সনাতন ধর্মে সুদ গ্রহণ বা প্রদান করা কি নিষিদ্ধ? এই প্রশ্নটি আপনার আমার সকলের মনেই উকি দেয় মাঝে মধ্যে। আর এর কারন হচ্ছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীগণদের অনেকের জন্যই সুদ গ্রহণ ও প্রদান করা নিষিদ্ধ। একারনে আমরা অনেকেই সুদকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকি। কিন্তু আসলেই কি তাই? সুদ গ্রহণ বা প্রদান করা কি সত্যিই খারাপ কাজ? আর সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থগুলোই বা সুদ আদান প্রদানের বিষয়টিকে ঠিক কিভাবে দেখে? সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের সুদ সম্পর্কিত সেইসব সংশয় দূর করতেই আমাদের আজকের আয়োজন। ভিডিওটি থেকে নতুন কিছু জানতে পারলে কমেন্টে একবার জয় সনাতন ধর্ম লিখে যাওয়ার অনুরোধ রইল।
আচ্ছা বর্তমান সময়ে কি সুদ ও ব্যাংক ব্যাবস্থা ছাড়া আমাদের অর্থনীতি কল্পনা করা যায়? মূলত আপনার গচ্ছিত অর্থের নিরাপত্তা বিধান ও আপনার প্রয়োজনে ঋণ সুবিধা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যেই ব্যাংক ব্যাবস্থার উদ্ভব। এবং বলাই বাহুল্য সুদ ব্যাতীত ব্যাংকিং সেক্টরের পক্ষে টিকে থাকা এক প্রকার অসম্ভব। অনেকেই সুদবিহীন ব্যাংক ব্যাবস্থার কথা বলে থাকেন যেখানে শুধুমাত্র লাভের অংশের বিনিময়ে ব্যাংক আপনাকে ঋণ প্রদান করবে। কিন্তু সেটিও বাস্তবিকভাবে অসম্ভব। কারন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহন করে ব্যাবসা করে আপনি কত টাকা লাভ বা মুনাফা অর্জন করছেন তা কিন্তু ব্যাংকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সেকারনে গৃহীত ঋণের বিপরীতে আপনি ঠিক কত টাকা ব্যাংককে প্রদান করবেন তা নির্দ্ধারণ করাও সম্ভব নয়। আবার ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে পরিচালিত আপনার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে যদি লাভের পরিবর্তে ক্ষতি হয় সেটিও ব্যাংকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সুতারাং সুদবিহীন ব্যাংক ব্যাবস্থা আধুনিক এই সময়ে অর্থহীন এক মতবাদ।
এবার আসুন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঋণ ও সুদের কথায়। আপনারা জানেন যে কোন ব্যাবসায় অর্থ বা মূলধন হচ্ছে এর মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু আপনি ব্যাবসা করার জন্য কোন ব্যাক্তির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে আপনার সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকলেন এবং যে ব্যাক্তি আপনাকে ঋণ প্রদান করলেন তিনি কিছুই পেলেন না এটা আসলে কিভাবে গ্রহণযোগ্য?
মোদ্দাকথা বর্তমান সময়ে সুদ ছাড়া ব্যবসা কল্পনাও করা যায় না। তবে আপনারা এটা হয়ত জানেন না সুদ কোন আধুনিক সময়ের ধারণা নয়, বরং সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই সুদের ব্যবহার চলে আসছে আমাদের সমাজে। তো এবার আসুন আমাদের সনাতন শাস্ত্রগ্রন্থগুলোতে সুদ সম্পর্কে কি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা জেনে নেওয়া যাক।
অথর্ববেদের ৩য় কাণ্ডের ১৫ নং সুক্তের ৫ম মন্ত্রে বলা হচ্ছে,
“যেন ধনেন প্রপণং চরামি ধনেন দেবা ধনমিচ্ছমানঃ।
তন্মে ভূয়ো ভবতু মা কণীয়োহগ্নে সাতঘ্নো দেবান্ হবিষা নিষেধ।।”
এর অনুবাদ হচ্ছে হে বিদ্বান্ গণ! মূলধন দ্বারা আমি ধন বৃদ্ধির ইচ্ছা করিতেছি। যে ধন দ্বারা বাণিজ্য করিতেছি তাহা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হউক। হে পরমাত্মন্! যাহারা আমার লাভের হানিকারক তাহাদিগকে আমার নিকট হইতে দূরে রাখ।
অর্থাৎ বেদ অনুসারে মূলধন বৃদ্ধির প্রয়াস তথা সুদ বা মুনাফা মোটেই নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে এখানে মূলধন বা ধনবৃদ্ধির মানে এই নয় যে ইচ্ছামত চড়া বা অতিরিক্ত সুদ ধার্য করার বিধান দেওয়া হয়েছে। বরং ধনবৃদ্ধিকে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বজায় রাখতে হবে। কিন্তু কি সেই নির্দিষ্ট সীমারেখা?
এ বিষয়ে মনুস্মৃতির ৮ম অধ্যায়ের ১৪০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, ধন বৃদ্ধির ইচ্ছাকারী ব্যক্তি প্রতি ১০০ টাকায় সর্বোচ্চ এর ৮০ ভাগের ১ ভাগ টাকা সুদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ ১০০ টাকার ৮০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ মাসিক ১ টাকা ২৫ পয়সা হারে সুদ নেওয়া বৈধ। সেই হিসেবে প্রতি ১০০০ টাকার বিপরীতে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ১৫ টাকা করে সুদ নেওয়ার বিধান। সুতারং এটা প্রমাণিত হল যে সনাতন শাস্ত্র ১৫% টাকা সুদ হিসেবে গ্রহণ করার অনুমতি দেয়।
আবার মনুস্মৃতির একই অধ্যায়ের ১৫৫ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, যদি কোন ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুদ না দিতে পারে তাহলে সে যতটুকু দিতে পারে তা গ্রহণ করা উচিত। অবশিষ্ট সুদ না দিয়ে সেটাকে মূলধনে পরিবর্তন করে দেওয়া উচিত।
পরাশর সংহিতায় বলা হচ্ছে, সুদে অর্থ বিনিয়োগ করা, স্বর্ণকার হওয়া, গবাদি পশুর পরিচর্যা করা, জমি চাষ করা, ব্যবসা করা-এসব হলো বৈশ্যদের পেশা। এ প্রসঙ্গে বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রেও ঠিক এই একই কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে চড়া সুদ অবশ্যই নিন্দনীয় ও পাপ কাজ। যারা অতিরিক্ত সুদ নেয় তাদেরকে উসুরী বলে সম্বোধন করা হয়েছে আমাদের বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে।
এ প্রসঙ্গে বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, বেদপাঠীদের মধ্যে যারা অল্পমূল্যের সম্পদ অতিরিক্ত মূল্যে প্রদান করে সে হলো উসুরী। এই বশিষ্ঠ ধর্মসুত্রেই আবার বলা হচ্ছে, অপরাধের মানদণ্ডে একজন ব্রাহ্মণ হত্যাকারী শীর্ষে অবস্থান করে এবং একজন উসুরী ঠিক তার নিচে।
সুতরাং শাস্ত্র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুদে অর্থ বিনিয়োগ বা সুদ গ্রহন করা কোন পাপকর্ম নয় বরং এটা বৈশ্যদের পেশা হিসেবেই পরিগণিত। তবে অবশ্যই চড়া বা অতিরিক্ত সুদে অর্থ বিনিয়োগ করা তথা উসুরীকে সর্বদাই নিকৃষ্ট কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে আমাদের শাস্ত্রে।