বিশ্বসাহিত্যের এক বিষ্ময় হচ্ছে মহর্ষি বাল্মিকী রচিত রামায়ণ। ৭টি কাণ্ড, ৫০০টি সর্গ ও সংস্করন ভেদে ২৪-৪৩ হাজার শ্লোক নিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটি, বিশ্বের কোটি কোটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থ নয় বরং আদর্শিক জীবন যাপনের এক অনন্য উদাহরন। পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে সত্য, ন্যায় ও ধর্মের পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে শ্রীনারায়নের অবতার শ্রীরামচন্দ্র জন্ম নিয়েছিলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম হয়ে। দেখিয়েছিলেন, ত্যাগ, প্রেম, কর্তব্য এবং ন্যায়পরায়নতার আদর্শিক দৃষ্টান্ত। কয়েক হাজার বছর আগে রচিত এই মহাগ্রন্থের চরিত্রগুলো পৃথিবী থেকে প্রস্থান করলেও, আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রামায়নে উল্লেখিত গুরুত্বপুর্ণ সব স্থান। এগুলো আজও সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র তীর্থভুমি।
সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদেরকে আজ আমরা নিয়ে যেতে চাই প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের পদস্পর্শধন্য সেই সমস্ত স্থানগুলোতে যেগুলো কালের স্রোতে হারিয়ে না গিয়ে আজও রামায়নের যুগের স্পষ্ট প্রমান হয়ে রয়ে গেছে। স্থানগুলো দর্শন করে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জয় সীতা রাম লিখে কমেন্ট করবেন। তো চলুন দর্শক, আর দেরী না করে দেখে আসি রামায়নের যুগের গুরুত্বপুর্ণ স্থানগুলো যা আজও টিকে আছে।
১. অযোধ্যা
রামায়নের সবচেয়ে আলোচিত স্থানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে আযোধ্যা। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এই অযোধ্যা থেকেই শুরু হয় রামায়ণের মূল কাহিনী। এই পরম পবিত্র পুণ্যভূমিতে, রঘুবংশীয় রাজা দশরথের ঔরসে জন্ম নিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্র। এই রাজ্যেই তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা। এছাড়াও সুর্যবংশীদের উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, ইত্যাদি রকমের বহু ঘটনার সাক্ষীও এই শহরটি। বর্তমান সময়ে অযোধ্যা এখনও একই নাম নিয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত। গবেষকদের মতে রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল বর্তমান অযোধ্যার দক্ষিণ প্রান্তের রামকোটে, যা আজ বিশ্বের কোটি কোটি রামভক্তের কাছে পরম পবিত্র এক তীর্থস্থান। তাইতো প্রতিবছর রাম নবমীর উৎসব উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও পুণ্যার্থী সমবেত হন এই পৌরাণিক তীর্থে। অবাক বিষ্ময়ে দর্শন করেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পদস্পর্শ ধন্য অযোধ্যাকে। আর সেই পূণ্য তিথিকে কেন্দ্র করে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে অযোধ্যার রামকোট, রাম মন্দির, তুলসী স্মারক ভবন, রাম কথা পার্ক, দশরথ মহল, কনক ভবন, রাজদ্বার মন্দির, রাম কি পায়দি তথা সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত ঘাটগুলো ইত্যাদি। বলা হয় এই পবিত্র ভূমি দর্শন, স্পর্শন ও প্রদক্ষিণ করলে আধ্যাত্মিকতার সীমা অতিক্রম করার মত স্বর্গীয় অনুভুতি লাভ করা যায়।
২. চিত্রকূট পর্বত
রামায়নের বর্ণনানুসারে দশরথ নন্দন শ্রী রামচন্দ্র ও মাতা সীতা তাদের ১৪ বছরের বনবাসকালীন সময়ের ১১ বছর বনবাস করলেছিলেন এই চিত্রকূট পর্বতের বনে। চিত্র শব্দের আক্ষরিক অর্থ সুন্দর এবং কূট শব্দের অর্থ পর্বত। এই সুন্দর পর্বত তথা চিত্রকূট পর্বতেই ঘটেছিল রাম ও ভরতের বিখ্যাত মিলাপ। অর্থাৎ ভ্রাতা ভরত এই চিত্রকূটে এসে দাদা রামকে অযোধ্যায় ফিরে আসার জন্য আবেদন করেছিলেন তাঁর অশ্রুজল দিয়ে। কিন্তু মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র তাঁর ভ্রাতা ভরতকে বুঝিয়ে এবং শান্তনা দিয়ে পুনরায় অযোধ্যায় ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এর পর থেকেই রাজা ভরত ভ্রাতা রামের পাদুকাযুগল সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করেছিলেন রামের প্রত্যাবর্তন না হওয়া পর্যন্ত। বর্তমানে সেই চিত্রকূট পর্বত ভারতের মধ্য প্রদেশ রাজ্যের সাতনা জেলার একটি নগর পঞ্চায়েত-শাসিত শহর। রামায়ণের যুগের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এখানে আজো দাঁড়িয়ে আছে রামঘাট এবং ভরত মিলাপ মন্দির। রামায়ণের বর্ণনা থেকে জানা যায় এই রামঘাটের পবিত্র এবং সুশীতল জল দিয়ে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এবং মাতা সীতা স্নান করতেন। এছাড়াও ভরত মিলাপ নামক মন্দিরটি সেই পুণ্যস্থানে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে শ্রীরামচন্দ্র ও তার ভ্রাতা ভরতের মিলাপ ঘটেছিল।
৩. প্রায়াগ
রামায়ণ অনুসারে জানা যায়, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, মাতা সীতা এবং প্রাণের ভাই শ্রীলক্ষ্মণকে সাথে নিয়ে পিতৃসম্মান রক্ষার্থে যাত্রা করেছিলেন বনবাসে। কিন্তু অযোধ্যাবাসী কিছুতেই তাদের মাথার তাজ তথা শ্রীরামচন্দ্রকে ছাড়তে রাজি নন। তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারাও তাদের প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের সাথে বনবাসে যাবেন। স্বয়ং মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে নিরস্ত করতে পারেননি। অগত্যা রামচন্দ্র স্ত্রী, ভ্রাতা ও অযোধ্যাবাসীকে নিয়ে চলে এলেন রাজ্যের শেষ প্রান্তে তথা প্রয়াগে। সেখান থেকে গঙ্গা পার হওয়ার আগে ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রম কুটিরে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করেছিলেন তাঁরা। অবশেষে অযোধ্যাবাসী রাতের অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়লে রামচন্দ্র এখান থেকে প্রস্থান করে অরণ্যে প্রবেশ করেন। গঙ্গা নদীর পাড়ে তাঁদেরকে অশ্রুসিক্ত বিদায় জানিয়েছিলেন রাজ-সারথী সুরথ।
পৌরাণিক সেই প্রয়াগ নামক স্থানটি আজ নতুন করে পরিচিতি পেয়েছে এলাহাবাদ নামে। এই শহরের গুরুত্ব, পবিত্রতা ও প্রাচীনত্বের প্রমান মেলে রামায়ণ, মহাভারত সহ অসংখ্য পুরাণ ও ভারতীয় ধর্মগ্রন্থে। এই প্রয়াগেই মিলন ঘটেছে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর যা ত্রিবেণীসঙ্গম তীর্থ নামে পরিচয় পেয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে। পুরাণমতে, এই ত্রিবেণীতেই সরস্বতী নদী অন্তঃসলিলা অবস্থায় যমুনার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া এখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষন হচ্ছে কুম্ভমেলা।
৪. জনকপুর বা মিথিলা
রামায়নের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হচ্ছে মিথিলা বা জনকপুর। এস্থানেই মাতা লক্ষ্মীর অবতার তথা দেবী সীতা মাতা বসুমতির বক্ষ বিদীর্ণ করে উঠে এসেছিলেন রাজর্ষি জনকের হালে। মাতা সীতার এই জন্মস্থানটি আজ পরিচিত সীতামারহি নামে। এরপর জনক রাজাই তাকে কন্যারূপে লালন পালন করেছিলেন এবং হরধনুকে ধনুর্গুণ চড়ানোর শর্তে বিবাহ দিয়েছিলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের সাথে। বলাই বাহুল্য এই জনকপুরীতেই মহা ধুম ধামের সাথে বিবাহ হয়েছিল রাজা দশরথের চার পুত্র ও জনক রাজা ও তাঁর ভ্রাতার চার কন্যার।
রামায়ণের সেই জনকপুর আজ ভারতের বিহার ও নেপালের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। ঐতিহাসিকভাবে মিথিলাঞ্চল নামেও বহুল পরিচিত এই জনকপুর যা মূলত মিথিল সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। শ্রীরামচন্দ্র ও মাতা সীতার পূণ্য স্মৃতির স্মরণে অসাধারন সব কারুকার্য সম্বলিত মন্দির রয়েছে এই জনকপুরে। বিশাল চত্বর নিয়ে নির্মিত মন্দির কমপ্লেক্স জুড়ে জানকীমন্দির, রাম-সীতার বিবাহ বাসর ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য পৌরাণিক মন্দির। তবে জনকপুরের সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে। এদিনটি রাম-সীতার বিবাহ বার্ষিকী বা বিবাহ-পঞ্চমী হিসেবে পালিত হয় সমস্ত নেপাল জুড়ে। আজও এখানে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে অযোধ্যা থেকে আসে বিবাহের বারাত । মহা সাড়ম্বরে পালিত হয় বিবাহ-বার্ষিকী। তাছাড়া বৈশাখের শুক্লা নবমীতে সীতার জন্মোৎসব পালিত হয় মহাসমারোহে।
৫. দণ্ডকারণ্য
সমগ্র রামায়ন জুড়ে দণ্ডকারণ্য নামক জঙ্গলটির গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত দণ্ডক রাজ্যের রাজা কোন এক মুনির রোষানলে পড়ে অভিশপ্ত হন এবং ফলশ্রুতিতে তার সমগ্র রাজ্য এক বিরাট বনভূমিতে পরিনত হয়। এই বিশাল বনভূমি পরিচিতি পায় দণ্ডকারণ্য নামে। গোদাবরী ও নর্দমার মধ্যবর্তী এই বিরাট অরণ্যভূষিত অঞ্চলটি নির্জন, দুর্গম ও গভীর বনভূমিবেষ্টিত হওয়ার কারনে সর্বসাধারণের বসবাসের উপযোগী ছিল না। পক্ষান্তরে মুনি ঋষিগণ, বেপরোয়া রাক্ষসগণ ও শ্বাপসংকুল জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ ছিল এই অরণ্যভূমি।
অযোধ্যা থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর এই দণ্ডকারণ্যে পর্ণকুটীর বেঁধে দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন রাম-সীতা এবং লক্ষ্মণ। এই অরণ্যে যে সকল শান্তি প্রিয় মুনি ঋষিরা বসবাস করতেন তাদের যজ্ঞ পণ্ড করতে সর্বদাই নিয়োজিত ছিলেন খড় ও দুশন নামের দুই ভয়ংকর রাক্ষস। সম্পর্কে এরা রাবণের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। অবশেষে মুনি-ঋষিদের অনুরোধে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন রাম এবং লক্ষ্মণ। সেই ভয়ানক যুদ্ধের সময় শ্রীরামচন্দ্রের মনোহর অবয়ব এবং রণনৈপুণ্যে মোহিত হয়েছিলেন রাবণের ভগিনী সূর্পণখা। এবং বলাই বাহুল্য এই দন্ডকারণ্যেই শ্রীরামকে প্রণয় নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন সূর্পণখা। দুধসাগর জলপ্রপাত বেষ্টিত এই দণ্ডকারণ্য আজও পর্বতময় ও দুর্গম অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এই ভারতবর্ষের বুকেই। মৎস্যকুণ্ড, শবরী, ইন্দ্রাবতী, বংশধারা, নাগবল্লী ইত্যাদি নদীর অববাহিকায় এবং উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র ব্যাপী বিস্তৃত হয়ে আজও তা জানিয়ে যাচ্ছে রামায়ণের যুগের স্পষ্ট ইতিহাস।
৬. পঞ্চবটী
পাঁচটি বট বৃক্ষের সমাহারকে বলা হয় পঞ্চবটী। রামায়নের যুগে এই বনে বিশালাকৃতির পাঁচটি বট বৃক্ষের অবস্থান থাকার কারনে এই বনের নামকরন করা হয়েছিল পঞ্চবটী। আবার অন্যমতে অশ্বত্থ-বট-বিল্ব-আমলকী ও অশোক-এই পাঁচ প্রকার বৃক্ষের অরণ্যকে বলা হয় পঞ্চবটী। রামায়ণের অরণ্যকাণ্ড অধ্যায়টি সম্পূর্ণভাবে সংগঠিত হয়েছিল এই পঞ্চবটি বনে। পঞ্চবটি বনের ঘটনা বদলে দিয়েছিল রাম-সীতা ও লক্ষ্মণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। রামের থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সূর্পণখা প্রণয় নিবেদন করেছিলেন লক্ষ্মণকে। কিন্তু লক্ষ্মণের পক্ষ থেকেও সুর্পনখার কপালে জুটেছিল প্রত্যাখ্যান। এই অপমানে সূর্পনখা ক্রোধান্বিত হয়ে আক্রমন করে বসেন দেবী সীতাকে। আর তখনই রাক্ষস কন্যা এবং রাবণ সহোদরা সূর্পনখার নাক কেটে দেন দশরথ নন্দন লক্ষ্মণ। ঘটনার পরম্পরায় দাদা রাবণের সমীপে নালিশ জানিয়েছিলেন বোন সূর্পনখা আর সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই এই পঞ্চবটী বন থেকে ছদ্মবেশে সীতাকে হরণ করেছিলেন লংকাধীশ রাবণ।
বর্তমানে রামায়ণের সেই পঞ্চবটী দৃশ্যমান বটে তবে তা আর কোন গহীন অরণ্য নয় বরং নাম পালটে এক ঝা চকচকে আধুনিক শহরে পরিনত হয়েছে পঞ্চবটী যার নাম নাসিক। এই নাসিকেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রামায়ণের যুগের পবিত্র সীতা গুহা, কাল রাম মন্দির, রামকুণ্ড প্রভৃতি তীর্থ। উল্লেখ্য এই রামকুণ্ডই হচ্ছে পঞ্চবটির সেই জায়গা যেখানে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র স্নান করতেন। এছাড়াও এখানেই দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত কপলেশ্বর শিব মন্দির যা শিবভক্তদের জন্য ভগবান শিবের স্পর্শধন্য একটি শৈব তীর্থ।
৭. কিষ্কিন্ধ্যা
দেবী সীতাকে রাবণ হরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর শোকে বিহব্বল রামচন্দ্র ভ্রাতা লক্ষণকে নিয়ে ছুটলেন ঘরের লক্ষ্মীর সন্ধানে। পথিমধ্যে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল পক্ষীরাজ জটায়ুর। এই জটায়ুর পরামর্শেই কিষ্কিন্ধ্যা অভিমূখে চললেন দুই দশরথ নন্দন। রামায়ণের যুগে কিষ্কিন্ধ্যা ছিল বানরের রাজ্য । মাতা সীতাকে হরণকালে পুষ্পক বিমান থেকে তিনি তাঁর পরিহিত অলংকার ফেলে গিয়েছিলেন সমস্ত পথ জুড়ে। কিষ্কিন্ধ্যার বানরগণ সেই অলংকার কুড়িয়ে দেখালেন শ্রীরামচন্দ্রকে। দেবী সীতার সেই অলংকার চিনতে একটুও অসুবিধা হয় নি রাম-লক্ষণের। এখন সীতা উদ্ধারের জন্য প্রয়োজন সেনাবিহিনীর। কিন্তু বানর রাজ্যে তখন তুমুল অশান্তি। কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালী ও তাঁর নিজের সহোদর ভ্রাতা সুগ্রীবের মধ্যে তখন তীব্র দন্দ্ব দৃশ্যমান। এরপর শ্রীরামচন্দ্র সুগ্রীবের পক্ষ নিয়ে বালীকে বধ করলেন এবং সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা নিযুক্ত করলেন। পরবর্তীতে সুগ্রীবের বিশাল বাণর সেনা নিয়ে লঙ্কা আক্রমন করেছিলেন রাম-লক্ষণ। এছাড়াও এই কিষ্কিন্ধ্যা কান্ডের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে এখানেই তথা ঋষ্যমুখ পর্বতে নিজের পরম ভক্ত হনুমানের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল শ্রীরামচন্দ্রের।
রাম-লক্ষণ, সুগ্রীব-বালী ও হনুমানের স্মৃতি বিজড়িত কিষ্কিন্ধ্যা নগরীটি আজ চিহ্নিত হয়েছে কর্ণাটকের হাম্পি এবং এর সন্নিকটে অবস্থিত তুঙ্গভদ্রা নদীর আশেপাশের অঞ্চলটি। রাম-হনুমানের মহামিলনের এই স্থলটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ।
৮. রামেশ্বরম এবং রামসেতু
মাতা সীতাকে উদ্ধার করার জন্য শ্রী রামচন্দ্রের সঙ্গে যোগ দিলেন কিষ্কিন্ধ্যার বানর বাহিনী। সীতাদেবী ও তাঁকে অপহরণকারীর অবস্থান চিহ্নিত করার পর শ্রীরামচন্দ্র ও তাঁর বানর সেনারা দ্রুতপদে চলতে লাগলেন লঙ্কা অভিমুখে। শত সহস্র দূর্গম রাস্তা পার হয়ে অবশেষে তাদেরকে থামতে হল পাম্বান দ্বীপের রামেশ্বরম নামক স্থানে। কারন সামনে আর কোন কোন স্থলপথ নেই, আছে তীব্র ঢেউয়ের গর্জনে উন্মত্ত সাগর। আর সাগরের ওপারেই অশোক কাননে শ্রীরামচন্দ্রের অপেক্ষায় অধীর হয়ে বসে আছেন দুঃখিনী মাতা সীতা। কিন্তু এই অগণিত বানর সেনা নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া কিভাবে সম্ভব? তবে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেনও সেই বানর সেনারাই। তাঁরা পাথরের ওপরে শ্রীরামের নাম লিখে ফেলে দিলেন সমুদ্রে। আর রাম নামের মহিমায় নিজের ধর্ম বিসর্জন দিয়ে সমুদ্রের অথৈ জলে ভাসতে থাকল পাথরগুলো। ক্রমান্বয়ে পাম্বান দ্বীপ থেকে মান্নার দ্বীপের তালাইমান্নার পর্যন্ত পৌছে গেল ভাসমান পাথরের সেই সেতু।
আপনারা অনেকেই জানেন, সেদিনের সেই ভাসমান সেতুটি মহাকালের প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় নি। কিছুকাল আগে নাসার স্যাটেলাইট থেকে তোলা একটি ছবিতে দৃষ্টি আটকে যায় বিজ্ঞানীদের। ছবিতে দেখা যায় রামেশ্বরম থেকে তালাইমান্নার পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ক্ষীণ রেখা যা মূলত চুনাপাথর দিয়ে নির্মিত। গবেষনায় নেমে পড়েন পুরাতাত্ত্বিকরাও। বের হয়ে আসে এক আশ্চর্যজনক তথ্য, যেখান থেকে জানা যায় এটি মূলত একটি সেতুর ধ্বংসাবশেষ। এবং এই সেতুতে ব্যাবহৃত চুনাপাথর এবং বালি পরীক্ষা করে জানা গেছে এগুলো আসলে প্রায় ৭০০০ বছরের পুরোনো। অর্থাৎ, শ্রীরামচন্দ্র ও তাঁর বানর সেনাদের দ্বারা নির্মিত সেই রাম সেতুকেই নির্দেশ করে সমস্ত গবেষনার ফলাফল। একারনেই রামেশ্বরম ও তৎসংলগ্ন রামসেতুটি আজ রামায়নের যুগের স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই ভারতবর্ষের বুকে।
৯. লঙ্কা
রামায়ণ অনুসারে জানা যায়, অসুর রাজা রাবণের দ্বীপ দুর্গের রাজধানী হল লঙ্কা। রাবণের জীবনের সমস্ত পাপ-পূণ্যের সাক্ষী এই সোনার নগরী। এখানেই সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক স্মরণীয় যুদ্ধ যার নাম রাম-রাবণের যুদ্ধ। এই মহাযুদ্ধে রামের হাতে পরাজিত ও নিহত হন লঙ্কাধিপতি রাবণ। মুক্ত হন মাতা সীতা আর সেই সাথে রাবণের দুঃশাসন থেকে মুক্ত হন লংকাবাসীও। লঙ্কার নতুন অধিপতি হিসেবে রাজ্যাভিষেক হয় রাবণেরই সহোদর ভ্রাতা বিভীষনের। তবে সেই প্রাচীন লঙ্কাপুরীকে আজ নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আপনারা সকলেই জানেন পৌরাণিক সেই লঙ্কানগরীর আজকের নাম শ্রীলংকা যা আজ ভারতবর্ষের বাইরে অবস্থিত একটি আলাদা রাষ্ট্র।
১০. অশোকবন
মাতা সীতার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়গুলো যেখানে কেটেছে সে স্থানটির নাম অশোক কানন। দুরাচারী লঙ্কাপতি মাতা সীতাকে অপহরন করে এই বনেই বন্দী করে রেখেছিলেন। কিংবদন্তী বলছে, মাতা সীতা রাবণের প্রাসাদে থাকতে অস্বীকার করেছিলেন এবং এই বনের অশোক গাছের নীচে নিজের বন্দী জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। সেই কারনে এই বনের নাম হয়েছিল অশোক কানন বা অশোক বন। কিন্তু জানেন কি, রামায়ণের অন্যান্য অনেক নিদর্শনের মত অশোক বনটিও আজও দৃশ্যমান। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী রামায়ণের সেই অশোক কাননটি আজ হাকগালা বোটানিক্যাল গার্ডেন নামে পরিচিতি পেয়েছে শ্রীলংকায়। তবে আজ অশোক কানন না থাকলেও মাতা সীতার স্মৃতি হিসেবে এখানে আজও দেখা যায় সীতা আম্মান কোভিল নামের মন্দিরটি।