চিত্রগুপ্তের জন্ম কিভাবে হয়েছিল? তিনি কিভাবে যমরাজের সহকারী হয়েছিলেন? Story of Chitragupta.

যেকোন ভালো বা খারাপ কাজ করার আগে আমাদের মনে ভেসে ওঠে চিত্রগুপ্তের খাতার কথা। কারন আমাদের প্রকাশ্য বা গোপন, সমস্ত কর্ম নির্ভূল ও অবিরামভাবে লিপিবদ্ধ হয় চিত্রগুপ্তের খাতায়। চিত্রগুপ্ত আমাদের সকল কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব বিবরনী প্রস্তুত করে প্রদান করেন যমরাজকে। আর তাঁর প্রদানকৃত সেই হিসাব থেকে যমরাজ নির্ধারণ করেন আমাদেরকে স্বর্গে প্রেরণ করবেন নাকি নরকে। তাই অনেকের কাছে চিত্রগুপ্ত শব্দটি যমরাজের মত একটি মূর্তিমান আতংকের নাম। কিন্তু এই চিত্রগুপ্ত আসলে কে? কিভাবে চিত্রগুপ্তের জন্ম হয়েছিল? কিভাবে তিনি যমরাজের সহকারী হিসেবে কর্মরত হয়েছিলেন? আজকে আমাদের সমাজে কায়স্থ নামক যে জাতি বা বর্ণ রয়েছে তাঁদের সাথে চিত্রগুপ্তের কি সম্পর্ক? এবং কেনই বা তাঁকে আদি কায়স্থ বলা হয়? এসকল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাজির সনাতন এক্সপ্রেস।

মৃত্যুই যে কোন মানুষের জীবনের সর্বশেষ ঘটনা। এই সেই ঘটনা যা আমাদেরকে নিয়ে যায় অজানা পারলৌকিক জগতে। যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। যখন মৃত্যুর ডাক এসে যায়, প্রিয়তমা স্ত্রী, আদরের সন্তানেরা, বাবা-মা অথবা হাজারো চেনা জানা মানুষের কেউই তাঁদের ভালোবাসার বন্ধন দিয়ে ধরে মৃত্যুপথযাত্রীকে বেধে রাখতে পারে না। তো পার্থীব লীলা শেষ হওয়ার পর জীবের সাথে সর্বপ্রথম যার সাক্ষাৎ ঘটে তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং চিত্রগুপ্ত।

বিভিন্ন পুরাণ ও বৈদিক সাহিত্য থেকে জানা যায় যম হলেন প্রথম নশ্বর, এবং তিনি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন। সেকারনে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল যমরাজ হিসেবে। মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দান করা, এবং তাদেরকে কর্মফল অনুসারে স্বর্গ বা নরকে পাঠানোর ব্যাবস্থা করার পাশাপাশি ত্রিভূবনের সমস্ত মৃত জীবের পাপ-পূণ্যের হিসাবও রাখতেন তিনি। কিন্তু কালক্রমে সৃষ্টি বর্ধিত হতে থাকলে এই কাজ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই একলা যমরাজের পক্ষে এই বিপুল দায়িত্ব সামলানও অসম্ভব হয়ে পড়ায় তিনি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন এবং বিকল্প কিছু ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন।

আরও পড়ুনঃ  বর্ণাশ্রম থেকে অভিশপ্ত জাতিভেদ- কতটা ঠিক কতটা ভুল? চার বর্ণের কে বড় কে ছোট?

যমরাজের আর্জি শুনে ব্রহ্মাও কোন তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে পারলেন না। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন ব্রহ্মা। এভাবে কেটে গেল কয়েক হাজার বছর। এরপর এক সময় ব্রহ্মার শরীরের তেজ থেকে উৎপন্ন হলেন হাতে দোয়াত-কলম ধারী এক ব্যক্তি। তিনি ব্রহ্মার ১৭তম মানসপুত্র। তাঁকে উদ্দেশ্য করে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বললেন, “হে পুত্র, তুমি আমার মনের গোপন চিত্তে চিত্রিত হয়েছ বিধায় তোমার নাম হবে চিত্রগুপ্ত। আর আমার শরীর বা কায়া থেকে উৎপন্ন হওয়ার কারণে তুমি এবং তোমার বংশরগণ কায়স্থ নামে পরিচিত হবে। এবার তুমি দেবী চণ্ডীকার তপস্যায় মনোনিবেশ করো। ” এই বলে ব্রহ্মা আবারও ধ্যানমগ্ন হলেন। তবে অন্যমতে, গোপনে মানুষের পাপ পূণ্য তাঁর হিসেবের খাতায় চিত্রিত করেন বলেই তাঁর নাম হয়েছিল চিত্রগুপ্ত।

যাইহোক, পিতার নির্দেশে নবজন্মা চিত্রগুপ্ত তখন রত হলেন দেবী চণ্ডীকার তপস্যায়। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী চণ্ডীকা হাজির হলেন তাঁর সামনে। এরপর তিনিও চিত্রগুপ্তকে পরোপকারী, স্বাধীন ও চিরজীবী হবার বরদান করে অন্তর্ধান করেন। এবার ব্রহ্মা চিত্রগুপ্তকে বললেন, “হে পুত্র যে উদ্দেশ্যে আমার কায়া থেকে তোমার জন্ম হয়েছে এখন সেই উদ্দেশ্য সাধনের সময় হয়েছে। এবার তুমি যমরাজের সহকারী হিসেবের জীবের সকল পাপ-পূণ্যের হিসাবরক্ষণ করো। ” আর এভাবেই চিত্রগুপ্তের জন্ম এবং যমরাজের সহকারী হিসেবে কর্মরত হওয়া।

হিন্দু পুরাণ থেকে পাওয়া তথ্য মতে যমরাজ তাঁর নিজের কন্যা ঈরাবতী বা মতান্তরে শোভাবতীর বিবাহ দিয়েছিলেন চিত্রগুপ্তের সাথে। আবার শ্রদ্ধাদেব মনু তাঁর পুত্রী সুদক্ষিণা তথা নন্দিনীর বিবাহ দিয়েছিলেন চিত্রগুপ্তের সাথে। তাঁর প্রথমা স্ত্রীর ৮ সন্তান হচ্ছেন কুলশ্রেষ্ঠ, মাথুর, গৌর, ভট্টনগর,  সাক্সেনা, আম্বাস্থ, নিগম, ও কর্ণ। এবং দ্বিতীয়া স্ত্রীর ৪ পুত্র হচ্ছেন শ্রীবাস্তব, সূর্যধ্বজ, বাল্মীক, এবং আস্থানা। এই চিত্রগুপ্ত ও তাঁর ১২ জন পুত্রের বংশধরগণ সমাজে পরিচিতি পেলেন কায়স্থ নামে। আজকের সনাতন হিন্দু সমাজে যে কায়স্থ শ্রেণীর মানুষ দেখা যায়, তাঁরা চিত্রগুপ্তের বংশধর বলেই ধারণা করা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুনঃ  দেবব্রত ভীষ্মঃ অস্টবসুর এক অভিশপ্ত বসুদেবতা || Devavrata Bhishma -The Cursed Vasu of the Asta Vasus

পদ্মপুরাণ বলছে চিত্রগুপ্ত অতিপ্রাকৃত জ্ঞানের অধিকারী। গরুড় পুরাণে চিত্রগুপ্তকে অক্ষরদাতা হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। তাছাড়া চিত্রগুপ্ত হলেন নবগ্রহের অন্যতম কেতু। পঞ্জিকায় উল্লেখিত তথ্য অনুসারে ভাইফোঁটা বা যমদ্বিতীয়াতে যমরাজের পাশাপাশি চিত্রগুপ্তের পূজারও বিধান। বর্তমানে চিত্রগুপ্তের পূজা ততটা প্রচলিত না হলেও প্রাচীন বঙ্গদেশে ভাইফোঁটার দিনে চিত্রগুপ্তের পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে এই পূজার মূল উদ্যোক্তা ছিল বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভা।

তাছাড়া চিত্রগুপ্তকে উৎসর্গ করে অসংখ্য মন্দির রয়েছে আমাদের ভারতবর্ষে। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহতে অবস্থিত চিত্রগুপ্ত মন্দির এবং তামিলনাড়ুর কাঞ্চীপুরমে অবস্থিত চিত্রগুপ্ত মন্দির বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনায় দেখা যায় এই মন্দিরগুলো এক হাজার বছরেরও পুরোনো। আর এ থেকেই বোঝা যায় কায়স্থ সমাজের শেকড় কর গভীরে প্রেথিত।

Rate this post

Leave a Comment

error: Content is protected !!