You are currently viewing যদি রামায়ণে শ্রীকৃষ্ণ এবং মহাভারতে শ্রীরামচন্দ্র আসতেন তাহলে কি ঘটত?

যদি রামায়ণে শ্রীকৃষ্ণ এবং মহাভারতে শ্রীরামচন্দ্র আসতেন তাহলে কি ঘটত?

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, ত্রেতা যুগে যদি শ্রীরামের পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণ এবং দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের পরিবর্তে শ্রীরাম জন্ম নিতেন তাহলে কি ঘটতে পারত? আপনারা জানেন রাম এবং কৃষ্ণ দুজনেই স্বয়ং ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার হওয়ার কারনে শ্রীবিষ্ণু ইচ্ছা করলেই রাম এবং কৃষ্ণের আবির্ভাবের সময় পাল্টে দিতে পারতেন। তবে এরকম কিছু ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

  • শ্রীকৃষ্ণ কৈকেয়ীর প্রতারণায় বনবাসে যেতেন কি?
  • শ্রীকৃষ্ণকে ধোকা দিয়ে রাবণ কি সীতা হরণ করতে পারতেন?
  • শ্রীকৃষ্ণ কি লঙ্কায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশাল সেতু নির্মান করতেন?
  • রাবণকে বধ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের কি বিশাল বানর সেনার প্রয়োজন ছিল?
  • আবার অনুরূপভাবে মহাভারতে শ্রীরামের ভূমিকা নিয়েও আমাদের মনে দেখা দিত নানান প্রশ্ন। যেমনঃ
  • কৃষ্ণের স্থলে রাম থাকলে মহাভারতের যুদ্ধ কি আদৌ সংঘঠিত হত?
  • কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীরাম সরাসরি যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন কি?
  • রামের নেতৃত্বে পাণ্ডবগণ কি আদৌ জয়ী হতে পারতেন?
  • কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে পাণ্ডবদের কোন বংশধর বেঁচে থাকতেন কি?

প্রিয় দর্শক, এই প্রশ্নগুলোর আলোকে ভগবান শ্রীরাম এবং শ্রীকৃষ্ণকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে চলেছি আমরা। তো রাম এবং কৃষ্ণ যুগ পরিবর্তন করলে তারা রামায়ণ ও মহাভারতকে কিভাবে পরিচালনা করতেন তা জানার জন্য আগে আমাদেরকে জানতে হবে ভগবান শ্রীরাম ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য ও তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো।

রাম অবতারের উদ্দেশ্য ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট

রাম অবতারে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল অন্যায় ও অধর্মের নাশ করা। আরও স্পষ্ট করে বললে তাঁর পৃথিবীতে আসার মূল কারণ ছিল রাবণ নামক মহা অত্যাচারীর হাত থেকে মর্ত্ত্যবাসীকে মুক্তি প্রদান করা। তবে রাবণের পাশাপাশি তিনি কুম্ভকর্ণ, তাড়কা, খর, দূষণ, মারীচ, বালি, মকরাক্ষ, সুবাহু, কবন্ধ, বিরাধ, ত্রিশিরা প্রভৃতি অসুর, রাক্ষস ও অত্যাচারীদেরকে বধ করে অধর্ম নাশ করেছিলেন। চারিত্রিকভাবে শ্রীরাম ছিলেন সমগ্র মানবকুলের জন্য আদর্শ পুরুষ তথা মর্যাদা পুরুষোত্তম। একজন আদর্শ সন্তান, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ স্বামী এবং আদর্শ রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। একপত্নীব্রত পালন করা, মাতা সীতার প্রতি অসীম প্রেম ও  কর্তব্যবোধ, মাতা অহল্যাকে উদ্ধার, বিমাতা কৈকেয়ীর নিষ্ঠুর আদেশ পালন করা প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছেন নারীর মর্যাদা এবং সম্মান। সর্বশক্তিমান হয়েও অসীম ধৈর্য্য, বিনয়, শৃঙ্খলতা, ভ্রাতৃত্ত্ববোধ, সাম্য, নীতি ও কর্তব্যপরায়নতার চূড়ান্ত উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। তাছাড়া কোন কোন মতে ভগবান বিষ্ণুর ১৬টি কলার মধ্যে ১৪টি কলা প্রদর্শন করেছিলেন তিনি।

কৃষ্ণ অবতারের উদ্দেশ্য ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট

অপরদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণাবতার। বলা হয় তিনি শ্রীবিষ্ণুর ১৬টি কলাই তাঁর লীলায় প্রদর্শন করেছেন। তো শ্রীরামচন্দ্রের মত শ্রীকৃষ্ণ অবতারের আবির্ভাবের মূল উদ্দেশ্যও ছিল ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও অধর্মের নাশ তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। তবে রাবণ বধের মত কোন একক মূল উদ্দেশ্য নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন নি। কারণ ত্রেতা যুগের তুলনায় দ্বাপর যুগের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক অবক্ষয় ছিল তুঙ্গে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যে আগমনের মূল উদ্দেশ্যগুলো ছিলঃ মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবদের বিরোধের চুড়ান্ত পরিণতি দান করা, সমগ্র মানবজাতির জন্য গীতার অমৃত জ্ঞান দান করা, বৃন্দাবনের রাসলীলার মাধ্যমে জীবাত্মা ও প্রমাত্মার আধ্যাত্মিক প্রেম ও ভক্তির শিক্ষা দান করা প্রভৃতি। শ্রীরামচন্দ্রের মত তিনিও পুতনা, তৃণভর্তা, অঘাসুর, বকাসুর, বৎসাসুর, ধেনুকাসুর, প্রলম্বাসুর, কালীয় নাগ, অরিষ্টাসুর, কেশী রাক্ষস, ব্যামাসুর, কংস প্রভৃতি অসুর ও রাক্ষসদেরকে বধ করেছিলেন। তবে শ্রীরামচন্দ্র যেভাবে তাঁর নিজের জীবনকে সরলতা, নীতি ও আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ সেখানে কিছুটা ব্যাতিক্রম। তিনি প্রয়োজনে তাঁর বাকচাতুর্য, ছলনা, ক্ষুরধার বুদ্ধি, চতুরতা ও আত্মবিশ্বাস ভঙ্গকারী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আগে থেকেই দূর্বল করে ফেলতেন তাঁর প্রতিপক্ষকে। কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ঐশ্বরিক ও অলৌকিক ক্ষমতাও প্রয়োগ করেছেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র তাঁর মানবীয় গুণ ও শক্তির বাইরে কোন ঐশ্বরিক শক্তি প্রয়োগ করেন নি।

আরও পড়ুনঃ  সীতার অভিশাপঃ আজও কষ্ট পাচ্ছেন অভিশপ্ত চার জন || Curse of Mata Sita Devi

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক রামায়ণে শ্রীরামের পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণ এলে কি ঘটত?

এক্ষেত্রে প্রথম যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে আসে সেটি হচ্ছে, কৈকেয়ীর চক্রান্তে শ্রীকৃষ্ণ কি বনবাস স্বীকার করতেন? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, করতেন। এখানে তিনটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত রামের মত শ্রীকৃষ্ণ পিতৃ আজ্ঞা ভঙ্গ করতেন না। দ্বিতীয়ত, রামের মত শ্রীকৃষ্ণও মাতা ও নারীদের মর্যাদা সবসময় সমুন্নত রেখেছেন। মহাভারতে গান্ধারীর দেওয়া অভিশাপ বিনা দোষে তিনি মাথা পেতে নিয়েছিলেন। সুতারাং বিমাতার চাওয়া তিনি অবশ্যই পূর্ণ করতেন। এবং তৃতীয়ত, রাবণ ও তাঁর মিত্র রাক্ষসদের বধ করার জন্য সপত্নীক বনবাসে যাওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণকে ধোকা দিয়ে রাবণ কি সীতা হরণ করতে পারতেন?

এ প্রশ্নের উত্তরও হচ্ছে হ্যাঁ, পারতেন। রাম এবং শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই স্বয়ং ভগবান এবং অন্তর্যামী। সীতা হরণ ভগবান শ্রীবিষ্ণু কর্তৃক রচিত নাটকের একটি দৃশ্য মাত্র। কারণ মাতা সীতাকে হরণ না করলে লঙ্কায় গিয়ে অত্যাচারী রাক্ষসদের বধ করার কোন কারন তৈরি হচ্ছিল না। সুতারাং রামের স্থানে শ্রীকৃষ্ণ হলে তিনিও রাবণকে মাতা সীতাকে হরণ করার সুযোগ দিতেন।

তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ কি লঙ্কায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশাল সেতু নির্মান করতেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দুই প্রকারের হতে পারে। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন অসীম ধৈর্যের অধিকারী। তাই তিনি ধৈর্যধারন করে তাঁর বানর সেনা দিয়ে কালক্ষেপণ করে সমুদ্রের উপরে সেতু নির্মাণ করেছিলেন। তবে শ্রীরামের পরিবর্তে যদি শ্রীকৃষ্ণ থাকতেন তাহলে তিনি এর থেকে কম সাপেক্ষ কোন পদ্ধতি নির্ধারণ করতেন। আপনারা নিশ্চই জানেন দ্বারকা নগরী নির্মাণের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্রদেবের কাছ থেকে ভূমি প্রার্থনা করেছিলেন, এবং সমুদ্রদেবের প্রদত্ব সেই ভূমিতে নির্মিত হয়েছিল দ্বারকা। অনুরূপভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্রদেবকে লঙ্কায় যাওয়ার রাস্তা প্রদান করার জন্য প্রার্থনা করতে পারতেন এবং বিনা সেতুতে পৌছে যেতেন সোনার লঙ্কায়। অথবা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেতু নির্মান করার জন্য দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার সাহায্যও গ্রহণ করতে পারতেন। ঠিক যেভাবে তিনি বিশ্বকর্মার দ্বারা দ্বারকা নগরী নির্মাণ করিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই তিনি তাঁর সাহয্যে সমুদ্রের উপরে সেতু নির্মাণ করিয়ে নিতে পারতেন।

 চতুর্থ প্রশ্নটি হচ্ছে রাবণকে বধ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের কি বিশাল বানর সেনার প্রয়োজন ছিল?

না ছিল না। আপনারা জানেন মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কোন অস্ত্র ধারণ করেননি। তাঁর এ সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তিনি যদি সুদর্শন চক্র নিয়ে রণভূমিতে প্রবেশ করেন তাহলে মুহূর্তেই সমস্ত কৌরব সেনা পরাস্ত হতে বাধ্য। সুতারাং রাবণ ও তাঁর সমগ্র রাক্ষস সেনাকে পরাজিত করতে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির প্রয়োজন হত না। তবে শ্রীরামচন্দ্রের ক্ষেত্রে একটি বিশাল মিত্রবাহিনীর প্রয়োজন হয়েছিল এই কারনে যে, ভগবান শ্রীরাম কোন অলৌকিক শক্তি বা ঐশ্বরিক অস্ত্র ব্যবহার করেননি। বরং তিনি নিজেকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে প্রদর্শন করেছেন এবং মানবীয় শক্তি দ্বারা কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয় তা আমাদেরকে শিখিয়ে গিয়েছেন।

আরও পড়ুনঃ  অশ্বিনীকুমার কারা? কিভাবে জন্ম হয়েছিল তাঁদের? সুকন্যা ও চব্যনের কাহিনী। Vedic Ashwini Kumar Brothers

প্রিয় দর্শক এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম রামায়ণে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটলে রাবণবধ কাহিনীতে তাৎপর্যপূর্ণ কোন পরিবর্তন হত না। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন শ্রীরামচন্দ্র যদি তাঁর সলতা ও মানবীয় গুণ নিয়ে মহাভারতে প্রবেশ করতেন তাহলে কি ঘটতে পারত?

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের পরিবর্তে শ্রীরামচন্দ্র এলে কি ঘটত?

আজ্ঞে হ্যাঁ, শ্রীরামচন্দ্র যদি মহাভারতে আসতেন তাহলে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন অবশ্যই আমরা দেখতে পেতাম। আসুন একে একে সেই প্রেক্ষাপটগুলো আলোচনা করা যাক।

তো প্রথমেই আসা যাক, দ্রৌপদী ও পাণ্ডবদের অন্যান্য স্ত্রীদের প্রসঙ্গে-

আপনারা জানেন শ্রীরামচন্দ্র এক পতি-পত্নী ব্রত পালন করেছিলেন এবং তাঁর ভ্রাতারাও তাকে অনুসরণ করেছিলেন। সুতারাং পঞ্চপাণ্ডবগণের সাথে দ্রৌপদীর বিবাহ অথবা দ্রৌপদীকে বিবাহ করার পর পাণ্ডবদের অন্য বিবাহ করার অনুমতি শ্রীরামচন্দ্র প্রদান করতেন না। তবে দ্রৌপদীর বিবাহের সময় উদ্ভূত পরিস্থিতি তিনি কোণ দিকে পরিচালনা করতেন তা অনুমান করা সত্যিই কষ্টকর।

এবার আসি মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের স্থানে শ্রীরাম থাকলে মহাভারতের যুদ্ধ আদৌ সংঘঠিত হত কিনা সেই প্রসঙ্গে?

প্রিয় দর্শক, আমরা মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্র বিশ্লেষন করে দেখতে পাই, তিনি ছিলেন পরম দয়ালু, ক্ষমার প্রতিভু, ত্যাগ এবং ন্যায়ের জীবন্ত মূর্তি এবং তীব্রভাবে ভ্রাতা-বাৎসল। নিজের ভ্রাতাকে রাজা নিযুক্ত করার জন্য তিনি নিজের ন্যায্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। সুতারাং ভ্রাতাদের প্রতি তাঁর মনোভাব আমাদের অজানা নয়। আর তাই মহাভারতে যখন ভ্রাতাদের মধ্যেই সিংহাসন নিয়ে বিরোধ দেখা দিত, তখন তিনি হয়ত তাঁর মিত্রগণ তথা পাণ্ডবদেরকে সিংহাসনের বাসনা ত্যাগ করে বনবাসী হওয়ার পরামর্শ দিতে পারতেন।

আবার রাম চরিত্রের আরও একটি দিক হচ্ছে নারীর সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা। সেদিক দিয়ে বিচার করলে রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে অপমান করার জেরে তিনি পাণ্ডবদেরকে যুদ্ধের পরামর্শ দিলেও দিতে পারতেন। তবে তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কি হত সেটা অনুমান করা মুশকিল।

ধরে নেওয়া যাক ভগবান শ্রীরামচন্দ্র কৌরবদের সাথে পাণ্ডবদের যুদ্ধ করার অনুমতি প্রদান করলেন। তাহলে সেক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীরাম সরাসরি যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন কি?

এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, তিনি নিজেও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। আপনারা জানেন রামায়ণে শ্রীরাম তাঁর মিত্র সুগ্রীবের জন্য বালিকে বধ করেছিলেন। সুতারাং মহাভারতে এসে তিনি তাঁর মিত্র পাণ্ডবদের জন্য অবশ্যই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। এবং শুধু তাই নয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথের ধ্বজায় অবস্থান করছিলেন শ্রীহনুমান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের মত হনুমানকেও যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ করেননি। তবে অর্জুনের পক্ষে শ্রীরাম যুদ্ধ করলে তিনি অবশ্যই হনুমানকে যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করতেন। কারন কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সৈন্য সংখ্যায় পান্ডবগণ ছিলেন দূর্বল। সুতারাং শ্রীহনুমানকে যুদ্ধভূমিতে প্রবেশ করাতে শ্রীরাম তাঁর স্বভাবসুলভ সহজ-সরল হিসাব-নিকাশকেই প্রাধান্য দিতেন।

এবার আসা যাক, অর্জুন কর্তৃক জয়দ্রথকে, অর্জুন কর্তৃক কর্ণকে এবং ভীম কর্তৃক দুর্যোধনকে বধ করার প্রসঙ্গে। প্রশ্ন হল ভগবান শ্রীরামের নেতৃত্বে অর্জুন কি জয়দ্রথকে সূর্যাস্তের আগে বধ করে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারতেন? আপনারা জানেন অভিমন্যুকে বধ করার জেরে অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন পরদিন সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে বধ করবেন। অন্যথায় তিনি তাঁর নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। সেদিন অর্জুন তুমুল যুদ্ধ করেছিলেন বৈকি। তবে সেদিন দ্রোণাচার্যকে পরাজিত করে, লক্ষ লক্ষ সেনাকে পাশ কাটিয়ে, শকটব্যুহ, চক্রব্যুহ, পদ্মব্যুহ ও সূচীব্যুহ ভেদ করে, এবং কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, বৃষসেন, শল্য ও কৃপাচার্যের নেতৃত্বে ৬০,০০০ রথী, ১৪,০০০ হাতি, ১ লক্ষ অশ্বারোহী এবং এক লক্ষ কুড়ি হাজার পদাতিক সৈন্য ভেদ করে জয়দ্রথকে বধ করা সম্ভব নয় বিধায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছিলেন। ফলে সূর্যাস্ত অতিক্রান্ত হয়েছে ভেবে জয়দ্রথ ব্যুহের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলে অর্জুন তাকে বধ করেছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  ভারতের এই ৯ মন্দিরে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ || 9 Men Only Temples In India ||

কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্র বিশ্লেষন করলে আমরা দেখতে পাই, কোন যুদ্ধ জয় করার জন্য তিনি কোন প্রকার চাতুর্যের আশ্রয় নেন নি। তাই বলা যায় অর্জুনের ক্ষেত্রেও তিনি শ্রীকৃষ্ণের মত কোন ছলনার আশ্রয় নিতেন না। এবং একারনে অর্জুন যদি জয়দ্রথকে সেদিন বধ না করতে পারতেন তবে তাঁর ফল কি হতে পারত তা আপনাদের সকলেরি জানা।

আবার কর্ণকে বধ করার ক্ষেত্রেও শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামচন্দ্রের বিচারের ভিন্নতা থাকতে পারত। শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে অর্জুন যখন কর্ণকে বধ করেছিলেন, তখন কর্ণ ছিলেন অসহায়। তাঁর রথের চাকা ছিল মাটিতে বসা, তিনি ছিলেন নিরস্ত্র এবং তাঁর অর্জিত অস্ত্রজ্ঞান বিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি। এমনই এক পরিস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণের প্ররোচনায় নিরস্ত্র কর্ণকে বধ করেছিলেন অর্জুন।

এবার ভেবে দেখুন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র কি কখনোই এই প্রকার কর্মের সমর্থন বা অনুমতি প্রদান করতেন? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে- না। তিনি তাঁর নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে এবং যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে কখনোই কর্ণকে বধ করার পরিকল্পনা করতেন না। এবং সরাসরি কর্ণের সাথে যুদ্ধ করে কর্ণকে বধ করা বা পরাজিত করা অর্জুনের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব ছিল বলা যায়। সেক্ষেত্রে হয়ত কর্ণের হাতে অর্জুনও বধিত হতে পারতেন।

আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, ভীম ও দুর্যোধনের অন্তিম যুদ্ধে ভীম কি দুর্যোধনকে বধ করতে পারতেন? আপনারা জানেন গান্ধারীর দিব্যদৃষ্টির কারনে দুর্যোধনের কোমর থেকে উরুদেশ পর্যন্ত অংশ ছাড়া বাকী শরীর ছিল সুরক্ষিত। আর গদাযুদ্ধে কোমরের নিম্নাংশে প্রহার করা নিষিদ্ধ। ঠিক এই কারনে ভীম কিছুতেই দুর্যোধনকে পরাজিত করতে পারছিলেন না। এসময় শ্রীকৃষ্ণের ইশারায় ভীম দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করে তাকে পরাজিত ও বধ করেন।

এবার ভাবুন তো শ্রীরামচন্দ্র কি নীতি বিসর্জন দিয়ে ভীমকে এই কাজ করতে উৎসাহিত করতেন? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে না। ফলে পুরোপুরি উলটে যেতে পারত ভীম এবং দুর্যোধনের যুদ্ধের ফলাফল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অর্জুন ও ভীমের মত মহারথীদের হারিয়ে পাণ্ডবগণ কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ী হতে পারতেন? আজ্ঞে হ্যাঁ, শ্রীকৃষ্ণের স্থানে শ্রীরাম থাকলেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষই জয়ী হতেন। কারন দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার ধারন করার অন্যতম একটি মূল উদ্দেশ্য ছিল মহাভারতের যুদ্ধের মাধ্যমে অধর্মের নাশ করে ন্যায় তথা ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা। এবং শ্রীবিষ্ণুকে ও তাঁর পরিকল্পনাকে নাশ করার ক্ষমতা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কারো নেই। তবে যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষ বিজয়ী হলেও সর্বোচ্চ পরিমান কৌরব সেনা সংহার করতেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র নিজেই।

তবে মহাভারতে শ্রীরামচন্দ্রের আরও একটি বিষয় আলোচনা না করলেই নয়। আর সেটি হচ্ছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে পাণ্ডবদের কোন বংশধর বেঁচে থাকতেন কি?

আপনারা জানেন অশ্বত্থামা দুর্যোধনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাণ্ডবদেরকে নির্বংশ করতে চেয়েছিলেন। আর তাই তিনি ব্রহ্মাস্ত্র আহবান করে আঘাত করেছিলেন অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভে। এসময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি ব্যবহার করে পুনরায় প্রাণ দান করেছিলেন উত্তরার গর্ভস্থ পাণ্ডবদের বংশধর পরিক্ষিৎ মহারাজকে।

তবে মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্থানে ভগবান শ্রীরাম থাকলে তিনি কি তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে পরিক্ষিতকে নবজীবন দান করতেন? আপনারা জানেন, রামায়ণের যুদ্ধে মেঘনাদ যখন লক্ষ্মণকে শক্তিশেল দ্বারা বিদ্ধ করেন, তখন লক্ষ্মণকে বাঁচাতে শ্রীরামচন্দ্র কোন আধ্যাত্মিক শক্তি ব্যাবহার না করে শ্রী হনুমানের দ্বারা সেই বানের প্রতিষেধক আনিয়েছিলেন? সুতারাং পরীক্ষিৎকে বাঁচাতে শ্রীরামচন্দ্র কি ধরণের ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন বা আদৌ পরিক্ষিতকে জীবন দান করতেন কিনা সেই বিষয়ের মতামত কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Rate this post

Leave a Reply