মহাকাব্য মহাভারত যেন এক অনন্ত রহস্যের খনি। কাহিনি-বিন্যাসের জটিলতায় এবং ততোধিক জটিল চরিত্র চিত্রায়ণে বেদব্যাস রচিত এই মহাকাব্য মানুষকে বিষ্মিত করেছে যুগে যুগে। আর মহাভারতের বিবিধ বিস্ময়ের মধ্যে অন্যতম হল এই মহাকাব্যে বর্ণিত বেশ কিছু চরিত্রের জন্মবৃত্তান্ত। আপনারা জানেন পুরুষের ঔরসে এবং নারীর গর্ভে জাত হলেই তাকে বলা হয় স্বাভাবিক জন্ম। কিন্তু মহাভারতে বার বার দেখা গিয়েছে যে, বেশ কিছু ব্যাক্তির জন্ম স্বাভাবিক উপায়ে হয়নি। তাঁদের কেউ জন্ম নিয়েছেন মাটির কলসি থেকে, কেউবা মাছের উদর থেকে কেউবা মাংসপিণ্ড থেকে আবার কেউ কেউ অন্যান্য বিভিন্ন উপায়ে। তো চলুন দর্শক আমরাও জেনে নিই আশ্চর্য ও অস্বভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া মহাভারতের সেই চরিত্রগুলোর জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে।
১. মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস
মহাভারতের সব থেকে জটিল এবং রহস্যময় চরিত্র হচ্ছে তার রচয়িতা স্বয়ং ব্যাসদেব। তিনি নিজে মহাভারত লিখছেন, আবার তিনিই মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র। তিনি না থাকলে মহাভারত যেমন লিখিত হত না, তেমনি মহাভারতের মূল চরিত্রদের জন্মের পিছনেও তার ছিল সক্রিয় ভূমিকা। তো মহর্ষি ব্যাসদেবের পিতা ছিলেন পরাশর মুনি এবং মাতা ছিলেন ধীবরকন্যা সত্যবতী। কোন এক সময় পরাশর মুনি যমুনা নদী পার হওয়ার উদ্দেশে নৌকায় ওঠেন। সেই নৌকার মাঝি ছিলেন ধীবরকন্যা সত্যবতী। নৌকার অভ্যন্তরে অতীব রূপবতী সত্যবতী ও পরাশর মুনি একে অপরকে দেখে আকৃষ্ট হলেন। এরপর পরাশর মুনি সত্যবতীকে মিলন উদ্দেশ্যে আহবান করলেন। তবে তিনি সত্যবতীকে বর দিয়েছিলেন যে, পরাশরের সাথে সঙ্গমের পরেও সত্যবতী কুমারীই থাকবেন এবং তাঁদের মিলন যাতে অন্য কেউ না দেখতে পারে সেজন্য ঘন কুয়াশারও সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এর ফলে পরাশর মুনির ঔরসে গর্ভবতী হন সত্যবতী। এবং এর কিছুকাল পরে একটি দ্বীপে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন সত্যবতী। পুত্রটির গায়ের রঙ কালো তাই তার নাম হয়েছিল কৃষ্ণ এবং দ্বীপের মধ্যে জন্ম হয়েছিল বলে তার নাম হয়েছিল দ্বৈপায়ন। তার মাথায় ছিল কপিল বর্ণের জটা, চোখ ছিল উজ্জ্বল ও মুখে ছিল পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি। পরবর্তীতে তিনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। এরফলে তিনি বেদব্যাস বা ব্যাসদেব নামেও পরিচিত হন। এবং এসকল কারনেই তার সম্পূর্ণ নাম হচ্ছে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস।
২. সত্যবতী
ব্যাসদেবের মাতা সত্যবতী ছিলেন মহাভারতের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। তবে সত্যবতীর জন্মবৃত্তান্ত অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হলেও তার জন্মবৃত্তান্তও কিন্তু কম আশ্চর্যের নয়। প্রাথমিকভাবে মহাভারতে তাকে ধীবরকন্যা বা জেলেকন্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও তিনি আসলে ধীবরকন্যা নন। তাঁর পিতা ছিলেন চেদিরাজ উপরিচর। এক দিন রাজা উপরিচর মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন এক গহীন বনে। সেখানে তিনি তার ঋতুস্নাতা সুন্দরী স্ত্রী গিরিকার স্মরণে কামাবিষ্ট হয়ে পড়েন এবং তাঁর স্খলিত শুক্র তিনি এক শ্যেনপক্ষীর মাধ্যমে গিরিকাকে প্রেরণ করলেন। কিন্তু রাজার শুক্র বহন করে রানী গিরিকার কাছে যাওয়ার সময় শ্যেনপক্ষীটি আরেকটি শ্যেনের আক্রমণের শিকার হয়। ফলে তার বহন করা সেই শুক্র যমুনার জলে পতিত হয়। সেসময় অদ্রিকা নামের এক শাপগ্রস্ত অপ্সরা মৎস্যরূপে যমুনায় বিচরণ করছিলেন। সেই মৎস্যরূপিনী অপ্সরা রাজা উপরিচরের সেই শুক্র নিজে গ্রহণ করেন এবং গর্ভবতী হন। পরবর্তীতে তিনি এক ধীবরের জালে ধরা পড়েন এবং জমজ পুত্র ও কন্যার জন্ম দেন। এরপর সেই ধীবর সদ্যোজাত পুত্রকন্যাকে নিয়ে রাজা উপরিচরের দরবারে উপস্থিত হন। রাজাও বুঝতে পারেন এই পুত্র এবং কন্যা তারই ঔরসজাত। তাই তিনি পুত্রটিকে নিজের কাছে রেখে কন্যাটিকে ধীবরের নিকট দান করেন। পরবর্তীতে সেই পুত্রটি পরিচিত হয় মৎস্যরাজ নামে। এবং ধীবরের গৃহে লালিত পালিত হওয়া কন্যাটির নাম হয়েছিল গন্ধকালী, গন্ধবতী, মৎস্যগন্ধা, যোজনগন্ধা বা সত্যবতী।
৩. ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর
মহারাজ শান্তনুর দুই পুত্র চিত্রঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য যখন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান এবং একমাত্র জীবিত পুত্র দেবব্রত ভীষ্ম আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন কুরু বংশের সামনে এক মহা সংকট উপস্থিত হয়। কারন ভীষ্মের পর বংশরক্ষা করার মত কেউ ছিল না এ বংশে।
এসময় সত্যবতী তখন তাঁর কুমারী অবস্থার সন্তান ব্যাসদেবের কথা বিবেচনা করেন। তিনি ব্যাসদেবকে অনুরোধ করেন বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীর গর্ভে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান স্থাপন করার জন্য। ব্যাসদেব এই প্রস্তাবে রাজি হলে সত্যবতী প্রথমে তাঁকে বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠা পত্নী অম্বিকার কাছে পাঠালেন। অম্বিকা ব্যাসদেবের কৃষ্ণ বর্ণ, আগুনের মতো বহ্নিমান চোখ এবং জটাজুট দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন। এর ফলে ব্যাসদেব অম্বিকার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে সত্যবতীকে জানালেন, অম্বিকার এক মহাবলবান, বিদ্বান ও বুদ্ধিমান পুত্র হবে। কিন্তু যেহেতু ব্যাসদেবকে দেখে অম্বিকা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন, সেহেতু সেই পুত্র হবে জন্মান্ধ। যথাকালে অম্বিকার গর্ভে জন্ম নেন জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু জন্মান্ধ ব্যক্তির পক্ষে রাজ্য পরিচালনা কঠিন হবে ভেবে সত্যবতী এবার বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয়া স্ত্রী অম্বালিকার কক্ষে পাঠালেন ব্যাসদেবকে। কিন্তু অম্বালিকাও ব্যাসেদেবের ভীতিপ্রদ রূপ দেখে পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করেন। এই কারণে তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাসদেব সত্যবতীকে জানিয়েছিলেন, অম্বালিকা তাকে দর্শন করে পাণ্ডুবর্ণ ধারন করার কারনে তার পুত্র পাণ্ডুবর্ণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। তবে ব্যাসদেব এ কথাও জানিয়েছিলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্রের এবং পাণ্ডু মহা গুণবান পঞ্চপুত্রের পিতা হবেন।
তবে অম্বিকা ও অম্বালিকার দুই পুত্র ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় সত্যবতী অম্বিকাকে পুনরায় ব্যাসদেবের কাছে পাঠান। কিন্তু অম্বিকা নিজে না গিয়ে এক রূপবতী দাসীকে পাঠালেন ব্যাসের কাছে। সেই দাসীর পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাসদেব তাঁকে জানান যে, তাঁর গর্ভস্থ পুত্র ধর্মাত্মা এবং পরম বুদ্ধিমান হবে। এবং সেই দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন মহামতি বিদুর।
৪. কর্ণ
মহাভারতের মহাবীর কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত আপনাদের অনেকেরই জানা। তার মাতা কুন্তী ছিলেন রাজা কুন্তীভোজের পালিতা কন্যা। তো কুন্তী যখন কুমারী ছিলেন তখন তার গৃহে দুর্বাসা মুনি একবার অতিথি হয়ে এসেছিলেন। তখন দেবী কুন্তী ঋষি দুর্বাসাকে গভীর ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং সেবা দ্বারা সন্তুষ্ট করেন। আর তাই কুন্তীর সেবায় মুগ্ধ হয়ে দুর্বাসা মুনি তাকে এক অদ্ভুত মন্ত্র বর হিসেবে দান করেছিলেন। এই মন্ত্রের এমন ক্ষমতা ছিল যে, এর প্রভাবে কুন্তী যেকোন দেবতাকে স্মরণ করে সেই দেবতার ঔরসে সন্তান প্রাপ্ত করতে পারবেন। কিন্তু কুমারী কুন্তী তখনও প্রকৃতভাবে এই মন্ত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি।
তাই কৌতূহলবশত তিনি মন্ত্রবলে সূর্যদেবকে আহবান করেন এবং সূর্যদেবের আশীর্বাদে এক পুত্র সন্তানের জননী হয়েছিলেন। তবে এভাবে অলৌকিক প্রক্রিয়ায় এবং এত সহজে পুত্র প্রাপ্তি হবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি কুন্তী। তাই পুত্র প্রাপ্তির পর তিনি অনুধাবন করেন, কুমারী অবস্থায় মাতৃত্ব লাভ করাটা সমাজ কোনভাবে মেনে নেবে না এবং একইসাথে বিষটি লজ্জারও বটে। তাই তিনি সেই সদ্যোজাত সূর্যপুত্রকে একটি পাত্রে রেখে ভাসিয়ে দেন নদীতে। এরপর অধিরথ ও রাধা নামের এক নিঃসন্তান সূত দম্পতি তাকে উদ্ধার করে পুত্রস্নেহে লালন পালন করেন। এবং পরবর্তীতে এই পুত্রটিই মহাবীর এবং দানবীর কর্ণ নামে জগতে খ্যাত হন।
৫. যুধিষ্ঠীর, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব
কর্ণের মত পঞ্চপাণ্ডবের জন্মও স্বাভাবিক উপায়ে হয় নি। আসলে পাণ্ডু নিজে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হওয়ার সত্ত্বেও তিনি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান লাভ করেননি। একদা পাণ্ডু তার দুই স্ত্রী মাদ্রী ও কুন্তীকে নিয়ে হিমালয়ের দক্ষিণে মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। এসময় কিন্দম নামক এক মুনি ও তার স্ত্রী হরিণ ও হরিণীর রূপ ধারণ করে সঙ্গমরত অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু পাণ্ডু এই হরিণ ও হরিণীকে সাধারণ মৃগ ভেবে তাঁদের দিকে তীরবর্ষণ করেন। ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হন মৃগরূপী ঋষি কিন্দম ও তার স্ত্রী। তবে মৃত্যুর আগে তিনি পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়ে যান, যদি কখনো পাণ্ডু স্ত্রীসম্ভোগে রত হন তাহলে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হবে। একারনে পাণ্ডু যখন কুন্তীকে দেওয়া দুর্বাসার বর সম্পর্কে জানতে পারেন তখন তিনি কুন্তীকে ধর্মদেব, বায়ুদেব ও ইন্দ্রদেবকে আহবান করে পুত্রলাভ জন্য অনুরোধ করেন। এরপর কুন্তী ধর্মদেবের আশির্বাদে যুধিষ্ঠির, বায়ুদেবের আশির্বাদে ভীম ও ইন্দ্রদেবের আশির্বাদে অর্জুনকে জন্মদান করেন। এবং এই একই প্রক্রিয়ায় তথা কুন্তীর মন্ত্রের প্রভাবে, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ঔরসে এবং মাদ্রীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন নকুল ও সহদেব।
৬. ১০০ কৌরব ও দুঃশলা
একদা গান্ধারীর গৃহে অতিথি হয়ে এসেছিলেন স্বয়ং মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব। গান্ধারীও ব্যাসদেবের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সেবার কোন ত্রুটি রাখেননি। তাই ব্যাসদেব গান্ধারীর সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে শতপুত্রের জননী হওয়ার আশির্বাদ দেন। ব্যাসদেবের এই আশির্বাদে যথাকালে গর্ভসঞ্চার হল গান্ধারীর। কিন্তু তিনি গর্ভবতী হওয়ার দুই বছর পরেও তাঁর কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হল না। এদিকে পাণ্ডু ও কুন্তীর প্রথম সন্তান হিসেবে ইতিমধ্যেই জন্ম হয়েছে যুধিষ্ঠিরের। তাই অধৈর্য হয়ে গান্ধারী নিজেই নিজের গর্ভচ্যুতি ঘটালেন। ফলে লোহার মতো কঠিন এক মাংসপিণ্ড প্রসূত হল গান্ধারীর গর্ভ থেকে। সন্তান প্রসবের পরিবর্তে লৌহকঠিন মাংসপিণ্ড প্রসব করায় ভেঙে পড়লেন গান্ধারী। অগত্যা তিনি তার দাসীদেরকে আদেশ দিলেন পিণ্ডটি চূর্ণ করে নষ্ট করে ফেলার জন্য। এসময় ব্যাসদেব এসে মাংসপিণ্ডটিকে রক্ষা করেন এবং সেটিকে শীতল জলে ভিজিয়ে রাখলেন। এর ফলে মাংসপিণ্ডটি থেকে ১০১টি ভ্রুণ সৃষ্টি হল। এরপর সেই ১০১টি ভ্রুণ ১০১টি ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখা হল। এর ১ বছর পর একটি কলস থেকে জন্ম নিয়েছিলেন দূর্যোধন ও এরপর একে একে জন্ম হয়েছিল বাকী ৯৯জন কৌরব ও তাঁদের একমাত্র বোন দুঃশলার।
৭. দ্রোণাচার্য
মহাভারতের আরও এক রহস্যময় জন্মবৃত্তান্ত জড়িয়ে রয়েছে কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের সাথে। আপনারা জানেন গুরু দ্রোণাচার্যের পিতা ছিলেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। মহাভারতের আদিপর্ব অনুযায়ী ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রম ছিল গঙ্গোত্তরী প্রদেশে। তো একদা তিনি প্বার্শবর্তী হাতির্ধান নামক স্থানে স্নান করতে গিয়েছিলেন। তবে সেস্থানে আগে থেকেই স্নানরতা ছিলেন অনন্ত রূপযৌবন সম্পন্না মদদৃপ্তা আপ্সরা ঘৃতাচি। সেইসাথে নদীটির স্রোতও ছিল তীব্র। এসময় জলের তীব্র স্রোতে ভেসে গেল আবেদনময়ী অপ্সরার অঙ্গবস্ত্র। জলে বিবস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন অপরূপ প্রভাযুক্ত, লাবণ্যময়ী ঘৃতাচি। এ দৃশ্য দেখে সংযম হারিয়ে ফেললেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। আর তার অসংযম প্রকাশ পেল শুক্র স্খলিত হওয়ার মাধ্যমে। ঋষি ভরদ্বাজ তার এই স্খলিত শুক্র সংরক্ষণ করলেন দ্রোণকলস নামের এক কাঠের তৈরি কলসে। আর সেখান থেকেই কিছুকাল পর জন্ম হয়েছিল গুরু দ্রোণাচার্যের। আর যেহেতু দ্রোণকলস থেকে তার জন্ম, তাই তার নাম রাখা হয়েছিল দ্রোণ।
৮. ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদী
মহাভারতের দুই অন্যতম প্রধান চরিত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রোপদীর জন্ম কাহিনী আপনাদের অনেকেরই জানা। সেকালে পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদ ও ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণাচার্যের গভীর মিত্রতা রূপ নিয়েছিল মহা শত্রুতায়। দ্রোণাচার্য তার শিষ্যদেরকে ব্যবহার করে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে পরাজিত করেন এবং তার অর্ধেক রাজত্ব ছিনিয়ে নেন। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে রাজা দ্রুপদ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যজ্ঞের মাধ্যমে দ্রোণবধী পুত্র লাভ করা। কিন্তু দ্রোণাচার্য শুধুমাত্র পুত্র সন্তান কামনা করে যজ্ঞে আহুতি প্রদান করলেও দেবতাদের আশির্বাদে তিনি দ্রোণবধী পুত্রের পাশাপাশি একটি অপরূপ প্রভাময়ী কন্যাও লাভ করেন। যজ্ঞের অগ্নি থেকে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্রোণাচার্যের এই পুত্র ও কন্যা। এবং পরবর্তীতে এই দুই পুত্র-কন্যার নামকরণ করা হয় ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদী।
৯. জরাসন্ধ
মহাভারতের অন্যতম কুশীলব মগধের রাজা জরাসন্ধ। এই জরাসন্ধের জন্মবৃত্তান্তও অত্যন্ত অদ্ভূত। তার পিতা বৃহদ্রথ বিবাহ করেছিলেন কাশীরাজের যমজ দুই কন্যকে। কিন্তু দুই দুইজন স্ত্রীর মধ্যে কেউই তাকে কোন সন্তান উপহার দিতে পারেনি। ফলে নিঃসন্তান অবস্থায় দুঃখে কষ্টে দিন কাটতে লাগল রাজা বৃহদ্রথের। এর কিছুকাল পরে রাজা বৃহদ্রথের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে ঋষি চন্দকৌশিকের। তিনি রাজার দুঃখে ব্যাথিত হয়ে তাকে একটি মন্ত্রপূত ফল উপহার দেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন এই ফল রাজার স্ত্রী ভক্ষণ করলেই তিনি পুত্র সন্তান প্রসব করবেন। কিন্তু রাজা বৃহদ্রথ সেই ফলটিকে দুইভাগ করে তার দুই স্ত্রীকে খেতে দেন। ফলে তার উভয় স্ত্রী গর্ভধারণ করলেন বটে তবে তারা দুজনেই একটি সন্তানের অর্ধেক করে প্রসব করলেন। একই সন্তানের দুটি অর্ধাংশ দুই রানীর গর্ভ থেকে প্রসূত হওয়ায় ক্রুদ্ধ হলেন বৃহদ্রথ। রাগে দুঃখে ক্ষোভে তিনি সেই অংশ দুইটি নিক্ষেপ করলেন গহীন অরণ্যে। আর সেই অরণ্যে বাস করতেন জরা নামের এক রাক্ষসী। রাক্ষসীটি সেই শিশু শরীরের অংশদুটি কুড়িয়ে পেলেন এবং তার মায়াবিদ্যা প্রয়োগ করে তা জোড়া লাগিয়ে ফেললেন। এরপর সুস্থসবল শিশুটিকে নিয়ে আবারও ফিরিয়ে দিলেন রাজার কাছে। আর যেহেতু জরা রাক্ষসী দুটি ছিন্ন অংশকে সন্ধিবদ্ধ করে শিশুটিকে পাণে বাঁচিয়েছিলেন, তাই শিশুটির নাম হয়েছিল জরাসন্ধ।
১০. কৃপাচার্য ও কৃপী
মহর্ষি গৌতমের পুত্র শরদ্বান ব্রাহ্মণ হয়েও ছিলেন অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। বিশেষত ধণুর্বিদ্যায় তার দখল ছিল অসামান্য। শরদ্বানের এই বীরোচিত স্বভাবে তার কাছে সিংহাসন হারনোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তাই তাকে বিপথে চালনা করার জন্য জানপদী নামক এক অপ্সরাকে তার কাছে প্রেরণ করেন ইন্দ্রদেব। লাস্যময়ী সুন্দরী অপ্সরা জানপদীকে দেখে শরদ্বানের হাত থেকে তির-ধনুক পড়ে যায় এবং একইসাথে তার শুক্রস্খলনও ঘটে। সেই শুক্র একটি তীরের উপর পড়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এবং তার এক ভাগ থেকে একটি পুত্র এবং অন্য ভাগ থেকে একটি কন্যার জন্ম হয়। রাজা শান্তনু এই জমজ পুত্র কন্যাকে নিজের পুত্র-কন্যা হিসেবে লালন পালন করেন। এদের মধ্যে পুত্রটির নামকরণ করা হয় কৃপ ও কন্যাটির নামকরণ করা হয় কৃপী। কন্যা কৃপীকে পরবর্তীতে বিবাহ করে দ্রোনাচার্য। এবং দ্রোনাচার্যের আগমনের আগ পর্যন্ত কৃপাচার্য ছিলেন কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু। মহাভারতের শেষে যে তিনজন কৌরব বেচে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন এই কৃপাচার্য। তাছাড়া তিনি সপ্ত চিরঞ্জীবীদের মধ্যে অন্যতম একজন যিনি শাস্ত্রমতে আজও বেঁচে আছেন।