার আপনার দেখা হবে। ঠিক যেমন আমিও আমার পিতা বরুণদেবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’

আরও পড়ুনঃ  কোন সরস্বতী মূর্তিতে অঞ্জলী দেওয়া যাবে না? Which Saraswati Idol Should Not Be Worshiped?

“জ্ঞানের জন্য অষ্টাবক্রকে অভিশপ্ত হতে হয়েছিলো তার জন্মের আগেই। আর সেই জ্ঞান সার্থক হোলো যখন তিনি তার সেই অভিশাপ দেওয়া পিতাকে ওই জ্ঞান আর বিদ্যা দিয়েই উদ্ধার করলেন বন্দির হাত থেকে। “পরবর্তীতে রাজর্ষি জনক অষ্টবক্র মুনির কাছে জ্ঞান, মুক্তি ও বৈরাগ্য লাভের উপায় জানতে চেয়েছিলেন। তার জিজ্ঞাসার উত্তরে অষ্টবক্র মুনি যা বলেছেন তা পরবর্তীতে অষ্টাবক্র গীতা নামে কুড়িটি অধ্যায়ে সংকলিত হয়েছে। এতে অদ্বৈতবাদ ও সমদর্শন বিষয়ে গভীর আলোচনা করা হয়েছে।

তবে এখানেই শেষ নয়। একটু পরেই জল থকে বেরিয়ে এলেন অষ্টাবক্র মুনির পিতা কহোড় মুনি। বেরিয়ে এলেন অন্যান্য পরাজিত ব্যাক্তিগনও। সন্তানের এই সাফল্যে কহোড় মুনি খুব খুশি হন এবং গর্ব বোধ করতে থাকেন। এরপর তিনি তাঁর পুত্রকে আশীর্বাদ করে বলেন যে,  হে বৎস, সমঙ্গ নদীর জলে স্নান কর, তবেই তোমার অঙ্গবিকৃতি দূর হবে। একথা শুনে পিতাকে প্রনাম করে অষ্টাবক্র আবার বেরিয়ে পড়লেন সমঙ্গ নদীর খোঁজে। সমঙ্গ অর্থাৎ সমান গতিতে বয়ে চলে যে নদী। বহুকাল ধরে পথ চলতে লাগলেন এই মহাজ্ঞানী অষ্টাবক্র। সেইসময় সূর্যবংশ তথা ভগবান শ্রীরামচন্দ্র যে বংশে জন্মগ্রহন করেছিলেন, সেই বংশ পুরুষশূন্য হয়ে নির্বংশ হতে বসেছিল। ব্রহ্মার অনুগ্রহে এই বংশে রাজা ভগীরথের জন্ম হয়েছিল বৈকি কিন্তু তাঁর শরীর ছিল অস্থিশূন্য। রাজা ভগীরথের জন্ম হয়েছিল তাঁর মাতা ও বিমাতার মাধ্যমে। কোন পুরুষের ঔরসে জন্ম না হওয়ার ফলে তাঁর শরীরে কোন অস্থি বা হাড় ছিল না। তাই তাঁর চলাফেরার ধরন ছিল অনেকটা অষ্টাবক্রের মত। অষ্টাবক্র যখন পিতার নির্দেশমত সমঙ্গ নদী খুঁজে বেড়াচ্ছেন, সেসমইয় একদিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে ভগীরথের। তিনি দেখলেন তাকে ব্যাঙ্গ করে কেউ একজন ঠিক তাঁর মত করেই পথ চলছেন। এ দেখে ভয়ংকর রকমের ক্রুদ্ধ হলেন অষ্টাবক্র। তিনি বললেন, যদি এই ব্যাক্তি আমাকে ব্যাঙ্গ করে থাকে তাহলে এখনই সে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যাক। আর যদি সে সত্যিই বিকলাঙ্গ হয়ে থাকে তাহলে আমার আশির্বাদে সে সুস্থ স্বাভাবিক শরীর প্রাপ্ত হোক।

ঋষি অষ্টাবক্রের আশির্বাদে তৎক্ষণাৎ স্বাভাবিক শরীর প্রাপ্ত হলেন রাজা ভগীরথ। এরপর তিনি স্বর্গের গঙ্গাদেবীকে মর্ত্যে এনে সাগর রাজার ষাট হাজার বংশধর তথা তাঁর পূর্বপুরুষদেরকে কপিলমুনির অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলেন। এছাড়াও সুর্যবংশকেও নির্বংশ হওয়ার হাত থেকে বাঁচালেন রাজা ভগীরথ। এর মাধ্যমে তরান্বিত হল শ্রীবিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম। যাইহোক রাজা ভগীরথকে আশির্বাদ করে আবারও পথ চলতে লাগলেন অষ্টাবক্র। সমঙ্গ নদীর খোঁজ করতে করতে অজানা এক গ্রামে এসে হাজির হন তিনি। সেই গ্রামে জনবসতি ছিল না বললেই চলে। চারপাশটা ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা। এইখানে ঘুরতে ঘুরতে একটি শিবলিঙ্গের সন্ধান পান অষ্টাবক্র ও এই লিঙ্গের সামনে গভীর সাধনায় মগ্ন হন। এরপর শিবের অনুগ্রহে পূর্বদিকের জঙ্গলের মধ্যে তিনি আটটি কুণ্ডের সন্ধান পান। তিনি লক্ষ করেন তার মধ্যে সাতটি কুণ্ডের জল গরম এবং একটি কুণ্ডের জল ঠান্ডা। তিনি এই ৮ কুণ্ডের জল যেখানে মিশছে, সেখানে স্নান করেন তিনি। এর ফলে তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর হয় এবং তিনি বক্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হন ।পরে অষ্টাবক্রের নামানুসারে সেই শিবলিঙ্গের নামকরণ হয় বক্রনাথ, এবং সেই গ্রাম বক্রেশ্বর নামে পরিচিতি পায়।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাপহরা নদীর তীরে বক্রেশ্বর মন্দির অবস্থিত। এছাড়াও একান্ন সতীপীঠেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পীঠ হচ্ছে এই বক্রেশ্বর। পুরাণমতে দেবী সতীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থান এখানে পতিত হয়েছিল। আবার মতান্তরে এখানে দেবীর তৃতীয় নয়ন পতিত হয়েছিল। বক্রেশ্বরের অধিষ্ঠিত দেবী হলেন মহিষাসুরমর্দিনী। আর এখানকার ভৈরব হলেন বাবা বক্রেশ্বর বা বক্রনাথ।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply