ধন তেরাস বা ধন ত্রয়োদশী মূলত অবাঙালীদের উৎসব। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে বাঙালীদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই উৎসবের আয়োজন। মূলত কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে উত্তর ভারতে ব্যপকভাবে পালিত হয় এই উৎসব। এদিন লক্ষ্মীদেবীর কৃপালাভের জন্য মূল্যবান ধাতু বা ধনরত্ন ক্রয় করা, লক্ষ্মীদেবী, গণেশদেব ও কুবেরের পূজা করা, সারা রাত্র ব্যাপী প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা, দরিদ্রদেরকে দান করা, বাসগৃহ সুচারুরূপে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা ইত্যাদি রকমের আচার পালন করে থাকেন মানুষ। সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজনে আপনাদের জন্য রইল ধন ত্রয়োদশীর ইতিহাস তথা দুটি পৌরাণিক কাহিনী।
ধন তেরাসের ১ম কাহিনীঃ হিমা রাজার অভিশপ্ত পুত্র
পুরাকালে হিমা রাজার ১৬ বছর বয়সী পুত্র এক কঠিন অভিশাপে অভিশপ্ত হয়েছিলেন। তার জন্মকুণ্ডলী বিচার করে দেখা যায় রাজকুমারের বিবাহের চার দিনের মাথায় তার অপঘাতে মৃত্যু হবে। ফলে রাজপুত্রের এমন সংক্ষিপ্ত জীবনের কথা শুনে কোন পিতাই তার কন্যাকে সেই রাজকুমারের সাথে বিবাহ দিতে চাননি। অবশেষে এক রাজকুমারী স্বেচ্ছায় এবং রাজকুমারের জন্মকুণ্ডলীতে উল্লেখিত অভিশাপ সম্পর্কে জেনেও রাজকুমারকে বিবাহ করতে রাজি হলেন। বিবাহের তিনদিন পরে এল সেই অভিশপ্ত রাত। কিন্তু সদ্যবিবাহিতা রাজকুমারীর মনে নেই কোন দুশ্চিন্তার ছাপ। রাত নামতেই তিনি বাড়ির সকল সোনা-রূপার গহনা ও মুদ্রা একত্রিত করে বোঝাই করে রাখলেন তাদের শোবার ঘরের সামনে। সেই সাথে তিনি সমস্ত রাজপ্রাসাদের প্রত্যেক কোনে কোনে মাটির প্রদীপ জ্বেলে আলোকিত করে তুললেন। ফলে সমস্ত রাজবাড়ি আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এবং এসকল কর্ম সমাপ্ত করার পর তিনি তার স্বামীর সাথে শোবার ঘরে জেগে বসে রইলেন সারা রাত। সেইসাথে স্বামীকে জাগিয়ে রাখার জন্য তিনি তার সাথে মেতে থাকলেন গান ও গল্প দিয়ে। রাজকুমারও তার স্ত্রীর গান ও গল্প উপভোগ করতে করতে জেগে রইলেন সারা রাত।
এদিকে জন্মকুণ্ডলীর ভবিতব্য অনুযায়ী যমরাজ এলেন রাজকুমারের প্রাণ হরণ করতে। কিন্তু রাজকুমারের শোবার ঘরে প্রবেশ করার সময় চারিদিক থেকে আগত আলোর ঝলকানি ও বোঝাই করা সোনা-রূপার গহনা ও মুদ্রায় সেই আলোর প্রতিবিম্বে চোখ ধাধিয়ে গেল যমরাজের। তিনি হয়ে পড়লেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাই শোবার ঘরে প্রবেশ করে রাজকুমারের প্রাণ হরণ করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে যমরাজ সেই সোনা-রূপার স্তূপের উপরে বসে রাজকুমার ও তার স্ত্রীর গান-গল্প উপভোগ করতে লাগলেন। আর এভাবেই একসময় পেরিয়ে যায় রাত, অতিবাহিত হয় রাজকুমারের বিবাহের চতুর্থ দিন। ফলে প্রভাতে নিজের কর্ম না সম্পূর্ণ করেই যমালয়ে ফিরে যান যমরাজ। এই রাতটি ছিল কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর রাত। আর সেদিন থেকেই প্রতিবছর এই তিথিতে পালিত হয় ধন ত্রয়োদশী বা ধন তেরাস।
ধন ত্রয়োদশীর ২য় কাহিনীঃ ধন্বন্তরির আবির্ভাব তিথি
ধন ত্রয়োদশীর ২য় কাহিনীটি প্রথম কাহিনী থেকে একেবারেই আলাদা। এবং এই কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে সমুদ্র মন্থনের অনুষঙ্গ। আপনারা জানেন ক্ষীরোদ সাগর থেকে অমৃত কলস প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে দেবতা ও অসুরগণ মিলে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। সমুদ্র মন্থন থেকে উঠে এসেছিল ১৪ প্রকার রত্ন, দেবী শ্রীলক্ষ্মী, চন্দ্রদেব, অসংখ্য অপ্সরাগণ, হলাহল বিষ, কামধেনুসহ অসংখ্য বস্তু। এবং সমুদ্র মন্থনের এক পর্যায়ে সমুদ্র থেকে উত্থিত হন দেববৈদ্য ধন্বন্তরি। কোন কোন মতে তিনি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর একটি রূপ বা অবতার। ধন্বন্তরি তার চার হাতে ধারন করেছিলেন অমৃত কলস, শঙ্খ, চক্র ও আয়ুর্বেদিক জড়িবুটি। সুতারাং, ধন ত্রয়োদশীর এই তিথিতে পূজা করা হয় আয়ুর্বেদের দেবতা ধন্বন্তরীকে।
তাই ধন ত্রয়োদশীর এই তিথিতে একাধারে ধনরত্ন ক্রয় করে সৌভাগ্যের প্রত্যাশা করা হয়, ধন্বন্তরির পূজা করে সুস্বাস্থ্য কামনা করা হয়, আবার লক্ষ্মী, গণেশ ও কুবের দেবের পূজা করে কামনা করা হয় ধন-সম্পদ, সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও সাফল্য।