You are currently viewing অপ্সরাদের অজানা ও গোপন কথা || উর্বশী, রম্ভা, মেনকা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী || Apsaras- Water Nymphs ||

অপ্সরাদের অজানা ও গোপন কথা || উর্বশী, রম্ভা, মেনকা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী || Apsaras- Water Nymphs ||

আপনারা সকলেই জানেন অতি সুন্দরী, অপরূপা ও মোহনীয় নারীদেরকে অপ্সরাদের সাথে তুলনা করা হয়। অনেকে আবার নিজের প্রিয়তমাকে খুশি করতেও ব্যাবহার করে থাকেন “অপ্সরা” নামক উপমাটি। খুব ছোট বেলা থেকেই দুর্দর্শনে দুর্গাপুজোর মহালয়া এবং রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী দেখতে দেখতে আমাদের সাথে পরিচয় ঘটে অপ্সরাদের। উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী প্রভৃতি লাস্যময়ী নারীগনই হচ্ছেন সেই স্বর্গীয় অপ্সরা। এদের রূপের ছটায় এবং শারিরীক আবেদনে মতিভ্রম ঘটেছে খোদ দেবতা, গন্ধর্ব, মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে সাধারন মনুষ্যগণেরও।  কিন্তু এই অঘটনঘটপটিয়সী অপ্সরাগণ আসলে কারা? কিভাবে জন্ম হয়েছিল তাঁদের? কি কার্যে দেবতাগণ তাঁদেরকে ব্যাবহার করে থাকেন?  এরকম হাজারো প্রশ্ন জমে আছে আমাদের প্রত্যেকের মনের কোণে।

তাই অপ্সরাদের নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। অপ্সরাদের মোট সংখ্যা ৬০ কোটি হলেও,  উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা ও ঘৃতাচী হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান পাঁচজন। তাই এই ভিডিওতে অপ্সরাদের পাশাপাশি এই প্রধান পাঁচজন অপ্সরাদের নিয়েও থাকছে কিছু চমকপ্রদ কাহিনী। আশা করি ভিডিওটির শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন।

 

সনাতন পৌরাণিক শাস্ত্রের পাশাপাশি বৌদ্ধ পুরাণেও উল্লেখ পাওয়া যায় অপ্সরা নামক কিছু স্বর্গীয় নারীসত্ত্বার। সংস্কৃত অপ শব্দের অর্থ জল এবং সরা শব্দের অর্থ সরন বা চারণ করা। তাই, অপ্সরা শব্দটির মৌলিক অর্থ হচ্ছে জলচারিণী। তবে জলচারিণী বা জল থেকে উদ্ভব হলেও অপ্সরাদের প্রকৃত কাজ হচ্ছে স্বর্গলোকে সম্মোহিনী নৃত্যকলা ও সঙ্গীতকলা পরিবেশন করে ইন্দ্রসভাকে আমোদিত করা। আপনারা নিশ্চই গন্ধর্বদের নাম শুনে থাকবেন। দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গসভায় তাঁরাও বাদ্য ও গীত পরিবেশন করে দেবতাগণের মনোরঞ্জন করে থাকেন। এবং এই স্বর্গসভার গন্ধর্বগনই হচ্ছেন অপ্সরাদের স্বামী বা সঙ্গী।

বৈদিকযুগে গন্ধর্বগণ ছিলেন এক শ্রেণীর গৌণ দেবতা । কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তারা নিম্নশ্রেণীর দেবতা বা উপদেবতা হিসাবে স্থান পেলেন । সঙ্গীতবিদ্যায় এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কৌশলে তাঁদের জুড়ি নেই। এছাড়াও ঔষধি বিষয়ে তাঁদের অসামান্য জ্ঞানের জন্য তাদেরকে স্বর্গের বৈদ্যও বলা হয়ে থাকে। এই গন্ধর্বগন ও অপ্সরাগণ নিজ ইচ্ছায় সঙ্গী চয়ন করে বিবাহ করেছিলেন বলে তাঁদের বিবাহকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে। পরবর্তীতে মনুষ্যকুলেও নারী পুষের নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে যে বিবাহ সম্পাদিত হয় তাঁকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

যাইহোক, সনাতন শাস্ত্রে দু প্রকার অপ্সরার উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা হচ্ছেন লৌকিক ও দৈবিক। আর এই সমগ্র অপ্সরাদের অধিপতি হচ্ছেন কামদেব। অপ্সরা নামক এই উপদেবীগণ তাঁদের অসাধারণ রূপ ও মোহনীয় শারীরিক আবেদনের পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। আর সেটি হচ্ছে তাঁরা মায়াবলে নিজ দেহের আকার পরিবর্তন করে দেবতা, যক্ষ, মানব বা দানবদেরকে প্রলুব্ধ এবং সম্মোহিত করার ক্ষমতা প্রাপ্ত।

অপ্সরাদের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত। প্রথম মতে ঋষি কশ্যপের ঔরসে জাত হন অপ্সরাগণ। আবার মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে, সাতজন মনু মিলে সৃষ্টি করেছিলেন এই অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারিণী অপ্সরাদের। তবে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত মতটি হচ্ছে সমুদ্র মন্থন থেকে উত্থিত হয়েছিলেন অসংখ্য লাস্যময়ী নারী। কিন্তু দেবতা বা দানব কেউই তাঁদেরকে গ্রহন করতে রাজি হননি। তাই তাঁরা সাধারন নারী হিসেবে গণ্য হতে থাকেন। এবং পরবর্তীতে গন্ধর্বগণ অপ্সরাগনকে সঙ্গী বা স্ত্রী হিসেবে চয়ন করেন। গন্ধর্বদের সঙ্গীনী হিসেবে তাঁরা স্বর্গলোকে বসবাস করতে থাকেন এবং একই সাথে দেবতাগণকে মোহনীয় নৃত্য গীতের ইন্দ্রজাল প্রদর্শন করে মনোরঞ্জন করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, দেবরাজ ইন্দ্রের দেবসভায় ২৬ জন অপ্সরা রয়েছেন এবং এরা প্রত্যেকেই এক একটি শিল্পকলায় বিশেষভাবে পারদর্শী।

এবার অপ্সরাদের আসল কাজ কি তা জেনে নেওয়া যাক। আপনারা সকলেই জানেন স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর সিংহাসন নিয়ে সর্বদাই শঙ্কিত থাকেন। তাঁর সহস্র নেত্র সর্বক্ষন খুঁজে বেড়ায় কোথাও তাঁর বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা অথবা কেউ তাঁর স্বর্গরাজ্য দখলের পায়তারা করছেন কি না। এবং যদি কখনো কেউ তাঁর বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন বা কঠোর তপস্যায় রত হন, তখন দেবরাজ অপ্সরাদেরকে ব্যাবহার করে থাকেন তাঁর শত্রুদেরকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য। অপ্সরাগণ তাঁদের মোহিনীশক্তি এবং কামনাময়ী আবেদন দ্বারা দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধাচারণকারীদেরকে বিভ্রান্ত করে থাকেন। তবে সবক্ষেত্রে তাঁরা সফল হতেন এমননটা নয়। ঠিক যেমন মহিষাসুর যখন দুষ্ট অভিসন্ধি নিয়ে কঠোর তপস্যায় রত হয়েছিলেন, তখনও দেবতাদের পক্ষ থেকে অপ্সরা উর্বসীকে পাঠানো হয়েছিল মহিষাসুরের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য। কিন্তু সে যাত্রা উদ্দেশ্য সফল হয় নি দেবতাদের। এছাড়াও অর্থবেদ অনুসারের জানা যায়, অপ্সরাগণ পাশা খেলায় খুবই পারদর্শী, এই কারনে তাঁরা বাজি খেলায় মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন। এবার আসুন সনাতন শাস্ত্র মতে পাঁচজন প্রধান অপ্সরার কাহিনী জানা যাক।

অপ্সরা রম্ভাঃ

স্বর্গের সমস্ত অপ্সরাদের মধ্যে উর্বশী অন্য সবার চেয়ে রূপসী ও আবেদনময়ী হওয়ার সত্বেও রম্ভাকে বলা হয় অপ্সরাদের রাণী। কারন অপ্সরা উর্বসীর জন্ম হয়েছিল অন্য একটি চমৎকার ঘটনার মাধ্যমে। অন্যদিকে অন্যান্য সকল অপ্সরাগণ উদ্ভুত হয়েছিলেন ক্ষীরোদ সাগরে সমুদ্র মন্থন কালে। যাইহোক, কলাগাছের মতো সুপুষ্ট ও সুন্দর ঊরুর অধিকারিণী হওয়ার ফলে তাঁর নাম হয়েছিল রম্ভা। রামায়ণ ও স্কন্ধ পুরাণে অপ্সরা রম্ভাকে নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তাঁর সুচারু রুপলাবন্যকে ব্যাবহার করে বহু মুনি ঋষিদের তপস্যা ভঙ্গ করেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। স্কন্ধ পুরাণ মতে একবার দেবরাজ ইন্দ্র রম্ভাকে প্রেরণ করেছিলেন ঋষি জাবালির ধ্যান ভঙ্গ করতে। ধ্যানরত ঋষির সম্মুখে এসে রম্ভা যে কমনীয় নৃত্যগীত পরিবেশন করেছিলেন, তা দেখে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন ঋষি জাবালি। ফলশ্রুতিতে ঋষি জাবালির ঔরসে রম্ভার গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিলেন ফলবতী নামক কন্যা। একইভাবে দেবরাজ ইন্দ্র অপ্সরা রম্ভাকে পাঠিয়েছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য।  ঋষি বিশ্বামিত্র তখন ব্রহ্মর্ষি হওয়ার ইচ্ছায় ধ্যানে লিপ্ত ছিলেন। এমন সময় অপ্সরা রম্ভা দেবরাজের নির্দেশে বিশ্বামিত্রের সামনে এসে তাঁকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাঁর মায়া ও সম্মোহনের মাত্রা বাড়িয়ে যথাসম্ভব কামাতুর করে তোলার চেষ্টা করলেন ঋষি বিশ্বামিত্রকে। কিন্তু কথায় বলে সব দেবতা সব ফুলে সন্তুষ্ট হন না। রম্ভার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। ঋষি বিশ্বামিত্র রম্ভার দুরাভিসন্ধির কথা অনুধাবন করে তাঁকে অভিশাপ দিলেন ১০০০ বছর শীলারূপে বাস করার জন্য। পরবর্তীতে কপিতীর্থের স্পর্শে রম্ভা আবার তাঁর অপ্সরা রূপ ফিরে পেয়েছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ৪টি ভয়ানক ছলনা || 4 Double-Dealings of Krishna In Mahabharat ||

তবে অপ্সরা রম্ভার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি হচ্ছে, রাবণের কুদৃষ্টিতে পড়া এবং দেবী সীতার সতীত্ত্ব রক্ষা। একবার কুবেরের পুত্র নলকুবেরের নিকট অভিসারে যাচ্ছিলেন অপ্সরা রম্ভা। এমন সময় তাঁর শ্বেতবর্ণ শারীরিক অবয়ব দেখে কামার্ত হন রাবণ। এরপর বলপূর্বক রম্ভার সাথে অন্তরঙ্গ সময় পার করেন তিনি। রতিশ্রমে বিহ্বল ও ভীতিগ্রস্থা রম্ভা নলকুবেরকে একথা জানালে নলকুবের রাবণকে অভিশাপ দেন যে রাবণ যদি কোন স্ত্রীলোকের অনিচ্ছায় তার প্রতি বলপ্রয়োগ করে, তাহলে রাবণের মস্তক সপ্তখণ্ডে ভগ্ন হবে । এই কারনেই, রাবণ দেবী সীতাকে অপহরণ করেও তাঁর সতীত্বে কোন আঘাত করেননি । তবে কোন কোন মতে রম্ভা স্বয়ং রাবণকে এই অভিশাপ দিয়েছিলেন আবার কোন মতে প্রজাপতি ব্রহ্মা রাবণের মস্তক চূর্ণ হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন।

অপ্সরা ঘৃতাচীঃ

স্বর্গীয় অপ্সরাদের মধ্যে ঘৃতাচী একটি উল্লেখযোগ্য নাম। রম্ভার মত ইনিও ইন্দ্রের আদেশে নিজের স্বর্গীয় দেহরূপ প্রদর্শন করে বহু মুনিদের তপস্যা ভঙ্গ করেছেন। এমনকি ঋষি ভরদ্বাজ পর্যন্ত এই অনন্ত যৌবনা ঘৃতাচীকে দেখে প্রণয়শীল হয়ে উঠেছিলেন। মহাভারতের আদিপর্ব অনুযায়ী ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রম ছিল গঙ্গোত্তরী প্রদেশে। এই ঋষি একদিন স্নানরতা অপ্সরা ঘৃতাচীকে দর্শন করার ফলে তাঁর অসংযম প্রকাশ পায়। এবং সেই অসংযম থেকেই জন্ম হয়েছিল গুরু দ্রোণাচার্যের। ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী বশিষ্ঠের ঔরসে অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে জন্ম হয়েছিল কপিঞ্জলের । এছাড়াও চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির ঔরসেও ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু নামক এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয় ।  রামায়ণের আদিকাণ্ড অনুযায়ী রাজর্ষি কুশানাভের পত্নী ছিলেন এই অপ্সরা ঘৃতাচী। এবং এই কুশানাভের ঔরসে একশত পরমা রূপবতী কন্যা উৎপাদন করেছিলেন অপ্সরা ঘৃতাচী।

অপ্সরা মেনকাঃ

মেনকা নামটি হিমালয়-পত্নী ও গৌরী-জননী হিসেবে বারংবার উচ্চারিত হলেও তিনিও ছিলেন দেবসভার এক অতি রমনীয় অপ্সরা। পুরাকালে ঋষি বিশ্বামিত্রকে ঘোর তপস্যারত দেখে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। পাছে বিশ্বামিত্র তাঁর স্বর্গসিংহাসন দাবি করে বসেন, এই ভয়ে তার তপস্যাভঙ্গের জন্য অপ্সরা মেনকাকে প্রেরণ করেন দেবরাজ। সর্বাঙ্গসুন্দরী মেনকা তার রূপ, রস, গন্ধ, কলা নিয়ে এলেন ধ্যানরত ঋষির পাশে।  শুরু করলেন কামনা মদির নৃত্য ও সঙ্গীত। একদিকে দেবরাজ ইন্দ্রের চক্রান্ত। অন্যদিকে লাস্যময়ী মেনকা, মোহিনী সঙ্গীত, মোহনীয় নৃত্য; আর কাম দেবতার ফুলশর।

আরও পড়ুনঃ  অমরনাথ গুহায় বরফের শিবলিঙ্গ || Amarnath Yatra || Frozen Shivling ||

অবশেষে বরফ গলল বিশ্বামিত্রের, দাউদাউ করে জ্বলে উঠল প্রণয়ের আগুন। মেনকার প্রয়োগকৃত কামশাস্ত্রের সকল কলা নৈপুণ্য প্রদর্শনে প্রণয়ী হয়ে উঠলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। তাঁদের প্রণয়ের ফল হিসেবে জন্ম হল শকুন্তলার। কিন্তু বিশ্বামিত্র শকুন্তলার দায়িত্ব না নিয়ে চলে গেলেন সাধনা ভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে। আর মেনকাও সদ্যজাতা কন্যাকে বনমধ্যে মালিনী নদীর তীরে পরিত্যাগ করে ইন্দ্রসভায় প্রস্থান করেন। এই পরিত্যক্ত কন্যাটিকে শকুন্ত পক্ষী রক্ষা করেছিল বলে তাঁর না হয়েছিল শকুন্তলা। পরবর্তী  মহর্ষি কন্বের আশ্রমে পালিত হয়েছিলেন এই শকুন্তলা ।

এছাড়াও গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর ঔরসে মেনকার গর্ভে জন্ম হয়েছিল প্রমদ্বরা নামক এক কন্যার। কিন্তু এবারও জন্মের পর প্রমদ্বরাকে পরিত্যাগ করেছিলেন মেনকা। এরপর মহর্ষি স্থূলকেশ্‌ তাকে নিজ আশ্রমে এনে পালন করেন। পরবর্তীতে এই প্রমদ্বরার বিবাহ হয়েছিল প্রমিতি ও অপ্সরা ঘৃতাচীর সন্তান রুরুর সাথে ।

তবে অপ্সরা মেনকা সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে কালিকা পুরাণে। এখানে হিমালয়ের পত্নী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অপ্সরা মেনকাকে। এই মেরুকন্যা মেনকা পুত্র কামনায় দীর্ঘকাল যাবৎ নিরাহারে, অল্পাহারে ও নানাবিধ কৃচ্ছ সাধনপূর্বক জগন্মাতা কালিকার আরাধনা করেন। তাঁর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেখা দিলেন মহামায়া। মেনকা চাইলেন “আমাকে অনন্ত বলবীর্য সম্পন্ন শতপুত্র এবং কুলানন্দকারিনী একটি কন্যা দান করুন।” দেবী বললেন “ তোমার প্রথম পুত্র অতি বীর্যবান হবে এবং বাকী ৯৯টি পুত্রও আশানুরূপ হবে। এছাড়াও দেবমনুষ্যের কল্যান সাধনার্থে আমি স্বয়ং তোমার কন্যারূপে জন্মগ্রহন করব ।” এর ফলে মেনকার গর্ভে মৈনাক নামক এক মহা বীর্যবান পুত্র এবং আরও ৯৯ টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করেন। পরিশেষে মেনকার গর্ভ থেকে জন্ম হয় জগন্ময়ী কালিকার। এবং তিনিই পরবর্তীতে জগত সংসারের পরিচিত হন মাতা পার্বতী রূপে।

অপ্সরা তিলোত্তমাঃ

তিলোত্তমা নাম থেকেই হয়ত কিছুটা হলেও তাঁর সৌন্দর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। উর্বশীর মত এই অনিন্দ্যসুন্দরী অপ্সরাও সমুদ্র মন্থন থেকে উত্থিত হন নি। বরং দেবকুলের বিশেষ প্রয়োজনে সৃজন করা হয়েছিলে এই সর্বাঙ্গসুন্দরী পূর্ণযৌবনাকে। জানেন কি সেই কারন?

মহাভারতের আদিপর্বে সুন্দ ও উপাসুন্দ নামক দুই অসুর ভ্রাতার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এই সুন্দ ও উপাসুন্দ ছিল অসুর নিকুম্ভের পুত্র। এই অসুরগণ একবার ব্রহ্মার কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁদের বহুযুগের নিরন্তর তপস্যায় ব্রহ্মা বাধ্য হন তাঁদের সম্মুখে প্রকট হওয়ার জন্য। এরপর এই অসুর ভ্রাতাগণ ব্রহ্মার কাছে তাঁদের কঠোর তপস্যার পুরষ্কার হিসেবে দাবী করেন অমরত্বের। কিন্তু ব্রহ্মা তাদেরকে সরাসরি অমরত্বের বর না দিয়ে বললেন “ত্রিলোকের কোন প্রাণীর হাতে তোমাদের মৃত্যু হবে না। তোমরা নিজেরা ছাড়া অন্য কেউই তোমাদের বধ করতে পারবে না।” অসুরগণ ব্রহ্মার বরের মর্মার্থ সম্পূর্ণরূপে বুঝে ওঠার আগেই শুরু করলেন মহা তান্ডব। স্বর্গরাজ্য থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে, মহাবিশ্বে জ্বালাও পোড়াও করে এবং সমগ্র সৃষ্টির সর্বনাশ করে তাঁদের ধবংসযজ্ঞ চালাতে লাগলেন পূর্ণদমে।  স্বর্গের দেবগণ অনাথের মত হাজির হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার দরবারে। বললেন “হে পিতা, আপনার বরে আজ আমরা সর্বহারা, দয়া করে কিছু একটা করুন।” দেবতাদের দুর্দশা দেখে চিন্তিত হলেন ব্রহ্মা। এরপর তিনি দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে নির্দেশ দিলেন এক পরমাসুন্দরী ও অনন্তযৌবনা নারী সৃষ্টি করতে । ব্রহ্মার নির্দেশে ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম জিনিস তিল তিল করে সংগ্রহ করে এক অতুলনীয় সুন্দরী নারী সৃষ্টি করলেন বিশ্বকর্মা। এই কারণেই এই অতুল্য সুন্দরীর নাম হয়েছিল তিলোত্তমা । এরপর এই মুক্তকেশী অনন্ত যৌবনাকে পাঠানো হল সুন্দ ও উপাসুন্দের মধ্যে বিবাদ ঘটানোর জন্য।

সুন্দ ও উপাসুন্দ যখন নারীবেষ্টিত হয়ে আমোদপ্রমোদ উপভোগ করছিলেন এবং বিন্ধ্য পর্বতমালায় মদিরাপানে মগ্ন ছিলেন, তখন তিলোত্তমা সেখানে উপস্থিত হলেন। শুরু করলেন তাঁর মোহনীয় ভঙ্গিমায় নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন। তার অতুল্য শারীরিক অবয়ব এবং আবেদনময়ী নৃত্য-গীতে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন অসুর ভ্রাতাদ্বয়। এক পর্যায়ে কামাতুর সুন্দ ও উপাসুন্দ যথাক্রমে তিলোত্তমার ডান হাত এবং বাম হাত স্পর্শ করলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই চেয়েছিলেন অপ্সরা তিলোত্তমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পেতে। আর এখান থেকেই ভাই ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয় বিবাদ। এই বিবাদ থেকে ঝগড়া এবং ঝগড়া থেকে শুরু হয় যুদ্ধ, এবং এই যুদ্ধে দুইভাই একজন আরেকজনের হাতে প্রাণ হারান। এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন দেবতারা, তাঁরা ফিরে পেলেন তাঁদের হারানো স্বর্গরাজ্য, সৃষ্টি ফিরে পেল তাঁর স্বাভাবিক ছন্দ। এরপর দেবতারা তিলোত্তমাকে অভিনন্দন জানালেন এবং ব্রহ্মা তাকে আশীর্বাদ হিসাবে মহাবিশ্বে অবাধে বিচরণের অধিকার দিলেন। ব্রহ্মা আরও বর দিয়েছিলেন যে তিলোত্তমার দীপ্তির কারণে কেউ তার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকাতে পারবে না।

আরও পড়ুনঃ  বিষ্ণুপাদপদ্মে গয়াসুর বধঃ গয়াধামের আসল রহস্য || Gayasur and Gaya Dham

অপ্সরা উর্বশীঃ

অপ্সরাদের রানি রম্ভা হলেও উর্বশী হচ্ছেন সবচেয়ে নামী অপ্সরা । তিনি অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী, সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ও অনন্তযৌবনা এক অপ্সরা। এমনকি বেদেও একমাত্র এই অপ্সরা উর্বশীর উল্লেখ রয়েছে। তবে অন্যান্য অপ্সরাগণের জন্ম সমুদ্র মন্থন থেকে হলেও, অপ্সরার জন্মের এক বিশেষ কাহিনী প্রচলিত রয়েছে পুরাণে। আর এই কারনেই অপ্সরা উর্বশী অন্যান্য অপ্সরাদের থেকে আলাদা।

একবার সুর্যদেবের কাছ থেকে সহস্র কবচের সুরক্ষা প্রাপ্ত করেছিলেন দম্ভোদ্ভব নামের এক অসুর। এর ফলে মহা অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কারন তাঁর প্রাপ্ত বর প্রায় অমরত্বেরই সমান। দিনে দিনে যখন তাঁর অত্যাচারের মাত্রা লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকল তখন ভগবান বিষ্ণু দুই অংশে বিভক্ত হয়ে জমজ শিশুরূপে অবতার ধারন করেন। এই দুই জমজ ভ্রাতার নাম ছিল নর এবং নারায়ন। দম্ভোদ্ভবকে বধ করার উদ্দেশ্যে হিমালয়ের এক গুহায় বসে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জ্ঞান লাভ করে ধ্যানে লীন হয়ে গেলেন তাঁরা। যুগের পর যুগ ধরে চলতে লাগল তাঁদের কঠোর সাধনা। এর ফলে দিনে দিনে উষ্ণতা বাড়তে থাকল স্বর্গ মর্ত্য ও পাতালের। দেবরাজ ইন্দ্র আবারও চিন্তিত হলেন, ভাবলেন এই দুই জমজ ভ্রাতাগণ বুঝি তাঁর সিংহাসনেকে পাওয়ার জন্যই এত কঠোর তপস্যায় লীন।

