You are currently viewing আরতি কি ও কেন করা হয়? আরতির উপকরণ || সময় || নিয়ম || কারন, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য || Aarti in Hinduism

আরতি কি ও কেন করা হয়? আরতির উপকরণ || সময় || নিয়ম || কারন, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য || Aarti in Hinduism

যেকোন পুজো পার্বণে উচ্চস্বরে গান বাজনা, ডিজে পার্টি বা মাদকের মাদকতায় উদ্দাম নৃত্যের আড়ালে যেন অসহায় হয়ে পড়েছে অঞ্জলী,আরতি বা ধুনুচি নাচের মত সনাতনী সংস্কৃতিগুলো। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, অঞ্জলী কেন প্রদান করা হয়? কেন দেবতার সামনে নানা উপাচারে দেবারতি করা হয়? আসলে আমরা অনেকেই হয়ত এগুলো নিয়ে ভাববার মত সময়ই পাই নি কখনো। কিন্তু হে অমৃতের সন্তানগণ, আমাদের এই সমৃদ্ধ সনাতনী সংস্কৃতিতে প্রতিটি নিয়ম, কাজ বা বিধানের পারমার্থিক গুরুত্ব রয়েছে সার্বজনীন কল্যানের উদ্দেশ্য। আরতির ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। আজকের প্রজন্ম আরতির মত বিষয়গুলো দেখতে, পালন করতে বা জানতে অনাগ্রহী এবং এর অন্যতম কারন হচ্ছে সঠিকভাবে শাস্ত্র অধ্যয়ন না করা। তবে হ্যাঁ, আরতি বিষয়টিকে যদি একটু সময় নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন, তাহলে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এই কর্মের কি অপরিসীম গুরুত্ব।

ধুনুচি নৃত্য
ধুনুচি নৃত্য

প্রিয় দর্শক, আসুন আমরা আমাদের শেকড়ের সংস্কৃতিকে জানি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও তা সম্পর্কে অবহিত করি। আজ আমরা জানবো-

  • আরতি কি?
  • আরতি করার উপাচারগুলো কি কি?
  • আরতির সাধারণ উপচারগুলোর মাহাত্ম্য কি?
  • দিনে কখন ও কতবার আরতি করতে হবে?
  • আরতি করার প্রক্রিয়া বা নিয়ম কি?
  • এবং আরতি করার কারন, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য কি?

আশা করি এই আয়োজনে আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকবেন এবং কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জয় শ্রীকৃষ্ণ লিখে কমেন্ট করবেন।

ধুনুচি নাচ
ধুনুচি নাচ

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক আরতি কি?

“আ” অর্থে ব্যাপ্তি এবং “রতি” অর্থে প্রেম, ভালাবাসা ও অনুরাগ। অর্থাৎ, যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রীভগবানের নিজের প্রীতি বর্ধিত হয় অর্থাৎ তিনি ভক্তের প্রতি প্রসন্ন বা সন্তুষ্ট হন এবং ভগবানের প্রতিও ভক্তের প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, ভক্তি ও অনুরাগ বৃদ্ধি পায় তাকে আরতি বলা হয়। আবার দেবের আরতিকে অরাত্রিক বা নিরাজন বলেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অতএব, আরতি ভগবানের প্রতি ভক্তের অন্তরের গভীর ভাবভক্তি পূর্ণ একটি মহা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। ভগবানের প্রতি ভক্তের অন্তরের ভাব ও ভক্তির মাধ্যমে, আকুলতা-ব্যাকুলতা প্রকাশের মাধ্যমে ও সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের মাধ্যমে, আরতির অনুষ্ঠান সার্থক ও সুন্দর হয়ে ওঠে। তবে ভাব ও ভক্তি শূন্য আরতি কেবল নাচানাচি বা অঙ্গবিক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই ওরকম আরতির মাধ্যমে ভগবানের আশীর্বাদ প্রাপ্তির পরিবর্তে ভগবানকে রুষ্ট করার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।

শাস্ত্রীয় পুজো যদি বিধিহীন ও মন্ত্রহীন হয়, তবে ভক্তিপূর্ণ আরতির মধ্য দিয়ে তা সম্পূর্ণতা লাভ করে। এ প্রসঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেব, দেবী পার্বতীকে বলেছেন-

“মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং যৎকৃতং পূজনং হরেঃ।

সর্ব্বং সম্পূর্ণতামেতি কৃতে নীরাজনে শিবে ॥”

অর্থাৎ, হে দেবী পার্বতী, শ্রীভগবানের পুজো যদি মন্ত্রহীন ও ক্রিয়াহীন হয়, তবে নীরাজন বা আরতির মাধ্যমে তা সম্পূর্ণতা লাভ করে।

তাছাড়া দেবদেবীর আরতি  করলে, দেবদেবীর পুজোর  মধ্যে যদি কোন ত্রুটি থেকে যায় তা দূর হয় এবং পুজো  ফলবতী  হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর স্বমুখে বলেছেন, “দৈনন্দিন পূজারতির ভিতর দিয়েই আমার শক্তি সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। গুরুশক্তি লাভের এটি একটি সহজ ও শ্রেষ্ঠ উপায়।”

আরও পড়ুনঃ  শনির সাড়ে সাতি থেকে নিশ্চিত মুক্তি
মঙ্গল আরতি
মঙ্গল আরতি

এবার আরতির সাধারণ উপচারগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ধূপ, পঞ্চপ্রদীপ, জলশঙ্খ, চামর, বাদ্যযন্ত্র, ত্রিশূল ও পুষ্প। সাধারণত এই ৭টি উপচার দ্বারা শ্রীভগবানের দৈনন্দিন পূজারতি করা হয়। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ শুভদিনে বা উৎসবাদিতে আরও বেশ কিছু উপচার দিয়েও আরতি করা হয়। এগুলো হচ্ছে কর্পূর, ঝাড়প্রদীপ, মোমবাতি, তরবারি, সুদর্শন চক্র, আম্রপল্লব, খড়গ, বস্ত্র ও পঞ্চফল ইত্যাদি । তবে জেনে রাখা ভালো, শ্রীভগবানের এই আরতির উপাদানগুলো স্থান, কাল, পাত্র বা মতভেদে ভিন্ন ভিন্নও হতে দেখা যায়। যাইহোক, আজ আমরা দেবারতিতে ব্যাবহৃত কিছু সাধারন উপাচারের গুরুত্ব জানতে চেষ্টা করব।

আরতি প্রদীপ
আরতি প্রদীপ

(১) ধূপ

দেবারতিতে যে ধূপ অর্পণ করা হয় তা মূলত ক্ষিতি বা মৃত্তিকা এবং গন্ধের প্রতীক। ধূপের মাধ্যমে আরতি করার অর্থ হল নাক অর্থাৎ নাসিকা ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রার্থনা জানানো। এই ইন্দ্রিয় বাসনা বলতে বহির্জগতের গন্ধ তথা নানা প্রকার সুগন্ধি কস্মেটিক দ্রব্যাদিকে বোঝানো হয় থাকে।পক্ষান্তরে পবিত্র পুজোর ধূপ, ধূনো, কর্পূর প্রভৃতির গন্ধে যাতে খুশি থাকতে পারি সেই পার্থনা জানানো হয় সদগুরুর নিকট।

ধূপ
ধূপ

(২) পঞ্চপ্রদীপ

পঞ্চপ্রদীপ তেজ বা অগ্নির প্রতীক। পঞ্চ প্রদীপ দিয়ে আরতির মাধ্যমে, চক্ষু ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা তথা বহির্জগতের রূপ দর্শন যেমন- অচিত্র, কুচিত্র, খারাপ দৃশ্য ইত্যাদির যাতে আকর্ষণ মুক্ত হতে পারি সেই প্রার্থনা জানানো হয় সদ্গুরুর নিকট। পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে দেবের কাছে আরও অনুরোধ জানানো হয়, “হে পূজ্য, তোমারই রূপ দর্শনে যেন আমি ধন্য হতে পারি।” এছাড়াও ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করলে নিজের মনের অন্ধকার নাশ হয় এবং সত্ত্বগুণের আলোকে আলোকিত হয় আমাদের তমসাচ্ছন্ন মন।

পঞ্চপ্রদীপ
পঞ্চপ্রদীপ

(৩) জলশঙ্খ

দেবারতিতে ব্যাবহৃত জলশঙ্খ হচ্ছে অপ বা জলের প্রতীক এবং রসের প্রতীক। জল শঙ্খ দিয়ে আরতি করে সদ্গুরুর নিকট জিহ্বা ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানানো হয়। উল্লেখ্য জিহ্বা ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা হচ্ছে মাছ, মাংস প্রভৃতি তামসিক খাদ্য দ্রব্য এবং বিভিন্ন প্রকার মাদক দ্রব্যের প্রতি আসক্তি। জলশঙ্খ দিয়ে আরতি করার সময় দেবের প্রতি আরও আকুতি জানানো হয়, “হে ঠাকুর, তোমার প্রতি নিবেদিত পবিত্র প্রসাদ গ্রহণ করে আমি যেন আমার জীবনকে ধন্য করতে পারি।”

জলশঙ্খ
জলশঙ্খ

(৪) চামর বা পাখা

আরতি কালে আপনারা চামর ও পাখা দিয়েও দেবতার আরতি করতে দেখে থাকবেন। এই চামর বা পাখা হচ্ছে মরুৎ বা বায়ুর প্রতীক এবং একইসাথে স্পর্শ সুখেরও প্রতীক। এই উপাচারে দেবারতি করার অর্থ হচ্ছে দেবের নিকট ত্বক ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা বা আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার আবেদন জানানো। আপনারা জানেন  ত্বক ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা হচ্ছে নর-নারীর একে অপরের প্রতি কু-বাসনা নিয়ে শরীরস্পর্শ করাকে বোঝায়। তাছাড়া চামর বা পাখা দিয়ে আরতি করার সময় আরও প্রার্থনা করতে হয়, “হে ঠাকুর, তোমার শ্রীচরণ অভিষেক করে, স্পর্শ করে, আমি যেন আমার জীবনকে ধন্য করতে পারি।

চামর
চামর

(৫) বাদ্যযন্ত্র

আরাত্রিকে যে বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্রের শব্দ করা হয় তা মূলত ব্যোম বা আকাশের প্রতীক। আরতির এপর্যায়ে ঘণ্টা, ঢাক, কাসর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আরতি করার হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে সদ্গুরুর নিকট কর্ণ ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা ও কুঅভ্যাস থেকে মুক্ত হওয়ার প্রার্থনা জানানো হয়। এখানে কর্ণ ইন্দ্রিয়ের ভোগ বাসনা ও কুঅভ্যাস হচ্ছে বহির্জগতের খারাপ শব্দ, পরনিন্দা, সমালোচনা, কু-সঙ্গীত প্রভৃতি শোনার আসক্তি। উপরন্তু বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে আরতি করে দেবতার কাছে আরও প্রার্থনা করা হয়, “হে ঠাকুর, তোমার পবিত্র ভজন সঙ্গীত শুনে, তোমার গুণগান শুনে, যেন জীবনকে ধন্য করতে পারি।”

আরও পড়ুনঃ  সরস্বতী পূজায় কি পড়াশোনা করা নিষিদ্ধ? Why Studying Prohibited During Saraswati Puja?
ঢাক
ঢাক

(৬) ত্রিশূল, তরবারি, চক্র

আরতি বা নিরাজনের সময় আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে ত্রিশূল, তরবারি, চক্র প্রভৃতি দিয়ে আরতি করার উদ্দেশ্য কি? আসলে এগুলো শক্তির প্রতীক। তাছাড়াও আমাদের ভিতর ও বাইরে লুকানো শত্রদের দমনের জন্য যে অস্ত্র ব্যাবহার করা হয় এগুলো মূলত তারই প্রতীক। তাই ত্রিশূল বা অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে আরতি করার মাধ্যমে আমাদের ভেতরের শত্রু তথা কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি রিপু ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়াসক্তি বা ভোগ বিলাসের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানানো হয়। সেই সাথে বাইরের শত্রু অর্থাৎ দুষ্ট, দুর্বৃত্ত, অত্যাচারীদের হাত রক্ষা পেতে দেবতার এই অস্ত্রগুলোর সাহায্য প্রার্থনা করা হয়।

ত্রিশূল, খড়গ এবং চক্র
ত্রিশূল, খড়গ এবং চক্র

(৭) পুষ্প বা ফুল

পুষ্প বা ফুল ভক্তি ও আত্মনিবেদনের প্রতীক। তাই পুষ্প পাত্র দিয়ে আরতি নিবেদনের মাধ্যমে শ্রীগুরু ভগবানের নিকট প্রার্থনা জানাতে হবে “হে আমার প্রাণের ঠাকুর, আমার এই জীবন কুসুমটিও তোমারই শ্রীপাদপদ্মে ভক্তি অর্ঘ্য রূপে উৎসর্গ করলাম। তুমি কৃপা পূর্বক গ্রহণ করে এই দীন সন্তানকে আশীর্বাদ করো। যেন আমার জীবনকে ফুলের মত পবিত্র করতে পারি অর্থাৎ সৎ চরিত্রবান হতে পারি।” এছাড়াও সুগন্ধি ফুল দিয়ে আরতি করলে আরতিকারী ভক্তের মন ফুলের মতো সুন্দর হয়। তিনি জগৎ সংসারের সকলের কাছে ফুলসৌরভের মতোই প্রিয় হয়ে ওঠেন।

ফুল বেলপাতা
ফুল বেলপাতা

প্রিয় দর্শক, আমরা আরতির উপকরণগুলোর মাহাত্ম্য তো জানলাম। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না দিনে কখন বা কতবার দেবের আরতি বা নিরাজন করতে হবে। মূলত দেবের আরতি করার সময় দিনে চারবার।

  • প্রথমত, সমস্ত দেব দেবীর পুজোর শেষে।
  • দ্বিতীয়ত, সকালে সূর্য উদয়ের আগে মঙ্গল আরতি ।
  • তৃতীয়ত, মধ্যাহ্ন কালে অর্থাৎ দুপুর বেলা মধ্যাহ্ন আরতি।
  • এবং চতুর্থত, সন্ধ্যায় সন্ধ্যা আরতি। সাধারণত সূর্য অস্ত যাবার পরে বা আকাশে তারা দেখা দেওয়ার পর সন্ধ্যা আরতি করা হয়ে থাকে।
দুর্গা আরতি
দুর্গা আরতি

এবার আরতি করার নিয়ম জানবার পালা।

  • আপনারা জানেন আরতি সুনির্দিষ্ট নিয়মে না করলে তা কেবল নাচানাচি বা অঙ্গবিক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই এবার আমরা জানবো আরতি করার নিয়ম।তবে এই নিয়ম অঞ্চলভেদে ভিন্নও হতে পারে।
  • প্রথমত, আরতি শুরু করার আগে আরতিকারীকে সর্বপ্রথম আচমন করে নিতে হবে।
  • দ্বিতীয়ত, তিনবার শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে আরতির আরম্ভের সংকেত জ্ঞাপন করতে বের। এরপর পঞ্চপাত্র থেকে জল নিয়ে শঙ্খটি তখনই ধুয়ে রাখতে হবে।
  • তৃতীয়ত, আরতির থালা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। এরপর এর উপর স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে ঘি ও কর্পূর দেওয়া একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে হবে।  খেয়াল রাখতে হবে, এই প্রদীপ প্রতিদিন যাতে পরিষ্কার করা হয় এবং প্রদীপ যাতে ভাঙা বা বাঁকা না হয়।
  • চতুর্থত, সব দেবদেবীর পুজোর নিয়ম যেমন আলাদা, তেমনি আরতিরও নিয়ম ভিন্ন। যেমন, বিষ্ণুরদেবের আরতির সময়, আরতির থালায় হলুদ ফুল, দেবী বা হনুমানজীর আরতির সময় লাল ফুল, মহাদেবের আরতির সময় ফুল, বেল পাতা এবং গণেশজীর আরতি থালায় ফুল ও দূর্বাও থাকতে হবে।
  • পঞ্চমত, আরতি করার বিভিন্ন উপকরণগুলো নির্দিষ্ট সংখ্যকবার দেবের শরীরের নির্দিষ্ট স্থানসমূহে ঘোরাতে হয়। এই সংখ্যা সাধারণত বিজোড় হয় যেমন ৫ বার, ৭ বার, ৯ বার ইত্যাদি। সাধারণভাবে প্রত্যেক দ্রব্য দেবতার পদতলে চারবার, নাভিদেশে দুইবার, মুখমণ্ডলে তিনবার এবং সর্বাঙ্গে সাতবার ঘোরাতে হয়। উল্লেখ্য, আরতির সময় দেবতার শ্রীচরণ, নাভি, মুখমণ্ডল ও পূত অঙ্গে দৃষ্টিপাত করে আরতি সম্পন্ন করতে হয়। এবং অন্য কোনদিকে তাকানো উচিত নয়।
  • ষষ্ঠত, বসে বসে এবং বাম হাত দিয়ে আরতি করা উচিত নয়। উল্লেখ্য প্রত্যেক উপকরণ দিয়ে আরতি করার সময় বাম হাতে অবশ্যই ঘণ্টাধ্বনি করতে হবে।
  • সপ্তমত, কোনও ব্যক্তি যখন আরতি করেন, সেই সময়ে তাঁকে স্পর্শ করা উচিত নয়।
  • অষ্টমত, শুদ্ধ মন ও পরিষ্কার শরীর নিয়ে আরতি করা উচিত। আরতির সময় আরতিকারীর কাপড়ও পরিষ্কার রাখতে হবে। তাছাড়া আরতি করার সময় মাথা খোলা রাখা উচিত নয়। মাথায় দোপাট্টা বা রুমাল ব্যাবহার করা নির্দেশিত।
আরও পড়ুনঃ  অক্ষয় তৃতীয়া কি? সৌভাগ্য আনতে অক্ষয় তৃতীয়া কেন ও কিভাবে পালন করবেন?
দুর্গাপূজার আরতি
দুর্গাপূজার আরতি

এবার আরতি করার কারন, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য জেনে নেওয়ার পালা।

শাস্ত্রে বলা হয়েছে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চ মহাভূত থেকে। সেই পঞ্চ মহাভূত ও তাদের পঞ্চবিষয় এবং যে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা জীব বিষয় ভোগ করে সেগুলো হল – পঞ্চ মহাভূত অর্থাৎ  ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ বা জল, তেজ বা অগ্নি, মরুৎ বা বায়ু এবং ব্যোম বা আকাশ। পঞ্চ বিষয় হচ্ছে গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও  শব্দ। এবং আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় হচ্ছে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ও ত্বক। এইভাবে এই সমস্ত উপচারে আরতির মাধ্যমে শব্দ,স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চ বিষয়ের প্রতি পঞ্চ ইন্দ্রিয় তথা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ও ত্বকের আসক্তি দূর করে শ্রীভগবানের চরণে আত্মনিবেদন করতে হয়। তখনই তাঁর প্রতি যথার্থ প্রেম-প্রীতি, অনুরাগ-ভালবাসা জাগ্রত হয়ে সাধক জন্ম-জন্মান্তরীন বন্ধন হতে মুক্ত হয়। আর তখনই সাধক মহামুক্তি বা পরাশান্তি লাভে ধন্য ও কৃতার্থ হয়। এছাড়াও, পঞ্চ মহাভূত থেকেই যেহেতু জগতের সমস্ত কিছু উৎপন্ন হয়েছে, সেহেতু এই সমস্ত উপচার দ্বারা আরতি করলে সমস্ত কিছুই শ্রীভগবানের শ্রীচরণে নিবেদন করা হয়।

দেবীর আরতি
দেবীর আরতি
  • স্কন্দপুরাণে আরতির মাহাত্ম্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি আরাধ্য দেবতার মন্ত্র বা পুজো পদ্ধতি না জানলেও ঈশ্বর তাঁর পুজো গ্রহণ করবেন যদি সেই ব্যক্তি পুজোর সময় শুধু দেবারতি করেন।
  • হিন্দুশাস্ত্র মতে, আগুন অতি পবিত্র পুজোপকরণ। তাই পুজো শেষে আরতির সময় বিশেষ ভঙ্গিতে দেবমূর্তির সামনে জ্বলন্ত প্রদীপ ঘোরানো হয়। দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর এটাই সহজতম উপায়। এবং আরতির শিখা কপালে ছোঁয়ানোর মাধ্যমে ভক্ত ঈশ্বরের আর্শীবাদলাভ করেন।
  • শুধু আরতি করা নয়, আরতি দেখাটাও পুণ্যের। আরতির সময় বেজে ওঠে শাঁখ, ঘণ্টা, কাসর ইত্যাদি। সেই শব্দ কানে প্রবেশ করলেই যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে মন ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে। এবং এর ফলে আমরা আমাদের আরাধ্য দেবতার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পাই। আরতির প্রভাবে অন্তরাত্মা ক্রমশ জেগে ওঠে। শরীরে-মনে পজিটিভ এনার্জি তৈরি হয়। এবং একসময় পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে ঈশ্বরকেও অনূভব করা সম্ভব হয়।
  • আরতিতে ব্যবহৃত তুলো, ঘি, কর্পূর, ফুল আর চন্দন শরীর-মন শুদ্ধ ও শান্ত করে। ঘি আর কর্পূর দিয়ে প্রদীপ জ্বালালে চারিদিকে এক অদ্ভূত সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। যা পরিবেশের নেগেটিভ এনার্জি নষ্ট করে পজিটিভ এনার্জির পরিমাণ বাড়ায়।
  • স্কন্দপুরাণ বলছে, কেউ যদি আরতি দর্শন করেন, আরতিতে অংশগ্রহণ করেন বা আরতি দর্শন করতে করতে নৃত্য করেন তাহলে ওই ব‍্যক্তির অনেক বছরের সঞ্চিত সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন। এমনকি ব্রহ্মহত‍্যার মতো জঘন্যতম পাপ থেকে মুক্ত হন তিনি ।
  • তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে, ভগবানের আরতির পুষ্প এবং ধূপের সুগন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করানো বা প্রদীপের আভা গায়ে গ্রহণ করলে জীব তাঁর সমস্ত পাপের বন্ধন থেকে মুক্ত হন ।
  • বরাহপুরাণে বলা হয়েছে, কেউ যদি আরতির সময় শ্রীভগবানের শ্রীবিগ্রহ বা মুখমণ্ডল আনন্দপূর্ণ ভাবে দর্শন করেন, তাহলে শ্রী যমরাজ তাকে দেখে ভয় পান এবং মৃত্যুর পর তার বৈকুণ্ঠধাম প্রাপ্ত হয়। তাই শ্রীভগবানের আরতিতে অংশগ্রহণ, কীর্তন, দর্শন, ও নৃত্য করন আমাদের জন্য অতি আবশ্যক এক কর্ম।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply