You are currently viewing রহস্যময় কোণার্ক সূর্য মন্দিরের ইতিহাস || History of Mysterious Konark Surya Mandir ||

রহস্যময় কোণার্ক সূর্য মন্দিরের ইতিহাস || History of Mysterious Konark Surya Mandir ||

কোণার্ক সূর্য মন্দির। যার গর্ভে লুকিয়ে আছে গা শিউরে ওঠার মত রহস্যের মায়াজাল। পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার এবং ভূবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটি আজও সমস্ত বিশ্ববাসীর নিকট এক বিষ্ময়। এই মন্দিরের নানা আশ্চর্যজনক কাহিনী আজও প্রচলিত রয়েছে মানুষের মুখে। শোনা যায়, এ মন্দিরের চুড়ায় স্থাপন করা ছিল ৫২ টন ওজনের একটি বিশাল চম্বুক। কিন্তু সেই চম্বুক আজ আর দেখা যায় না কেন? কেন এ মন্দিরে কোন দেবতার বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় না? কেনই বা এখানে কোন দেবতার পূজা করা হয় না? এ মন্দিরে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ বা রাত্রিযাপন করা সম্ভব নয় কেন? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে স্বয়ং সূর্যদেব, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব, রাজা প্রথম নরসিংহদেব এবং ধর্মদাস নামক এক ১২ বছরের বালকের নাম। তাহলে চলুন দর্শক আমরাও জেনে নিই এ মন্দিরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ও রহস্যে ঘেরা পৌরাণিক ইতিহাস। তবে শুরু করার আগে আপনাদের কাছে অনুরোধ, সনাতন ধর্মের ইতিহাস ঐতিহ্য ও শাস্ত্রভিত্তিক এরকম কন্টেন্ট নির্মানে আমাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য ভিডিওতে একটি লাইক দিয়ে কমেন্টে একবার শ্রী সূর্যনারায়ণের নাম লিখে যাবেন।

ইতিহাস বলছে কোনার্কের সূর্যমন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ১২৫৫ খ্রীষ্টাব্দে। পূর্বগঙ্গ রাজবংশের রাজা প্রথম নরসিংহদেব বাংলা জয়ের স্মারকরূপে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে প্রাচীন মিত্রবনে এই সূর্যমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। গোটা মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে ভগবান শ্রী সূর্যনারায়ণের রথের আকারে। উল্লেখ্য কোণার্ক নামটি গঠিত হয়েছে কোন এবং অর্ক শব্দের সংমিশ্রণে। আপনারা জানেন অর্ক শব্দের অর্থ হচ্ছে সূর্য। আর তাই সূর্যের বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানকে নির্দেশ করে এই মন্দিরটি নির্মান করা হয়েছে বিধায় এর নামকরণ করা হয়েছিল কোণার্ক সূর্য মন্দির। এবং যেহেতু এটিকে সূর্যদেবের রথের আকারে নির্মাণ করা হয়েছে তাই সূর্যদেবের রথের মত এ মন্দিরেও রয়েছে ১২ জোড়া চাকা এবং সাতটি ঘোড়া। এই ১২ জোড়া বা ২৪ টি চাকা বছরের ২৪টি পক্ষকে নির্দেশ করে। এছাড়াও এর প্রত্যেকটি চাকায় রয়েছে ঘড়ির কাটার মত আটটি করে দণ্ড। এই আটটি দণ্ড দিনের এক একটি প্রহর বা মোট অষ্টপ্রহরকে নির্দেশ করে। তাছাড়া এ মন্দিরের ৭টি ঘোড়া সপ্তাহের সাতটি দিনকে নির্দেশ করে।

আরও পড়ুনঃ  মহাপ্রসাদ কিভাবে এলো পৃথিবীতে?

তবে পুরাণ বলছে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুত্র সাম্ব। একদা নারদের প্ররোচনায় পিতা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক জরাগ্রস্থ হওয়ার অভিশাপ প্রাপ্ত হন সাম্ব। এরপর সমুদ্র পাড়ে বসে সূর্যদেবের কঠোর তপস্যা করে তাঁর হারানো রূপ ফিরে পেয়েছিলেন সাম্ব। আর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি সমুদ্র তীরে নির্মান করেছিলেন এই কোণার্ক সূর্য মন্দির। পুরাণে বর্ণিত এই কাহিনী অনুসারে ধারণা করা হয় যে শ্রীকৃষ্ণ পুত্র সাম্বের নির্মিত সেই কোণার্ক সূর্যমন্দিরটি সংস্কার বা পুনঃনির্মান করেছিলেন রাজা নরসিংহদেব।

এখন প্রশ্ন হল এত যত্নে নির্মিত মন্দিরের এই বেহাল দশা হল কিভাবে? প্রথমেই আসা যাক মন্দিরের চুড়ায় প্রতিষ্ঠিত ৫২ টন ওজনের চম্বুকটির কথায়। বলা হয় কোণার্ক মন্দিরটির অবস্থান সমুদ্রের প্বার্শবর্তী এলাকায় হওয়ায় এ মন্দিরের চম্বুকটি সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোর কম্পাসগুলোকে বিকল করে দিত। এজন্য সমুদ্রপথে চলাচলকারী নাবিকেরা কোণার্ক মন্দিরের নাম দিয়েছিলেন ব্ল্যাক প্যাগোডা এবং পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের নাম দিয়েছিলেন হোয়াইট প্যাগোডা। চম্বুকের প্রভাবে জাহাজের কম্পাস বিকল হয়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ নাবিক ও পর্তূগীজ জলদস্যুরা দিগভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে চলে যেতেন এবং প্রায়শই দুর্ঘটনায় পতিত হতেন। ফলে পর্তুগীজ জলদস্যুদের দস্যুবৃত্তি করতে অসুবিধা হওয়ার জন্য তাঁরা কোণার্ক মন্দিরের সেই অতি শক্তিশালি চুম্বকটিকে নষ্ট করে দেন। তবে অন্য একটি মতে, ইংরেজদের শাসনামলে বৃটিশ সরকার এই চম্বুকটি লোকচক্ষুর অন্তরালে স্থানান্তর করে ইংল্যান্ডে নিয়ে চলে যায়।

তাছাড়া কোণার্ক মন্দিরের আজকের এই বেহাল দশার পিছনে আরও একটি কারন হচ্ছে, মন্দিরটি তাঁর সৃষ্টিলগ্নের পর থেকেই দেশী-বিদেশী শত্রুশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বহুবার। তাঁর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় মন্দিরের অনেক অংশ। তাই ১৬২৬ সালে রাজা ২য় নরসিংহদেব এমন্দিরের সূর্যদেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যান। সেখানে একটি পৃথক মন্দিরে সূর্য ও চন্দ্রদেবতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। শুধু বিগ্রহই নয় তিনি কোণার্ক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথরও পুরীর মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি নবগ্রহ পথ নামের একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডও তিনি পুরীতে নিয়ে স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে মারাঠা শাসনামলে কোণার্ক মন্দির থেকে আরও অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখণ্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সর্বশেষ ১৭৭৯ সালে কোণার্ক থেকে অরুণ কুম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয়। এই সময় মারাঠা প্রশাসন কোনার্কের নাট মন্ডপটি অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে।

আরও পড়ুনঃ  অঘোরী কে? কি তাদের উদ্যেশ্য? অঘোরী সম্পর্কে সমস্ত ভুল ধারনার জবাব

আর এভাবেই ১৮ শতকের আগেই কোণার্ক মন্দির তার সকল অতীত গৌরব হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। মন্দিরের অনেক অংশ চাপা পড়ে যায় বালির নিচে। ঘন অরণ্যে ছেয়ে যায় মন্দির চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা। ধীরে ধীরে বুনো জন্তুরা বাসা বাঁধে মন্দিরের ভিতরে। তাছাড়া জলদস্যু ও ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয় নয়নাভিরাম কোণার্ক মন্দির। সেসময় দিনের আলোতেও সাধারণ মানুষ ভয়ে এর ত্রিসীমানায় যেত না। এরপর ৩০০ বছর ধরে বালিরস্তূপের নিচে অনাদর ও অবহেলায় পড়ে থাকা এই সূর্য মন্দিরটিকে ১৯০৪ সালে উদ্ধার করেন বড়লাট লর্ড কার্জন ৷ তবে ততদিনে কোণার্ক মন্দির চত্ত্বরের মূল সূর্য মন্দিরটি অবলুপ্ত হয়। আজকে এখানে যে মন্দিরটি দৃশ্যমান সেটা আসলে নাট মন্দির, মূল মন্দির নয়৷

