আজকের পৃথিবীতে সর্বত্রই হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রের জয় জয়কার। একটু কান পাতলেই সারা পৃথিবীব্যাপী শ্বেতকায়, পীতকায়, ও কৃষ্ণকায় মানুষের মুখ থেকে ভেসে আসে মধুর হরিনাম সংকীর্ত্তন। যে সনাতন ধর্মের প্রবেশদ্বার দীর্ঘদিন ধরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল, সেই রুদ্ধ দ্বার খুলে দিয়ে আবারও সনাতনের আলোকিত পথে মানুষকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এই বঙ্গদেশেরই এক মহাপুরুষ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মাধ্যমে যে অমৃতসুধা আমাদেরকে উপহার হিসেবে দান করেছিলেন, সেই শ্রীমদভগবদগীতাকে ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করে তিনি পৌছে দিয়েছেন বিশ্বের সর্বত্র। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের কথাই বলছি। কিন্তু কে এই প্রভুপাদ? কিভাবে কোলকাতার একটি ছোট্ট গলিতে জন্ম নেওয়া অভয় চরণ দে সারা বিশ্বব্যাপী প্রভুপাদ নামে পরিচিতি পেলেন? আজ সেই কাহিনীই বলতে এসেছি আপনাদেরকে। চলুন দর্শক জেনে নেওয়া যাক এই মহান বৈষ্ণবের সংক্ষিপ্ত জীবনী, তাঁর কৃষ্ণপ্রেম প্রচারের তীব্র সংগ্রাম, হরে কৃষ্ণ আন্দোলন ও ইসকন সম্পর্কে।
সময়টা ১৮৯৬ সাল। বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত বণিক পরিবারে জন্মষ্টমীর দিনে জন্ম নিয়েছিলেন এক ফুটফুটে দিব্যশিশু। পিতা গৌর মোহন দে এবং মাতা শ্রীমতি রজনী দে দুজনেই ছিলেন কৃষ্ণভক্ত এবং কৃষ্ণজয়ন্তীতে পুত্রসন্তান লাভ করে বাধভাঙা আনন্দে ভাসলেন এই দম্পত্তি ও তাদের আত্মীয় স্বজনেরা। পুত্রের নাম রাখা হল শ্রী অভয় চরণ দে। কিন্তু কে জানত এই ছোট্ট শিশুটি একদিন সারা বিশ্বের বৈষ্ণব আন্দোলনের কাণ্ডারী হয়ে সকলকে কৃষ্ণনামের মাধ্যমে অভয় দান করবেন?
অভয়চরণ দের পরিবারের সাথে তৎকালীল ভবানীপুরের মল্লিক পরিবারের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। পিতার সাথে সেই বাড়িতে মাঝেমধ্যেই যাতায়াত করতেন শিশু অভয়চরণ। এসময় মল্লিকবাড়িতে রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ দেখে তাঁর হৃদয়ে জাগ্রত হয় কৃষ্ণপ্রেম। পিতা গৌর মোহন দে পুত্রের মধ্যে এই ভক্তিভাব দেখে খুশি হয়ে তাকে একটি রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ উপহার দিয়েছিলেন। উপহারের এই বিগ্রহ হাতে পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে মাত্র ৪ বছর বয়স থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাধা কৃষ্ণের পূজা করা শুরু করলেন তিনি। তাছাড়া রথযাত্রা উৎসবে পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে পুরীর রথযাত্রার আদলে রথযাত্রাও পালন করতেন তিনি।
এভাবেই হৃদয়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রতিভক্তিভাব নিয়েই বড় হতে লাগলেন অভয়চরণ দে। ৮ বছর বয়সে তিনি নিকটবর্তী মতিলাল শীল স্কুলে ভর্তি হন এবং তাঁর পরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল স্কটিশ চার্চ কলেজে। এই কলেজে পড়াকালীন সময়ে ইংরেজী ও সংস্কৃতভাষায় খুব ভালোভাবেই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
এরপর ১৯২২ সালে কলকাতায় তিনি দর্শন পেলেন শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদের। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ছিলেন ভক্তিমার্গের বিদগ্ধ পণ্ডিত এবং ৬৪টি গৌড়ীয় মঠের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই বুদ্ধিদীপ্ত, তেজস্বী ও শিক্ষিত যুবক অভয়চরণকে চিনতে একটুও ভুল করেননি। সস্নেহে তাকে কাছে টেনে নিয়ে তাকে উদবুদ্ধ করেছিলেন বৈদিক জ্ঞান অর্জন ও প্রচারের কাজে। অভয়চরণ এগার বছর ধরে তার আনুগত্যে বৈদিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে ১৯৩৩ সালে এলাহাবাদে তার কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত হন।
ইতিমধ্যে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর লক্ষ্য করেছিলেন তখনকার যুবক যুবতীরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি নিয়ে উন্মত্ত। সুতারাং কৃষ্ণনামকে তাদের পর্যন্ত পৌছাতে হলে পশ্চিমা ভাষায় শাস্ত্র অনুবাদ করা অত্যন্ত জরুরী। তাই তিনি তাঁর শিষ্য অভয়চরণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায় বৈদিক জ্ঞান প্রচার করতে এবং আমেরিকায় গিয়ে এই মধুর হরিনাম বিতরন করতে।
প্রিয় শিষ্য অভয়চরণের প্রতি এই নির্দেশ দিয়ে ১৯৩৩ সালে ইহলোক থেকে অপ্রকট হন শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর। অভয়চরণ দে তখনও গার্হস্থ্য জীবন যাপন করছেন এবং এলাহাবাদে একটি ছোট ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যাবসা পরিচালনা করতেন। এরপর একে একে কেটে গেল বেশ কিছু বছর। গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ প্রচার, মহাভাগবত পুরাণ অধ্যয়ন ও ভাষ্য রচনা, শ্রীমদভগবদগীতা কেন্দ্রিক গবেষনা সবই চলছিল এর মধ্যে। কিন্তু গুরুদেবের আদেশ বাস্তবায়ন করা তখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি অভয়চরনের পক্ষে। অবশেষে ১৯৪৪ সালে তিনি প্রকাশ করলেন ব্যাক টু গডহেড নামক একটি ইংরেজি পাক্ষিক পত্রিকা। নিজে পত্রিকা ছাপানো, লেখা, এবং বিতরণ করে যে সামান্য অর্থ তিনি পেতেন তাতে ছাপার খরচও যোগানো সম্ভব হত না। ছাপাখানার মালিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বললেও অভয়চরন ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এরপর এল ১৯৪৭ সাল। তাঁর অসামান্য দার্শনিক জ্ঞান, গৌড়ীয় মঠের প্রচারের জন্য তাঁর রচিত গীতার ভাষ্য, গভীর ভাগবত জ্ঞান ব্যাক টু গডহেড পত্রিকার বিশ্লেষনধর্মী অথচ সরল লেখাগুলো ও ভক্তির উৎকর্ষতার স্বীকৃতিরূপে ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ’ তাকে আখ্যায়িত করলেন ভক্তিবেদান্ত নামে। শ্রীল অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের মূল কর্মজীবনই যেন শুরু হল এবার।
১৯৫০ সালে ৫৪ বছর বয়সে সংসার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন শ্রীল প্রভুপাদ। এবং এর আরও চার বছর পর তিনি বানপ্রস্থাশ্রম গ্রহণ করেন এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন, প্রচার ও গ্রন্থরচনার কাজে মনোনিবেশ করেন। এসময়টা তিনি বৃন্দাবনে শ্রীশ্রী রাধা-দামোদর মন্দিরে বসবাস করতে থাকেন এবং অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে শুরু করেন। এই মন্দিরে বসেই শ্রীল প্রভুপাদের শ্রেষ্ঠ অবদানের সুত্রপাত হয়। এখানে বসেই তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের ভাষ্য ও তাৎপর্যসহ আঠার হাজার শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং একইসাথে “পরলোকে সুগম যাত্রা”নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এই মন্দিরে অবস্থান কালেই তিনি কৃষ্ণকৃপায় ১৯৫৯ সালে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তাঁর এসময়টাও কেটেছে কৃষ্ণতত্ত্বের গুঢ় রহস্য অনুসন্ধানে এবং শাস্ত্রের বিভিন্ন টীকা-ভাষ্য রচনায়। ততদিনে তাঁর বয়স প্রায় ৬৫।
কিন্তু তাতে কি? এমন মহামানবকে কি বয়সের ছকে আটকে রাখা যায়? এবার তিনি শুরু করলেন আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি। যে বয়সে মানুষ অবসর গ্রহণ করে সারাজীবনের ক্লান্তি দূর করতে চায়, একটু নিরিবিলি পরিবেশে জীবনের বাকী সময়টা কাটাতে চায় সেই বয়সে তিনি মনস্থির করলেন গুরুর আজ্ঞা পালনহেতু আমেরিকায় যাবেন এবং সেখানে কৃষ্ণপ্রেম বিতরন করবেন। অন্যদিকে সেখানে যাওয়ার জন্য কোন প্রকার আর্থিক সুব্যাবস্থাও ছিল না তাঁর। অতএব আমেরিকাতে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র প্রচার করার আবেদন নিয়ে তিনি গেলেন একটি স্টীম শিপ কোম্পানীর মালিক শ্রীমতী সুমতি মুরার্জীর কাছে। ভক্তিমতি রমনী শ্রীমতী সুমতি মুরার্জী স্বামী প্রভুপাদের বয়স বিবেচনা করে আশ্চর্য হলেন। এই বয়সের একটা মানুষের মধ্যে কতটা তারুন্য থাকলে এরকম কোন সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন।
অবশেষে তাঁর সহযোগিতায় একই মালবাহী জাহাজে চেপে ৬৯ বছরের স্বামী প্রভুপাদ চললেন আমেরিকার উদ্দেশ্যে। সাথে ছিল কিছু শ্রীমদভাগবত গীতা, কিছু কাপড়, একটি টাইপরাইটার, একটি টেপ রেকর্ডার আর থলেভর্তি চিড়ে। ভাবা যায়, এই সম্বল নিয়ে পাশ্চাত্যের এক অপরিচিত দেশে হরিনাম চলেছেন একজন ৬৯ বছরের মানুষ! তবে জাহাজে চড়ে তিনি আমেরিকা যাত্রা করলেও যাত্রাপথ খুব সুবিধার ছিল না। সাগরের প্রবল ঢেউ, কনকনে শীত এ সবকিছুই কৃষ্ণপ্রেমের টানে সহ্য করে নিয়েছিলেন তিনি। জাহাজে ভ্রমণকালে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালন করতেও ভোলেননি এই কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা মানুষটি। এর মধ্যে দুই দুইবার হৃদরোগে আক্রান্তও হয়েছিলেন স্বামী প্রভুপাদ। তবে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় সুস্থ হয়ে অবশেষে পৌছে গেলেন আমেরিকায়। আমেরিকায় পৌছে প্রভুপাদ লিখেছিলেন-
বড়-কৃপা কৈলে কৃষ্ণ অধমের প্রতি
কি লাগিয়ানিলে হেথা কর এবে গতি
আছে কিছু কার্য়্য তব এই অনুমানে
নহে ক্যানো আনিবেন এই উগ্র-স্থানে
রজস তমো গুণে এরা সবাই আচ্ছন্ন
বাসুদেব-কথা রুচি নহে সে প্রসন্ন
তবে যদি তব কৃপা হয় অহৈতুকী
সকল-ই সম্ভব হোয় তুমি সে কৌতুকী
কি ভাবে বুঝালে তারা বুঝে সেই রস
এত কৃপা কর প্রভু করি নিজ-বশ
তোমার ইচ্ছায় সব হয় মায়া-বশ
এর আগেও অনেক বৈদান্তিক সন্যাসী আমেরিকায় গিয়ে সনাতন ধর্মের মহিমা প্রচার করে এসেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখের পদাঙ্ক অনুসরন করে এবার আমেরিকার মাটিতে পা রাখলেন শ্রীল অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। ৭০ বছর বয়সী স্বামী প্রভুপাদ সেখানে জ্বেলে দিলেন হরে কৃষ্ণ আন্দোলনের মহাপ্রদীপ। সেদেশের উদ্ভ্রান্ত ও ভোগ-সর্বস্ব যুবক যুবতীদের ডাকলেন হরিনামের সুশীতল ছায়াতলে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার শ্বেতাংগ নরনারী বিলাসী জীবনযাত্রাকে পরিত্যাগ করে রত হলেন হরিনামে।
তবে এসবকিছু এতটা সহজ ছিল না। জাহাজে করে আমেরিকা পৌছে তিনি সর্বপ্রথম আশ্রয় নিয়েছিলেন পেন্সিলভেনিয়ার বাটলারে বন্ধুপুত্র গোপাল আগারওয়ালের গৃহে। সেখানে ১মাস অবস্থান করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর নিউ ইয়র্কে প্রচার করবেন হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র। ইতিমধ্যে চিঠি পেলেন শ্রীমতী সুমতি মোরার্জীর। চিঠিতে এই ভক্তিমতী নারী লিখেছিলেন, “স্বামী প্রভুপাদ, আপনি ৬ মাসের জন্য আমেরিকা গিয়েছেন, কিন্তু আমার ইচ্ছা যতদিন না সেখানে আপনার হরিনাম প্রচার সম্পূর্ণ হয় ততদিন আপনি ভারতে ফিরবেন না। ” আনন্দিত হলেন প্রভুপাদ। এবার নিউ ইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় একাকী এই বৃদ্ধ মানুষটি শুরু করলেন হরিনাম প্রচার। কিন্তু তাতে আবারও বিঘ্ন। এবার তাঁর টীকা-ভাষ্য রচনার সম্বল টেপরেকর্ডার ও টাইপরাইটারটি চুরি হয়ে গেল। কিন্তু আদম্য এই মানুষটি হার মানলেন না কিছুতেই। ধীরে ধীরে তাঁর মধুর হরিনাম সংকীর্ত্তনে আকৃষ্ট হলেন সেখানকার স্থানীয় যুবক যুবতীরা। তাঁরা ভেবেছিলেন এই সংকীর্ত্তন হয়ত নতুন কোন আধুনিক ফ্যাশনের অঙ্গ।
স্বামী প্রভুপাদও এই বিপথগামী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রাধা-কৃষ্ণ নামের উন্মাদনা। সেখানে তাঁর ভক্ত ও শিষ্যরা আশ্চর্য হয়ে দেখতেন ৭০ বছর বয়সী একটা মানুষ কিভাবে ১৮ বছরের যুবকের মত কাজ করছেন। এক হাতে তিনি রচনা করতেন শাস্ত্রীয় টীকা ভাষ্য, ধর্মীয় পুস্তকাদির ইংরেজী অনুবাদ করতেন, রাস্তায় রাস্তায় অনাথের মত ঘুরে হরিনাম বিতরন করতেন, এবং , বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভারতীয় দর্শনের উপর ভাষন দিতেন।
এভাবে কেটে গেল ১ বছর। ১৯৬৬ সালে একটি পরিত্যাক্ত দোকান ঘরে তিনি স্থাপন করলেন একটি ছোট্ট কৃষ্ণমন্দির। আর সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল আজকের ইসকন বা International Society for Krishna Consciousness যার বাংলা করলে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সঙ্ঘ। সেবছরেরই জন্মাষ্টমীর পরের দিন তিনি পাশ্চাত্যে প্রথম দীক্ষা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন ও ১১ জন শ্বতাঙ্গকে কৃষ্ণনামে দীক্ষা দেন। ১৯৬৭ রথযাত্রার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরের রাজপথে তিনিই প্রথম রথযাত্রা পরিচালনা করে ভগবান জগন্নাথের মহিমা ছড়িয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা সবাই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করো। এই অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গ তোমাদের মনের সমস্ত কলুষ দূর করে তোমাদেরকে সুখী করে তুলবে।” এভাবে বিদেশের মাটিতে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল কৃষ্ণপ্রেমীদের সংখ্যা। ১৯৭২ সালে মাত্র ৩ জন ছাত্র নিয়ে তিনি ডালাসে গড়ে তোলেন গুরুকুল বিদ্যালয়। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রচলন করলেন বৈদিক শিক্ষাব্যাবস্থা। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে গুকুল বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩০ টিরও বেশি গুরুকুল আছে। এছাড়াও এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বহু শহরসহ ১৪ বার পৃথিবী পরিক্রমা করেছিলেন তিনি। তিনি যেখানে গিয়েছেন সেখানে জ্বেলেছেন কৃষ্ণনামের দ্যুতি, প্রতিষ্ঠা করেছেন মন্দির, বিপথগামীদের পথ দেখিয়ে তাদের হাতে জ্বেলে দিয়েছেন হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের মহাপ্রদীপ। শুধু তাই নয় মাত্র ১০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সব বড় বড় শহরে ১০৮টি কৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠাও করেছেন এই মহান বৈষ্ণব গুরু।
এভাবে সারা বিশ্বে যখন রাধা-কৃষ্ণ নামের উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে, তখন থামলেন প্রভুপাদ। ১৯৭৭ সালে ৮১ বছর বয়সে হরিনামের এই কাঙাল অপ্রকট হলেন ইহলোক থেকে। রেখে গেলেন তাঁর অগণিত ভক্ত-শিষ্য, তাঁর রচিত অগণিত পুস্তক, টীকা-ভাষ্য, তাঁর ভগবত প্রেম এবং চৈতন্য বৈষ্ণববাদ। শাস্ত্রের গুঢ় তত্ত্বগুলো সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মানুষের কাছে তুলে ধরাই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এবং সেইকাজে তাঁর অসামান্য সফলতার জেরে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তারই দেখানো পথে ধ্বনিত হয় অমৃতসম হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র।