আংকর ওয়াট বা আংকর ভাট। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক অতি পরিচিত নাম। ভারতবর্ষের বাইরেও যে একসময় সনাতন হিন্দু ধর্মের জয়জয়াকার ছিল তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছে কম্বোডিয়ার এই অতি প্রাচীন মন্দিরটি। তাছাড়া কোনো মন্দিরের চুড়া, সাজসজ্জা ও পরিমার্জনা যে এত সুন্দর হওয়া সম্ভব তা একজন মানুষের কল্পনার বাইরে। এখানে আংকর শব্দটি সংস্কৃত নগর শব্দের অপভ্রংশ এবং ওয়াট শব্দের অর্থ হচ্ছে মন্দির। অর্থাৎ আংকর ওয়াটের সরলার্থ হচ্ছে মন্দিরের শহর বা শহরের মন্দির। তবে এই মন্দিরটি কোন সাধারন মন্দির নয়। এটি একাধারে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা, পৃথিবীর বৃহত্তম মন্দির এবং ভারতবর্ষের বাইরের সনাতনী স্থাপনার প্রাচীনতম নিদর্শন। এমনকি কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকায়ও চিত্রিত হয়েছে এই সুবিশাল ও প্রাচীনতম মন্দিরের প্রতিকৃতি। পাশাপাশি এটি কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীকও বটে। আজ সনাতন এক্সপ্রেসের সকল দর্শকদেরকে আমরা নিয়ে যেতে চাই আংকর ওয়াটের দ্বার প্রান্তে। দেখাতে চাই ভগবান বিষ্ণুর এই মন্দিরের গঠনশৈলী, কারুকার্য, চমৎকারিত্ব, এবং হিন্দু মন্দির থেকে বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত হওয়ার ইতিহাস।
কম্বোডিয়ার সিয়াম রিপ প্রদেশে অবস্থিত পৃথিবী বিখ্যাত মন্দির আংকর ওয়াট। মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ১২শো শতকে। খেমার সম্রাজ্যের রাজত্বকালে রাজা ২য় সূর্যবর্মণ নির্মান করেছিলেন এই অত্যাশ্চর্য মন্দিরটি। তবে সূর্য্যবর্মনের পূর্বপুরুষরা শিবের অনুসারী হওয়ার সত্ত্বেও তিনি প্রথা ভেঙ্গে এই মন্দির উৎসর্গ করেন শ্রীবিষ্ণুকে। জানা যায় ৮০৫-১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দাপটের সাথে পঁচিশ জন খেমার রাজা রাজত্ব করেছিলেন এখানে। তাঁরা ১ হাজারের অধিক মন্দির নির্মাণ করেন, যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে আংকর ওয়াট। আসলে আংকর ওয়াট শব্ধযুগল দ্বারা সমগ্র শহরকে বোঝানো হলেও বর্তমানে আংকর ওয়াট দ্বারা শুধু মন্দিরের নামকেই বোঝানো হয়। আর নগরীর নাম হয় যশোধারাপুর। তবে রাজা সুর্যবর্মনের মৃত্যুর পর এ মন্দিরকে বরাহ বিষ্ণুলোক বা পরম বিষ্ণুলোক নামেও নামকরন করা হয়।
যাইহোক, বর্তমানে কালের করল গ্রাসে এই স্থাপনার কিছুটা ক্ষতিসাধন হলেও আজ ও এই আংকর ওয়াট মাথা উচু করে জানান দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী সনাতন হিন্দু ধর্মের গৌরবময় ইতিহাসের। আপনি জেনে অবাক হবেন, প্রতিবছর কম্বোডিয়ায় যে পরিমান বিদেশী পর্যটক ভ্রমণ করেন তার অর্ধেকেরও বেশী আসেন শুধুমাত্র এই মন্দির দর্শন করার জন্য।
ভোরের আলো ফোটার আগেই মন্দিরের জলবেষ্টনীর পাশে জমে ওঠে পর্যটকদের ভীড়। কারন মন্দিরের আড়াল দিয়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দর্শন করা এখানকার একটি প্রধান আকর্ষন। আস্তে আস্তে রাতের আধার কেটে ভেসে ওঠের আংকর ওয়াট মন্দিরের অবয়ব। পূবের আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পশ্চিমমূখী মন্দিরের পিছন থেকে উদিত হন সুর্যদেব। মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখেন এই মন্দির ও সুর্যোদয়কে। কেউ কেউ ক্যামেরাবন্দী করারও চেষ্টা করে থাকেন এই নৈসর্গিক দৃশ্যকে। আর এভাবেই আংকর ওয়াট দর্শনের সুচনা হয় পর্যটকদের।
খেমার স্থাপত্যের এই উৎকৃষ্ট সৃষ্টি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। একটি অংশ অনেকটা পর্বতের ন্যায় এবং আরেকটি অংশ গ্যালারির মতো। পর্বতের মত অংশটুকু দ্বারা মূলত মেরু পর্বতকে বোঝানো হয়। মন্দিরের আয়তন ৪০২ একর। বাইরের দেওয়ালের দৈর্ঘ্য ১০২৫ মিটার ও প্রস্থ ৮০২ মিটার। ছোট বড় পাথরখণ্ড দিয়ে নির্মান করা হয়েছে এই সুবিশাল মন্দিরটি। দেওয়াল থেকে ৩০ মিটার দূরে চারিদিকে ১৯০ মিটার প্রশস্ত জলের পরিখা। পরিখার ওপর পাথরের সেতু। সেতু পার হয়ে মাঠ। মাঠের দুইপাশে দুটি ছোট ছোট ঘর তৎকালে গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মন্দিরটির বৈশিষ্ট্য, পর্যায়ক্রমে তিনটি চারকোণা গ্যালারি। এই গ্যালারিগুলো উৎসর্গ করা হয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রাজাকে। প্রতি গ্যালারির মূল বিন্দুতে গোপুরম। আর ভিতরের দিকে চার কোণায় চারটি টাওয়ার। সবচেয়ে উঁচুটা মধ্যখানে। পুরো মন্দিরের উচ্চতা ৬৫ মিটার। মন্দিরে প্রবেশপথে প্রথমেই চোখে পড়বে সাত মাথার নাগরাজ মূর্তি। সিঁড়ি বেয়ে একতলায় উঠলে বামদিকে অষ্টভূজ বিষ্ণু মূর্তি। তাছাড়া ভিতরের একটি কক্ষে রয়েছে বুদ্ধ মূর্তি।
করিডোর দিয়ে বামে এগোলে দেওয়ালের গায়ে রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনীর রিলিফ, সাথে সূর্য্যবর্মনের ছবিও। পুরো মন্দির কাঠামোর একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা আছে। যেমন: মেরু পর্বতের প্রতীক পঞ্চচূড়া, দেশ ও মহাসাগরের প্রতীক দেওয়াল ও পরিখা। সাধারণত দর্শনার্থীরা নিচতলায় প্রবেশের অধিকার পেতেন কারন উপরের তলাগুলোতে সিঁড়ি খুব খাড়া। এবং সবচেয়ে উঁচুস্তরে আছে দেবতাদের জন্য বিশেষ কক্ষ।
তবে এত প্রাচীন মন্দির হওয়ার সত্ত্বেও আজও এটির টিকে থাকার কারন হচ্ছে এর চারপাশের পরিখা। এই পরিখার কারনেই আশেপাশের জঙ্গল এই মন্দিরটিকে গ্রাস করতে পারে নি। তাছাড়া বিংশ শতাব্দীতে কম্বোডীয়ার সরকার মন্দিরটির ব্যাপক সংস্কারকার্য পরিচালনা করে। ফলশ্রুতিতে কম্বোডিয়ায় সনাতন ধর্মের ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দিরটি।
প্রশ্ন করতে পারেন বিষ্ণুমন্দিরে বুদ্ধদেবের মূর্তি কিভাবে এলো? আসলে বর্তমানে আংকর ওয়াট আর কোন হিন্দু মন্দির নয়। ১৪শ শতকের দিকে কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের ফলে এদেশে শুরু হয় বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্য। মূলত বার্মা থেকে আগত বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকদের হাত ধরেই এখানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব। এবং সেকারনেই আংকর ওয়াট মন্দিরটিও পরিবর্তিত হয় হিন্দু মন্দির থেকে বৌদ্ধ মন্দিরে।