এবার আসি এ মন্দিরের রাত্রিবেলার ঘটনায়। স্থানীয় উপকথা থেকে জানা যায়, এ মন্দির নির্মানের সময় এক অদ্ভূত শর্ত দিয়েছিলেন রাজা প্রথম নরসিংহদেব। তিনি এই সূর্যমন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন ১২০০ জন শ্রমিক। শর্ত ছিল ১২ বছরের মধ্যেই এ মন্দিরের নির্মানকাজ শেষ করতে হবে। এবং এই শ্রমিকের সংখ্যা একজন বেশী বা কম হলে চলবে না এবং ১২ বছরের অধিক এক দিনও অতিরিক্ত সময় নেওয়া যাবে না। যদি সেরকম কিছু ঘটে তাহলে রাজদণ্ডে ১২০০ জন শ্রমিকেরই প্রাণ যাবে। তো এখানে যে ১২০০ জন শ্রমিক মন্দিরের নির্মানকাজ শুরু করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন শ্রমিকের স্ত্রী ছিলেন গর্ভবতী। মন্দিরের নির্মানকাজ শুরু হওয়ার পর পরই তিনি ধর্মদাস নামক এক পুত্র সন্তানের জনক হয়েছিলেন। কিন্তু ধরাবাধা নিয়মের কারনে তিনি তাঁর সন্তানকে দেখতে যেতে পারেন নি। এভাবে কেটে গেল প্রায় ১২ বছর। ততদিনে সেই পুত্রের বয়স প্রায় বারো এবং মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হতে বাকী আর মাত্র ৭ দিন। এসময় পিতাকে খুঁজতে খুঁজতে ধর্মদাস পৌছে গেলেন কোণার্ক মন্দিরের চত্ত্বরে। পিতা-পুত্রের প্রথমবার মিলনে অশ্রুসিক্ত হল তাঁদের নয়ন। তবে পিতার চোখে মুখে পুত্রের সাথে মিলনের আনন্দ ছাপিয়ে যেন ভর করে রয়েছে এক অজানা আতঙ্ক। পিতাকে জিজ্ঞাসা করে ধর্মদাস জানতে পারলেন, মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হতে আর মাত্র ৭ দিন বাকী। কিন্তু গর্ভগৃহের মঙ্গলঘটটি কোনভাবেই স্থাপন করা যাচ্ছে না। বালক ধর্মদাস তাই সাতপাঁচ না ভেবে সেই মঙ্গল ঘট স্থাপনে অন্যান্য শ্রমিকদের সাহায্য করলেন এবং তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্থাপিত হল মঙ্গলঘটখানি। কিন্তু ততক্ষণে আরও একটি অমঙ্গল ঘটে গিয়েছে। আর তা হল ধর্মদাস সহ মোট শ্রমিকের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১২০১ জন। একথা রাজার কানে গেলে সমস্ত শ্রমিকের প্রাণদণ্ড অবধারিত। তাই বালক ধর্মদাস সেই ১২০০ জন শ্রমিককে বাঁচাতে মন্দিরের চুড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহূতি দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  দেবব্রত ভীষ্মঃ অস্টবসুর এক অভিশপ্ত বসুদেবতা || Devavrata Bhishma -The Cursed Vasu of the Asta Vasus

এ ঘটনার পরে অপবিত্র হয়ে যায় মন্দিরটি। ফলে এখানে কখনো কোন পূজা-অর্চনা হয়নি। তবে এখনও নাকি নিশুতি রাতে এ মন্দির থেকে ভেসে আসে এক ভয়াল আর্তচিৎকার। ফলে রাত্রিবেলাতে কেউই প্রবেশ করতে চান না কোণার্কের এই জগদ্বিখ্যাত মন্দিরটিতে।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply