বৈশাখ মাসের ব্রত হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রত। এই ব্রত পালন করলে পরম সুখ শান্তিতে ভরে ওঠে জীবন। এই ব্রত প্রভাবে ব্রতকারীর চোখের জলও পড়ে না, বরং, ধন-ধান্য ও সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে জীবন।
হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণঃ
- তুলসীপাতা।
- দুর্বা ঘাস।
- আলো চাল (আতপ চাল)।
- কাঁঠালী কলা।
- মালা।
- ঘট।
- ও আমপাতা।
হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের সময় বা কালঃ
বৈশাখ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রত পালনে বিধান। অর্থাৎ, বৈশাখ মাসের কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে যথারীতি পূজা ও ধ্যান সহযোগে এই ব্রত পালন করা উচিত।
কারা হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রত পালন করতে পারেনঃ
হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রত মূলত মেয়েদের জন্য পালনীয় একটি ব্রত। যেকোন সধবা অথবা বিধবা এই দুই শ্রেণীর মেয়েরাই এই ব্রত করতে পারে। তবে কুমারী মেয়েরা এই ব্রত পালন করতে পারে না।
হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের ব্রতকথাঃ
এক গ্রামের এক গোয়ালা বৌ সেই গ্রামেরই এক ব্রাহ্মণীর সঙ্গে সই পাতিয়েছিল। এদের মধ্যে ভাবও ছিল খুব। প্রত্যেক বার বৈশাখ মাসে ব্রাহ্মণী হরিষ মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করতেন আর গোয়ালা বৌও তাঁর ব্রত করা দেখতো। এইভাবে কিছুদিন যাবার পর গোয়ালা বৌয়েরও এই ব্রত করার ইচ্ছে হল আর সে ব্রাহ্মণীকে জিগ্যেস করল যে, এই ব্রত করলে কী ফল হয়। ব্রাহ্মণী তার কথা শুনে বললেন যে, এই ব্রত করলে জীবনে কারুর চোখের জল পড়ে না, উল্টে তার সারা জীবন কেটে যায় খুব আনন্দে।
গোয়ালা বৌয়ের আর আনন্দ ধরে না। সে ধরে বসল ব্রাহ্মণীকে আর বলল যে, সেও এই ব্রত করতে চায়। ব্রাহ্মণী গোয়ালা বৌকে অনেক বোঝালেন, তিনি বললেন, ‘তুমি পারবে না সই, এ ব্রত করা খুবই কঠিন।’ কিন্তু গোয়ালা বৌ তাঁর কোনো কথাই শুনতে চাইল না। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণী বাধ্য হয়ে তাকে ব্রতের সব কথা বলে দিলেন। এরপর বৈশাখ মাস পরার সঙ্গে সঙ্গে গোয়ালা বৌও এই হরিষ মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করতে আরম্ভ করে দিল। এই ভাবে দুটো ব্রত করার পরই মা মঙ্গলচণ্ডীর তার ওপর দয়া হল আর সঙ্গে সঙ্গে ঐশ্বর্য্য, সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠল গোয়ালা বৌয়ের সংসার।
এর আগে গোয়ালা বৌ খুবই গরীব ছিল। এখন তার এত ধন-দৌলত হওয়ার ফলে সে কেমন যেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে আর সহ্য করতে পারল না তার অবস্থার এই পরিবর্তন। এখন খানিক কাঁদবার ইচ্ছে হ’তে লাগল তার। কিন্তু যার এতো ঐশ্বর্য্য তার কান্না আসবে কেমন করে! শেষে গোয়ালা বৌ আবার গিয়ে ব্রাহ্মণীকে ধরে বসল আর বলল, ‘সই! আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না, ইচ্ছে হচ্ছে খুব খানিকটা কাঁদি। তুমি আমায় বলে দাও সই, কী করলে আমি খানিকটা কাঁদতে পারবো ?”
গোয়ালা বৌয়ের কথা শুনে ব্রাহ্মণী তো একেবারে আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘সে কী সই, তুমি কাঁদবে কেন? তোমার এমন সুখের সংসার হয়েছে, এতআনন্দ ভোগ করছ—এতে কাঁদতে আবার কেউ চায় নাকি? এযে হরিষ মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত। এই ব্রত করার ফলে, শুধু আনন্দই হয়—কান্নাকাটি এর কাছেই আসতে পারে না। আমি তো আগেই তোমাকে বলেছিলুম যে, এই ব্রত করা খুবই কঠিন, তখন তুমি শুনলে না—এখন কাঁদতে চাইলে চলবে কেন বল?? গোয়ালা বৌয়ের তখন প্রায় পাগলের মত অবস্থা। সে বললে, ‘আমি কাঁদতে না পেলে বাঁচবো না সই। তুমি বলে দাও, কী করলে আমার কান্না আসবে।’ সইয়ের কথা শুনে ব্রাহ্মণী খুবই চিন্তিত হ’য়ে পড়লেন, কী বলবেন কিছু ভেবে পেলেন না। এমন সময় তাঁর চোখে পড়ল একটু দূরে একটা চাষের ক্ষেত। সেখানে অনেকগুলো লাউ আর কুমড়ো ফলেছিল। ব্রাহ্মণী গোয়ালা বৌকে বললেন, ‘যাও সই, ওই ক্ষেতটা দেখা যাচ্ছে, খুব লাউ আর কুমড়ো ফলেছে ওখানে—ওই ক্ষেতে গিয়ে লাউ কুমড়োগুলোকে তুলে নাও আর গাছগুলোকে একেবারে ছিঁড়ে খুঁড়ে দাও। তাহলেই চাষারা খুব রেগে গিয়ে তোমাকে খুব গালমন্দ দেবে, তাহলেই তোমার কান্না আসবে।’ সইয়ের কথা শুনে, গোয়ালা বৌ তখুনি সেই ক্ষেতের ভেতর ঢুকে, গাছগুলো সব ছিঁড়ে খুঁড়ে দিয়ে চলে এল। কিন্তু এতে আসল কাজ কিছু হল না বরং ফল উল্টো হল, মা মঙ্গলচণ্ডীর দয়ায় গাছগুলো আবার সতেজ হয়ে উঠলো আর চাষাদেরও খুব আনন্দ হল। তারা গোয়ালা বৌয়ের কাছে গিয়ে বললে, ‘মা! তোমার হাতের ছোঁয়া লেগে আমাদের মরা গাছগুলো আবার জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। তুমি মা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। এর ফলে গোয়ালা বৌ কাঁদবার সুযোগই পেল না। সে তার সইকে গিয়ে সব কথা জানান। ব্রাহ্মণী বুঝলেন যে, মা মঙ্গলচণ্ডীর দয়াতেই এটা হয়েছে। তিনি তখন গোয়ালা বৌকে বললেন, ‘দ্যাখো সই, ওই দূরে পাহাড়ের ধারে রাজার হাতিটা মরে পড়ে আছে—তুমি ওখানে গিয়ে হাতিটার গলা জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি কর। তাহলে রাজার লোকেরা ভাববে যে, তুমি হাতির দাঁত চুরি করতে গেছ। তখন তারা তোমায় খুব মারধর করবে আর তুমিও খুব কাঁদবার সুযোগ পাবে।’
কিন্তু এবারেও কোনো কাজ হল না। গোয়ালা বৌ হাতিটার গায়ে হাত দিতেই হাতিটা বেঁচে উঠল। তাই দেখে রাজার লোকেরা একেবার অবাক হয়ে গেল আর সব কথা রাজাকে গিয়ে জানালো। সব শুনে রাজা খুব খুশি হলেন আর গোয়ালা বৌকে অনেক ধনরত্ন দিলেন। এবারেও কোনো কাজ হল না দেখে ব্রাহ্মণী বুঝলেন যে, এবারেও মা মঙ্গলচণ্ডীই দয়া করেছেন। ব্রাহ্মণী তখন বললেন, ‘দ্যাখো সই, এক কাজ করো, কতকগুলো বিষের নাড়ু তৈরী করে তোমার মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দাও, তা হলে নাড়ু খেয়ে তারা সবাই মরে যাবে আর তুমিও তখন কাঁদতে পারবে।’ সইয়ের কথামত গোয়ালা বৌ তাই করল, কিন্তু মা মঙ্গলচণ্ডীর দয়ার বিষের নাড়ু অমৃত হয়ে গেল। মেয়ের বাড়ির লোকেরা খেয়ে খুব খুশি হল আর আরও কিছু নাড়ু পাঠাবার জন্যে লিখে পাঠালো। এতেও যখন কাজ হলো না, তখন ব্রাহ্মণী গোয়ালা বৌকে বললেন, ‘যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, তখন তুমি মা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করা ছেড়ে দাও সই।’
গোয়ালা বৌ মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করা ছেড়ে দিল, এতে মা মঙ্গলচণ্ডী তার ওপর খুব বিরূপ হয়ে গেলেন। ক্রমে গোয়ালা বৌয়ের স্বামী-পুত্র, দাস-দাসী, হাতি-ঘোড়া, ধন-রত্ন সব চলে গেল। গোয়ালা বৌয়ের সব চলে যাওয়ার ফলে এবার সে হাউমাউ করে কাদতে লাগল। কান্না আর কিছুতেই সে থামাতে পারল না। শেষে ব্রাহ্মণীর কাছে গিয়ে বললে, ‘সই! আমি আর কাঁদতে পারছি না, যেমন করে পারো আমার কান্না থামিয়ে দাও।’
ব্রাহ্মণী তখন বললেন, ‘তুমি তো কাঁদতেই চেয়েছিলে সই, এখন কান্না থামাতে বললে কী হবে। যাক যা হবার হয়ে গেছে, এখন বাড়ি গিয়ে মড়াগুলো জড়িয়ে ধরে খুব খানিক কাঁদো, তার পর সেগুলোকে খুব সাবধানে রেখে সামনের মঙ্গলবার থেকে আবার মা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করতে আরম্ভ কর।’ সইয়ের কথা শুনে গোয়ালা বৌ বাড়ি ফিরে এসে’ ব্রাহ্মণীর কথামত সবই করল আর খুব খানিক মাথা খুঁড়ে কাঁদবার পর মা মঙ্গলচণ্ডীর স্তব করতে লাগল। তার পর মঙ্গলবার আসতেই সে খুব শুদ্ধাচারে মা মঙ্গলচণ্ডীর পুজো আর স্তব করল, সব শেষে দু’হাতে মার ঘট ধরে মাকে খুব ডাকতে লাগল। এমন সময় সে শুনতে পেল—কে যেন বলছে ‘আর কখনো এমন কাজ করিস নি, যা তোর আর কোনো ভয় নেই। এই ঘটের জল মড়াগুলোর গায়ে ছিটিয়ে দে, তাহলেই সবাই বেঁচে উঠবে।’
ঘটের জল ছিটিয়ে দেওয়ার ফলে গোয়ালা বৌয়ের সবাই মা মঙ্গলচণ্ডীর দয়ায় বেঁচে উঠল, আর তার আগের অবস্থাও ফিরে এল। গোয়ালা বৌ তখন খুব শুদ্ধাচারে মার ঘটটি তুলে রেখে ছুটে গেল ব্রাহ্মণীর কাছে, তাঁকে সব কথা জানাল আর তাঁর পা জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ চেয়ে নিল। এদিকে গোয়ালা বৌয়ের এই অবস্থার পরিবর্তনের ব্যাপার দেখে পাড়াশুদ্ধ সবাই অবাক হয়ে গেল আর গোয়ালা বৌকে ধন্য ধন্য করতে লাগল।
হরিষ মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের ফলঃ
হরিষ মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত যেই নারী করে।
সব দুঃখ চোখের জল মা তা হরে॥
তথ্যসূত্রঃ সচিত্র বৃহৎ বারোমেসে মেয়েদের ব্রতকথা (শ্রীকালীকিশোর বিদ্যাবিনোদ কতৃক সংকলিত ও শ্রীসুরেশ চৌধুরী কর্তৃক সংশোধিত, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত)