কোন সরস্বতী মূর্তিতে অঞ্জলী দেওয়া যাবে না? নিশ্চই টাইটেল দেখে আপনি আশ্চর্য হয়েছেন? আসলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। পৌরাণিক-স্মার্ত মতে দেবতার মূর্তি তৈরি করা হয় মাটি দিয়ে। অতঃপর তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার পর তা পরিনত হয় মৃন্ময়ী প্রতিমাতে। অর্থাৎ মাটি দ্বারা নির্মিত মূর্তিতে আরধ্য সেই দেবতা ভাস্বর হয়ে ওঠার পরেই তা পরিনত হয় প্রতিমাতে। কিন্তু সেই কাজে কতটা সফল আমরা? আজ আমরা মাটি দিয়ে প্রতিমা তো নির্মান করছি, কিন্তু দেবতার সেই সঠিক রূপকল্পের আকৃতি দিতে পারছি তো? আধুনিকতা আর থিমপূজার নামে আমরা নিজেরাই আমাদের ধর্মকে, দেব-দেবীকে বিতর্কিত করছি না তো? আর সেই মূর্তিকে পূজা করে বা তাতে অঞ্জলী প্রদান করে আসলেই কি আমাদের কিছু লাভ হচ্ছে?
আজ সেই কঠিন বাস্তবতাকে সামনে আনতে চলেছি আমরা। আমাদের গৃহাঙ্গন, বিদ্যালয়, বারোয়ারী থান বা ক্লাবে জননীরূপা দেবীর পূজার নামে যে অনাচার আমাদের দ্বারাই সৃষ্ট হচ্ছে সেটার সমাধান না হলে ভবিষ্যতে শেকড়হীন এক সংস্কৃতিকে বহন করবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। আসুন তাহলে দেখা যাক কোন ধরনের মূর্তিতে পূজা কার্য সম্পাদন ও অঞ্জলী প্রদানে ফল তো দূরের কথা স্বয়ং দেবীও রুষ্ট হন আমাদের উপর। আশা করি ভিডিওটি সম্পূর্ন পড়ার পর কমেন্টে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন এবং শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকেও দেখার সুযোগ করে দেবেন।
নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নিজে হাতে নাশকারীদের উদাহরণ হয়ত সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা প্রতিনিয়তই অনুকরণ করে চলেছি পশ্চিমাদের। তাঁদের চাল-চলন, কথা-বার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার এসবের অনুকরণ না করলে যেন সভ্য হয়ে উঠতে পারি না আমরা। তাই দেদারছে চলছে পশ্চিমা ভঙ্গি নকল করার প্রতিযোগিতা। কিন্তু সেই পশ্চিমা ছোয়া যেন এবার ছুয়ে যাচ্ছে আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকেও। প্রতিবছর সরস্বতী পূজা এলেই আমরা দেখতে পাই সরস্বতী পূজার নামে বিভিন্ন থিম বা থিমের পূজা। যেমন কোথাও স্কুটারে বসে পিছনে হাস নিয়ে যাচ্ছেন দেবী, কোথাও মারণ ভাইরাসের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছেন দেবী, কোথাও তিনি অধুনিক পোশাক পরিহিতা এবং যৌন আবেদনময়ীর ভূমিকায়, অথবা দেবীর হাতে বীণার পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে গিটার বা অন্য কোন পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র, এরকম হাজারো থিমে পূজিতা হচ্ছেন বেদ প্রসবিনী দেবী সরস্বতী। কিন্তু আসলে এখানে কি লাভ হচ্ছে? এখানে কি আমরা সেই সর্বশুক্লা দেবীর বন্দনা করছি নাকি মনগড়া থিম বানিয়ে সেই থিমের পূজা করছি মাত্র?
