রাজনীতির কূটকৌশল, যুদ্ধের দামামা, বীরোচিত চরিত্রসমূহ, অতুল্য জ্ঞান এবং গভীর জীবনবোধের ভাণ্ডার হচ্ছে মহাভারত। এবং মহাভারতের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে যে নারীর অবস্থান তার নাম দ্রৌপদী। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অনুষ্ঠিত যুদ্ধটিরও কেন্দ্রীয় কারন হিসেবেও উল্লেখ করা হয়ে দ্রৌপদীর নাম। শুধু তাই নয়, তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্বয়ংবর, দাম্পত্য জীবন, যৌন জীবন, বস্ত্র হরণ, সন্তান উৎপাদন প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করেও রয়েছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা এবং বিতর্ক। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে দ্রৌপদী সম্পর্কে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হচ্ছে তার যৌন জীবন। কেমন ছিল সেই জীবন? কিভাবে পাঁচজন স্বামীকে নিয়ে গার্হস্থ্য জীবন যাপন করতেন তিনি? আর এভাবে ৫ জন স্বামীর সাথে সহবাসে থাকা নারীকে সতী নারী বলা যায় কি? কিংবা পাঁচজন স্বামীর শয্যাসঙ্গী হয়েও কিভাবে তিনি পঞ্চসতীর একজন সতী হিসেবে বিবেচিত হন? প্রিয় দর্শক, আজ আমাদের আয়োজন দ্রৌপদীর যৌন জীবন ও তার সতীত্ব নিয়ে। আশা করি সম্পূর্ণ আয়োজন জুড়ে আমাদের সাথেই থাকবেন।
দ্রৌপদীর যৌন জীবন সম্পর্কে জানার আগে তার জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে জেনে নেওয়া একান্ত আবশ্যক। আপনারা জানেন পাঞ্চালের রাজা মহারাজ দ্রুপদ তার শত্রু দ্রোণাচার্যকে পরাজিত করার জন্য দ্রোণবধী পুত্র কামনা করে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। এবং সেই যজ্ঞের অগ্নি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় উদ্ভূত হয়েছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন নামের এক পুত্র। তবে সেই সাথে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আরো এক কন্যার আবির্ভাব হয় যার নাম দ্রৌপদী। তার গায়ের রঙ কালো ছিল বলে তার নাম হয়েছিল কৃষ্ণা, এবং যজ্ঞের অগ্নি থেকে আবির্ভূত হওয়ার কারনে তার নাম হয়েছিল যাজ্ঞসেনী। এছাড়াও পাঞ্চালী, পর্ষতী, মালিনী, পঞ্চবল্লভা ইত্যাদি নামেও ডাকা হত তাকে। তো দ্রৌপদীর এই সংক্ষিপ্ত জন্ম বৃত্তান্ত থেকে আপনারা বুঝতে পারলেন, দ্রৌপদী সাধারন যোনীজাত মানুষের মত সাধারন কেউ নন।
এবার আসি দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে। আপনারা জানেন দ্রৌপদীর স্বয়ংবর অনুষ্ঠানে এক জটিল ধণুর্বান পরীক্ষার আয়োজন করেছিলেন মহারাজ দ্রুপদ। এবং সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ব্রাহ্মণবেশে বনবাসরত পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন। এরপর দ্রৌপদীকে তাদের পর্ণকুটিরে নিয়ে গিয়ে অর্জুন তার মাতা কুন্তিকে বলেছিলেন, “মা, আজ এক রমণীয় বস্তু ভিক্ষা লাভ করেছি” কিন্তু কুন্তী সেই রমনীয় ভিক্ষাবস্তুর দিকে না তাকিয়েই বলেছিলেন, “তোমরা সকলে মিলে তা ভোগ করো।” এখান থেকেই শুরু হয় দ্রৌপদীর দাম্পত্য জীবনের জটিলতা। একজন নারী কিভাবে ৫ জন পুরুষের স্ত্রী হতে পারেন? মহা দুশ্চিন্তায় পড়লেন পঞ্চপাণ্ডব, কুন্তী, দ্রৌপদী এবং রাজা দ্রুপদ। এসময় যুধিষ্ঠির বললেন “কল্যাণীয়া দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই ভার্যা হবে।” তখন দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “স্বয়ং ধর্মের প্রতিভূ হয়ে আপনি কীভাবে এমন অধর্ম করতে পারেন? ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এ প্রশ্নের জবাবে ব্যাসদেব কর্তৃক বর্ণিত দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের কাহিনী সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন।
বকরাক্ষস বধের পর পাণ্ডবগনের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে মহামুনি ব্যাসদেবের। ব্যাসদেব তখন প্রসঙ্গক্রমে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত পাণ্ডবদের কারছে বর্ণনা করেন। “কোনো তপোবনে সর্বাঙ্গসুন্দরী ও সর্বগুণসম্পন্না এক ঋষিকন্যা বাস করতেন। আসলে দেবী স্বর্গলক্ষ্মী তথা ইন্দ্রপত্নী শচীদেবীই এই ঋষিকন্যারূপে মর্ত্যে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু মানবজন্মে তিনি উপযুক্ত পতি লাভ না করতে পেরে অত্যন্ত ব্যথিতা হয়েছিলেন। আর তাই তিনি উপযুক্ত পতি লাভের ইচ্ছায় মহাদেবের তপস্যা করতে শুরু করেন। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তার সমক্ষে উপস্থিত হলেন শিব। তখন শিবের কাছে সেই মহীয়সী ঋষিকন্যা সর্বগুণসম্পন্ন পতিলাভের বর প্রার্থনা করেন। কিছুটা ইতস্তত হওয়ার কারনে সেই রমণী পাঁচবার শিবের কাছে একই বর প্রার্থনা করেন। আর তাই পাচবার একই বর প্রার্থনা করার কারনে ভগবান শিব তাকে পঞ্চস্বামী প্রাপ্ত হওয়ার বর প্রদান করেন”। সেই ঋষিকন্যাই পরজন্মে দ্রুপদের কন্যারূপে যজ্ঞ থেকে দ্রৌপদীরূপে জন্ম নিয়েছিলেন।
কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই বিচার সম্পুর্ণভাবে মেনে নিতে পারেননি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ। তাই পরবর্তীতে ব্যাসদেবের আগমন হলে তিনি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, “হে ভগবান, একটি স্ত্রী বহু পুরুষের পত্নী হবে, অথচ তাতে কেন পাপ হবে না?” ব্যাসদেব দ্রুপদের মনের ব্যাথা বুঝতে পেরে তাকে নিয়ে একটি কক্ষে প্রবেশ করলেন। এসময় মহামুনি বেদব্যাস রাজা দ্রুপদের কাছে পাণ্ডবদের পূর্বজন্মের কাহিনী বর্ণনা করেন। বস্তুত পঞ্চপাণ্ডবগণ প্রত্যেকেই পূর্বজন্মে এক একজন ইন্দ্র হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু তাদের অহংকারের কারনে তারা দেবাদিদেব মহাদেব কর্তৃক অভিশপ্ত ও বন্দী হন। এরপর সেই পাচজন ইন্দ্র মহাদেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে মহাদেব তাদেরকে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করার শাস্তি দেন। তবে ইন্দ্রগণের আকুতিতে মহাদেব তাদেরকে ধর্মরাজ, বায়ুদেব, ইন্দ্রদেব ও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের মাধ্যমে জননীগর্ভে স্থাপন করেন। আর পূর্বজন্মের সেই পাচজন ইন্দ্রই হচ্ছেন মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব। ব্যাসদেবের কাছে এসমস্ত সমাচার শোনার পর আশ্বস্ত হলেন মহারাজ দ্রুপদ। এবং এর পরেই বিবাহ হয় পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর।
সংসার জীবনের শুরুতে নারদ মুনি পঞ্চপাণ্ডবদের কাছে সুন্দ ও উপসুন্দ নামের দুই অসুরের কাহিনী বর্ণনা করেন। এই দুই অসুর ভ্রাতা বর পেয়েছিলেন যে, জগতের কেউই তাদেরকে বধ করতে পারবে না। তবে শুধুমাত্র তারা একে অপরকে বধ করতে পারবেন। কিন্তু তিলোত্তমা নামক এক অপ্সরার মোহে তারা দুজনেই দুজনের হাতে নিহত হয়েছিলেন। তাই দ্রৌপদীকে কেন্দ্রকে তাদের পঞ্চভ্রাতার মধ্যে যাতে কোন দ্বন্দ্ব না ঘটে তা সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করেন নারদ মুনি। তাছাড়া নারদ মুনির উপস্থিতিতে পাণ্ডবগণ সিদ্ধান্ত নেন যে, দ্রৌপদী পাণ্ডবদের স্ত্রী হিসেবে এক বৎসর কাল একেকজন পাণ্ডবের কক্ষে অবস্থান করবেন। এসময় অন্য কোন পণ্ডব দ্রৌপদীর কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। এবং এই নিয়ম ভঙ্গ করলে তাকে ১২ বছরের জন্য নির্বাসিত হয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। একবার যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে নিয়ে গৃহবাস করার সময় অর্জুন তার ধনুক আনতে তাদের কক্ষে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার ফলস্বরূপ তাকে ১২ বছরের জন্য নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। যাইহোক, দ্রৌপদীও পাণ্ডবদেরকে শর্ত দিয়েছিলেন যে পঞ্চপাণ্ডব আর কাউকে বিবাহ করে ইন্দ্রপ্রস্থে রানী হিসেবে নিয়ে আসতে পারবেন না। একারনে অর্জুন সুভদ্রাকে বিবাহ করলে, সুভদ্রা দাসীর বেশে দ্রৌপদীর সামনে হাজির হয়েছিলেন।
পত্নী হিসেবে দ্রৌপদী ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী। প্রত্যেক স্বামীকেই তৃপ্ত করার ক্ষমতা ছিল তার। নিয়ম অনুসারে, এক বৎসর কাল একজন স্বামীর গৃহে নিবাস করার পর অগ্নিসম্ভূতা দ্রৌপদী অগ্নিস্নান করে নিজেকে পবিত্র করে নিতেন। তাছাড়া ব্যাসদেবের বরে অগ্নিস্নান করার পরে পুনরায় নিজের কুমারীত্ব ফিরে পেতেন তিনি। এবং এর পরেই তিনি অন্য স্বামীর সাথে দাম্পত্য জীবন পালন করতেন।
ভ্রাতাদের মধ্যে যুধিষ্ঠির যেহেতু জ্যেষ্ঠ ছিলেন সেহেতু তিনি স্থির করেন, দ্রৌপদীর সান্নিধ্য তিনিই সবার আগে উপভোগ করবেন। আর জ্যেষ্ঠতা অনুসারে অন্য ভ্রাতারা পর্যায়ক্রমে দ্রৌপদীর সান্নিধ্য লাভ করবেন। যুধিষ্ঠিরের এই সিদ্ধান্ত বিনা বাক্য ব্যায়ে মেনে নিয়েছিলেন তার অন্য ভ্রাতারা। এবং এই নিয়মে পর্যায়ক্রমিকভাবে চলত তাদের গৃহজীবন। আর এভাবে প্রত্যেক স্বামীর ঔরসে পাঁচটি পুত্র সন্তানের জননী হয়েছিলেন দ্রৌপদী। যুধিষ্ঠির তৃপ্ত হয়েছিলেন দ্রৌপদীকে কাছে পেয়ে। কিন্তু দ্রৌপদীর মনে হয়েছিল, যুধিষ্ঠিরের মধ্যে বড় বেশি আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা ক্রিয়াশীল। নারীর সূক্ষ্ম অনুভূতি বোঝার ক্ষমতাও তার কিঞ্চিৎ কম বলেই মনে হয়েছিল দ্রৌপদীর।
যুধিষ্ঠিরের পর একে একে ভীম, অর্জুন ও নকুল ও সহদেব দ্রৌপদীর সঙ্গ লাভ করেন। তবে এদের মধ্যে দ্রৌপদীর প্রতি ভীমের ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়। পঞ্চ স্বামীর মধ্যে তিনিই সর্বাধিক ভালবাসতেন দ্রৌপদীকে। দ্রৌপদীর সমস্ত ছোটখাটো ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারে ভীম ছিলেন সদা তৎপর। তিনি দ্রৌপদীকে কুবেরের বাগান থেকে ফুল এনে উপহার দিতেন নিয়মিত। বস্তুত ভীম বাহ্যত কর্কশ ও ক্রোধী প্রকৃতির হলেও দ্রৌপদীর প্রতি তার ব্যবহার ছিল সদা কোমল। বনবাসের সময় দ্রৌপদীকে মৎস্য রাজ্যের রানি সুদেষ্ণার দাসীর ভূমিকা পালন করতে হবে জেনে দুঃখে কেঁদে ফেলেছিলেন ভীম। দ্রৌপদীও অত্যন্ত ভরসা করতেন ভীমকে। আর তাই মৎস্য রাজ্যে কীচকের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পরে প্রতিবিধানের আশায় দ্রৌপদী ছুটে গিয়েছিলেন ভীমের কাছেই।
তবে পাঁচ স্বামীর মধ্যে দ্রৌপদী সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন অর্জুনকে। কারণ অর্জুনই তাকে স্বয়ম্বর সভায় জিতে নিয়েছিলেন। তাই অন্যান্য স্বামীরা যখন একাধিক বিবাহ করেছেন, তখন দ্রৌপদীকে খুব একটা ব্যথিত হতে দেখা যায় নি। কিন্তু অর্জুন যখন সুভদ্রাকে বিয়ে করলেন, তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন দ্রৌপদী। তবে অর্জুনের প্রিয়তমা পত্নী কিন্তু দ্রৌপদী ছিলেন না। অর্জুন তার স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন সুভদ্রাকে, যিনি ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী। আর সুভদ্রার গর্ভজাত অভিমন্যু ছিলেন অর্জুনের প্রিয়তম পুত্র। দ্রৌপদীর গর্ভজাত নিজের সন্তানের তুলনায় অভিমন্যুকে সবসময়েই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন অর্জুন।
ভ্রাতাদের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি নকুল ও সহদেবের আনুগত্য ছিল সর্বাধিক। আর সেকারনে দ্রৌপদীর সঙ্গে নকুল ও সহদেবের সম্পর্কও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে যুধিষ্ঠিরের নির্দেশ ও পরামর্শের দ্বারা।
প্রিয় দর্শক, এবার আপনারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন পঞ্চ পাণ্ডব ছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রেরই পাঁচজন মানব অবতার এবং দ্রৌপদী হচ্ছেন স্বর্গলক্ষ্মী বা শচীদেবীর মানবীরূপ। তাই আপাতত দৃষ্টিতে দ্রৌপদীর যৌন জীবনে পাঁচজন স্বামীর অস্তিত্ব থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ইন্দ্র ও শচীদেবী দম্পত্তির পার্থিব রূপ মাত্র। আর এ কারনেই সমাজের হীনমন্যতাকে শূলবিদ্ধ করে দ্রৌপদীকে পঞ্চসতীর অন্যতম সতী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে অনেক গবেষকদের কাছে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর বিষয়টি বহুবিবাহে অভ্যস্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হীন মানসিকতার মূলে একটি কুঠারাঘাত মাত্র।