বামন দ্বাদশী ব্রত কথা || বামন অবতারের কাহিনী || Story of Vamana Avatar of Lord Vishnu ||

ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশী তিথিতে ভগবান শ্রীবিষ্ণু অবতার ধারণ করেছিলেন বামন রূপে। এ উপক্ষ্যে এই তিথিতে দেশজুড়ে পালিত হয় বামন দ্বাদশী ব্রত। আসুন জেনে নেওয়া যাক বামন দ্বাদশীর ব্রতকথা।

ভক্তরাজ প্রহ্লাদের পৌত্র মহাদানবীর রাজা বলি ছিলেন মহাশক্তিশালী। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামহ প্রহ্লাদের মতো অনন্য ভক্ত, পিতা বিরোচনের মতো দানশীল, আর বীরত্বে তিনি হিরণ্যকশিপুকেও টক্কর দিতে পারতেন। সর্বদা তিনি গুরু শুক্রাচার্যের সেবায় নিবেদিত ছিলেন। একদা গুরু শুক্রাচার্যের প্রেরণায় বলিরাজা মহাযজ্ঞ বিশ্বজিৎ যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। সেই যজ্ঞের ফলে তিনি দেবতাদের স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল— সমগ্র ত্রিভুবনের অধিকারী হয়ে ওঠেন।

এদিকে দেবতারা স্বর্গচ্যুত হয়ে দুঃখভারে ক্লান্ত হলে, তাঁদের মাতা অদিতি স্বামী মহর্ষি কশ্যপের শরণ নিলেন। অদিতির ব্যাকুল আর্তি শুনে মহামুনি কশ্যপ বললেন “হে দেবমাতা, এই দুঃসময়ে ভগবান মধুসূদন ছাড়া আর কারো আশ্রয় নেই। তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য তুমি পয়োব্রত পালন কর।”

মাতৃ হৃদয়ে ব্যাকুল ভক্তি নিয়ে দেবমাতা অদিতি পালন করলেন পয়োব্রত। ব্রতশেষে হঠাৎ তাঁর সম্মুখে প্রকাশিত হলেন চতুর্ভুজ, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী শ্রীভগবান নারায়ণ। শ্রীনারায়ণের দর্শন পেয়ে আপ্লুত হলেন দেবমাতা অদিতি।  মাতৃসুলভ স্নেহে আপ্লুত হয়ে অদিতি তখন ভগবানকে নিজের সন্তানরূপে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, “হে প্রভু, আমি আদিত্যগণকে জন্মদান করেছি, কিন্তু স্বয়ং ভগবাঙ্কে জন্মদান করার সুখ আমি এখনো লাভ করতে পারিনি। এদিকে বলিরাজার প্রচণ্ড পরাক্রমের ফলে আমার সন্তানেরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। প্রভু, আপনি এই মাতৃহৃদয়ের পীড়াকে প্রশান্ত করুন, আমি আপনাকে আমার সন্তান হিসেবে প্রাপ্ত করতে চাই। সেইসাথে আপনার মাধ্যমে আমি আমার অন্যান্য সন্তানদেরকে রক্ষা করতে চাই। ”

সর্বহৃদয়ের অধিপতি, করুণাময়  শ্রীভগবান মৃদু হাস্য করে বললেন, “ হে মাতঃ, আমার প্রুতি আপনার মাতৃসুলভ স্নেহে আমি অত্যন্ত আপ্লুত হয়েছি। আমি শীঘ্রই আপনার গর্ভে জন্ম নেব। আপনার মাতৃস্নেহের স্বাদ নেব, আপনার সন্তানদের রক্ষা করব আর আর দানবরাজ বলির গর্বও ভঙ্গ করব।”

আরও পড়ুনঃ  তুলসী মাহাত্ম্য-বৃক্ষ হয়েও তুলসী কেন পূজনীয়া? || Tulsi Mahatmya ||

এভাবে, ভাদ্রমাসের শুক্লা দ্বাদশীতে শ্রীভগবান অপূর্ব বামনবেশে আবির্ভূত হলেন মাতা অদিতির পুত্র রূপে। ক্ষুদ্র অথচ দীপ্তিময় সেই ব্রাহ্মণ বালককে দর্শনে অভিভূত হলেন মুনি-ঋষিরা । স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি তাঁর উপনয়ন সম্পন্ন করলেন, দেবতারা তাঁকে দান ও অলঙ্কারে ভূষিত করলেন। এরপর নিয়ম অনুসারে ভিক্ষার জন্য বেরিয়ে পড়লেন সেই  ব্রাহ্মণ বালক, হাতে তাঁর ছত্র ও কমণ্ডলু।

কিছুকাল পরে বামনদেব পৌঁছালেন নর্মদার তীরে ভৃগুকচ্ছক্ষেত্রে, যেখানে বলিরাজা তাঁর মহাযজ্ঞে ব্যস্ত। সেখানে খর্বকায় বামনদেবের উপস্থিতিতে যজ্ঞশালায় উপস্থিত সকলেই তাঁর অপূর্ব জ্যোতির্ময় রূপ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। রাজা বলি নিজে উঠে দাঁড়িয়ে ভক্তিভরে তাঁর শ্রীচরণ বন্দনা করলেন। পুজা অর্চনা শেষে বলিরাজা বললেন, “হে ব্রাহ্মণকুমার, আমাকে বলো, তুমি কী চাও? আমি তোমাকে তোমার অভীষ্ট অবশ্যই দান করব।”

তখন বামনদেব স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন “হে মহাদানবীর, আমি এক তুচ্ছ ব্রাহ্মণ। আমার ত্রিপদ ভূমিই যথেষ্ট। আপনি আমাকে তিন পা পরিমান জমি আমাকে দান করুন।”

রাজা বলি প্রথমে হেসে উঠলেন, “আমি ত্রিলোকের অধিপতি, এক দ্বীপ বা এক লোক পর্যন্ত তোমাকে দান করতে পারি। আর তুমি শুধু তিন পা ভূমি চাও?”
শ্রীবামনদেব বললেন, “যার যা প্রাপ্য, সেটুকুই যথেষ্ট। আমি ত্রিপাদ ভূমিতেই সন্তুষ্ট হব।”

এদিকে বামনদেবের আগমন ও দান প্রার্থনা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করছিলেন অসুর গুরু শুক্রাচার্য। খর্বকায় বামন বালকের উপরে সন্দেহ হওয়ায় তিনি এই এই বালকের আসল পরিচয় জানার জন্য ধ্যান শুরু করলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, ধ্যানের মাধ্যমে শুক্রাচার্য জানতে পারলেন, এ বামন বালক আর কেউ নন, স্বয়ং শ্রীহরি বিষ্ণু। সাথে সাথে তিনি বলিরাজাকে সতর্ক করলেন, “রাজন, শ্রীহরি দেবতাদের পক্ষ নিয়ে তোমাকে ছলনা করছেন। তুমি তাঁকে দান করলে সবকিছু হারাবে। এই দান দেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

কিন্তু বলির হৃদয়ে অন্য দৃঢ় সংকল্প। তিনি ভাবলেন, “আমি ভক্ত প্রহ্লাদের বংশধর। যদি শ্রীহরি আমার কাছে দান চান, আমি তাঁকে ফিরিয়ে দেব কী করে? ভগবানকে কিছু দেওয়ার জন্য যদি আমাকে নরকেও যেতে হয়, তবুও আমি পিছপা না। পাপীগন পাপ কর্ম করে নরক ভোগ করে, আমি না হয় ভগবানের চরণে সর্বস্ব সমর্পণের জন্য নরকেই যাবো!”

আরও পড়ুনঃ  শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম

তাই এই প্রথমবার তিনি গুরুকে অমান্য করলেন। শুক্রাচার্যের কথা অমান্য করে দান দিতে উদ্যত হলেন বামনদেবকে। আর ক্ষুব্ধ হয়ে শুক্রাচার্যও অভিশাপ দিলেন বলিরাজাকে, “বলি, তুমি শ্রীভ্রষ্ট হবে।” তবুও বলি বিচলিত হলেন না। তিনি কমণ্ডলু হাতে সংকল্প নিলেন দান করার।

অতঃপর, তিনি বললেন— “হে বামন, নাও, মাপো তোমার ত্রিপদ ভূমি।”
বলি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যখন সেই ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণ মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন বিশাল ত্রিবিক্রম রূপে! স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর সীমাহীন আকার। এক পদক্ষেপে তিনি পৃথিবী আচ্ছাদিত করলেন, দ্বিতীয় পদক্ষেপে স্বর্গলোক অধিকার করলেন। দেবতারা আনন্দে ভাসল, ব্রহ্মা তাঁর ঊর্ধ্বচরণে অর্ঘ্য নিবেদন করলেন।

এবার ভগবান প্রশ্ন করলেন, “হে রাজন, আমার তৃতীয় পদক্ষেপ রাখব কোথায়?”

মহাদানবীর বলি কণ্ঠে অটল ভক্তির সুরে বললেন, “প্রভু, আমার মস্তক ছাড়া আর কিছু নেই। এই শিরই আপনার তৃতীয় পদক্ষেপের স্থান।” আর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ভগবানের শ্রীচরণে মস্তক সমর্পণ করলেন। ভগবান বামন সেই মস্তকে পদার্পণ করলেন।

এভাবেই বলিরাজা সম্পূর্নভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন শ্রীভগবানের চরণে। সমস্ত ত্রিলোক জেনেছিল বলিরাজার সমর্পণের কথা ভক্তির কথা। এমনকি তাঁর পিতামহ প্রহ্লাদও ভগবান বিষ্ণুকে বলেছিলেন, “প্রভু, আমার পৌত্রের আপনার প্রতি এই অটুট ভক্তি ও সমর্পণ দেখে আপনার প্প্রতি আমার ভক্তিকে খুব ছোট মনে হয়। ”

শ্রীবামনদেব বলির ভক্তি দেখে অশেষ কৃপায় বললেন “হে বলি, তুমি সত্যিই মহাভক্ত। তুমি এখন সুতলে গমন করো। সেখানে বিশ্বকর্মা নির্মিত প্রাসাদে বাস করবে। আমি স্বয়ং তোমার দ্বাররক্ষক হয়ে থাকব। আর সাবর্ণি মন্বন্তরে তুমি পুনরায় দেবতাদের রাজা ইন্দ্র হবে।”

এই আশীর্বাদ পেয়ে বলি আনন্দাশ্রুতে ভিজে গেলেন। তিনি সানন্দে তাঁর পিতামহ প্রহ্লাদের সাথে সুতলে গমন করলেন। অন্যদিকে শ্রীবামনদেব দেবতাদের স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে দেবমাতা অদিতির অভিলাষ পূর্ণ করলেন।

বামনদেবের এই কাহিনীর মূলকথা হচ্ছে, বামনদেবের তিন পা জমি আসলে ভক্তদের দেহ, মন আর ধন। এগুলো ভগবানের সেবায় সমর্পণ করতে পারলে মানুষ সত্যিই মুক্ত হয়। তাই আসুন আনন্দচিত্তে গেয়ে উঠি “জয় বামন ভগবান! জয় ভক্তপ্রতিপালক শ্রীহরি!”

1.5/5 - (2 votes)

Leave a Comment

error: Content is protected !!