গণেশের প্রতি তুলসীর একতরফা প্রেম, পরিণতি পেল অভিশাপ-পাল্টা অভিশাপে || Ganesh & Tulsi: Love and Curse

অম্বিকার প্রিয় পুত্র দেব গজানন,

সিদ্ধির নিমিত্তে স্মরি তাহার চরণ।

নমি পদে বার বার মঙ্গল দেবতা,

বিঘ্ননাশ সিদ্ধি দান কর হে সিদ্ধিদাতা।

আপামর বাঙালী সমাজের একটি বিরাট অংশ শাক্ত বিশ্বাসের অনুগামী হলেও গণেশ বা গাণপত্যের অনুসারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। বছরে একবার মহাসমারোহে গণেশ চতুর্থী পালন করা এবং নববর্ষের হালখাতায় গণেশ পুজোর পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই বাঙালীর গৃহে এবং ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে পূজিত হন গণপতি বাপ্পা। তাছাড়া সকল দেব দেবীর পুজোর আগে বিঘ্নেশ গণেশের পুজো করার বিধান রয়েছে সনাতন শাস্ত্রে। তিনি সিদ্ধিদাতা ও বিঘ্নহর্তা, তাই যে কোন কাজে সিদ্ধি ও সাফল্য অর্জনে সর্বাগ্রে স্মরণ করা হয় তাকে।

তাছাড়া গজানন দেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য রক্ত জবা, কুন্দ, অপরাজিতা, গাঁদা, দূর্বা, মোদক, সিঁদুর প্রভৃতি উপাচারে গণেশ ভক্ত ও কৃপাপ্রার্থীগণ গণেশ পুজো করে থাকেন। কারন যেকোন প্রকারে সিদ্ধিদাতা সন্তুষ্ট হলেই ভাগ্য ফিরে যেতে বাধ্য। কিন্তু কখনো কি খেয়াল করেছেন, গণেশের পুজোতে তুলসী পাতা অর্পণ করা হয় না কেন? আপনি বলতেই পারেন অনেক দেব দেবীর পুজোতেই তো তুলসী পাতার ব্যাবহার নেই, এতে আর আশ্চর্য কি? আজ্ঞে হ্যাঁ, এটা আশ্চর্যের বিষয়ই বটে। মূলত গণেশের পুজোতে তুলসীপাতা নিষিদ্ধ হওয়ার কারনেই অনেক দেবতার পুজোতে তুলসী পাতা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। প্রশ্ন আসতে পারে, গণেশের পুজোয় তুলসী পাতা নিষিদ্ধ হল কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে পৌরাণিক যুগে। জানতে হবে গণেশ দেবের প্রতি তুলসী দেবীর একতরফা প্রেমের কাহিনী যা পরিণতি পেয়েছিল অভিশাপ এবং পাল্টা অভিশাপে। এবং বলাই বাহুল্য, সেই অভিশাপ ভোগ করতে হয়েছিল তাঁদের দুজনকেই। তো চলুন দর্শক আমরাও জেনে আসি, গণেশ ও তুলসীর প্রেম ও বিবাদের কাহিনীটি। আশা করি এ আয়োজনে আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকবেন এবং কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জয় গনেশ এবং জয় তুলসী মহারানী লিখে কমেন্ট করবেন।

 

তুলসী দেবী ও বিঘ্নহর্তা গণেশের বিবাদ নিয়ে যে কাহিনীটি প্রচলিত, তা মূলত বর্ণিত হয়েছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে। একসময় দক্ষসাবর্ণি নামক মনুর বংশোদ্ভুত রাজা ধর্মধ্বজ কুলানন্দকারিনী কন্যা প্রার্থনা করে দীর্ঘকাল ধরে তপস্যা করেছিলেন। তার তপস্যার ফল হিসেবে তিনি লাভ করেছিলেন মনোহরা এক পদ্মিনী কন্যা। সেই চম্পকবর্ণা, সুকেশী, মনোহরা, অপূর্ব সুন্দরীকন্যাকে দর্শন করে নরনারীগণ তাঁর তুলনা দিতে অক্ষম হয়েছিলেন বলে পুরাবিদ পন্ডিতগণ তাঁকে ‘তুলসী’ নামে অভিহিত করেন। ধীরে ধীরে পিতৃগৃহে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন তুলসী। এক পর্যায়ে নবযৌবনা এক অপরূপ সুন্দরীতে পরিনত হলেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  হাজার বছর ধরে জাপানে পূজিত হচ্ছেন হিন্দু দেবতারা || Japanese Versions of Hindu Gods ||

অন্যদিকে, পার্বতীপুত্র গণেশ তখন পালন করছেন কঠিন ব্রহ্মচর্য। তাই পবিত্র গঙ্গার তীরে নিয়মিতভাবে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন তিনি। কোন একদিন গণেশ যথারীতি গঙ্গাতটে বসে একমনে ধ্যান করছিলেন। আর তার সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন তুলসী মহারানী। স্বাভাবিকভাবেই সদ্যযৌবনা তুলসীর দৃষ্টিপাত হল শ্রীমান গণেশের দিকে। সর্বাঙ্গে চন্দনের সুগন্ধ মাখা সুঠাম-সুপুরুষ গণেশ দেব একমনে বসে ধ্যানে লীন। দেবগণ এমনিতেই সুদর্শন ও সুপুরুষ, তাই গণেশও তার ব্যাতিক্রম নন। তাঁর দেদীপ্যমান শরীরের দিকে যতই দেখেন ততই তুলসী দেবী আকৃষ্ট হতে থাকেন গজাননের প্রতি। কিন্তু তাঁর সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, দৃষ্টি বিনিময়ও আপাতত সম্ভব নয়। কারন তিনি এখন গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। চঞ্চলা তুলসী তাই সিদ্ধান্ত নিলেন পার্বতী নন্দনের ধ্যান ভঙ্গ করার। তাছাড়া তুলসী দেবীর মত অপরূপ রূপলাবন্যবতী কোন নারীকে ধ্যান ভঙ্গ করতে দেখলে আর যাই হোক ক্ষিপ্ত হবেন না গণেশ দেব। এতসব ভাবতে ভাবতে গণেশদেবের স্তুতি করে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করলেন তুলসী দেবী। তুলসীর স্তুতিতে ধ্যান ভঙ্গ করে গণেশ দেবও তুলসীকে আশির্বাদ করলেন। কিন্তু এর পরেই ঘটে গেল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। তুলসী দেবী শ্রীগণেশের সেই দিব্য সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাকে প্রণয় নিবেদন করে বসলেন। ইচ্ছা ব্যাক্ত করলেন গণেশ দেবের সাথে পরিনয় সূত্রে গ্রথিত হয়ে তাঁর পত্নী হিসেবে মর্যাদা পেতে।

স্থির মস্তিস্কসম্পন্ন গণেশ দেব এতক্ষণে খুব ধৈর্যের সাথে শুনছিলেন তুলসী মহারানীর কথা। একে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করা তাঁর উপরে তাঁর ব্রহ্মচর্য পালনের মধ্যে বিবাহের প্রস্তাব। অন্য কোন দেবতা হলে হয়ত সরাসরি অভিশাপ দিয়েই বসতেন তুলসীকে। কিন্তু তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ স্মিত হাসি হেসে বললেন, “হে দেবী, আমি ব্রহ্মচর্য পালন করছি। তাই আমার পক্ষে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। প্রণয় নিবেদন এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আপনার মানসিক স্থিতি আমি অনুমান করতে পারছি, তবুও আমি ব্রহ্মচর্য ভঙ্গ করে আপনাকে বিবাহ করতে পারব না। আশা করি আমার এই বিনীত প্রত্যাখ্যান আপনাকে আঘাত করবে না। ” শ্রীগণেশের এমন বিনম্র প্রত্যাখ্যানের পরেও তুলসী বার বার তাঁর প্রণয় স্বীকার করার জন্য শ্রীগণেশকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।  কিন্তু বরাবরের মত গণেশ তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তিনি কিছুতেই তাঁর ব্রহ্মচর্য ভাঙবেন না বলে জানিয়ে দিলেন তুলসীকে।

আরও পড়ুনঃ  মহর্ষি দধিচীর প্রকৃত পরিচয় ও আত্মত্যাগের কাহিনী || বজ্রসম কঠিন অস্থি যার || Mahrshi Dadhichi Story||

এক পর্যায়ে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হলেন তুলসী দেবী। তাঁর মত চম্পকবর্ণা, সুকেশী, মনোহরা, অপূর্ব সুন্দরীকন্যাকে যে কেউ এত কঠিনভাবে প্রত্যাখান করতে পারে তা ছিল তাঁর কল্পনারও অতীত। তাই ক্ষোভে ও অপমানে গণেশ দেবকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন তিনি। বললেন, “ হে পার্বতী নন্দন, নিজের দেবত্ব, সৌন্দর্য ও ব্রহ্মচর্যের মোহে আজ আপনি আমাকে অপমান করলেন, কিন্তু আমি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি, একদিন আপনার এই ব্রহ্মচর্যের অহংকার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আপনি অবশ্যই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন এবং একটি নয় একাধিক পত্নীর স্বামী হবেন আপনি। ” এবার স্থিরমস্তিসস্কসম্পন্ন গণেশ দেবেরও ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। বিনা অপরাধে তুলসী দেবী কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে পাল্টা অভিশাপ দিলেন তিনিও। তিনি তুলসী দেবীকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, “ হে তুলসী দেবী, নিজের রূপ এবং সৌন্দর্যের অহংকারে বশীভূত হয়ে আপনি আমাকে অভিশম্পাত করেছেন। তাই আমিও আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি, আপনার এই অতুলনীয় রূপ লাবন্য ও যৌবন মনুষ্যভোগ্য হবে না। আপনার বিবাহ হবে অসুরের সাথে। ”

এবার সম্বিত ফিরল দেবী তুলসীর। ক্রোধের বসে গণেশ দেবকে অভিশাপ দিয়ে এবং গণেশ দেব কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে অনুতাপ করতে লাগলেন তিনি। এরপর গণেশ দেবের কাছে রোদন করে বললেন, “ হে পার্বতী নন্দন, আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আপনাকে অভিশাপ দেওয়ার মত হীন কাজ করে বসেছি। আমি অনুতপ্ত, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। হে সিদ্ধিদাতা, আপনি দয়া করে আপনার অভিশাপ ফিরিয়ে নিন। ” তুলসী দেবীর এরকম ক্রমাগত রোদন শুনে শ্রীগণেশও কিছুটা নমনীয় হলেন। এরপর তুলসী দেবীকে উদেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন, “হে দেবী, আমার অভিশাপ কখনোই নিষ্ফল হওয়ার নয়। তবে আপনার অনুতাপের ফলে এই অভিশাপ আশির্বাদে পরিনত হবে। এ জন্মে আপনাকে অসুর পত্নী হিসেবে জীবন ধারন করতে হলেও আগামী জন্মে আপনি পরিনত হবেন এক পবিত্র উদ্ভিদে। প্রত্যেক গৃহের সম্মুখে থাকবে সেই উদ্ভিদ, তাঁর পাতা থেকে অজস্র রকমের শারীরিক ব্যামো থেকে মুক্তি মিলবে সাধারন মানুষের। তাছাড়া শ্রীবিষ্ণুর পদপাদ্মে ঠাই হবে সেই বৃক্ষপত্রিকার এবং বৈষ্ণবগণের কণ্ঠেও শোভা পাবে এই বৃক্ষের কাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত মালা। কিন্তু আমার পুজোতে সর্বদাই নিষিদ্ধ থাকবে তুলসী বৃক্ষ তথা তুলসী পাতা। ”

আরও পড়ুনঃ  দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের ফুলশয্যা ও দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল? Family Life of Draupadi and Pandavas

 

তুলসী দেবী ও গণেশ দেবের প্রণয় সংক্রান্ত বিবাদের সমাপ্তি এখানেই। তবে তাঁরা একে অপরকে যে অভিশাপ দিয়েছিলেন তা ভোগ করতে হয়েছিল তাঁদের দুজনকেই। পরবর্তীকালে গণেশেকে ভঙ্গ করতে হয়েছিল তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত ব্রহ্মচর্য। তাঁর বিবাহ হয়েছিল সিদ্ধি ও বুদ্ধির সাথে বা মতান্তরে সিদ্ধি ও রিদ্ধির সাথে। অপরদিকে তুলসী দেবীর বিবাহ হয়েছিল শঙ্খচূড় নামক এক অসুরের সাথে। তাছাড়া তুলসী বৃক্ষের কথা তো আপনারা সকলেই জানেন। আজও শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের পুজোতে তুলসী পত্র বাধ্যতামূলক ভাবে অর্পণ করতে হয়। তবে আমাদের ধর্মের বহু দেব দেবীর পুজো যেহেতু গণেশ পুজো দিয়ে শুরু হয়, তাই গণেশ পুজোর পাশাপাশি বহু দেবদেবীর পুজোতে কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গেল তুলসী পত্র।

5/5 - (1 vote)

Leave a Comment

error: Content is protected !!