রাস লীলা কি? কি ঘটেছিল সেই রাতে?
মানবরূপী ভগবান বিষ্ণুর সর্বোত্তম লীলা ছিল রাস লীলা। শারদীয়া পুর্নিমার রূপবতী সেই রাতে অজস্র গোপী ও শ্রীরাধা সহকারে অপ্রাকৃত এক নৃত্যে রত হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাসলীলার মত একটা অপার্থিব ও আধ্মাত্মিক বিষয়কে সাহিত্য, সিনেমা ও গানে উপস্থাপন করা হয়েছে নিছক কামসর্বস্ব জৈবিক চাহিদা মেটানোর ঘটনা হিসেবে। এসকল অপব্যাখ্যা ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রামক ব্যাধির মত আর ক্ষুন্ন করেছে সনাতন ধর্মের মুল্যবান সব ঘটনা ও তত্বকে। তাই শিক্ষিত মানুষ হিসেবে রাসলীলার প্রকৃত রহস্যকে জানা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আমাদেরকে জানতে হবে শ্রীকৃষ্ণ আসলে কে? তিনি যাদের সাথে স্বর্গীয় রাসলীলা করেছিলেন তারা কি আমাদের মতই জড়জাগতিক জীব নাকি অন্য কিছু। আর আমাদের জানার মধ্যেই লুকিয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণ, রাধা, ব্রজঙ্গনা ও রাসলীলা সম্পর্কে সমস্ত ভ্রান্ত ধারনা থেকে উত্তোরনের উপায়।
সকল বিশ্বজীবের অন্তরে যিনি অধ্যক্ষ বা বুদ্ধি প্রভৃতির সাক্ষী, সেই পরমাত্মা আজ ক্রীড়ার তরে লীলা বিগ্রহধারী। সকলের অন্তরের অন্তরতম রূপে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান। তাঁর কেউ পর নেই। কি পুরুষ, কি নারী, সকলেরই হৃদয় বিহারী তিনি। তাঁর এই লীলা আত্মার সঙ্গে আত্মার বিহার, নিজের সঙ্গে নিজে্রই খেলা। এই খেলা বিশ্বজুড়ে চলছে প্রতিনিয়ত। তাঁরই বৈচিত্র্যময় প্রকাশ রাসলীলা। গোপীদের ব্রতসাধন, দীর্ঘদিনের তপস্যা, এবং হৃদয়ে পুঞ্জীভূত অনুরাগের ফলে তাঁদেরকে অনুগ্রহ করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ এই রাসলীলা করেন।
বর্তমানে আমরা একবিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষ। আত্মসুখের আয়োজনে আমরা সদা তৎপর এবং উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর মানুষ। সব কিছুই আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা ছুটে চলেছি বিশ্ব বিজয়ে। চলছে পারমনাবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। চাহিদা বেড়ে চলেছে ভোগ্য বস্তুর। আমরা ভুলে গেছি আত্মানুসন্ধানের যথার্থতা। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জানতে চাই শ্রীভগবানের রাসলীলা রহস্য। অথচ মন ছুটে চলে জড় জাগতিক বিকৃত কদর্য রসের দিকে। কিন্তু এর বাইরেও যে জগৎ আছে তা কি আমরা জানি? জগতের কেউ সুখী নয়। সুশোভিত চির বিকাশমান পুষ্পের মতো জীবনের আরেক রূপ যথার্থ বাস্তব জীবন। যা শাশ্বত, জরা-ব্যাধি-মৃত্যুহীন। এই জীবনেই তা লাভ করা সম্ভব।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশেষ সংখ্যাতত্ত্বের পশ্চাৎগণনানুসারে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীধাম বৃন্দাবনের ধীরসমীরে, যমুনা তীরে বংশীবটমূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজঙ্গনাদের সঙ্গে অপ্রাকৃত রাসলীলা বিলাস করেছিলেন। এই রাস নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল শারদীয়া পূর্ণিমার মোহিনি রাতে । সেই রাতে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি সুসজ্জিত হয়েছিল অপরূপ সাজে ।পূর্ণ চন্দ্রের স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে গগণমন্ডল ছিল উদ্ভাসিত। বৃক্ষ, লতা, গুল্মাদি, পশুপক্ষী উন্মুখ হয়েছিল ভগবানের রাসলীলা দর্শনে। শ্রীকৃষ্ণের নরলীলা সমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হল রাসলীলা। এই রাসনৃত্য ছিল সম্পূর্ণ চিন্ময় এবং বেশ কিছু মতবাদ অনুসারে সেই সইময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন কিশোর।
শ্রীকৃষ্ণের কেবল আনন্দময় ‘আনন্দময়োহভ্যাসাৎ’। বৃন্দাবনে সকলেই আনন্দময়। পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা, জল-স্থল, গাভী, গোবৎস, গোপবালক এবং গোপবালিকারা সকলেই কৃষ্ণপ্রেমে আনন্দময়। শ্রীকৃষ্ণকে ভালবেসে তারা পরম আনন্দে মগ্ন। ভগবানের ভগবত্তার নির্যাস হল মাধুর্য্যরস। যা পূর্ণরূপে প্রকটিত হয়েছে দ্বাপর যুগের শেষে কৃষ্ণলীলায়। শরতের শেষে বিশ্বপ্রকৃতি যেন আনন্দমগ্না, যমুনাপুলিন শরদজ্যোৎস্না দ্বারা বিধৌত। এ যেন আধ্যাত্মিকতার আড়ালে এক অসামান্য প্রেম কাহিনি। প্রেমের সর্বোচ্চ উচ্চতায় মনের বন্ধহীন ডোরই যেন এখানে উপজীব্য। ভালবাসা এখানে ‘শারীরিক’ কোনও চাহিদা নয় এক ‘মিলনের তিতিক্ষা’। আর এই মিলন পুরোটাই আধ্যাত্মিক, যাকে আমরা বলি ‘প্ল্যাটোনিক’। এই কারণে আজও কার্তিক পূর্ণিমায় বারবার ফিরে আসে রাস-লীলার অসামান্য প্রেমকাহিনি। দুর্গাপুজোর মতো জাক-জমক না থাকলেও হিন্দুদের অন্যতম এক বড় উৎসব রাস। তবে অঞ্চল বিশেষে রাস-এর প্রভাব এবং জমক কিন্তু বিশাল রকমের।
‘রাস’ শব্দের উৎপত্তি ‘রস’ শব্দ থেকে। মূলত কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে ‘রাস’-এর ক্ষণ। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। হিন্দুশাস্ত্রে অনুযায়ী রাস পূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনধামে লীলাবিলাস করেন। তাই রাস পূর্ণিমাতেই পালিত হয় রাস-লীলা। এই দিনটি বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের লীলা করার দিন। এ ‘লীলা’ মানে নৃত্য। ‘চিরহরণ’-এর গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃ্ষ্ণের এই লীলা। কথিত আছে গোপীরা নাকি এই দিনটিতে অপেক্ষা করে কৃষ্ণের ডাকের জন্য। কতক্ষণে তাঁদের প্রাণপ্রিয় সখা শ্রীকৃষ্ণ লীলা-র জন্য ডাক দেবে তা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে গোপীরা। ‘রাসলীলা’-য় যে নৃত্য পরিবেশিত হয় তার নাম ‘রাস-নৃত্য’ । মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিব্যরাস, ও নিত্যরাস এই পাচ ভাগে বিভক্ত রাসলীলা। প্রেমরসের এই পঞ্চলীলায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ মহারাস-এ। এই পর্যায়েই রয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা-র অভিসার, গোষ্ঠী অভিসার, গোপীগণের রাস-আলাপ, কৃষ্ণনর্তন, রাধানর্তন, গোপীদের নর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান-প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি, ও গৃহগমণ।
বাংলাদেশী মণীপুরী আদিবাসীদের সর্বোৎকৃষ্ট উৎসব রাসনৃত্য। এটি মণীপুরী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্লাসিক্যাল মূর্চ্ছনা, যাকে বলে এক অপূর্ব শৈল্পিক সৃষ্টি। এঁদের রাস-নৃত্যে কৃষ্ণ ও রাধার ভূমিকা দেওয়া হয় পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের। আর গোপীদের ভূমিকায় তরুণীরাই নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন। বাংলাদেশের মণীপুরী আদিবাসীদের স্থির বিশ্বাস শিশু-দের মধ্যেই থাকে দৈব্যকান্তি। কিন্তু, পাঁচ বছর অতিক্রম করলেই সেই দৈব্যকান্তি রূপ হারিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পরিচিতি পায় বাংলাদেশী মণীপুরীদের এই উৎসব। বাংলা, মৈথিলী, ব্রজবুলি ও মৈতৈ কবিদের পদাবলী থেকে রাসনৃত্যের গীত গাওয়া হয়। ১৯২৬ সালে সিলেটে বেড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশী মণীপুরী আদিবাসীদের রাস-নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন। এই নাচের কোমল আঙ্গিক রবীন্দ্রনাথের কবিমনকে আলোড়িত করেছিল ভীষনভাবে। পরবর্তীকালে এই মণিপুরীদের এই রাস-নৃত্যকে নিজের সাহিত্য সৃষ্টির আঙিনায় ঠাঁই দেন রবীন্দ্রনাথ। আর এভাবেই আরও বিশাল জনসমষ্টির কাছে পৌঁছয় বাংলাদেশী মণিপুরী আদিবাসীদের রাস-নৃত্যের মাহাত্ম্য।
নবদ্বীপ ও কোচবিহারের রাস-মেলা রাজ্যের সবচেয়ে বড় দু’টি রাস-মেলা পালিত হয় । নদিয়ারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৃষ্টপোষকতায় তিনশো বছর আগে নবদ্বীপের রাস উৎসবের শুরু।অন্যদিকে কোচবিহারের রাজপরিবারের পৃষ্টপোষকতায় দু’শ বছরেরও বেশি সময় আগে রাস-উৎসব পালন শুরু হয়েছিল। আজও এই দুই স্থানের রাস প্রত্যক্ষ করতে দেশ-বিদেশ থেকে বহু ভক্তগণ সমবেত হন।
এবার আসুন শ্রবন করি কি ঘটেছিল রাসপুর্ণিমার সেই মোহিনী রাতে। বিশ্বপ্রকৃতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশে শরৎ পূর্ণিমার রাতে বংশীবটমূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বংশী বাদন শুরু করলেন। মন প্রাণ হরণকারী বংশীর ধনি শুনে ব্রজগোপীকারা তাঁদের পতি, পুত্র, গৃহকর্ম, জাতি-কুল-মান সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মহামিলনের জন্য রাসস্থলীতে ছুটে এসেছিলেন। ভগবানের সঙ্গে মিলনের জন্য এইরূপ ব্যাকুলতাই মানুষকে চরম সার্থকতা এনে দেয়। কৃষ্ণানুরাগে রঞ্জিত হয়ে ওঠাই ছিল ব্রজবালাদের একমাত্র সাধনা। শ্রীকৃষ্ণও নৃত্যানুষ্ঠানের উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র-বিবেচনা করে মল্লিকা, জুঁই ও অন্যান্য অত্যন্ত সুগন্ধিযুক্ত পুষ্প দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করেছিলেন। অপ্রাকৃত রাসনৃত্য শুরু হলো। রাসমন্ডলীতে দুই গোপী তার মধ্যে কৃষ্ণ। যত গোপী তত কৃষ্ণ। রাসরসের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ। ‘নাচতঘন নন্দলাল রসবতী করি সঙ্গে।’ এই রাসনৃত্যে বিশ্বভুবন নাচে। ফুলের উপর নাচে ভ্রমরভ্রমরী। মেঘের তালে নাচে ময়ূরময়ূরী। কদম্ব শাখায় নাচে শুক-শারী। বৃক্ষ-লতা, পশু-পক্ষী, জল-স্থল, আকাশ-বাতাস আনন্দে নৃত্য করে গোপী-গোবিন্দের প্রেমের উদ্বেলতায়। এই চির আনন্দ খেলার বিরাম নেই। চলছে নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন।
শ্রীধাম বৃন্দাবনে চার শ্রেণীর ব্রজলাল নাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ রাসনৃত্য করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল নিত্যসিদ্ধ গোপকন্যারা, যাঁরা ছিলেন শ্রীমতী রাধারানীর কায়ব্যূহ। অন্য শ্রেণী ছিল দেবকন্যারা, যাঁরা নিত্যসিদ্ধদের সঙ্গের ফলে নিত্যসিদ্ধ স্তর লাভ করেছিলেন। অন্য আর এক শ্রেনী ছিল মূর্তিমানশ্রুতিরা, যাঁরা তপস্যা করে গোপকূলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁরাও ছিল সাধনাসিদ্ধ। আর ছিলেন ঋষিরা, যাঁরা দন্ডকারণ্যে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে দেখে শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন। ব্রজরামারাও যমুনার তীরে এক মাস ব্যাপী কাত্যায়নীর ব্রত করেছিলেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে পতি রূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন। ব্রজবালাদের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্যই এই রাসনৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
যাইহোক রাসনৃত্যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে অসংখ্য রূপে বিস্তার করে প্রত্যেক গোপীর সঙ্গে যুগপৎভাবে নৃত্য করেছিলেন। রাসপূর্ণিমার রাতটি ছিল ব্রহ্মরাত। মানুষের কাছে যা চারশত বত্রিশ কোটি বছর। ‘রাস পূর্ণিমা’-র চাঁদ যেন বিরহকাতর সখা-র প্রতিভূ। দীর্ঘ অসন্দর্শনে সখার মন আজ বিরহকাতর। প্রাণপ্রিয়া-র সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খায় তার মন ক্ষত-বিক্ষত। ফিরে আসে যেন বৈষ্ণব পদাবলীর সেই পদ– ‘সই কে বা শোনাইলো শ্যামনাম, কানের মরমে পশিল গো আকুল করিল মোর প্রাণ’। যমুনার জলে শরীর ধুয়ে সন্ধ্যাকাশে ঘরে ফিরেছে গোপীদের দল। কিন্তু, ক্ষণিকের ঘন অন্ধকার কাটিয়ে যেন আকাশ ফুড়ে বেরিয়ে এল সুগোল চন্দ্র। দিব্যকান্ত তার চেহারা। বৃন্দাবন আলোকিত। সোনালী থালার মতো সেই চন্দ্রের আলোয় ঘটল আবেগের বিস্ফোরণ। প্রতীক্ষার তিতিক্ষা মিটিয়ে মিলনের এক বার্তা। চারিদিকে বেজে উঠল কৃষ্ণ বাঁশরী। ঘর ফেলে বৃন্দাবনের পাড়ে ছুটল গোপীরা। এরকম এক মহারজনীতে কৃষ্ণসঙ্গ লাভ করে ব্রজগোপিকারা একটু গর্বিত হলে, রাধারানীকে নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হয়ে যান। এরপর কৃষ্ণবিরহে গোপীরা প্রেমে উন্মাদ্গ্রস্ত হয়েছিলেন এবং সারা রাত্রি কৃষ্ণের লীলা অনুসরন করে অন্বেষন করেছিলেন। অবশেষে কৃষ্ণ দর্শন দান করে রাসনৃত্যের মাধ্যমে গোপীদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন।
হিন্দুশাস্ত্র থেকে শুরু করে ভাষা-সাহিত্য বা বৈষ্ণব পদাবলী সবখানেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমার চাঁদের তুলনা টানা হয় দীর্ঘদিন বিদেশ-বিভুইয়ে পড়ে থাকা সখাদের দ্বারা। আর এই মিলনের ক্ষণেই যে লীলা হয়, তারই নাম ‘রাস-লীলা’। ব্রজগোপীদের কৃষ্ণের প্রতি যে আকর্ষন বা ভালবাসা, এই আকর্ষন বা ভালবাসা-ই তাঁদের সবকিছু পরিত্যাগ করে কৃষ্ণ সান্নিধ্য লাভে সহায়তা করেছিল। গভীর প্রেমার্তি না থাকলে তাঁকে পাওয়া যায় না। যতরকমের সাধন-মার্গ আছে, সবেরি মূলকথা প্রেম-গভীর আকর্ষন।
কৃষ্ণপ্রেমে ‘কাম’-কে জাগতিক ভাবনায় ভাবাটা অপরাধ রাস-লীলা-র ব্যাখ্যায় কৃষ্ণের বংশীবাদনকে ‘অনঙ্গ বর্দ্ধনম’ বলা হয়েছে। কেউ যদি ভগবানের স্পর্শ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয় বা তাকে খাওয়াবার জন্য ব্যকুল হয় অথবা ভগবানের কাছ থেকে আনন্দ পেতে বা দিতে চায়, তাহলে তাকে বলে ‘অনঙ্গ’। এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘কাম’। কিন্তু গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ককে এতটা সরলীকরণ করে ভাবাটা অপরাধ। বলা হয় গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম আধ্যাত্মিক-জাগতিক নয়। গোপীরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কৃষ্ণকে প্রেম নিবেদন করে। এতে কোনও দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা জড়জাগতিক কামউপভোগ নয়। আমাদের কাম-কলুষিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে শুদ্ধ চিত্তে রাসলীলা রহস্য উন্মোচনে প্রয়াসী হতে হবে। মনে রাখতে হবে ব্রজাঙ্গনারা সাধারণ স্ত্রীলোক ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ পার্ষদ।ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে , তাঁরা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ। শ্রদ্ধা সহকারে যিনি শ্রীকৃষ্ণের এই অপ্রাকৃত রাসলীলা শ্রবণ, কীর্তন ও স্মরণ করবেন, তিনি অচিরেই শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্যে প্রেমভক্তি লাভ করবেন।