বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীর পাঁচালি, বারমাস্যা, ব্রতকথা ও পূজা পদ্ধতি

বৃহস্পতিবার মানেই বাঙালী হিন্দুর ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন। প্রত্যেক বাড়ী থেকে মেয়েদের কন্ঠে ভেসে আসে শ্রীশ্রী লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালী, ব্রতকথা ও বারমাস্যা। অনাদিকাল থেকেই বাড়ির মেয়ে বৌদের আয়োজিত এই লক্ষ্মী পূজায় উচ্চারিত হয় লক্ষ্মীদেবীর ধ্যান মন্ত্র, প্রণাম মন্ত্র, এবং পুষ্পাঞ্জলী মন্ত্র। আর সেই সাথে, ব্রত কথা আর পাঁচালী তো রয়েছেই।  জেনে রাখা ভালো, লক্ষ্মী দেবী শুধুমাত্র ধনসম্পদের দেবী নন, তিনি সৌন্দর্যেরও প্রতীক । তাই জীবনের সবকিছু সুন্দরভাবে শ্রীমণ্ডিত করতে হলে লক্ষ্মীদেবীর কৃপা আবশ্যক। তাই আজ আপনার জন্য রইল প্রতি বৃহস্পতিবারে শ্রী শ্রী লক্ষ্মীদেবীর পূজা পদ্ধতি, ব্রতকথা, পাঁচালী এবং বারমাস্যা।

লক্ষ্মীপূজা করার নিয়ম

লক্ষ্মীপূজা করে দেবী শ্রীলক্ষ্মীর কৃপা প্রাপ্ত করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তবেই মন্ত্র পাঠ করা উচিত, তা না হলে কিন্তু কোনও ফলই মেলে না। প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা, পাঁচালী, রাবমাস্যা পাঠ করার সময় এবং পূজা করার সময় এই নিয়মগুলো অবশ্যই মেনে চলুনঃ

  • আপনার উচ্চারণ যেন স্পষ্ট এবং সঠিক হয়।
  • আপনি যে মন্ত্রটি জপ করছেন, অথবা যে পাঁচালী পাঠ করছে তা কতবার পাঠ করতে হবে তা ভাল করে জেনে নেবেন।
  • মন্ত্র পাঠের সময় হাতে ১০৮ টা পুঁথির মালা রাখবেন। এমনটা করলে কতবার মন্ত্রটি জপ করছেন তা বুঝতে পারবেন।
  • মন্ত্র পাঠ করার সময় চোখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করবেন।
  • মা লক্ষ্মীর মন্ত্র পাঠ করার সময় চোখ বন্ধ করে তাঁর অবয়বটা কল্পনা করার চেষ্টা করবেন। এমনটা করলে মন্ত্রের কার্যকারিতা আরও বেড়ে যাবে।
বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজার নিয়ম, ব্রতকথা, পাঁচালী ও বারমাস্যা।
বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজার নিয়ম, ব্রতকথা, পাঁচালী ও বারমাস্যা।

বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজার উপকরণ

খুব সামান্য কিছু উপকরণ দিয়েই  বৃহস্পতিবারে মা লক্ষ্মীর সাপ্তাহিক পূজা করা যায়। উপকরণগুলো হলঃ

  • ঘট ১টি।
  • সিঁদুর – পরিমাণমত।
  • ধান – সামান্য।
  • মাটি – সামান্য।
  • আমপল্লব – ১টি।
  • ফুল – পদ্মফুল এবং অন্যান্য।
  • দুর্বা – সামান্য।
  • কাঁঠালি কলা – ২টি।
  • হরিতকী – ১টি।
  • আতপচাল – সামান্য।
  • জল – পরিমাণমত।
  • পান-সুপারি – ১টি করে।
  • চন্দন, ধূপ, দীপ, এবং নৈবেদ্য।

বিঃ দ্রঃ কোনো দ্রব্য সংগ্রহ করতে না পারলে, পূজার শেষে সেই দ্রব্যটির কথা মা লক্ষ্মীর কাছে উল্লেখ করে ক্ষমা চেয়ে নিন।

আরও পড়ুনঃ  শনিদেবের পাঁচালী এবং ব্রতকথা

লক্ষ্মীদেবীর পূজার দিন-ক্ষণ-তিথি

লক্ষ্মীপূজা বৃহস্পতিবার মাত্রেই করা যায়। তার জন্য তিথি নক্ষত্রের বিচার করতে হয় না। তাই যাঁরা প্রবাসী তাদের ভারতীয় বা বাংলাদেশী সময় মিলিয়ে পূজা না করলেও চলবে, যেদেশে যেমন বৃহস্পতিবার পড়বে, সেই দেশে তেমনই করবে। তাছাড়া শাস্ত্রে আছে, প্রবাসে নিয়মং নাস্তি। তাই প্রবাসী হলে রবিবার বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও লক্ষ্মীপূজা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে পূজার আগে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে নেবেন, মা বৃহস্পতিবার পূজা করতে পারলাম না, আজ পূজা নাও। ভারত বা বাংলাদেশবাসী হলে বৃহস্পতিবারের পূজা বৃহস্পতিবারেই করবেন।

লক্ষ্মীপূজায় বর্জনীয়

লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা বাজাতে নেই। লক্ষ্মীকে তুলসীপাতা দিতে নেই। কিন্তু লক্ষ্মীপূজার পর একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা দিয়ে নারায়ণকে পূজা করতে হয়। লক্ষ্মীপূজা সাধারণত সন্ধ্যাবেলা করে, তবে অনেকে সকালেও করে থাকেন। সকালে করলে সকাল ন-টার মধ্যে করে নেওয়াই ভাল। পূজার পর ব্রতকথা পাঠ করতে হয়। লক্ষ্মীপূজায় লোহা বা স্টিলের বাসনকোসন ব্যবহার করবেন না। লোহা দিয়ে অলক্ষ্মী পূজা হয়। তাই লোহা দেখলে লক্ষ্মী ত্যাগ করে যান।

বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা করার নিয়ম
বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা করার নিয়ম

লক্ষ্মীপূজার প্রস্তুতি

লক্ষ্মীপূজা প্রতিমা, সরা বা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে হয়ে থাকে। পূর্ববঙ্গীয়রা সাধারণত সরা বা প্রতিমায় লক্ষ্মীপূজা করেন, পশ্চিমবঙ্গীরা লক্ষ্মীর ধানপাত্রে বা ঘটে পূজা করেন। কারো কারো বিশেষ পারিবারিক লক্ষ্মীপ্রতীক রয়েছে। যাঁর যা আছে, বা যাঁদের যা নিয়ম তাঁরা তাতেই লক্ষ্মীপূজা করবেন। পূজার পূর্বে পূজাস্থান পরিষ্কার করে নিয়ে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে দেবেন। পূজাস্থানে লক্ষ্মীর পা-সহ আলপনা আঁকবেন। ঘটের পাশে একটি লক্ষ্মীর পা অবশ্যই আঁকবেন। পূজার সময় অন্যমনস্ক হবেন না বা অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না। মনকে লক্ষ্মীতে স্থির রাখবেন। পূজার সময় অন্য কথা বললে বা অন্যমনস্ক হলে মন্ত্রপাঠাদি করে লক্ষ্মীপূজা করাই শ্রেয়। কিন্তু একমনে আন্তরিকভাবে লক্ষ্মীপূজা করলে বিনা মন্ত্রেই পূজা সিদ্ধ হয়। অবশ্য দীক্ষিত হলে গুরুমন্ত্রেও পূজা চলে। বিশেষভাবে মনে রাখবেন, মন্ত্রপাঠ ও পূজাক্রিয়াদিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিনা মন্ত্রে পূজা করবেন না। বিনা মন্ত্রে পূজা শুধু সেই সবে অনভিজ্ঞদের জন্য।

বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজার প্রণালী

প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল নিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করে নিন। পূজার আগে মাথায় জল নিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল দিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উৎস সূর্যকে জল দেওয়ার নিয়ম, তাই জল দেওয়ার জন্য ঠাকুরের সিংহাসনে একটি ছোটো তামার পাত্র সর্বদা রাখবেন। সূর্যের নাম করে সেই কুশীতে জল নিয়ে সেই তামার পাত্রে দেবেন। তারপর সংসারের সকলের মঙ্গলকামনা করবেন। এরপর একটু গঙ্গাজল আপনার পূজার আসন, পূজার ফুল-নৈবেদ্য ইত্যাদি উপকরণের উপর ছিটিয়ে দেবেন। এইভাবে পূজাদ্রব্যগুলিকে শুদ্ধ করে নিতে হয়।

আরও পড়ুনঃ  শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণের ব্রতকথা ও পাঁচালী

এরপর লক্ষ্মীর সামনে সামান্য ধান ও এক চিমটি মাটি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর জলভরা ঘট স্থাপন করবেন। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে নিতে ভুলবেন না। ঘটে একটি আমপল্লব (যাতে বিজোড় সংখ্যায় আমপল্লব থাকে) ও তার উপর একটি কলা বা হরিতকী দিয়ে উপরে একটি ফুল দেবেন। ইচ্ছা করলে ঘটে ও লক্ষ্মীকে একটি করে মালাও পরাতে পারেন। এবার লক্ষ্মীকে ধ্যান করবেন। লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্র হল—

ওঁপাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।

পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।

গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।

রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।

সরলার্থঃ 

ত্রিভুবনের মাতা তুমি , তুমি  যে শ্রীস্বরুপা ।

বামে তব পদ্ম , অঙ্কুশ দক্ষিনে পাশ , অক্ষমালা।।

রত্নালঙ্কারে ভূষিতা তুমি গৌরবর্না সুরুপা ;

স্বর্ণপদ্মহস্তে লয়ে পদ্মাসনে আসীনা ।।

দক্ষিন হস্তে বরমুদ্রা দিতেছে অভয় ।

ধ্যান করি তোমায় মাগো , রহ সর্বময় ।

বৃহষ্পতিবারের ব্রতকথা
বৃহষ্পতিবারের ব্রতকথা

আপনি যদি সংস্কৃত মন্ত্রটি পাঠ করতে অসামর্থ্য হন তাহলে বাংলা সরার্থ পাঠ করুন অথবা মা লক্ষ্মীর রূপটি চোখ বুজে মনে মনে খানিকক্ষণ চিন্তা করবেন। এরপর মা লক্ষ্মীকে আপনার ঘরে আবাহন করবেন। আবাহন মন্ত্রটি হল—

ওঁ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।

সংস্কৃতে মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বাংলায় বলবেন, এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, যতক্ষণ তোমার পূজা করি, ততক্ষণ তুমি স্থির হয়ে থাকো মা।

তারপর ভাববেন, মা লক্ষ্মী আপনার হৃদয়ে এসে বসে আপনার দেওয়া ফুল-নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। একে বলে মানসপূজা।

এরপর আপনার পূজাদ্রব্যগুলি একে একে লক্ষ্মীকে দেবেন। লক্ষ্মী আপনার গৃহে পূজা নিতে এলেন, তাই প্রথমেই একটুখানি জল ঘটের পাশে লক্ষ্মীপদচিহ্নে দেবেন। এটি মা লক্ষ্মীর পা ধোয়ার জল। এরপর দুর্বা ও একটু আতপ চাল ঘটে দেবেন। এটি হল অর্ঘ্য। এর সঙ্গে একটি ফুলও দিতে পারেন। এরপর লক্ষ্মীকে একটি চন্দনের ফোঁটা দেবেন। লক্ষ্মীর প্রতিমা না থাকলে ফুলে চন্দন মাখিয়ে ঘটে দেবেন। এরপর লক্ষ্মীকে ফুল দেবেন। তারপর প্রথমে ধূপ ও তারপর প্রদীপ দেখাবেন। শেষে নৈবেদ্যগুলি নিবেদন করে দেবেন। তারপর ফুল দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন। মন্ত্রটি হচ্ছে-

ওঁ নমস্তে সর্বাদেবানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে।

যা গতিস্ত্বাৎ প্রপন্নানাং সা মে ভুয়াত্ত্বদ অর্চনাৎ ।।

এষ সচন্দনপুষ্পাঞ্জলি ওঁ শ্রীঁ লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।

(শ্রীঁ উচ্চারণ হবে শ্রীং, নমঃ উচ্চারণ হবে নমহ।)

পুষ্পাঞ্জলি এক, তিন বা পাঁচ বার দিতে পারেন। পুষ্পাঞ্জলির পর নারায়ণের উদ্দেশ্যে একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা ঘটে দেবেন। তারপর ইন্দ্র ও কুবেরের নামে দুটি ফুলও ঘটে দেবেন। মা লক্ষ্মীর পেচককেও একটি ফুল দেবেন। আপনি যদি দীক্ষিত হন, তবে এরপর আপনার গুরুমন্ত্র যথাশক্তি জপ করে মা লক্ষ্মীর বাঁ হাতের উদ্দেশ্যে জপসমর্পণ করবেন। শেষে এই মন্ত্রে প্রণাম করবেন—

ওঁ   বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে

সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমঽস্তু তে।।

আরও পড়ুনঃ  নির্ভুল হরিষ মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতকথা || মেয়েদের ব্রতকথা ||

সরলার্থঃ 

বিশ্বরুপের ভার্যা তুমি , তুমি পদ্মধারিণী

মঙ্গলপ্রান তুমি মাগো , তুমি পদ্মবাসিনী ।।

সর্বদুঃখ হতে রক্ষা কর এই মোর প্রার্থনা ।

প্রনাম করি তোমায় আর নেই কোন কামনা ।।

পদ্মাসন  স্থিতে দেবী পরমব্রহ্মস্বরূপিণী ,

সর্বদুঃখ হরে  মহালক্ষ্মী নমোস্তুতে ।

বিঃ দ্রঃ সংস্কৃত মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বাংলা সরলার্থ পাঠ করুন অথবা বিনা মন্ত্রেই ভক্তিভরে মা-কে প্রণাম করবেন। এরপর ব্রতকথা পাঠ করবেন বা শুনবেন।

পুনশ্চঃ কেউ কেউ লক্ষ্মীকে পান-সুপারিও দেন। আপনাদের বাড়িতে তেমন প্রথা থাকলে দেবেন।

লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালী
লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালী

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা-পাঁচালি

বাড়িতে যে লক্ষ্মীর পাঁচালি আছে সেটিই পড়বেন। কিন্তু যদি লক্ষ্মীর পাঁচালী আপনার গৃহে না থাকে তাহলে নিচে আপনার জন্য লক্ষ্মীর পাঁচালী দেওয়া হল।

দোলপূর্ণিমা নিশীথে নির্মল আকাশ।

মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।।

লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।

কহিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।

হেনকালে বীণাযন্ত্রে হরি গুণগান।

উপনীত হইলেন নারদ ধীমান।।

ধীরে ধীরে উভপদে করিয়া প্রণতি।

অতঃপর কহিলেন লক্ষ্মীদেবী প্রতি।।

শুন গো, মা নারায়ণি, চলো মর্ত্যপুরে।

তব আচরণে দুখ পাইনু অন্তরে।।

তব কৃপা বঞ্চিত হইয়া নরনারী।

ভুঞ্জিছে দুর্গতি কত বর্ণিবারে নারি।।

সতত কুকর্মে রত রহিয়া তাহারা।

দুর্ভিক্ষ অকালমৃত্যু রোগে শোকে সারা।।

অন্নাভাবে শীর্ণকায় রোগে মৃতপ্রায়।

আত্মহত্যা কেহ বা করিছে ঠেকে দায়।।

কেহ কেহ প্রাণাধিক পুত্রকন্যা সবে।

বেচে খায় হায় হায় অন্নের অভাবে।।

অন্নপূর্ণা অন্নরূপা ত্রিলোকজননী।

বল দেবী, তবু কেন হাহাকার শুনি।।

কেন লোকে লক্ষ্মীহীন সম্পদ অভাবে।

কেন লোকে লক্ষ্মীছাড়া কুকর্ম প্রভাবে।।

শুনিয়া নারদবাক্য লক্ষ্মী ঠাকুরানি।

সঘন নিঃশ্বাস ত্যজি কহে মৃদুবাণী।।

সত্য বাছা, ইহা বড় দুঃখের বিষয়।

কারণ ইহার যাহা শোনো সমুদয়।।

আমি লক্ষ্মী কারো তরে নাহি করি রোষ।

মর্ত্যবাসী কষ্ট পায় ভুঞ্জি কর্মদোষ।।

মজাইলে অনাচারে সমস্ত সংসার।

কেমনে থাকিব আমি বল নির্বিকার।।

কামক্রোধ লোভ মোহ মদ অহংকার।

আলস্য কলহ মিথ্যা ঘিরিছে সংসার।।

তাহাতে হইয়া আমি ঘোর জ্বালাতন।

হয়েছি চঞ্চলা তাই ওহে বাছাধন।।

পরিপূর্ণ হিংসা দ্বেষ তাদের হৃদয়।

পরশ্রী হেরিয়া চিত্ত কলুষিত ময়।।

রসনার তৃপ্তি হেতু অখাদ্য ভক্ষণ।

ফল তার হের ঋষি অকাল মরণ।।

ঘরে ঘরে চলিয়াছে এই অবিচার।

অচলা হইয়া রব কোন সে প্রকার।।

এসব ছাড়িয়া যেবা করে সদাচার।

তার গৃহে চিরদিন বসতি আমার।।

এত শুনি ঋষিবর বলে, নারায়ণি।

অনাথের মাতা তুমি বিঘ্নবিনাশিনী।।

কিবা ভাবে পাবে সবে তোমা পদছায়া।

তুমি না রাখিলে ভক্তে কে করিবে দয়া।।

বিষ্ণুপ্রিয়া পদ্মাসনা ত্রিতাপহারিণী।

চঞ্চলা অচলা হও পাপনিবারণী।।

তোমার পদেতে মা মোর এ মিনতি।

দুখ নাশিবার তব আছে গো শকতি।।

কহ দেবি দয়া করে ইহার বিধান।

দুর্গতি হেরিয়া সব কাঁদে মোর প্রাণ।।

দেবর্ষির বাক্য শুনি কমলা উতলা।

তাহারে আশ্বাস দানে বিদায় করিলা।।

জীবের দুঃখ হেরি কাঁদে মাতৃপ্রাণ।

আমি আশু করিব গো ইহার বিধান।।

নারদ চলিয়া গেলে দেবী ভাবে মনে।

এত দুঃখ এত তাপ ঘুচাব কেমনে।।

তুমি মোরে উপদেশ দাও নারায়ণ।

যাহাতে নরের হয় দুঃখ বিমোচন।।

লক্ষ্মীবাণী শুনি প্রভু কহেন উত্তর।

ব্যথিত কি হেতু প্রিয়া বিকল অন্তর।।

যাহা বলি, শুন সতি, বচন আমার।

মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত করহ প্রচার।।

গুরুবারে সন্ধ্যাকালে যত নারীগণ।

