আপনি যদি সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকেন, তাহলে অসুর, দানব, দৈত্য এবং রাক্ষস এই নামগুলোর সাথে আপনি খুব ভালোভাবেই পরিচিত। সনাতন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে বার বার উঠে আসে এই নামগুলো। আপনারা অনেকেই হয়ত ভেবে থাকেন অসুর, দানব, দৈত্য এবং রাক্ষস বলতে হয়ত একই জাতীয় ঐশ্বরিক বা অর্ধ-ঐশ্বরিক সত্ত্বাকে বোঝানো হয়। কিন্তু বাস্তবে এদের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। আর সেই পার্থক্যগুলো আপনাদেরকে অবগত করানোর জন্যই আমাদের আজকের আয়োজন। আশা করছি আজ অসুর, দানব, দৈত্য এবং রাক্ষস সম্পর্কে আপনার সংশয় ও বিভ্রান্তি দূর হবে।
অসুর কারা?
তো প্রথমেই আসা যাক অসুরদের কথায়। স্বামী ভূতেশানান্দ মহারাজের মতে তাল ছন্দ লয়- এই তিন নিয়ে সুর! এবং যাদের মধ্যে এগুলো অনুপস্থিত তাঁরা অসুর। তবে আমাদের সনাতন শাস্ত্রে অসুরের ধারণা আরও বিস্তৃত। একসময় বৈদিক দেবতাদেরকে অসুর হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও পৌরাণিক যুগে এসে সম্পুর্ণভাবে পাল্টে গেছে অসুরদের সংজ্ঞা। আপনারা জানেন ঋষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী অদিতির পুত্রগণকে বলা আদিত্য। এই আদিত্যগণ দেবত্ব প্রাপ্তির পর তাদেরকে সুর হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে যারা ক্ষমতাবঞ্চিত হওয়ার ফলে সুর তথা দেবতাদের বিরুদ্ধাচারণ করা শুরু করে তাদেরকেই বলা হয় অসুর। সুতারাং সুর বা অসুর সরাসরি কোন ভালো বা খারাপ প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত নয়। সেকারনে মহিষাসুর, বিত্রাসুর, শুম্ভাসুর, ত্রিপুরাসুর ইত্যাদি ভয়ংকর অসুরের পাশাপাশি গয়াসুর, মায়াসুর প্রভৃতি সৎগুণসম্পন্ন অসুরের কথাও জানতে পারা যায়। তবে সাধারণভাবে দেবতাদের শত্রু, অত্যাচারী, সৃষ্টির বিনাশ সাধনকারী ঐশ্বরিক প্রাণীদেরকেই অসুর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এবং এদিক দিয়ে দেখতে গেলে দৈত্য এবং দানবেরাও অসুর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
দানব কারা?
এবার আসা যাক দানবদের প্রসঙ্গে। মজার ব্যাপার হচ্ছে দেবতা, অসুর, দানব এবং দৈত্যগণ সকলেই ঋষি কশ্যপেরই সন্তান এবং প্রজাপতি দক্ষের দৌহিত্র। পুরাণ মতে ঋষি কশ্যপের ঔরসে এবং প্রজাপতি দক্ষের কন্যা দনুর গর্ভে জন্মেছিলেন দানবগণ। তবে তাঁদের কোন খারাপ স্বভাবের কারনে তাঁদের নাম দানব নয়। বরং তাঁদের মাতা দনুর নামানুসারেই তাঁদের নামকরন করা হয়েছিল দানব। ঋষি কশ্যপের সন্তান হওয়ার সুবাদে তাঁরা জন্মগতভাবেই অতিপ্রাকৃত এবং রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী। বিষ্ণু পুরাণ, শিব পুরাণ সহ বেশ কিছু পৌরাণিক শাস্ত্র থেকে জানা যায়, দানবগণ অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সত্ত্বেও, প্রাথমিকভাবে তাঁরা ছিলেন ত্রিদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সদাচারী। তবে কালক্রমে ক্ষমতার লোভ ও দেবতাদের প্রতি বিদ্বেষের কারণে তাঁদের অধঃপতন ঘটে। স্বরভানু, বিত্রাসুর, একাক্ষ, বাতাপি প্রভৃতিরা হচ্ছেন দানবগণের উদাহরণ।
দৈত্য কারা?
