বন্ধুরা আজ আমরা কথা বলতে চলেছি ভারতবর্ষ থেকে প্রায় ৫০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আফ্রিকার একটি দ্বীপ দেশ মরিশাসকে নিয়ে। সমগ্র আফ্রিকার জীবনযাত্রা, আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির তুলনায় মরিশাস নামক দেশটি একেবারেই ব্যাতিক্রমী। এদেশটির মাথাপিছু আয় ছাড়িয়ে গেছে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়কেও। এখানে রয়েছে সুসজ্জিত নগরী, উন্নত জীবনযাত্রা, আইনের সুশাসন এবং প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা। তাছাড়া সম্পদের দিক দিয়ে এটি সমস্ত আফ্রিকার মধ্যে ২য় ধনী দেশ। তবে সবচেয়ে অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে, এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী। এবং জনসংখ্যার অনুপাতে এটি বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম হিন্দু রাষ্ট্র যার অবস্থান নেপাল ও ভারতের পরেই। কিন্তু কিভাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের আজকের আয়োজন। ভারতবর্ষ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দুরের এই দেশে সনাতন হিন্দু ধর্মের বিস্তৃতি কিভাবে সম্ভব হল এবং সেদেশের সনাতন সংস্কৃতি ও সনাতনী নিদর্শনগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য শেষ পর্যন্ত পড়বেন। এবং ভালো লাগলে কমেন্টে একবার জয় সনাতন ধর্ম লিখে যেতে ভুলবেন না।
আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের সন্নিকটে এবং ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র দ্বীপদেশ হচ্ছে মরিশাস। ছোট বড় কিছু দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দেশটির মোট আয়তন ২০৪০ বর্গকিলোমিটার যা কলকাতা নগরীর থেকে প্রায় ১০ গুণ বড় এবং ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৭ গুণ বড়। সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮১০ সালে নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার দ্বীপটি দখল করে নেয়। এবং ১৮৩৫ সালে ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলে যে শ্রমঘাটতি সমস্যা উদ্ভূত হয়, তা সমাধানের জন্য ব্রিটিশরা আখের খামারগুলোতে কর্মরত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের পরিবর্তে ভারতীয় উপমহাদেশীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়। এই শ্রমিকরা ছিলেন মূলত উত্তর প্রদেশ, বিহার, ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। ফলে ১৯৬১ সাল থেকে মরিশাসের নাগরিকদের অধিকাংশই হয়ে ওঠেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী। এ কারনে আজ মরিশাসের প্রচলিত কথ্য ভাষা ক্রেওল এর পাশাপাশি এখানে হিন্দী, তামিল, মারাঠী, ভোজপুরী ইত্যাদি ভাষার ব্যাপক ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। আর মরিশাস দেশটি নতুন করে পরিচিতি পায় আফ্রিকার একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে। তাছাড়া জনসংখ্যার অনুপাতে এ দেশটি আজ বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম হিন্দু রাষ্ট্র।
আপনারা জেনে অবাক হবেন, মরিশাসের বর্তমান রাষ্ট্রপতি পৃথ্বীরাজসিংহ রূপন, প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জগন্নাথ এবং জাতীয় সংসদের স্পীকার সুরুজদেব ফকির সকলেই সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তাছাড়া এদেশের পোশাক পরিচ্ছদেও রয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির স্পষ্ট ছাপ। আমাদের মতই শাড়ী, সালোয়ার, কামিজ এবং দোপাট্টা ব্যাবহার করে থেকেন মরিশাসের মহিলারা। পুরুষের পোশাকেও রয়েছে এদেশীয় পোশাকের ছাপ। এসকল কারনে ২০১৫ সালে মরিশাস সফরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী সেদেশে প্রতিষ্ঠিত সনাতনী সংস্কৃতি উপভোগ করে মরিশাসকে লিটল ইন্ডিয়া বা ছোট্ট ভারতবর্ষ নামে অভিহিত করেন। তাছাড়া ভারত ও মরিশাসের মধ্যে উষ্ণ কূতনৈতিক সম্পর্কের কারনও হচ্ছে সেদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ ও তাঁদের সনাতন সংস্কৃতির চর্চা।
তবে মরিশাস সম্পর্কে আরও একটি আশ্চর্যজনক তথ্য হচ্ছে মরিশাসকে মন্দিরের দেশ নামেও অভিহিত করা হয়। কারন এই ছোট্ট দেশটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য হিন্দু মন্দির ও সনাতন ধর্মীয় স্থাপনা। আর এসব কিছু সম্ভব হওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর আদর্শে পরিচালিত সংগঠন আর্য সমাজ ও শ্রীল প্রভুপাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণবীয় সংগঠন ইসকন। তো চলুন দর্শক আমরাও দেখে আসি মরিশাসে প্রতিষ্ঠিত সনাতন ধর্মীয় কিছু মন্দির ও সনাতনী স্থাপনা।
ছবিতে যে মন্দিরটি দেখতে পাচ্ছেন তাঁর নাম সাগর শিব মন্দির। মরিশাসের পূর্বাংশের একটি ছোট্ট দ্বীপে এই শিব মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। চারিদিকে সাগর ও ম্যানগ্রোভ বেষ্টিত এই শিব মন্দিরে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ১০৮ ফুট উচু শিবের মূর্তি। এবং সঙ্গত কারনেই এস্থানে প্রতিবছর বিপুল পরিমান ভক্ত ও পূন্যার্থীদের পাশাপাশি বহু সংখ্যক পর্যটকের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়।
মরিশাসের আরও একটি অনিন্দ্যসুন্দর ও প্রাচীন মন্দির হচ্ছে এই শ্রী প্রসন্ন ভেংকেটেশ্বরা মন্দির। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ভগবান বিষ্ণুর এই মন্দিরটি ২০১০ সালে সংস্কার করে আরও আকর্ষনীয় করে তোলা হয়েছে বিষ্ণুভক্ত ও পর্যটকদের কাছে। শুভ্র সুন্দর পাহাড়ী প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত এই বিষ্ণুমন্দিরে শ্রী ভেংকেটেশ্বরের মূর্তির পাশাপাশি রয়েছে শিবলিঙ্গ, দেবী শ্রীলক্ষ্মীর মূর্তি, মহাভারতের বিভিন্ন ভাষ্কর্য এবং বৃহৎ প্রার্থনা কক্ষ।
মরিশাসের সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন হিন্দু মন্দিরটির নাম হচ্ছে মহেশ্বরনাথ শিব মন্দির। ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং অপরূপ কারুকার্য খচিত এই মন্দিরটির অধিষ্ঠিত দেবতা দেবাদিদেব মহাদেব। তবে প্রাথমিকভাবে এই মন্দিরটি একটি শিব মন্দির হলেও এখানে রয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান ব্রহ্মা, ভগবান কার্ত্তিকেয় বা মুরগান, শ্রীগণেশ এবং শ্রী বিষ্ণুর মূর্তি। যে কারনে সকল দেবতার ভক্ত যাতায়াত করেন এই মন্দির চত্বরে। তবে এ মন্দিরে সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম শিব রাত্রি যা প্রতি বছর শিব চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয় মহা ধুমধামের সাথে।
এছাড়াও মরিশাসের গাণপত্যের অনুসারীরাও পিছিয়ে নেই এখানে। আকারে ছোট হলেও মরিশাসের ক্যাসেকেভিলের পাণ্ডুরাং ক্ষেত্র মন্দিরটি গণেশ ভক্তদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থ। মূলত মহারাষ্ট্রের গাণপত্যের অনুসারীরা মরিশাসে আসার পর ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনটি সুন্দর গম্বুজ বিশিষ্ট এই নয়নাভিরাম মন্দিরটি। তবে মন্দিরটি গণেশ দেবের উদ্দেস্যে উৎসর্গীকৃত হলেও, অন্যান্য দেবদেবীদের মূর্তি ও উপসনার রীতিও প্রচলিত রয়েছে এখানে।
এগুলো ছাড়াও ইসকন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হরে কৃষ্ণ মন্দিরটিও মরিশাসের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। তবে ধর্মীয় স্থাপনার বাইরেও এই মন্দিরটির অতুলনীয় শৈল্পিক কারুকার্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তাছাড়া মন্দিরের চারপাশ জুড়ে অসংখ্য ফলবতী বৃক্ষ ও মন্দিরের গায়ে অঙ্কিত দেবদেবীদের বিগ্রহ ও দেয়ালচিত্র দর্শন করে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন মন্দিরে আগত ভক্ত ও দর্শনার্থীরা।
তবে এগুলোর বাইরেও শিব-শক্তি মন্দির, শিব শুভ্রমনিয়া মন্দির, গঙ্গা তালাও সহ অসখ্য সনাতন ধর্মীয় স্থাপনার মনোরম সৌন্দর্যে শোভিত হয়ে আছে মরিশাস নামক এই সাগরদ্বীপের প্রত্যেকটি অঞ্চল। তাছাড়া ১৯১৪ সালে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারীগণের উদ্যোগে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় আর্য সমাজ। এদেশে বৈদিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, বাল্য বিবাহ রোধ এবং নারী শিক্ষার বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আর্য সমাজ। উল্লেখ্য এখানে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও খ্রীষ্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে ধর্মীয় সম্প্রীতির এই দেশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন সকল ধর্মের মানুষ। শিল্প ও পর্যটন কেন্দ্রিক এই দেশটির সুষ্ঠ গনতান্ত্রিক চর্চা, ধর্মনিরপেক্ষতা, শান্তিপ্রিয়তা ও অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ দেশটিকে গড়ে তুলেছে আফ্রিকার ২য় ধনী দেশ হিসেবে। যেখানে আফ্রিকার অনেক বড় বড় আয়তনের দেশেও আজ অবধি এতটা উন্নয়ন চোখে পড়ে নি। সব মিলিয়ে ভারত মহাসাগরের বুকে গড়া ওঠা এই দ্বীপ কেন্দ্রিক সভ্যতাটি আজকের পৃথিবীর জন্য এক বিষ্ময়। তাই সুযোগ হলে একবারের জন্যও ভারতবর্ষের বাইরে সনাতনের এই জয়জয়াকার দেখে আসতে ভুলবেন না।