অনেকে বলবেন আমাদের ধর্ম এতটা সংকীর্ণ নয়। সময়ের সাথে সাথে আমাদের রূচিবোধের পরিবর্তনের ফলে দেবীমূর্তিতে পরিবর্তন আসতেই পারে। মনের শুদ্ধতাই বড় শুদ্ধতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু হে অমৃতের সন্তানগণ, এ ধারনা সম্পূর্ণ অবান্তর। আমাদের ধর্মের প্রতিটি অঙ্গের বা কর্মের এক একটি বিশেষ কারন রয়েছে। আমাদের পূজায় ব্যাবহৃত প্রতিমাগুলোও তাঁর ব্যাতিক্রম নয়। মূলত আমরা যে প্রতিমা বা মূর্তিগুলোর পূজা করে থাকি সেগুলো হচ্ছে নিরাকার পরম ব্রহ্মের এক একটি গুণ বা শক্তি। সেই গুণ বা শক্তিকে মূর্তিকল্পের আবরণে ঢেকে নির্মান করা হয় প্রতিমা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই শক্তি বা গুণের একটি প্রতিকী রূপই হচ্ছেন আমাদের এই দেব দেবী বা তাঁদের প্রতিমাগুলো। আবার এই দেব-দেবীদের বিভিন্ন গুণ ও শক্তি প্রকাশিত হয় তাঁদের প্রতিমার মাধ্যমে।
যেমন ধরুন সরস্বতী শুক্লবর্ণা ও শ্বেত বসন পরিহিতা কেন?
পুরাণে বর্ণিত দেবী সরস্বতীর রূপকল্পের প্রথমেই ধরা পড়ে তাঁর শ্বেতবর্ণ গাঁয়ের রঙ ও তাঁর পরনে সাদা বসন। কিন্তু তাঁর এই গাত্রবর্ণ ও পরিধানের পোশাকে যে সাদা রঙের কথা বলা হয়েছে তা কিন্তু একেবারে নিরর্থক নয়। এই শ্বেত বা শুক্লবর্ণের রয়েছে আলাদা প্রতিকী তাৎপর্য। আপনারা জানেন জ্ঞানময়ী রূপে তিনি সর্বত্রব্যাপিনী। এই বিশ্বভুবন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শুক্ল জ্যোতিতে। তাই সরস্বতীর বিশেষ অর্থ জোতির্ময়ী। আবার দেবী শ্বেতবর্ণা ও শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা এর অর্থ হচ্ছে তিনি সত্ত্বগুণের প্রতীক। তাছাড়া দেবী সরস্বতীর শুভ্রমূর্তি তাঁর নিষ্কলুষ চরিত্রেরও প্রতীক। আর যেহেতু এই শুক্ল বর্ণ বা সাদা হল সৎ গুণের প্রতীক তাই এই রঙ শিক্ষা দেয় যে, আমাদেরকে হতে হবে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী। তাই জ্ঞানময়ী সর্বশুক্লা দেবী শ্রী শ্রী সরস্বতী সর্ব জ্ঞানে-গুণে গুণান্বিত বলে তার গায়ের রঙ শুক্লবর্ণ অর্থাৎ দোষহীনা। তাই আমরা যখন কোন মূর্তিকে শ্বেত বসনের পরিবর্তে বাহারী রঙের এবং হাল ফ্যাশানের পোশাক পরিয়ে পূজা করছি তখন কি আমরা আদৌ সেই বাগেশ্বরী সরস্বতীর পূজা করছি?
দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান পদ্মের উপর কেন?
আপাতদৃষ্টিতে এই পদ্মফুলটিকে দেবীর বসার স্থান হিসেবে দেখা গেলেও এরও রয়েছে প্রতিকী তাৎপর্য। আপনারা জানেন পদ্ম পাঁকে জন্মায়। কিন্তু এর ফুলেল অংশে কোন পাঁক স্পর্শ করে না বরং এর সুরভিত সৌন্দর্য সেই পাঁককেই ঢেকে দেয় আড়ালে। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের জন্ম যেখানেই হোক না কেন, আমাদের কর্ম পদ্ম ফুলের সেই ফুলের অংশের মতই সুরভিত এবং শুভ্র হোক। কিন্তু আজ আমরা যখন সেই পদ্মের স্থানে স্কুটি বা ভাইরাস বসিয়ে দিচ্ছি তাতে কি সেই প্রতিকী তাৎপর্য ফুটে উঠছে?
দেবী সরস্বতীর বাহন শ্বেত রাজহংস। কিন্তু কেন?
আপনারা নিশ্চই জানেন এতটুকু একটি হাস দেবীকে বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম নয়। কিন্তু তাহলে এই তাঁর এই বাহন হাসের নিশ্চই কোন প্রতিকী তাৎপর্য রয়েছে। আজ্ঞে হ্যাঁ। এই হাসটি হচ্ছে আসলে জ্ঞানের বাহকের প্রতিরূপ। আর জ্ঞানের প্রকৃত বাহক হচ্ছে মানুষ। যুগ যুগ ধরে জ্ঞানের বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে আমরা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জ্ঞানের ধারা প্রবাহমান রেখেছি। তাই এই হাস আমাদের মনুষ্যকুলেরই প্রতিনিধি। এছাড়াও এর গায়ের শ্বেত-শুভ্র বর্ণ হচ্ছে আমাদের সেই সত্ত্বগুণের প্রতীক। বলা হয় হংস জল ও দুধের মিশ্রন থেকে জল বাদ দিয়ে শুধু দুধটুকু পান করতে সক্ষম। তাই এই স্বেত বর্ণের হাস এই তাৎপর্য বহন করে যে, যে ব্যাক্তি জ্ঞানের বাহক তিনি সমাজের নানা ভালো-মন্দের মধ্য থেকে শুধু ভালোটুকু গ্রহণ করে অপ্রয়জনীয় বা মন্দ অংশটুকু বর্জন করতে সক্ষম। তাহলে আজ আমাদের সরস্বতী পূজার বিভিন্ন প্রতিমায় যে রঙ-বেরঙের হাস দেখা যায় বা কোথাও হাসের চিহ্নটুকুও দেখা যায় ন সেখানে আপনি কি বলবেন?
দেবী সরস্বতীর হাতে থাকে সুদৃশ্য বীণা।
সেই কারণে তাঁর আরও এক নাম বীণাপাণি। বাস্তবে এই বীণা ধ্বনি বা নাদ সৃষ্টিকারী বাদ্যযন্ত্র হলেও এর মহিমা আরও ব্যাপক। দেবী সরস্বতীর এই বীণা মূলত সুর ও সঙ্গীত তথা শিল্পকলার প্রতীক। তাছাড়া বীণার সুরের মত অত্যন্ত মধুর স্বর ও সুর দানের উদ্দেশ্যেই দেবীর হাতে এই বাদ্যযন্ত্রের অবস্থান। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ জায়গায় জায়গায় বীণার পরিবর্তে সরস্বতীর হাতে দেখা মেলে গিটার বা গিটার জাতীয় পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু কক্ষনো কি ভেবে দেখেছেন, রূপকল্পে যে দেবীর হাতে বীণা থাকার কথা, সেখানে গিটার থাকাটা কতটা অবমাননাকর?
আবার দেবী সরস্বতীর এক হাতে দেখা যায় বেদ।
কারন তিনি স্বয়ং বেদ-প্রসবিনী। সমস্ত বিদ্যা ও জ্ঞানের জননী তিনি। তাঁর হাতের সেই পুস্তক আমাদের জ্ঞান দান তথা জ্ঞানার্জনে উদবুদ্ধ করার জন্যই প্রদর্শিত হয়। কিন্তু থিমপূজার প্রয়োজনে নির্মিত মূর্তিতে জ্ঞানের ধারক সেই পুস্তকই এখন আর ঠাই পায় না। তাঁর পরিবর্ততে সরস্বতীর দুই হাত যেন ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে স্কুটির হ্যান্ডেল বা থিমের অন্য কোন অনুষঙ্গকে ধরার জন্য।
আশা করি এবার আপনারা বুঝতে পেরেছেন কোন কোন ধরনের মূর্তিতে পূজা বা অঞ্জলী প্রদানে বিশেষ কোন ফল লাভ হয় না। বাস্তবপক্ষে এর ফলে হিতের পরিবর্তে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। তাই আসুন আমরা রীতি অনুসরণ করে প্রতিমা নির্মান করি এবং বিধি মোতাবেক তাঁর বন্দনা করে প্রকৃত সনাতনী আচার পালনে ব্রতী হই।