এবার জেনে নেওয়া যাক দৈত্য কারা? আগেই বলা হয়েছে দেবতা, অসুর, দৈত্য বা দানব সকলেই ঋষি কশ্যপের সন্তান। এবং মাতুল শ্রেণীর দিকে নজর দিলে দেখা যায় এঁরা সবাই প্রজাপতি দক্ষের কন্যার পুত্র। তো ঋষি কশ্যপ যে ১৩ জন দক্ষ কন্যা বিবাহ করেছিলেন তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলেন দিতি। এবং দানবগণ যেভাবে তাঁদের মাতার নামানুসারে দানব নামে পরিচিত হয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই দিতির পুত্রগণও পরিচিত হয়েছিলেন দৈত্য নামে। বলাই বাহুল্য, এই দৈত্যকুলে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকেকেই দৈত্য নামেই ডাকা হয়।
স্বভাবগতভাবে দৈত্যরাও ছিলেন দানবদের মত অতিপ্রাকৃত ও রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী। তাছাড়া তাঁরা দৈহিকভাবেও ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ভীতিকর। অদিতির পুত্রগণ দেবত্ব প্রাপ্তির পর দানবদের মত দৈত্যরাও দেবতাদের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। আর তাই স্বর্গের নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে আনতে লাগাতার দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগ্রামে লিপ্ত হন তাঁরা। এবং দেবতাদের সাথে তাঁদের এ লড়াইয়ে তাঁরা তাঁদের সৎ ভাই তথা দানবগণকেও নিজেদের দলভুক্ত করেছিলেন। আর এভাবেই দৈত্যগণ পরিণত হয়েছিলেন দেবতাদের চিরশত্রুতে।
হিরণ্যকশিপু, হিরণ্যক্ষ, তারকাসুর, বজ্রাঙ্গ হচ্ছেন দৈত্যদের উদাহরণ। তবে অধিকাংশ সময় দৈত্যরা মন্দ হিসেবে গন্য হলেও প্রহল্লাদ ও বলিরাজার মত সদাচারী ব্যক্তিও জন্মগ্রহণ করেছিলেন দৈত্যকুলে।
রাক্ষস কারা?
সবশেষে এবার রাক্ষসদের সম্পর্কে জেনে নেওয়ার পালা। রাক্ষস শব্দটি এসেছে সংস্কৃত রাক্স শব্দ থেকে যার অর্থ রক্ষা করা। বিভিন্ন পৌরাণিক শাস্ত্র বিশ্লেষন করে জানা যায়, মূলত সমূদ্র ও বণভূমিকে রক্ষা করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছিল রাক্ষসদেরকে। একারনে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাদেরকে বনবাসী বা সমূদ্রের তলদেশে বসবাসকারী হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। এঁরা প্রকৃতিগতভাবেই মাংসাশী এবং কোণ কোন ক্ষেত্রে এঁরা নরমাংসও ভোজন করত বলে জানা যায়। রাক্ষসদের মধ্যে মায়াবিদ্যা, উড্ডয়ন ক্ষমতা, বর্ধিত দৈহিক শক্তি এবং অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মত বৈশিষ্ট্য দেখা যেত। তাছাড়া তপস্যার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা বৃদ্ধিও করতে পারতেন। তবে তাঁরা মূলত বনবাসী হলেও তাঁরা মানব সভ্যতায় অনুপ্রবেশ করে বিশৃংখলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছেন বহুবার।
দানব ও দৈত্যদের সাথে রাক্ষসদের মূল পার্থক্য দুইটি। প্রথমটি হচ্ছে দৈত্য এবং দানবগণ দেবতাদের চিত্রশত্রু এবং দেবতাদের সাথে নিরন্তর যুদ্ধ-বিগ্রহে রত থাকেন। অন্যদিকে রাক্ষসগণ মনুষ্যগণের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরন করে থাকেন এবং তাঁদের সমস্ত নেতিবাচক শক্তি মানুষের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে থাকেন। তবে রাক্ষসগণ দেবতাগণকে কখনোই শত্রু মনে করেন না।এবং ২য় পার্থক্যটি হচ্ছে, দানব ও দৈত্যগণ বসবাস করেন পাতালে এবং রাক্ষসগণ বসবাস করেন পৃথিবীতে। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, মেঘনাদ, সূর্পণখা, অতিকায় প্রভৃতি চরিত্রগুলো হচ্ছে রাক্ষসগণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে রাক্ষসকুলে বিভীষণ, ভীমের স্ত্রী ও পুত্র হিড়ীম্বা ও ঘটোৎকচ প্রভৃতি সদাচারী ব্যক্তিগণও জন্ম নিয়েছিলেন।
প্রিয় দর্শক, আশা করছি অসুর, দানব, দৈত্য এবং রাক্ষসগণ সম্পর্কে আপনার মনে আর কোন সন্দেহ রইল না।