ভোলানাথ মহেশ্বর। দুর্দণ্ড প্রতাপ, অসীম শক্তি এবং তুমুল ক্রোধের অধিকারী হয়েও, ভক্তের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন নেহাত এক শিশু। ভক্তের কাছে ভক্তির দামের বিক্রি হয়ে মাথায় তুলে নেন ভক্তের অর্পণ করা মাংসের টুকরো, মুখের থুথু বা ভক্তের পা। কি, অবিশ্বাস্য লাগছে? কিন্তু বাস্তবেই এই ঘটনা ঘটেছিল দক্ষিণ ভারতের শ্রীকলাহস্তেশ্বর মন্দিরে। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ এবং কান্নাপ্পা নাইনার নামক এক শিকারীর মধ্যে ঘটে গিয়েছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। শিবলিঙ্গে মাংসের টুকরো অর্পণ, মুখের থুথু মিশ্রিত জল অর্পণ, শিবলিঙ্গের উপর পা দ্বারা স্পর্শ করা, শিবলিঙ্গের চোখে রক্তক্ষরণ এসকল ঘটনা জড়িয়ে আছে সেই কাহিনীর সাথে। আজ সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের জন্য রইল ভোলানাথের প্রতি ভক্তির সেই অসামান্য কাহিনীটি। তবে শুরু করার আগে আপনাদের কাছে অনুরোধ, কমেন্ট বক্সে একবার হর হর মহাদেব লিখে যাবেন।
কান্নাপ্পা নায়নারের প্রাথমিক জীবন থেকে জানা যায় তাঁর জন্ম হয়েছিল যীশু খ্রীস্টের জন্মের প্রায় ৩০০০ বছর আগে। স্থানটি ছিল প্রাচীন অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপতি জেলার শ্রীকলাহস্তি শহরের নিকটে একটি গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন রাজা নাগ ব্যাধ নামক এক কার্ত্তিক ভক্ত শিকারী। এবং ব্যাধ বা শিকারী বংশে জন্মগ্রহণ করার কারনে তিনি নিজেও ছিলেন পেশায় একজন ব্যাধ। দক্ষিণ ভারতে যে ৬৩ জন সাধুকে নয়নার বা শিবের পবিত্র ভক্ত হিসেবে গণ্য করা হয় তিনি তাঁদের মধ্যে ১০ম। তাই থিন্নাপ্পান, ডিন্না, কান্নাপ্পা, তিন্নাপ্পান, ধীরা, থিন্নান ইত্যাদি নামেও তাঁকে সম্বোধন করে থাকেন স্থানীয়রা।
এবার আসি আসল ঘটনায়। একদা কান্নাপ্পা নয়নার তাঁর পেশাগত কর্মের জন্য তাঁর পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে গমন করলেন এবং সেখানে পশু শিকার করা শুরু করলেন। শিকারের এক পর্যায়ে তিনি আবিষ্কার করলেন জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটি সাজানো গোছানো মন্দির। এবং মন্দিরে স্থাপন করা ছিল একটি সুদৃশ্য শিবলিঙ্গ। কান্নাপ্পা যেইমাত্র সেই মন্দিরে প্রবেশ করে শিবলিঙ্গটির দর্শন করলেন, তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে এক আশ্চর্য ভক্তিভাব জেগে উঠল। শিবলিঙ্গের সামনে মস্তক আনত করে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন তিনি। শান্ত হল তাঁর প্রাণ। কিন্তু তাতেও তাঁর মনের ক্ষুধা দূর হল না। তিনি ভগবান মহাদেবকে কিছু একটা অর্পণ করতে চাইলেন। কিন্তু অর্পণ করার মত তাঁর কাছে কিছুই ছিল না। অন্যদিকে ব্যাধ বা শিকারী পরিবারের সন্তান হওয়ায় পূজা-অর্চনা সম্পর্কেও তেমন কোন জ্ঞান ছিল না তাঁর। এমন সময় তিনি তাঁর থলিটি হাতড়ে দেখতে পেলেন সেখানে কয়েক টুকরো বন্য পশুর মাংস পড়ে আছে। অগত্যা সেই মাংসের টুকরোগুলো শিবলিঙ্গের মাথার উপরে অর্পণ করলেন তিনি। এরপর তিনি এক গভীর প্রশান্তি নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে ওই মন্দিরের দেখাশোনা ও পৌরহিত্য করতেন এক ব্রাহ্মণ। যেহেতু মন্দরটির অবস্থান ছিল দূর্গম-গহীন বনে এবং ব্রাহ্মণের বাড়িও ছিল অনেক দূরে, তাই তিনি কয়েকদিন পর পর মন্দিরে এসে পূজা অর্চনা করে এবং মন্দির পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাড়ি ফিরে যেতেন। কিন্তু এবার মন্দিরে এসে ব্রাহ্মণ কিছুটা আশ্চর্য হলেন। কারন তিনি দেখতে পেলেন শিবলিঙ্গের মাথায় কয়েক টুকরো পচা মাংস দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তবে যেহেতু স্থানটি জনমানবশূন্য তাই তিনি ভাবলেন হয়ত কোন বণ্য প্রাণী এই কাজ করেছে। তাই তিনি সেদিনকার মত মন্দির পরিষ্কার করে, মন্ত্রের মাধ্যমে শিবলিঙ্গকে শুদ্ধ করে এবং শিবের পূজা সমাপন করে বাড়ি ফিরে গেলেন।
এর কিছুদিন পরে আবারও সেই ব্যাধ এসে হাজির হলেন সেই শিবমন্দিরে। মন্দিরে প্রবেশ করে তিনি দেখতে পেলেন গতদিনে তিনি শিবলিঙ্গের মাথায় যে মাংসের টুকরোগুলো অর্পণ করেছিলেন তা আর নেই। ফলে তিনি ধরেই নিলেন দেবাদিদেব তাঁর অর্পিত মাংস গ্রহণ করেছেন। এতে শিবের প্রতি শ্রদ্ধায় আনত হল তাঁর শরীর-মন। আর তাই এবার তিনি আরও বেশী পরিমানে মাংস অর্পণ করলেন শিবলিঙ্গে। এবং যেহেতু তিনি পূজা পাঠ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তাই শিবের সামনে বসে নিজের মনের কথাগুলো বলতে শুরু করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল এই মন্দিরটি সুন্দরভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা উচিত। কিন্তু তার জন্য তো জলের প্রয়োজন। অথচ চারপাশে অনেক খুঁজেও তিনি কোন জলের উৎস খুঁজে পেলেন না। সেই সাথে দূর থেকে জল আনার জন্য কোন পাত্রেরও সন্ধান পাওয়া গেল না। অগত্যা মন্দির থেকে একটু দূরে স্বর্ণমূখী নদী থেকে মুখের মধ্যে জল নিয়ে সেই জল এনে ঢাললেন শিবলিঙ্গের উপর। এরপর খুশিমনে তিনি ফিরে গেলেন তাঁর গৃহে।
তারপরদিন সেই শিবমন্দিরে হাজির হলেন পূজারী ব্রাহ্মণ। কিন্তু মন্দিরে ঢুকেই গোটা মন্দির চত্ত্বর ও শিবলঙ্গের অবস্থা দেখে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মত অবস্থা। শিবলিঙ্গের মাথায় ও মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মাংসের টুকরো। তাছাড়া শিবলিঙ্গের উপর মানুষের মুখের থুথুও ছেটানো। এবার তিনি বুঝতে পারলেন, এটা কোন বণ্যপ্রাণীর কাজ নয়, কেউ একজন ভালো করে জেনে-বুঝে মন্দির ও এর ভিতরে অবস্থিত শিবলিঙ্গের পবিত্রতা নষ্ট করছে। কিন্তু উপায় কি? এই গহীন জঙ্গলে কে, কখন এই কাজ করছে তা বুঝতে পারা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই সেদিনও ব্রাহ্মন আবার মন্দির পরিষ্কার করে এবং শিবলিঙ্গকে শুদ্ধ করে তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন।
এরপর থেকে প্রায়শই এই একই ঘটনা ঘটতে লাগল সেই মন্দির ও শিবলিঙ্গে। প্রতিবার ব্রাহ্মণ মন্দিরটিকে শুদ্ধ করে এবং শিবলিঙ্গের পূজা করে সেই স্থান থেকে চলে যান এবং পরবর্তী দিন এসে দেখেন শিবলিঙ্গটি অপবিত্র হয়ে পড়ে রয়েছে।এভাবে কয়েকদিন চলার পর আর সহ্য করতে পারলেন না ব্রাহ্মণ। তিনি শিবলিঙ্গের সামনে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হে দেবাদিদেব মহাদেব, হে দয়াময়, আপনি কেন এই অপমান প্রত্যেকদিন সহ্য করছেন? আমি এত যত্ন করে আপনার মন্দির ও শিবলিঙ্গের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখি, আর কে একজন সেখানেই প্রতিনিয়তই অনাচার করে চলেছে। স্বচক্ষে দেখার পরেও কিছুই কি করার নেই আপনার?”
দীর্ঘদিন ধরে যে পূজারী ব্রাহ্মণ তাঁকে সেবা করে আসছেন তাঁর কণ্ঠের এই আকুলতা শুনে সাড়া দিলেন দেবাদিদেব মহাদেব। তিনি শিবলিঙ্গের মধ্য থেকে দৈববাণী করলেন, “হে পুত্র, এই মন্দির ও শিবলিঙ্গ যে প্রতিনিয়ত অপবিত্র করছে সে তোমারই মত আমার একজন ভক্ত। যাকে তুমি অপমান মনে করছ তা আমারই সেই ভক্তের দেওয়া অর্পণ! আমি যে তাঁর ভক্তির সাথে বাধিত হয়ে গেছি, তাই সে যা অর্পণ করে আমি খুশি মনে তা গ্রহণ করি। যদি তুমি সত্যিই তাঁর ভক্তির রূপ দেখতে চাও তাহলে একটু আড়ালে গিয়ে অপেক্ষা করো, সে একটু পরেই চলে আসবে। ”
মহাদেবের নির্দেশ পেয়ে ব্রাহ্মণ বলে উঠলেন, “হে প্রভু, তাই হবে। আপনি আপনার নির্দেশ মত আড়ালে থেকে আপনার সেই ভক্তের কর্মকাণ্ড দেখবো।” এই বলে মন্দিরের একটু আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন তিনি। এদিকে অন্যদিনের মত হাতে মাংসের থলি ও মুখের ভিতরে জল নিয়ে মহানন্দে মন্দিরে প্রবেশ করলেন ব্যাধ। কিন্তু আজ তিনি একটু আশ্চর্য হলেন। কারন তিনি দেখলেন তাঁর গতদিনের অর্পণ করা মাংসের টুকরোগুলো মহাদেব গ্রহণ করেননি। আসলে সেদিন পূজারী ব্রাহ্মণ মন্দির আর শিবলিঙ্গ পরিচ্ছন্ন করেননি। এমন সময় শিকারী লক্ষ্য করলেন, শিবলিঙ্গের চোখ দিয়ে কিছু একটা তরল জাতীয় পদার্থ নির্গত হচ্ছে। শিকারী বুঝলেন শিবলিঙ্গের ঐ চোখটি কোনভাবে আগাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাই তিনি ছুটে গেলেন মন্দিরের বাইরের জঙ্গলে। সেখান থেকে দ্রুততার সাথে জরিবুটি এনে প্রলেপ দিলেন শিবলিঙ্গের চোখে। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হতে শুরু করল, শিকারী দেখলেন এবার শিবলিঙ্গের চোখ দিয়ে রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এখন উপায়? অগত্যা কোন উপায় না দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভোলানাথের ওই চোখের স্থানে তিনি নিজের চক্ষু স্থাপন করবেন। তাই তাঁর হাতে থাকা তীর দিয়ে তিনি নিজের নয়ন উপড়ে স্থাপন করলেন শিবলিঙ্গের চোখের স্থানে। এতে সেই চোখ দিয়ে রক্তপ্রবাহ তো থেমে গেল, কিন্তু নতুন করে আরও এক সমস্যার উদ্ভব হল। এবার শিকারী দেখতে পেলেন, শিবলিঙ্গের অপর চক্ষু দিয়েও একইভাবে রক্ত ঝরছে অনাবরত। ব্যাধ ভাবলেন, চিন্তা কি? আমার তো এখনও একটি চোখ অবশিষ্ট আছে। সেই চোখ অর্পণ করে হলেও আমি ভোলানাথের নেত্র থেকে রক্তপাত বন্ধ করবো। কিন্তু মুশকিল হল, তিনি যদি তাঁর অবশিষ্ট চোখটি তুলে ফেলেন তাহলে তিনি শিবলিঙ্গের ক্ষতস্থান দেখবেন কিভাবে আর সেখানে নিজের চোখ স্থাপন করেবেনই বা কিভাবে?
এমন সময় হঠাৎ করে একটি বুদ্ধি খেলে গেল শিকারীর মনে। তিনি তাঁর এক পা তুলে দিলেন শিবলিঙ্গের সেই রক্তাক্ত চোখের উপর আর তীর দিয়ে নিজের বাকী চোখটি উপড়ে ফেলতে উদ্যত হলেন। এতক্ষণ একটু আড়াল থেকে ব্যাধের এসব কর্মকাণ্ড দেখছিলেন পূজারী ব্রাহ্মণ। কিন্তু এবার তিনি চমকে উঠলেন। একদিকে শিবের প্রতি অপরিসীম ভক্তি অন্যদিকে শিবলিঙ্গে পদস্পর্শ করার স্পর্ধা। ভয়ে কেঁপে উঠলেন তিনি। এমন সময় থর থর করে কেঁপে উঠল সমগ্র মন্দির। শিবলিঙ্গের মধ্য থেকে এক বিশাল আলোকছটা বেরিয়ে এসে আস্তে আস্তে রূপ নিতে লাগল দেবাদিদেব মহাদেবের। প্রকট হলেন মহেশ্বর। ঠোটে তাঁর মৃদু প্রসন্নতার হাসি। প্রথমে তিনি চক্ষু উৎপাটনে উদ্যত ব্যাধকে থামালেন, এরপর বলে উঠলেন, “হে পুত্র, তোমার ভক্তিতে আমি অভিভূত। কি নিষ্পাপ তোমার অর্পণ! কি সরল তোমার ভক্তি! তোমার এই সরল মনের সাধনায় আমি অত্যন্ত তুষ্ট হয়েছি। হে পুত্র, আমি তোমার উভয় নেত্রের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছি। সেই সাথে আমি তোমাকে আশির্বাদ করছি, আজ থেকে তোমার নাম হবে কান্নাপ্পা নায়নার।”
উল্লেখ্য, কান্নাপ্পা শব্দের অর্থ যে ব্যাক্তি নেত্রদান করেন এবং নায়নার শব্দের অর্থ শিবের পবিত্র ভক্ত। এদিকে, স্বয়ং মহাকালকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে এবং তাঁর থেকে আশির্বাদ প্রাপ্ত হয়ে শিকারী ব্যাধও লুটিয়ে পড়লেন মহাদেবের পদতলে। বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে চোখের জলে ধুয়ে দিলেন তাঁর চরণ। আর এভাবেই শিকারী জীবনের মহাপাপ থেকেও মুক্ত হলেন তিনি। তাই ভক্ত আর ভগবানের সম্পর্ক টা সম্পূর্ণ আলাদা। ভগবানের পুজোর জন্য আমিষ , নিরামিষ , উপবাসের চেয়ে স্বার্থহীন ভালোবাসা আর মনের ভক্তি বেশী মাহত্ম্য বহন করে। আর তাই যে সমস্ত ভক্তরা ভক্তি ভরে ভগবানের পুজো করেন সেই ভক্তদের কোন ক্ষতি হতে দেন না স্বয়ং ভগবান, ভক্তদের ডাকে বারংবার সাড়া দেন তিনি।