তাই তাঁদের ধ্যান ভঙ্গ করতে একদিন স্বয়ং ইন্দ্রদেব হাজির হলেন নর নারায়নের সামনে। তপস্যারত ভ্রাতাগণকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন “হে বৎসগণ, তোমাদের তপস্যায় আমি যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়েছি। এবার ধ্যান ভঙ্গ কর আর বর চাও।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা। ধ্যানমগ্ন ভ্রাতাগণ ইন্দ্রের কথায় নূন্যতম কর্ণপাত না করেই তাঁদের তপস্যা অব্যাহত রাখলেন। আর অপমানিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ইন্দ্র ফিরে গেলেন দেবলোকে। এরপর অপ্সরা রম্ভা ও তিলোত্তমা এবং কামদেব ও তাঁর স্তী রতিকে নিয়ে আবারও ফিরে এলেন ধ্যানরত নর নারায়নের সম্মুখে। এবার শুরু হল অপ্সরাদের প্রলুব্ধকর কন্ঠে স্বর্গীয় সঙ্গীত এবং মহোনীয় নৃত্যের ইন্দ্রজাল। অন্যদিকে কামদেব সমস্ত পুষ্পিকা কুসুমিকাদের পরিস্ফুটিত করে রমনীয় আভা সৃষ্টি করলেন নর নারায়নের চারপাশের । কিন্তু নর নারায়ন অনড়। এদিকে কামদেব ও তাঁর দল কামশাস্ত্রের সমস্ত কলানৈপুণ্য প্রয়োগ করে যাচ্চছেন একের পর এক। এসময় নারায়ণ সঙ্গোপনে নরকে বললেন, ভ্রাতা, ইন্দ্র এবং এই স্বর্গীয় অপ্সরাদের রুপলাবণ্যের খুব অহংকার, তাই আমি এদের অহংকার চূর্ণ করতে যাচ্ছি। এই বলে তিনি তাঁর উরু থেকে সৃষ্টি করলেনে এক অভূতপূর্ব নারী। অতুলনীয়া, অনন্তযৌবনা, অপরূপা, আবেদনময়ী এসকল বিশেষণ যেন তুচ্ছ হয়ে যায় সেই নারীর কাছে। নারায়নের উরু থেকে উৎপন্ন হওয়ার কারনে তাঁর নাম হল উর্বশী। তাঁর স্বর্গীয় রুপ, রস ও মাধুর্য দেখে লজ্জিত হলেন উপস্থিত রতি, রম্ভা ও তিলোত্তমা। তারপর তাঁরা প্রত্যেকেই ক্ষমা প্রার্থনা করলেন নর ও নারায়নের কাছে। তাঁদেরকে ক্ষমা করে নারায়ণ ইন্দ্রকে আশ্বস্ত করলেন যে তাঁরা স্বর্গরাজ্য আক্রমন করার জন্য তপস্যা করছেন না। এবং একই সাথে উর্বসীকে অন্যান্য অপ্সরাদের সাথে দেবলোকে প্রেরণ করলেন দেবতাদের মনোরঞ্জন করার জন্য।

তবে অপ্সরা উর্বশীর জন্ম নিয়ে আরও কয়েকটি কাহিনী প্রচলিত, কোন মতে উর্বশীর জন্ম সমুদ্র মন্থন থেকে, কোন মতে সাতজন মনুই সৃষ্টি করেছিলেন উর্বশীকে আবার কোন কোন মতে মিত্র বরুণের অভিশাপে উর্বশী মনুষ্যভোগ্যা হয়ে মর্ত্যে জন্মগ্রহন করেছিলেন।

মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রম উর্বশী’ নাটকের ঘটনা অনুসারে জানা যার- কেশী দৈত্য উর্বশীকে হরণ করলে পুরূরবা উর্বশীকে উদ্ধার করেন। এর ফলে উর্বশী ও পুরূরবা উভয়ে প্রেমে আসক্ত হন। এরপর স্বর্গে অভিনয়কালে ভুল ক্রমে উর্বশীর মুখ থেকে পুরূবার নাম উচ্চারিত হলে, দেবতাগণ উর্বশীকে অভিশাপ দেন মর্ত্যে পুরূরবার স্ত্রী হয়ে জন্মানোর জন্য। আবার কোন কোন মতে পুরূরবা গন্ধর্বদের সন্তুষ্ট করে গন্ধর্বলোকে স্থান পান এবং উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক হয়ে সেখানেই  বসবাস করতে থাকেন।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply