সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এবং বিদ্যাদেবী সরস্বতী। ইন্টারনেট জুড়ে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াতে তাঁদের সম্পর্কে বিভিন্ন মুখরোচক, রুচিহীন, এবং অশালীন গল্পের শেষ নেই। কেউ বলেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নাকি তাঁর কন্যা দেবী সরস্বতীকে বিবাহ করেছিলেন, কেউ বলেন দেবী সরস্বতীর পিতা ও স্বামী একজনই। আবার কেউ বলে থাকেন ব্রহ্মা তাঁর কন্যা সরস্বতীকে সৃষ্টি করে নিজেই তাঁকে কামনা করেছিলেন। তবে এসকল গল্পগুলো এখানে যতটা শালীনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে গল্পকাররা কিন্তু তাঁদের এই কাহিনীগুলো বলা বা লেখার সময় এতটা শালীনতা দেখান না। তবে সত্যি বলতে বিভিন্ন পুরাণে দেবী সরস্বতী ও তাঁর পিতা বা স্বামীর চরিত্রে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে রেখে যে কাহিনীগুলো লেখা হয়েছিল সেগুলোই এসকল অশালীন গল্পের সূত্রপাত ঘটিয়েছে বলে ধারনা করা হয়। কিন্তু যদি বলি ব্রহ্মা সরস্বতীকে দেখে কামার্ত হননি এবং বিবাহও করেননি তাহলে কি আমাদের পুরাণশাস্ত্রের কাহিণীগুলো মিথ্যা হয়ে যাবে? আসুন জেনে নেওয়া যাক দেবী সরস্বতী আসলে কে এবং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সাথে তাঁর আসলে কি সম্পর্ক। তবে শুরু করার আগে আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের সনাতন সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ও বিকৃত ধারনাগুলো দূর করতে এটি যথাসম্ভব শেয়ার করে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিন।
পরম ব্রহ্ম এবং পরম ব্রহ্মময়ীঃ
দেবী সরস্বতী আসলে কে তা জানার আগে আসুন জেনে নিই আমাদের অজ্ঞাত নিরাকার পরম ব্রহ্মের ব্যাপারে। আমাদের ধর্মের সর্বোচ্চ যে ঈশ্বরের কথা বলা হয় তিনি হচ্ছেন পরম ব্রহ্ম। তিনি অজ্ঞাত, নিরাকার ও নির্গুণ। আবার যেহেতু সনাতন ধর্মে সর্বদাই নারী ও পুরুষের সহাবস্থান প্রদর্শিত হয়েছে, তাই সেই নিরাকার পরম ব্রহ্মের নারী রূপ হচ্ছেন তাঁর পট্টমহিয়সী শক্তি বা পরম ব্রহ্মময়ী। এই পরম ব্রহ্ম বা ব্রহ্মময়ী বিভিন্ন প্রয়োজনে সাকার রূপে ধরা দিয়েছেন আমাদের সামনে। যেমন সৃষ্টি করার প্রয়োজনে তিনি ব্রহ্মা রূপ ধারন করেছেন, সৃষ্টির ভারসম্য রক্ষার প্রয়োজনে ধারন করেছেন শ্রীবিষ্ণুর রূপ আবার ধ্বংসের প্রয়োজনে তিনি ধারন করেছেন রুদ্রমূর্তি। এবার ঠিক বিপরীত দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায়, পরম ব্রহ্মের পট্টমহিয়সী শক্তি বা পরম ব্রহ্মময়ী একইভাবে ধারন করেছেন পার্বতী, লক্ষ্মী বা সরস্বতীর রূপ। এবং মোদ্দাকথা আমাদের সকল দেব-দেবীই সেই অনাদি ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণময়ী রূপ মাত্র।
দেবী সরস্বতী আসলে কে?
এবার আসি আমাদের দেবী সরস্বতী আসলে কে সেই প্রসঙ্গে। এই প্রশ্নের এককথায় উত্তর হচ্ছে জ্ঞান। দেবী সরস্বতী নিজেই জ্ঞান স্বরূপা। প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে আমরা যে দ্বিভুজা বা চতুর্ভূজা যে শুভ্রবসনা দেবীকে পূজা করি তাহলে তিনি কে? আসলে নির্গুণ ঈশ্বরের জ্ঞান শক্তির সাকার বা প্রতিকী রূপ হচ্ছেন এই দেবী সরস্বতী। অর্থাৎ স্বয়ং জ্ঞানকে আমরা মতৃরূপে প্রকাশ করে তাঁর পূজা করছি মাত্র। কিন্তু বাস্তবে সরস্বতী পূজা করার অর্থ হচ্ছে পরম ব্রহ্ম বা ব্রহ্মময়ীর সেই জ্ঞানরূপ শক্তিকে পূজা করা। আবার এই জ্ঞানের অবস্থান আমাদের অন্তরে, অর্থাৎ আমাদের অন্তরেই জ্ঞানরূপী দেবী সরস্বতীর অবস্থান। সরস্বতী পূজার মাধ্যমে আমাদের অবচেতনে থাকা সেই জ্ঞানকে জাগ্রত করার চেষ্টা করছি মাত্র।
রূপক পৌরাণিক কাহিনীঃ
এবার আসি আমাদের পুরাণ কাহিনীতে। পুরাণে বর্ণিত হয়েছে দেবী সরস্বতী সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা থেকে জন্ম নিয়েছেন। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে দেবী সরস্বতী প্রজাপতি ব্রহ্মার কন্যা। কিন্তু সেই কন্যাকে দেখে কামার্ত হলেন ব্রহ্মা, এরফলে তাঁর আরও একটি মস্তকের উদ্ভব হল এবং দেবাদিদেব মহাদেব এসে সেই মস্তক কর্তন করলেন।
এবার একটু ভাবুন তো, আমরা এই যে ব্রহ্মা, সরস্বতী বা দেবাদিদেব মহাদেবের কথা বলছি তাঁরা কি আমাদের মত মানুষ? আজ্ঞে না, তাঁরা পরমব্রহ্মের বিভিন্ন শক্তি বা গুণের এক একটি রূপভেদ মাত্র। এর অর্থ হচ্ছে তাঁরা আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও আদতে তাঁরা এক ও অভিন্ন সত্ত্বা। এখন এই এক ও অভিন্ন স্বত্বার মধ্যে কি কাম, ক্রোধ, বিরোধ বা হিংসা করা সম্ভব? নিশ্চই না। তাহলে পুরাণে কেন এরকম ঘটনা বারবার দেখতে পাওয়া যায়? যেখানে আমাদের সনাতন সমাজে কাকাতো, মাসতুতো বা পিসতুতো ভাই-বোনেদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ, সেখানে ব্রহ্মা কিভাবে তাঁর পুত্রীকে কামনা করতে পারেন?
আসলে এই জায়গাটাতেই আমরা সবচেয়ে বড় ভুল করে থাকি। আমরা সাধারন মানুষগণ পৌরাণিক আখ্যানগুলোর বাস্তব স্বরূপ না জেনেই বিকৃত কিছু ভেবে বসি। জেনে রাখা ভালো আমাদের বেদাদি শাস্ত্র সর্বজনবোধ্য না হওয়ার কারণে রচিত হয়েছিল আমাদের পুরাণশাস্ত্রগুলো। সেখানে বিভিন্ন রূপক বা কাহিনীর আশ্রয় নিয়ে একের পর এক ব্যাখ্যা করা হয়েছে আমাদের ধর্মের নিগুঢ় তত্ত্বগুলো। কিন্তু আমরা যে মুহুর্তে সেই রূপকগুলো বুঝতে না পেরে আক্ষরিক অর্থে পুরাণের ব্যাখ্যা করি সেই মুহুর্তেই আমারা ভুল পথে ধাবিত হই। সরস্বতী ও ব্রহ্মার ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে।
যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা আমাদের সৃজনকর্তা, তাই তাঁর থেকে দেবী সরস্বতীর উদ্ভব হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এখন যদি বলা হয় ব্রহ্মার থেকে যেহেতু দেবী সরস্বতীর উদ্ভব হয়েছে তাই ব্রহ্মা সরস্বতীর পিতা সেটা মোটেও ঠিক নয়। কারন সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা তাঁর একটি গুণ বা শক্তির প্রকাশ করেছেন মাত্র। তাই দেবী সরস্বতী ঈশ্বরের জ্ঞানরূপ শক্তির মূর্ত প্রতীক।
দেবী সরস্বতীকে দেখে কামার্ত হলেন ব্রহ্মাঃ
এবার আসি ব্রহ্মা কেন সরস্বতীকে কামনা করলেন? আমরা আগেও বলেছি আমরা যে সকল দেব-দেবী নিয়ে আলোচনা করছি তাঁরা আমাদের মত রক্ত-মাংসে গড়া নশ্বর মানব-মানবী নন। তাঁরা স্বয়ং ঈশ্বর। তাই জাগতিক কাম বলতে আমরা যে নর-নারীর এঁকে অপরের প্রতি আকর্ষন বুঝে থাকি, ঐশ্বরিক কাম কোনভাবেই সেরকম কিছু নয়। সরস্বতীর প্রতি ব্রহ্মার যে কাম সেটি হচ্ছে এক ধরনের কামনা, অর্থাৎ তাঁকে বশে রাখার কামনা। জ্ঞানের দেবী সরস্বতী আসলে সরস ও বতী এই দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত। অর্থাৎ তিনি প্রবহমান। ঠিক যেমন জ্ঞানের প্রবাহ নদী তথা প্রকৃতির মত অনন্তকাল ধরে অনন্ত দিশায় প্রবাহিত সেই জ্ঞানকেই বশ করতে চেয়েছিলেন ব্রহ্মা। কিন্তু প্রকৃতি স্বরূপা দেবী সরস্বতীকে কেউই নিয়ন্ত্রন বা বশে রাখতে পারেন না। তাই ব্রহ্মার কাম মস্তক নামক যে পঞ্চম মস্তকের উদ্ভব হয়েছিল তা আসলে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করার একটি অভিপ্রায় মাত্র।
ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক নাশ করলেন শিবঃ
এবার আসি ব্রহ্মার সেই কাম-মস্তককে বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায়। দেবাদিদেব মহাদেব ব্রহ্মার সেই কামার্ত মস্তক ছিন্ন করেছিলেন বলে যে কাহিনীটি পুরাণে বর্ণিত হয়েছে সেটিও আসলে রূপকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের সামনে। আপনারা জানেন শিব ধ্বংসকর্তা। ব্যাপক অর্থে তিনি নিরাকার ঈশ্বরের ধ্বংসকারী রূপের বহিপ্রকাশ। কিন্তু তিনি আসলে কি ধ্বংস করেন? আপনারা অনেকেই বলবেন তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস করেন। কিন্তু তাঁর আসল কাজটি হচ্ছে তিনি সমস্ত অশুভের বিনাশ কর্তা। আমাদের মধ্যে যে সকল আসুরিক ও বিনাশী শক্তিগুলো বাস করে তিনি তাদেরই ধ্বংসকর্তা। তাই ঈশ্বরের সৃজন শক্তির মধ্যে প্রকৃতিস্বরূপা দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করে যে অহমিকা এবং তাঁকে নিয়ন্ত্রন করার যে কামনা জন্ম নিয়েছিল সেটাকেই একটি মস্তক দ্বারা রূপকভাবে প্রকাশ করে মহাদেব কর্তৃক ধ্বংস করা হয়ছে।
যুক্তিখণ্ডনঃ
তাই আমাদের সমাজে আমরা যারা পুরাণ দ্বারা প্রভাবিত, এবং পৌরাণিক আচার পালনের মাধ্যমে ধর্ম পালন করি, তাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমাদের পুরাণশাস্ত্রগুলো আমাদের জন্য অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার বটে, তবে সেই জ্ঞানকে জ্ঞানচক্ষু দিয়ে না দেখে আক্ষরিকভাবে দেখলে বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। তাই আসুন আমরা অন্যের মুখনিঃসৃত মুখরোচক কাহিনী না শুনে নিজেই শাস্ত্রপাঠে ব্রতী হই এবং আমাদের জ্ঞানচক্ষুকে উন্মীলিত হতে সাহায্য করি।