‘ভৈরব’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই বাঙালির কানে বেজে উঠতে বাধ্য— হে ভৈরব, শক্তি দাও… ভক্ত পানে চাহ…। রবীন্দ্রগানের অমোঘ মায়া কাটিয়ে ক’জন বাঙালি বা আরও কমিয়ে বললে ক’জন আধুনিক বাঙালি ‘ভৈরব’ নামক ব্যাপারটির খোঁজ রাখেন? বেনারস অথবা উজ্জয়িনী বেড়াতে গেলে বঙ্গজন কালভৈরবের মন্দির ভিজিট করেন। নেপালে গেলে হেথায়-হোথায় ছড়িয়ে থাকা বিবিধ ভৈরবমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলেন। কিন্তু খবর রাখেন কি, এই ট্যুরিজমের ছকে কোথাও স্থগিত থেকে যাচ্ছে কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য, তার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা রহস্য? প্রথমেই প্রশ্ন জাগে— ‘ভৈরব’ কেমন দেবতা? তাঁর তো তেমন কোনও পুরাণ-পরিচয় নেই। আর আবহমানে তো স্বয়ং শিবকেই ভৈরব বলে ডাকা হয়। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক থাকলেও, পার্থক্য কিন্তু বিস্তর। আজ সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের জন্য রইল কাল ভৈরব সমাচার। এই ভিডিওটি দেখলে জানতে পারবেন কে এই কালভৈরব, তার জন্মরহস্য কি এবং সনাতন ধর্মে তিনি কতটা গুরুত্ব বহন করেন। তাই ভগবান শিবের এই বিনাশী রূপের নিগুঢ় তত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে শেষ পর্যন্ত দেখুন।
‘ভৈরব’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতে। এর অর্থ ‘ভয়ঙ্কর’ বা ‘ভয়াবহ’। মুলত ভগবান শিবের উগ্র রুপকে ‘ভৈরব’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে ‘শিব পুরাণে। কালভৈরবকে পাপীদের শাস্তিদাতা রূপে এবং ভয়ংকর দর্শনা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে পুরানে ও প্রাচীন শিল্পকলায়। তার এক হাতে শুল, এক হাতে দন্ড, হাতে মুন্ড ও আরেক হাতে থাকে আশির্বাদ মুদ্রা। কালভৈরবের বাহন কালো কুকুর। এই কালভৈরবকে মূলত অঘোরিদের দেবতা বলে মনে করা হয়। হিন্দু পুরাণ বলছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আদিতে পাঁচটি মস্তক বা মাথা ছিল। অন্যদিকে শিবও পঞ্চানন তথা ৫টি মস্তকের অধিকারী।কিন্তু গোল বাঁধল যখন, ব্রহ্মা শিবের থেকে অধিক গুরুত্ব দাবি করেন এবং অসম্ভব অহঙ্কার প্রকাশ করতে থাকেন। প্রজাপতির এহেন অহকারে ক্রুদ্ধ হয়ে ভগবান শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তকটি কর্তন করেন। ব্রহ্মার চার মাথা চারটি বেদের জ্ঞান সম্পন্ন। কিন্তু এই পঞ্চম মস্তক ছিলো কামাবৃত্ত । যে মুহুর্তে কামের দমন হয় তখনই জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে। সেই কারনে ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক ছিন্ন হওয়া মাত্রই ব্রহ্মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাপ্রার্থী হন। কিন্তু ব্রহ্মার মস্তক কর্তনের ফলে ব্রহ্মহত্যার পাপ অর্পিত হয় স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের উপর।এর ফলে ব্রহ্মা-কপাল হাতে নিয়ে শিবকে এক দীর্ঘ সময় ভ্রাম্যমান অবস্থায় কাটাতে হয়। এই ভ্রাম্যমান শিবরূপই হচ্ছেন ‘ভৈরব’।
বামন পুরানে অন্য একটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে কালভৈরব ও ব্রহ্মা সম্পর্কে। এই পুরান মতে ‘ভগবান বিষ্ণুর’ নাভি থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি হয় এবং ভ্রুযুগলের মধ্য থেকে শিবের উৎপত্তি হয়। এর পর ভগবান বিষ্ণু অহংকার সৃষ্টি করেন। তার ফলে ব্রহ্মা ও শিব দুজনেই অহংকারের প্রভাবে এসে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেন এবং এর ফলে দুজনের মধ্যে প্রবল তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। এই তর্কযুদ্ধে শিব পরাজিত হন ফলে তিনি কালভৈরব রূপে নিজের নখ দ্বারা ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক ছেদন করেন। এতে যন্ত্রণায় কাতর ব্রহ্মা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সূর্যের সমান দিপ্তমান এক শ্বেতবর্ণ তেজস্বি পুরুষ সৃষ্টি করেন। সেই তেজস্বী দৈবপুরুষ চতুর্ভুজ মুর্তি ধারন করে ছিলেন এবং তার চার হাতে ধনুক, বান, তরবারি এবং ঢাল ধারন করে ছিল। সেই দৈবপুরুষ শিবেকে অধার্মিক সম্বোধন করে তার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে বলেন। অন্যদিকে ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক ছিন্ন করার কারনে শিবের ওপর ব্রহ্মহত্যার পাপ লাগে এবং ব্রহ্মা তাকে অভিশাপ দেন যে ব্রহ্মার এই ছিন্ন মস্তক শিবের হাতে লেগেই থাকবে। শিব এতে দুঃখ পেয়ে কৈলাস ত্যাগ করে চলে যান এবং ভিক্ষুক বেশে বিচরণ করতে থাকেন, আর সৈই ব্রহ্মানির্মিত তেজস্বী দৈবপুরুষ কৈলাশ অধিকার করে থাকতে শুরু করেন। এইভাবে একদিন শিব বদ্রিকাশ্রমে গিয়ে ভিক্ষাপ্রার্থনা করেন। তার প্রার্থনায় নারায়ণ ভিক্ষা দেবার জন্য বাইরে আসেন। নারায়ণ বলেন “যদি আপনি ভিক্ষা চান তবে প্রথমে আপনার ত্রিশূল দ্ধারা আমার আঙুলে প্রহার করুন।” নারায়ণের নির্দেশে শিব তার আঙুলে প্রহার করলে সেখান থেকে রক্তের তিনটি ধারা প্রকট হয়। তার দুটি ধারা থেকে ‘মন্দাকিনী ও শিপ্রা’ নামে দুই নদীর উৎপত্তি হয় এবং তৃতীয় ধারাটি পড়ে মহাদেবের হাতের উপর । এতে শিবের হাত থেকে ব্রহ্মার মস্তক আলাদা হয়ে যায় এবং ব্রহ্ম হত্যার পাপও ধুয়ে যায়। এরপর সেই জলধারা থেকে অগ্নির সমান তেজস্বী এক শ্যামবর্ণ এবং চতুর্ভুজ এক দৈবপুরুষের জন্ম হয়। সে তার চার হাতে ধনুক, বান, তরবারি ও শক্তিঅস্ত্র ধারন করে ছিল। সে হাত জোর করে নারায়ণকে প্রনাম করে বললো “আজ্ঞা দিন প্রভু” নারায়ণ আদেশ করলেন “ব্রহ্মা দ্বারা নির্মিত পুরুষকে বধ করো।” নারায়ণের আদেশে সে কৈলাশ যাত্রা করে এবং ব্রহ্মা নির্মিত দৈবপুরুষের সাথে প্রবল যুদ্ধের পর দুজনে দুজনকে বধ করে। এর পর ব্রহ্মা ও শিব দুজনেই দুজনের ভুল বুঝতে পারেন এবং দুজনেই দুজনের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হন।
তাই কালভৈরবের মুর্তিতে তার হাতে যে মুন্ড থাকে সেটা ব্রহ্মারই মুন্ড বলে মনে করা হয়। এছাড়াও ৫১ সতীপীঠের আশেপাশে যে ভৈরব মন্দির থাকে সেখানকার ভৈরব ওই পীঠস্থানকে পাহারা দিয়ে থাকেন। হিন্দু পুরাণ, বজ্রযানী বৌদ্ধ শাস্ত্র এবং জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি মতে, মহাজগতের বিশেষ স্থানগুলি রক্ষা করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে ভৈরবের উপর। ভৈরবের মোট সংখ্যা ৬৪। এই ৬৪জন ভৈরবকে আবার ৮টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রতিটি শ্রেণির একজন করে প্রধান ভৈরব রয়েছেন। এই ৮ টি শ্রেণির প্রধান ৮ জন ভৈরবকে বলা হয় ‘অষ্টাঙ্গ ভৈরব’ । এই আটজন মহাবিশ্বের আটটি দিকেরও অধিপতি। এই আট জন আবার নিয়ন্ত্রিত হন মহা স্বর্ণ কালভৈরবের দ্বারা। শিব মন্দিরগুলোতে কালভৈরব এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ওই মন্দিরের চাবির রক্ষক বলে গণ্য হন। এছাড়াও প্রত্যেক ভৈরবের একজন করে ভৈরবীও থাকেন। একটু আগে যে অষ্টাঙ্গ ভৈরবের কথা বলা হল তাদের নাম- অসিতাঙ্গ ভৈরব, রুরু ভৈরব, চণ্ড ভৈরব, ক্রোধ ভৈরব, উন্মত্ত ভৈরব, কপাল ভৈরব, ভীষণ ভৈরব, এবং সংহার ভৈরব। এছাড়াও কালভৈরব স্বয়ং বরাহরূপী ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে তন্ত্রে বিশ্বাস করা হয়।
বজ্রযানী তন্ত্রগ্রন্থ গুলিতে বিপুল পরিমাণে ভৈরব-স্তুতি করা হয়েছে। বিশেষ করে ‘ডামর’ শাখার তন্ত্রের প্রায় পুরোটাই ভৈরব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ‘ভূতডামর তন্ত্র’-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, বৈদিক দেব-দেবীদের প্রভাব কলিযুগে অস্তমিত হবে। প্রধান দেবতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন ভৈরবরা। যাইহোক, জৈন ধর্মেও ভৈরবের অস্তিত্ব একই গুরুত্বের সঙ্গে স্থিত।এখানে ভৈরবদের মহিমা অনেকটাই গুপ্ত। সাধারণভাবে জমসমক্ষে পুরাণ-কাহিনি আওড়ানো হয়ে থাকলেও ৬৪জন ভৈরব ও তাঁদের সঙ্গিনী ৬৪ যোগিনী তন্ত্রমতে বিবিধ শক্তির আধার। ভৈরবরা হলেন সুপ্ত এবং দূরবর্তী। কিন্তু ভৈরবীরা সক্রিয়। তাই তাঁরা বিভিন্ন পূজা, উপচার ইত্যাদির মাধ্যমে ভৈরবীশক্তিকে তুষ্ট করে ভৈরবের প্রসাদ লাভ করতে চান। এই সাধনধারা সুদীর্ঘ কাল ধরে চলে আসছে সমগ্র আর্যাবর্তে। নেপালে হিন্দু ও বৌদ্ধ তন্ত্রের এক অনবদ্য মিশেল ঘটেছে দীর্ঘকাল ধরে। এখানকার ভৈরব মূর্তিগুলিতে সেই মিশেলের ছাপ স্পষ্ট।
কাশীর কালভৈরব মন্দিরে বা উজ্জয়িনীর বিবিধ ভৈরব মন্দিরে জমা হয়ে রয়েছে অসংখ্য রহস্যময় আচার ও প্রথা। আজ সে সবের মানে খুঁজতে যাওয়া মুশকিল। কিন্তু, একদা এই সব আচারই যে তন্ত্রের বেশ ছায়াময় দিকের সঙ্গে জড়িত ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।