রাম শব্দটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে লক্ষ্মণ শব্দটি। সমগ্র রামায়ণ জুড়ে শ্রীনারায়ণের অবতার রামচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী ছিলেন তাঁর প্রাণের ভাই লক্ষ্মণ। রামায়ণ থেকে জানা যায়, জন্মের পর লক্ষ্মণ অবিরামভাবে কাঁদছিলেন, কোন উপায়েই তাঁর কান্না থামানো যাচ্ছিল না। নানা চেষ্টার পর যখন তাঁকে শ্রীরামের পাশে শোয়ানো হয়, তখন তিনি তাঁর কান্না বন্ধ করেন। সেই থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ভ্রাতা রামের পাশেই থেকে তাঁর সেবা করেছিলেন লক্ষ্মণ। সনাতন শাস্ত্রমতে লক্ষ্মণ ছিলেন শেষ নাগের অবতার। বলাই বাহুল্য, এই শেষনাগের উপরেই ভগবান শ্রীবিষ্ণু সার্বক্ষণিক বিশ্রামে থাকেন। তাই পার্থিব অবতারেও রামরূপী ভগবান বিষ্ণুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন লক্ষ্মণরূপী শেষ নাগ। কিন্তু আপনি জানেন কি শ্রীরামচন্দ্রের জন্য শ্রীলক্ষ্মণ একটানা ১৪ বছর না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলেন? আর এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে রয়েছেন লক্ষণের স্ত্রী উর্মিলা ও নিদ্রাদেবীর নাম। তাছাড়া এই ১৪ বছর না ঘুমানোর বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে রাবণের পুত্র মেঘনাদকে বধের সাথেও। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই চমৎকার কাহিনীটি। তবে শুরু করার আগে কমেন্ট বক্সে একবার জয় সীতা-রাম লিখে কমেন্ট করবেন।
পুত্রহীন রাজা দশরথ যখন একেবারে চার-চারটি পুত্রের জনক হলেন তখন অযোধ্যাপুরী ভেসে গেল আনন্দের বন্যায়। এরপর এই রাজ্যেই চার রাজকুমারের একসাথে বেড়ে ওঠা- শৈশব, কৈশর, যৌবন। এবং মিথিলার রাজা জনক ও তাঁর ভ্রাতার চার কন্যার সাথে একই দিনে বিবাহ হয়েছিল তাঁদের চারজনের। জীবনের এই সময় পর্যন্ত এই চার দশরথ নন্দনের জীবন কাটছিল সমানভাবে। কিন্তু সমস্যা শুরু হল জ্যেষ্ঠ্য পুত্র শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক হওয়ার সময়। বিমাতা কৈকেয়ী তাঁর দাসী মন্থরার পরামর্শে রাজা দশরথের কাছে তাঁর পূর্বের পাওনা দুটি বর দাবী করে বসলেন। সেই বরে রামচন্দ্রকে রাজ্য ছেড়ে যেতে হল বনবাসে। সঙ্গে চললেন মাতা সীতা এবং প্রাণের ভাই লক্ষ্মণ। নিজের বনবাসের কষ্টের জীবনে কোনভাবেই প্রিয় ছায়াসঙ্গী ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও দেবী সীতাকে নিয়ে যেতে চাননি মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র। কিন্তু দেবী সীতা তাঁর পতিব্রত পালনের অধিকারে এবং ভাই লক্ষ্মণ তাঁর ভ্রাতার সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শ্রীরামের সাথে বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। রামায়ণের এ পর্যন্ত আমাদের সবারই কমবেশী জানা। কিন্তু লক্ষ্মণ তাঁর দাদার সাথে বনবাসে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী উর্মিলার কি হয়েছিল? সেটা নিয়েই আজকের কাহিনী।
রামচন্দ্র, মাতা সীতা ও শ্রীলক্ষ্মণ বনবাসে যাওয়ার আগে একে একে বিদায় নিতে লাগলেন সকলের কাছ থেকে। এসময় লক্ষ্মণ এলেন দেবী উর্মিলার কাছে। কিন্তু দেবী সীতার মত দেবী উর্মিলাও প্রস্তুত হয়ে আছেন বনবাসে যাওয়ার জন্য। তিনি বললেন, “হে আর্য, যদি সীতা দিদির তাঁর স্বামী সেবা করার জন্য বা পতিব্রত পালনের জন্য বনগমনের অধিকার থাকে তাহলে আমার কেন স্বামীর সেবা-শুশ্রূষা করার বা স্বামীর সমব্যাথী হওয়ার অধিকার নেই?” দেবী উর্মিলার এমন মহান হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে আনন্দিত হলেন লক্ষ্মণ। কিন্তু সেই সাথে তাঁর করা প্রশ্নেরও তেমন কোন উত্তর ছিল না শ্রীলক্ষণের কাছে। তা-সত্বেও তিনি উর্মিলাকে বাস্তবতা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, “হে উর্মিলা, তোমার মহান হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে আমি সত্যিই গর্বিত। কিন্তু হে প্রিয়ে, আমি আমার জন্মের সাথে সাথে আমার এই জীবন ভ্রাতা শ্রীরামচন্দ্রকে উৎসর্গ করেছি। ভ্রাতা রামের সুরক্ষা প্রদান করা এবং তাঁর পথ চলাকে মসৃন রাখাই আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। স্ত্রী হিসেবেও তোমার প্রতি যে আমার কর্তব্য রয়েছে তা আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু তোমাকে বনবাসে নিয়ে গেলে আমি আমার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বো। ভ্রাতা রাম ও মাতা সীতার প্রতি আমার যে কর্তব্য তা সঠিকভাবে পালন করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। ”
দেবী উর্মিলা তাঁর স্বামীর উভয় সংকটের কথা গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করলেন। এরপর প্রশ্ন করলেন, “তাহলে হে স্বামী, আমি আমার জীবন কিভাবে কাটাবো ?” উত্তরে লক্ষ্মণ বললেন, “হে প্রিয়তমা, আমি যেমন ভ্রাতার প্রতি দায়ীত্ববোধ থেকে বনবাসে যাচ্ছি, তেমনি আমার পিতা-মাতাদের প্রতিও আমার দায়ীত্ব-কর্তব্য রয়েছে। আমার ইচ্ছা, তুমি তাঁদেরকে আমার পক্ষ থেকে সঠিকভাবে সেবা-যত্ন করো। ” পতিব্রতা উর্মিলা দেবী স্বামীর আদেশ মেনে নিয়ে বিদায় দিলেন স্বামী লক্ষ্মণকে আর সেই সাথে বিসর্জন দিলেন ১৪ বছরের স্বামী ভালোবাসা। এরপর রাজসুখ বিসর্জন দিয়ে তিন বনবাসী এসে পৌছালেন বনে। দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত তাঁরা সবাই। এসময় রাম-সীতা ঘুমিয়ে পড়লেও জেগে রইলেন লক্ষ্মণ। রাম-সীতার কুটিরের আশেপাশে পায়চারী করে কাটাতে লাগলেন রাত। এসময় আকাশপথে যাচ্ছিলেন নিদ্রাদেবী। তিনি খেয়াল করলেন, সমস্ত পৃথিবী যখন নিদ্রামগ্ন, তখন গহীন বনে কেউ যেন না ঘুমিয়ে পায়চারী করছেন। কাছে এসে দেখলেন, দশরথ নন্দন লক্ষ্মণ রাম-সীতাকে কুটিরে রেখে রাত্রি জাগরণ করে তাঁদেরকে পাহারা দিচ্ছেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, “হে দশরথ নন্দন, তুমি কেন রাত্রি জাগরণ করছো?”
লক্ষ্মণ নিদ্রাদেবীকে বললেন, “হে দেবী, আমার প্রাণপ্রিয় দাদা শ্রীরামচন্দ্র এবং মাতা সীতা ওই পর্ণোকুটিরে ঘুমাচ্ছেন, তাই আমি তাঁদের পাহারা দিচ্ছি।” নিদ্রাদেবী বললেন, “কিন্তু হে লক্ষ্মণ, তোমরা তিনজনই ক্লান্ত, তোমারওতো ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে।” লক্ষ্মণ বললেন, “না দেবী, আমাদের বনবাসের সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাতে পারবো না।” নিদ্রাদেবী বললেন, “কিন্তু হে লক্ষ্মণ, নিদ্রা আমাদের সকলের জন্যই অতি প্রয়োজনীয়। আমাদের শরীরের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে নতুন করে কর্মক্ষমতা সৃষ্টি করতে ঘুমের তো কোন বিকল্প নেই। এভাবে না ঘুমালে তোমার শরীরের কার্যক্ষমতা কমতে থাকবে এবং শরীর ভেঙে পড়বে। ” নিদ্রাদেবীর কথা যৌক্তিক হলেও লক্ষ্মণ নাছোড়বান্দা। তিনি যেভাবেই হোক তাঁর ভ্রাতার সুরক্ষার জন্য জেগে থাকবেন। তাঁর ভ্রাতার প্রতি এমন সুগভীর প্রেম দেখে প্রসন্ন হলেন নিদ্রাদেবী। তিনি বললেন, “হে লক্ষ্মণ, ভ্রাতার প্রতি তোমার এই ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু পৃথিবীর নিয়ম লঙ্ঘন করাটাও তো উচিত নয়। তবে কেউ যদি তোমার হয়ে ১৪ বছর ঘুমিয়ে থাকতে পারে, তাহলে আমি তোমার চোখ থেকে ১৪ বছরের জন্য নিদ্রা হরণ করতে প্রস্তুত আছি।”
এবার লক্ষ্মণ বললেন, “হে দেবী, আমার স্ত্রী উর্মিলা অত্যন্ত পতিব্রতা। আমি আশা করি সে আমার জন্য এই ১৪ বছরের ঘুম স্বীকার করবে।” লক্ষণের কথা শুনে নিদ্রাদেবী গেলেন উর্মিলার কাছে। খুলে বললেন লক্ষণের অনুরোধ। সব শুনে একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন উর্মিলা। নিজের এবং স্বামীর ঘুম মিলিয়ে জীবনের ১৪ বছর কাটিয়ে দিলেন ঘুমের রাজ্যে। রামায়ণে প্রধান চরিত্রগুলো যেমন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ বা হনুমান তাঁদের কৃতকর্মের জন্য সর্বক্ষেত্রে প্রশংসিত হলেও বরাবরই আড়ালে থেকে যায় এই মহিয়সী নারীর আত্মত্যাগ। তাঁর এই ১৪ বছরের ঘুম যে শুধু মাত্র লক্ষ্মণকে ১৪ বছরের জন্য জেগে থাকতে সাহায্য করেছে তা নয়। মেঘনাদ বধের জন্যও তাঁর রয়েছে বিশাল অবদান। রামায়ণ থেকে জানা যায়, রাক্ষসপতি রাবণের পুত্র মেঘনাদ ছিলেন অজেয়। কারন তিনি বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, যে ব্যাক্তি ১৪ বছর যাবত ঘুমাননি শুধুমাত্র সেই ব্যাক্তিই তাঁকে বধ করতে পারবেন। স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষই না ঘুমিয়ে বেশীদিন বাচতে পারে না। তাই অনেকটা অমরত্বের সমান বরের অধিকারী ছিলেন মেঘনাদ। কিন্তু লক্ষনের ১৪ বছরের ঘুম উর্মিলা নিজের নেত্রে নিয়েছিলেন বিধায় লক্ষ্মণ ১৪ বছর জেগে থেকে অপ্রতিরোধ্য মেঘনাদকে বধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।