সারা বছর জুড়ে ভাই-বোনদের মধ্যে চলমান খুনসুটি থেমে যায় ভাইফোঁটার দিনে। কারন এদিনটা আর লড়াই-ঝগড়া বা খুনসুটির নয়, এদিনটি আনন্দের, ভালোবাসার। এদিনটি ভাই-বোনদের একে অপরের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনার দিন। কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, ভাইদুজ, ভৌবিজ, যমদ্বিতীয়া, ভাইটিকা ইত্যাদি নামে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে পালিত হয় এই পার্বণটি। তবে ভাইফোঁটা শুধুমাত্র ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেওয়া, মিষ্টি খাওয়ানো বা যম-যমুনার অনুষঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পিছনে রয়েছে তিনটি পৌরাণিক কাহিনী। রয়েছে কিছু নিয়ম কানুনও। তাই যে সকল ভাই-বোনেরা এই ভাইফোঁটা অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন তাঁদের জন্যই আমাদের আজকের আয়োজন। পুরাণের আলোকে আজ আমরা জানব ভাইফোঁটার বিস্তৃত ইতিহাস। আশা করি ভিডিওটির শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন এবং কমেন্ট বক্সে আপনার ভাই বা বোনের জন্য আশির্বাদ ও শুভকামনা লিখে যাবেন।
ভাইফোঁটার সাধারন নিয়মে কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ভাই বা দাদাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রন জানায় বোন। শাস্ত্র মতে, পূর্ব দিকে মুখ করে বসে ফোঁটা নেন ভাই। আবার উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করেও ফোঁটা নেওয়া যেতে পারে। তবে দক্ষিণ দিকে মুখ করে ফোঁটা নেওয়া নিষিদ্ধ কারন ভাইফোঁটায় এই দিকটিকে অশুভ বলে মনে করা হয়। চালের গুড়ো দিয়ে অঙ্কিত আল্পনার মাঝখানে ভাইকে আসনে বসিয়ে কাসা বা পিতলের থালায় ধান-দূর্বা, আমপাতায় রাখা কাজল ও চন্দন সাজিয়ে রাখা হয় ভাইয়ের সামনে। সঙ্গে থাকে ঘিয়ের প্রদীপ এবং শঙ্খ। আর মুখ মিষ্টি করানোর জন্য থাকে ভাইয়ের পছন্দের সমস্ত মিষ্টিও। এর পর বোনেরা বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কাজল নিয়ে এঁকে দেয় ভাইয়ের ভ্রু-যুগল। তারপর ভাইয়ের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার সময় বোনেরা ছড়া কাটে—
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা পেয়ে আমার ভাই হোক অমর।
বোনের পাশাপাশি ভাইয়ের পক্ষ থেকে বোনের জন্য থাকে আশির্বাদী মিষ্টি ও উপহারের ব্যাবস্থা। এভাবেই ভাই-বোনের অটুট বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে ভাইফোঁটা পার্বণ। কিন্তু জানেন কি ভাইকে ফোঁটা দেওয়ার এই রীতি কিভাবে শুরু হল। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই কাহিনীগুলো। ভাইফোঁটা প্রসঙ্গে প্রথমেই সামনে চলে আসে যম ও তাঁর জমজ বোন যমী বা যমুনার কাহিনী। পুরাণ বলছে যমুনা তাঁর নিজের ভাই যমকে বারংবার নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন। কিন্তু যমের কাঁধে অর্পিত বিরাট দায়িত্বের কারণে ধর্মরাজ যম বোনের সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারতেন না। তাই বোনের অভিমান ভাঙাতে একবার কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে যমুনার বাড়িতে হাজির হলেন যম। নিজের গৃহের দ্বারে নিজের ভাই যমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে যান যমুনা। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসানে তাঁর চোখে মুখে ফুটে ওঠে প্রসন্নতা ও স্নেহের ছাপ। সেই আবেগ ও ভালোবাসার আধারে যমকে মিষ্টিমুখ করিয়ে কপালে ফোঁটা একে দেন যমুনা। যমুনার ভাইয়ের প্রতি এই অপরিসীম ভালোবাসায় আপ্লুত হলেন স্বয়ং যমরাজও। তিনিও ভাইফোঁটা দানের পরিবর্তে যমুনাকে বললেন বর চাইতে। তবে যমুনা চেয়েছিলেন তিনটি বর।
- প্রথম বর, প্রতি বছর যম কার্তিক শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় যমুনার বাড়িতে ভোজন গ্রহণ করতে আসবেন।
- দ্বিতীয় বর, এই তিথিতে যে বোন নিজের ভাইকে ফোঁটা দিয়ে ভোজন করাবে, তাঁর কখনও যমের ভয় থাকবে না।
- এবং তৃতীয় বর, যে ব্যাক্তি যমুনার জলে স্নান করবেন তিনি যেন সমস্ত নরক যাতনা থেকে মুক্তি লাভ করেন।
যমুনার চাওয়া সেই তিনটি বরই মঞ্জুর করেছিলেন ধর্মরাজ যম। তবে তিনি এ বলেও সতর্ক করেন যে, যে ভাই নিজের বোনের তিরস্কার করবে ও অপমান করবে, তাঁকে যমপাশে বেঁধে যমপুরী নিয়ে যাবেন তিনি। তা সত্ত্বেও, সেই ভাই যদি অনুতপ্ত হয়ে যমুনার জলে স্নান করে সূর্যকে অর্ঘ্য দেন, তা হলে তাঁর অপরাধ ক্ষমা করে স্বর্গলোক প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। তাই বলা হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে ভাই-বোন উভয়েরই যমুনায় স্নান করা কর্ত্তব্য। তাছাড়া মৎস্য পুরাণেও যমকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভাতৃদ্বিতীয়ার দিনে ষোড়শ উপচার বিধিতে পুজো করা বিধান রয়েছে। ধারনা করা হয় যম ও যমুনার এই ফোঁটা দেওয়া থেকেই মর্ত্যে প্রচলন ঘটেছিল ভাইফোঁটার।
তবে ভাইফোঁটার প্রচলন সম্পর্কে আরও একটি ঘটনা রয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর আদরের বোন সুভদ্রাকে কেন্দ্র করে। ধনত্রয়োদশীর পরের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশী তিথিতে বা নরক চতুর্দশী তিথিতে নরকাসুরকে বধ করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তারপর তিনি প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে দ্বারকায় ফিরে এলেন কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে। এতবড় মহাবলশালী অসুর নিধনে যাওয়ার সময় বোন সুভদ্রা ছিলেন খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। তাই অসুরবধের পর শ্রীকৃষ্ণকে ফিরে আসতে দেখে উচ্ছ্বাসের বাঁধ যেন ভেঙে গেল বোন সুভদ্রার। তিনি বরাবরই দাদার আদরের বোন। তাই অসুরবধের এই সময়টাতে তিনি ছিলেন দাদার আদর বঞ্চিত। তার উপর আবার সুভদ্রা খবর পেয়েছেন, নরকাসুরের সাথে যুদ্ধে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়েছে হয়েছেন ভ্রাতা কৃষ্ণ। অতএব, দ্বারকা পৌঁছতেই চালের গুড়ো দিয়ে আঁকা আল্পনার মাঝখানে আসন পেতে বসালেন প্রাণের ভাই শ্রীকৃষ্ণকে। প্রথমেই তাঁর কপালে পরিয়ে দিলেন বিজয়তিলক। তারপর তাঁকে মিষ্টিমুখ করিয়ে কপালে ভাইফোঁটা একে দিয়েছিলেন সুভদ্রা। তাই অনেকে মনে করেন, ভাই ফোঁটার শুরু হয়েছিল কৃষ্ণের কপালে সুভদ্রার ফোঁটা অঙ্কনের মধ্য দিয়েই। সেই কারনেই ভাইকে নরকাসুর বধকারী শ্রীকৃষ্ণ কল্পনা করেই তাঁর কপালে ফোঁটা এঁকে দেন আজকের বোনেরা।
ভাইফোঁটা সম্পর্কে তৃতীয় যে ঘটনাটি প্রচলিত তা মূলত জানা যায় সর্বানন্দসুরী নামক এক আচার্য পণ্ডিতের দীপোৎসবকল্প নামক তালপাতার পুথি থেকে। চতুর্দশ শতাব্দীর সেই পুথি অনুসারে, জৈন ধর্মের অন্যতম প্রচারক মহাবীর বর্ধমানের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর অন্যতম সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন। এমনকি বন্ধ করে দেন খাওয়াদাওয়াও। এরকম অবস্থায় তাঁর প্রিয় বোন অনসূয়া রাজা নন্দীবর্ধনকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। দিনটি ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। রাজার কপালে চন্দনের ফোঁটা অংকন করে দেন বোন অনসূয়া। তারপর ভাইয়ের কাছে আবদার করেন, “রাজ্যের প্রজারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, এই অনশন তোমাকে মানায় না দাদা। হে ভ্রাতা, হে রাজন, তোমার কপালেএঁকে দিলাম রাজতিলক। এবার ক্ষুধা নিরসনের জন্য খাদ্য গ্রহণ করো এবং সাদর আপ্যায়িত হও৷ সর্ববিধ মঙ্গলের জন্য তুমি জেগে ওঠো এবং ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন৷ আমি তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি৷এখন থেকে প্রতি বছর এইদিনে তোমাকে রাজতিলক পরিয়ে অভিষিক্ত করা হবে, এই আমার ব্রত৷”
বোনের মুখে এই কথা শুনে রাজা নন্দীবর্ধন অনশন ভেঙে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন জীবনসত্যে৷ দীপোৎসবকল্পতে বর্ণিত এই ইতিহাসও প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। এবং এই ঘটনা থেকেও ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানের সূচনা হতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে। তবে ঘটনা যেটাই হোক না কেন, ভাই-বোনের এঁকে অপরের প্রতি বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতেই যে ভাইফোঁটার এই আয়োজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।