পূজা করি ব্রতকথা করিবে শ্রবণ।।

ধন ধান্য যশ মান বাড়িবে সবার।

অশান্তি ঘুচিয়া হবে সুখের সংসার।।

নারায়ণ বাক্যে লক্ষ্মী হরষ মনেতে।

ব্রত প্রচারণে যান ত্বরিত মর্তেতে।।

উপনীত হন দেবী অবন্তী নগরে।

তথায় হেরেন যাহা স্তম্ভিত অন্তরে।।

ধনেশ্বর রায় হয় নগর প্রধান।

অতুল ঐশ্বর্য তার কুবের সমান।।

হিংসা দ্বেষ বিজারিত সোনার সংসার।

নির্বিচারে পালিয়াছে পুত্র পরিবার।

একান্নতে সপ্তপুত্র রাখি ধনেশ্বর।

অবসান নরজন্ম যান লোকান্তর।।

পত্নীর কুচক্রে পড়ি সপ্ত সহোদর।

পৃথগন্ন হল সবে অল্প দিন পর।।

হিংসা দ্বেষ লক্ষ্মী ত্যাজে যত কিছু হয়।

একে একে আসি সবে গৃহে প্রবেশয়।।

এসব দেখিয়া লক্ষ্মী অতি ক্রুদ্ধা হল।

অবিলম্বে সেই গৃহ ত্যজিয়া চলিল।।

বৃদ্ধ রানি মরে হায় নিজ কর্মদোষে।

পুরীতে তিষ্ঠিতে নারে বধূদের রোষে।।

পরান ত্যজিতে যান নিবিড় কাননে।

চলিতে অশক্ত বৃদ্ধা অশ্রু দুনয়নে।।

ছদ্মবেশে লক্ষ্মীদেবী আসি হেন কালে।

উপনীত হইলেন সে ঘোর জঙ্গলে।।

সদয় কমলা তবে জিজ্ঞাসে বৃদ্ধারে।

কিবা হেতু উপনীত এ ঘোর কান্তারে।।

লক্ষ্মীবাক্যে বৃদ্ধা কহে শোন ওগো মাতা।

মন্দভাগ্য পতিহীনা করেছে বিধাতা।।

ধনবান ছিল পিতা মোর পতি আর।

লক্ষ্মী বাঁধা অঙ্গনেতে সতত আমার।।

সোনার সংসার মোর ছিল চারিভিতে।

পুত্র পুত্রবধূ ছিল আমারে সেবিতে।।

পতি হল স্বর্গবাসী সুখৈশ্বর্য যত।

একে একে যাহা কিছু হল তিরোহিত।।

ভিন্ন ভিন্ন হাঁড়ি সব হয়েছে এখন।

অবিরত বধূ যত করে জ্বালাতন।।

অসহ্য হয়েছে এবে তাদের যন্ত্রণা।

এ জীবন বিসর্জিতে করেছি বাসনা।।

বৃদ্ধা বাক্যে নারায়ণী কহেন তখন।

আত্মহত্যা মহাপাপ শাস্ত্রের বচন।।

ফিরে যাও ঘরে তুমি কর লক্ষ্মীব্রত।

সর্ব দুঃখ বিমোচিত পাবে সুখ যত।।

গুরুবারে সন্ধ্যাকালে বধূগণ সাথে।

লক্ষ্মীব্রত কর সবে হরষ মনেতে।।

পূর্ণ ঘটে দিবে শুধু সিঁদুরের ফোঁটা।

আম্রশাখা দিবে তাহে লয়ে এক গোটা।।

গুয়াপান দিবে তাতে আসন সাজায়ে।

সিন্দুর গুলিয়া দিবে ভক্তিযুক্ত হয়ে।।

ধূপ দীপ জ্বালাইয়া সেইখানে দেবে।

দূর্বা লয়ে হাতে সবে কথা যে শুনিবে।।

লক্ষ্মীমূর্তি মানসেতে করিবে ধ্যান।

ব্রতকথা শ্রবণান্তে শান্ত করে প্রাণ।।

কথা অন্তে ভক্তিভরে প্রণাম করিবে।

অতঃপর এয়োগণ সিঁদুর পরাবে।।

প্রতি গুরুবারে পূজা যে রমণী করে।

নিষ্পাপ হইবে সে কমলার বরে।।

বার মাস পূজা হয় যে গৃহেতে।

অচলা থাকেন লক্ষ্মী সেই সে স্থানেতে।।

পূর্ণিমা উদয় হয় যদি গুরুবারে।

যেই নারী এই ব্রত করে অনাহারে।।

কমলা বাসনা তার পুরান অচিরে।

মহাসুখে থাকে সেই সেই পুত্রপরিবারে।।

লক্ষ্মীর হাঁড়ি এক স্থাপিয়া গৃহেতে।

তণ্ডুল রাখিবে দিন মুঠা প্রমাণেতে।।

এই রূপে নিত্য যেবা সঞ্চয় করিবে।

অসময়ে উপকার তাহার হইবে।।

সেথায় প্রসন্না দেবী কহিলাম সার।

যাও গৃহে ফিরে কর লক্ষ্মীর প্রচার।।

কথা শেষ করে দেবী নিজ মূর্তি ধরে।

বৃদ্ধারে দিলেন দেখা অতি কৃপা ভরে।।

লক্ষ্মী হেরি বৃদ্ধা আনন্দে বিভোর।

ভূমিষ্ট প্রণাম করে আকুল অন্তর।।

ব্রত প্রচারিয়া দেবি অদৃশ্য হইল।

আনন্দ হিল্লোলে ভেসে বৃদ্ধা ঘরে গেল।।

বধূগণে আসি বৃদ্ধা বর্ণনা করিল।

যে রূপেতে বনমাঝে দেবীরে হেরিল।।

ব্রতের পদ্ধতি যাহা কহিল সবারে।

নিয়ম যা কিছু লক্ষ্মী বলেছে তাহারে।।

বধূগণ এক হয়ে করে লক্ষ্মীব্রত।

স্বার্থ দ্বেষ হিংসা যত হইল দূরিত।।

ব্রতফলে এক হল সপ্ত সহোদর।

দুঃখ কষ্ট ঘুচে যায় অভাব সত্বর।।

কমলা আসিয়া পুনঃ আসন পাতিল।

লক্ষ্মীহীন সেই গৃহে লক্ষ্মী অধিষ্ঠিল।।

দৈবযোগে একদিন বৃদ্ধার গৃহেতে।

আসিল যে এক নারী ব্রত সময়েতে।।

লক্ষ্মীকথা শুনি মন ভক্তিতে পুরিল।

লক্ষ্মীব্রত করিবে সে মানত করিল।।

কুষ্ঠরোগগ্রস্থ পতি ভিক্ষা করি খায়।

তাহার আরোগ্য আশে পূজে কমলায়।।

ভক্তিভরে এয়ো লয়ে যায় পূজিবারে।

কমলার বরে সব দুঃখ গেল দূরে।।

পতির আরোগ্য হল জন্মিল তনয়।

ঐশ্বর্যে পুরিল তার শান্তির আলয়।।

লক্ষ্মীব্রত এই রূপে প্রতি ঘরে ঘরে।

প্রচারিত হইল যে অবন্তী নগরে।।

অতঃপর শুন এক অপূর্ব ঘটন।

ব্রতের মাহাত্ম্য কিসে হয় প্রচলন।।

একদিন গুরুবারে অবন্তীনগরে।

মিলি সবে এয়োগন লক্ষ্মীব্রত করে।।

শ্রীনগরবাসী এক বণিক নন্দন।

দৈবযোগে সেই দেশে উপনীত হন।।

লক্ষ্মীপূজা হেরি কহে বণিক তনয়।

কহে, এ কি পূজা কর, কিবা ফল হয়।।

বণিকের কথা শুনি বলে নারীগণ।

লক্ষ্মীব্রত ইহা ইথে মানসপূরণ।।

ভক্তিভরে যেই নর লক্ষ্মীব্রত করে।

মনের আশা তার পুরিবে অচিরে।।

সদাগর এই শুনি বলে অহংকারে।।

অভাগী জনেতে হায় পূজে হে উহারে।।

ধনজনসুখ যত সব আছে মোর।

ভোগেতে সদাই আমি রহি নিরন্তর।।

ভাগ্যে না থাকিলে লক্ষ্মী দিবে কিবা ধন।

একথা বিশ্বাস কভু করি না এমন।।

হেন বাক্য নারায়ণী সহিতে না পারে।

অহংকার দোষে দেবী ত্যজিলা তাহারে।।

বৈভবেতে পূর্ণ তরী বাণিজ্যেতে গেলে।

ডুবিল বাণিজ্যতরী সাগরের জলে।

প্রাসাদ সম্পদ যত ছিল তার।

বজ্র সঙ্গে হয়ে গেল সব ছারখার।।

ভিক্ষাঝুলি স্কন্ধে করি ফিরে দ্বারে দ্বারে।

ক্ষুধার জ্বালায় ঘোরে দেশ দেশান্তরে।।

বণিকের দশা যেই মা লক্ষ্মী দেখিল।

কমলা করুণাময়ী সকলি ভুলিল।।

কৌশল করিয়া দেবী দুঃখ ঘুচাবারে।

ভিক্ষায় পাঠান তারে অবন্তী নগরে।।

হেরি সেথা লক্ষ্মীব্রত রতা নারীগণে।

বিপদ কারণ তার আসিল স্মরণে।।

ভক্তিভরে করজোড়ে হয়ে একমন।

লক্ষ্মীর বন্দনা করে বণিক নন্দন।।

ক্ষমা কর মোরে মাগো সর্ব অপরাধ।

তোমারে হেলা করি যত পরমাদ।।

অধম সন্তানে মাগো কর তুমি দয়া।

সন্তান কাঁদিয়া মরে দাও পদছায়া।।

জগৎ জননী তুমি পরমা প্রকৃতি।

জগৎ ঈশ্বরী তবে পূজি নারায়ণী।।

মহালক্ষ্মী মাতা তুমি ত্রিলোক মণ্ডলে।

গৃহলক্ষ্মী তুমি মাগো হও গো ভূতলে।।

রাস অধিষ্ঠাত্রী তুমি দেবী রাসেশ্বরী।

তব অংশভূতা যত পৃথিবীর নারী।।

তুমিই তুলসী গঙ্গা কলুষনাশিনী।

সারদা বিজ্ঞানদাত্রী ত্রিতাপহারিণী।।

স্তব করে এইরূপে ভক্তিযুক্ত মনে।

ভূমেতে পড়িয়া সাধু প্রণমে সে স্থানে।।

ব্রতের মানত করি নিজ গৃহে গেল।

গৃহিণীরে গৃহে গিয়া আদ্যান্ত কহিল।।

সাধু কথা শুনি তবে যত নারীগণ।

ভক্তিভরে করে তারা লক্ষ্মীর পূজন।।

সদয় হলেন লক্ষ্মী তাহার উপরে।

পুনরায় কৃপাদৃষ্টি দেন সদাগরে।।

সপ্ততরী জল হতে ভাসিয়া উঠিল।

আনন্দেতে সকলের অন্তর পূরিল।।

দারিদ্র অভাব দূর হইল তখন।

আবার সংসার হল শান্তি নিকেতন।।

এইরূপে ব্রতকথা মর্ত্যেতে প্রচার।

সদা মনে রেখো সবে লক্ষ্মীব্রত সার।।

এই ব্রত যেই জনে করে এক মনে।

লক্ষ্মীর কৃপায় সেই বাড়ে ধনে জনে।।

করজোড় করি সবে ভক্তিযুক্ত মনে।

লক্ষ্মীরে প্রণাম কর যে থাক যেখানে।।

ব্রতকথা যেবা পড়ে যেবা রাখে ঘরে।

লক্ষ্মীর কৃপায় তার মনোবাঞ্ছা পুরে।।

লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড়ো মধুময়।

প্রণাম করিয়া যাও যে যার আলয়।।

লক্ষ্মীব্রতকথা হেথা হৈল সমাপন।

আনন্দ অন্তরে বল লক্ষ্মী-নারায়ণ।।

আরও পড়ুনঃ  ইতু পূজা কি? কেন করা হয়? ইতুপূজার ব্রতকথা || ইতুব্রতের ইতিহাস ||

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর বারমাস্যা

লক্ষ্মীদেবীর বারমাস্যা
লক্ষ্মীদেবীর বারমাস্যা

বছরের প্রথম মাস বৈশাখ যে হয়।

পূজা নিতে এস ওমা আমার আলয়।।

জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠী পূজা হয় ঘরে ঘরে।

এসো বসো তুমি ওমা পূজার বাসরে।।

আষাঢ়ে আসিতে মাগো নাহি করো দেরি।

পূজা হেতু রাখি মোরা ধান্য দুর্বা ধরি।।

শ্রাবণের ধারা দেখ চারি ধারে পড়ে।

পূজিবারে ও চরণ ভেবেছি অন্তরে।।

ভাদ্র মাসে ভরা নদী কুল বেয়ে যায়।

কৃপা করি এসো মাগো যত শীঘ্র হয়।।

আশ্বিনে অম্বিকা সাথে পূজা আয়োজন।

কোজাগরী রাতে পুনঃ করিব পূজন।।

কার্তিকে কেতকী ফুল চারিধারে ফোটে।

এসো মাগো এসো বসো মোর পাতা ঘটে।।

অঘ্রাণে আমন ধান্যে মাঠ গেছে ভরে।

লক্ষ্মীপূজা করি মোরা অতি যত্ন করে।।

পৌষপার্বনে মাগো মনের সাধেতে।

প্রতি গৃহে লক্ষ্মী পূজি নবান্ন ধানেতে।।

মাঘ মাসে মহালক্ষ্মী মহলেতে রবে।

নব ধান্য দিয়া মোরা পূজা করি সবে।।

ফাল্গুনে ফাগের খেলা চারিধারে হয়।

এসো মাগো বিষ্ণুজায়া পূজিগো তোমায়।।

চৈত্রেতে চাতক সম চাহি তব পানে।

আসিয়া বস ওমা দুঃখিনীর ভবনে।।

লক্ষ্মীদেবী বারমাস্যা হৈল সমাপন।

ভক্তজন মাতা তুমি করহ কল্যাণ।।

—সমাপ্ত—

Rate this post

Leave a Comment

error: Content is protected !!