‘মান্ধাতার আমল’। বহু পুরনো কোন কিছুকে নির্দেশ করতেই মূলত এই পৌরাণিক বাগধারাটির ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাঙালীর আটপৌরে আলাপচারিতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এই মান্ধাতা আসলে কে? ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের সাথে তাঁর কি সম্পর্ক? কেন তিনি মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম না নিয়ে পিতার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন? রাজা মান্ধাতা ঠিক কত বছর আগে রাজত্ব করতেন? ঋগ্বেদ, রামায়ণ, মহাভারত বা বিষ্ণুপুরাণে কেন তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে? মধ্যপ্রদেশের মান্ধাতা নামক স্থানটির সাথে কি তাঁর কোন সম্পর্ক রয়েছে? কি ভাবছেন? মান্ধাতা নিয়ে এত কিছু? আজ্ঞে হ্যাঁ, একটা সাধারন বাগধারার আড়ালে যে কত বিশাল পৌরাণিক ইতিহাস লুকিয়ে থাকতে পারে তা ভিডিওটি শেষ অব্দি দেখলে বুঝতে পারবেন। তবে হ্যাঁ ভিডিওটি দেখার পর কমেন্ট বক্সে অবশ্যই “জয় শ্রী রামচন্দ্র” লিখে কমেন্ট করবেন।
ইক্ষ্বাকু রাজবংশের বা সূর্যবংশের ১৭তম পুরুষ ছিলেন মান্ধাতা এবং এই একই রাজবংশের ৫০তম পুরুষ ছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সুতারাং রাজা মান্ধাতা ছিলেন শ্রী রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। একারনেই কৃত্তিবাসী রামায়ণে মান্ধাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যদিকে ঋগ্বেদ এর দশম মণ্ডলের ১৩৪ সংখ্যক স্তোত্র মান্ধাতার প্রতিই উৎসর্গীকৃত। আবার মহাভারতের বনপর্বে লোমশ মুনি পাণ্ডবদের কাছে রাজা মান্ধাতার জন্মকাহিনী বর্ণনা করেন। তাছাড়াও বিষ্ণুপুরাণসহ আরও বেশ কিছু পৌরাণিক শাস্ত্রে রাজা মান্ধাতার উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কেন? আসুন জেনে নেওয়া যাক মান্ধাতার জন্ম বৃত্তান্ত।
তখন সত্য যুগ। সেকালে ইক্ষ্বাকু রাজবংশ বা সূর্যবংশের ১৬তম অধিপতি ছিলেন রাজা যুবনাশ্ব। কিন্তু রাজা হয়েও তিনি ছিলেন সন্তানসুখ বঞ্চিত। আর তাই পিতা ডাক শোনার আকুতি তাঁর অন্তরে ধ্বনিত হত সারাক্ষণ। একদা প্বার্শবর্তী জঙ্গলের কিছু মুনি-ঋষিদের দ্বারে দ্বারস্ত হলেন এই রাজা যুবনাশ্ব। আকুতি জানালেন, “হে মুনিবরগণ, আমি এই রাজ্যের রাজা, বিপুল ঐশ্বর্যের অধিপতি আমি। কিন্তু কি হবে সেই বিপুল বিত্ত-বৈভব দিয়ে, যদি না আমার কোন সন্তান না থাকে? হে মান্যবরগন, দয়া করে আপনারা আমাকে মার্গ দর্শন করুন। ” এই বলে মুনি ঋষিদের পদতলে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর এই পিতা ডাক শোনার জন্য যে করুণ আকুতি, তাতে মন গলল ঋষিগণের। তাঁরা যুবনাশ্বকে পরামর্শ দিলেন পুত্র কামনায় একটি যজ্ঞের আয়োজন করতে এবং তাঁরাই সেই যজ্ঞের পৌরহিত্য করবেন।
রাজা যুবনাশ্ব সানন্দে ঋষিদের প্রণাম করে যজ্ঞের আয়োজন শুরু করলেন। নির্ধারিত দিনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বৈদিক মন্ত্রোশ্চারণের মধ্য দিয়ে শুরু হল যজ্ঞ। সারাদিন ধরে চলল সেই যজ্ঞানুষ্ঠান। সন্ধ্যায় যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর ঋষিগণ এ যজ্ঞের ফলস্বরূপ এক কলস মন্ত্রঃপূত জল রেখে গেলেন যজ্ঞবেদীতে। এই জল যুবনাশ্বের স্ত্রী পান করলেই সন্তান সম্ভবা হবেন তিনি। কিন্তু রাজা যুবনাশ্ব এই জলের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। তাই সারাদিনের ক্লান্তি ও পিপাসা নিবারন করতে সেই কলসের জল তিনি নিজে পান করেন।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। ঋষিগণ যুবনাশ্বকে বললেন, “হে রাজন, মহারাণীর জন্য রক্ষিত মন্ত্রঃপূত জল আপনি ভুলবশত পান করেছেন। এখন আপনাকেই গর্ভে সন্তান ধারন করতে হবে। এবং সংগত কারনেই আপনাকে প্রসব যন্ত্রনাও ভোগ করতে হবে।”
অগত্যা রাজা যুবনাশ্ব নিয়তিকে মেনে নিয়েই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন সন্তান জন্মদান করার জন্য। অন্যদিকে দিনে দিনে তাঁর উদরের স্ফীতি জানিয়ে দিল তিনি সন্তান ধারন করেছেন। এভাবে প্রায় একশত বছর গর্ভধারণ করলেন যুবনাশ্ব। এরপর একদিন শরীরের বাম প্বার্শ ভেদ করে তিনি জন্ম দিলেন এক পুত্রসন্তানের। আজকের যুগে যে সিজারিয়ান অপারেশন তা লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বেও যে বর্তমান ছিল তাঁর স্পষ্ট প্রমাণ এই ঘটনা। যাইহোক, অপূর্বদর্শন ও তেজস্বী সেই শিশুপুত্রকে দেখতে উপস্থিত হলেন স্বর্গের দেবতারাও। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই পুত্রসন্তান মাতৃগর্ভজাত নয়, সুতারাং তাঁর জন্য মাতৃদুগ্ধেরও কোন ব্যাবস্থা নেই। সদ্যজাত এই শিশুটি যখন ক্ষুধায় চিৎকার করে উঠল তখন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি তাঁর তর্জনী আঙ্গুলটি শিশুটির মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, “মাং ধাস্যতি”। এর অর্থ হচ্ছে আমাকে পান করো। উল্লেখ্য, ইন্দ্রের তর্জনি আঙ্গুলটি ছিল অমৃতক্ষরা। অর্থাৎ, সেটি দিয়ে অমৃত ঝরত। ইন্দ্রের সেই আঙুলের অমৃত পান করেই পুষ্ট হয়ে উঠল শিশুটি। এবং দেবরাজ ইন্দ্রের বলা মাং এবং ধস্যতি শব্দবন্ধের মাধ্যমে শিশুটির নাম রাখা হয় মান্ধাতা।
কালক্রমে এক তেজস্বী পুরুষ হয়ে উঠলেন মান্ধাতা। যুদ্ধবিদ্যা তথা ধনুর্বিদ্যায় অসামান্য পারদর্শিতা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনন্য উচ্চতায়। একারনে তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। তাছাড়া তাঁর ধর্মপরায়ন মানসিকতার জন্য বহু জাগ-যজ্ঞ করে ইন্দ্রের অর্ধাসন লাভ করেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে মান্ধাতার বিবাহ হয় বিন্দুমতীর সাথে। এই বিন্দুমতী ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা শশবিন্দুর কন্যা।এরপর মান্ধাতা ও বিন্দুমতীর ঘর আলো করে জন্ম নেয় তিন পুত্র- পুরুকুৎসু, অম্বরীষ এবং মুচুকুন্দ। এই দম্পত্তির ৫০টি কন্যা সন্তানও ভুমিষ্ঠ হয়েছিল যারা ছিলেন ঋষি সৌভরির স্ত্রী। তাছাড়া রাজা মান্ধাতা ছিলেন শিবের পরম ভক্ত। নর্মদা নদীর মধ্যস্থ একটি নির্জন দ্বীপে ওঁকারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গে বহুকাল সাধনা করেছিলেন তিনি। অধুনা মধ্যপ্রদেশের সেই স্থানটি আজও ‘মান্ধাতা’ নামেই পরিচিত।
যাইহোক, রাজা যুবনাশ্বের মৃত্যুর পর ইক্ষ্বাকু সিংহাসনে আরোহণ করেন মহারাজ মান্ধাতা। সিংহাসনে বসেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন বিশ্ববিজয়ে। তাঁর অসামান্য রণনৈপুণ্যে বহুযুদ্ধে জয়লাভ করেন তিনি। পুরাণ বলছে, মান্ধাতার সঙ্গে রাক্ষসরাজ রাবণেরও এক মহাযুদ্ধ সংগঠিত হয়। কিন্তু এই দুই শিবভক্তের কারওই জয় হয়নি সেই যুদ্ধে। মহা পরাক্রমশালী রাবণও মান্ধাতার শৌর্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তবে পরবর্তী কালে মান্ধাতারই বংশধর শ্রীরামচন্দ্রের হাতে নিহত হয়েছিলেন মহা পরাক্রমশালী রাবণ । মূলত মান্ধাতার এই পরাক্রমের জন্য তাঁকে বহু পুরাণে ‘ত্রাসদস্যু’বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যাইহোক, এক পর্যায়ে সমগ্র পৃথিবীর জয় করে মহাপ্ররাক্রমশালী হয়ে উঠলেন তিনি। পৃথিবী জয় করে তিনি চললেন স্বর্গরাজ্য জয় করতে। কিন্তু মাঝপথে বাধ সাধলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি মান্ধাতাকে ডেকে বললেন, “হে বৎস, তুমি স্বর্গরাজ্য জয় করতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু পৃথিবীতেই এমন একজন আছেন যিনি এখনো তোমার বশ্যতা স্বীকার করেননি”। মান্ধাতা জানতে চাইলেন, “কে সে?” উত্তরে দেবরাজ বললেন “লবনাসুর।”
বাস্তবে লবনাসুর ছিলেন লঙ্কাধিপতি রাবণের ভগ্নিপতি ও দেবাদিদেব মহাদেবের পরম ভক্ত। দেবরাজের কাছ থেকে লবনাসুরের কথা জানতে পেরে মান্ধাতা ছুটলেন লবনাসুরকে পরাজিত করতে। কিন্তু লবনাসুরের দখলে ছিল এক অমোঘ অস্ত্র। দেবাদিদেবের তপস্যা করে তিনি এক অলৌকিক ত্রিশূল অর্জন করেছিলেন যা নিমেষেই যে কোন কিছুকে ভষ্ম করে দিতে সক্ষম। এই ত্রিশূলের কল্যাণে অপরাজেয় ছিলেন লবনাসুর। অবশেষে যখন মান্ধাতা ও লবনাসুরের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন মান্ধাতার আক্রমণ প্রতিহত করতে সেই ত্রিশূল প্রয়োগ করেন লবনাসুর। এবং দূর্ভাগ্যজনকভাবে সমস্ত সৈন্য-সামন্ত সহ সেই ত্রিশূলের তেজে ভস্মীভূত হন মান্ধাতা । এবং এর বহু যুগ পরে মান্ধাতার বংশধর শত্রুঘ্ন লবণাসুরকে বধ করে পূর্বপুরুষের পরাজয়ের বদলা নেন। প্রসঙ্গত, সেই যুদ্ধে লবণাসুর ত্রিশুলটি নিয়ে অবতীর্ণ হননি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মান্ধাতার আমল আসলে কি এবং এসময়টা কেন এত বিখ্যাত?
আসলে মান্ধাতার রাজত্ব ছিল সত্যযুগে। হিসেবে দেখা যায় আজ থেকে প্রায় ৩৫ লক্ষ বছর আগের রাজা ছিলেন মান্ধাতা। এ কারণেই অনেক পুরনো কিছু নির্দেশ করতে মান্ধাতার আমলের কথা উল্লেখ করা হয়।
অনেকে বলে থাকেন মান্ধাতার আমল ছিল অসম্ভব সম্মৃদ্ধিতে পূর্ণ। তিনি এত সম্পদ আহরণ করেছিলেন যে, প্রজাদের কাছ থেকে কর নেওয়ারও কোনও প্রয়োজন ছিল না। তিনি সমস্ত কর অবলুপ্ত করেন। ‘মান্ধাতার আমল’ প্রবাদটি সম্ভবত সেই সুখ ও স্মৃদ্ধির কালকেই চিহ্নিত করে।
তাছাড়া দাতা বা দানবীর হিসেবেও মান্ধাতা বিপুল খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি একশত অশ্বমেধ এবং একশত রাজসূয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করেন। সেই সব যজ্ঞে তিনি পু্রোহিত ও অন্য ব্রাহ্মণদের বিপুল পরিমাণ সোনা ও গরু দান করেন।সেই স্বর্ণযুগের সময়কালকে নির্দেশ করতেও মান্ধাতার আমল বাগধারাটির প্রচলন হতে পারে বলেও মতামত দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞগণ।
আবার অনেকে মনে করেন, দেবরাজ ইন্দ্রের অঙ্গুলির অমৃতসুধা পান করে মহারাজ মান্ধাতা বেড়ে উঠেছিলেন ঐশ্বরিক দ্রুততায়। খুব অল্পদিনে শৈশব থেকে যৌবন ও যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌছেছিলেন তিনি। তাঁর এই দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া বা পুরনো হয়ে যাওয়া বোঝাতেও মান্ধাতার আমল শব্দযুগলের ব্যাবহার শুরু হতে পারে।