আপনারা নিশ্চই পঞ্চসতী বা পঞ্চকন্যার নাম শুনে থাকবেন। বলা হয় প্রতিদিন সকালে এই পঞ্চকন্যাকে স্মরণ করলে আমাদের মহাপাপগুলোও দূরীভূত হয়। এই পঞ্চকন্যাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন লঙ্কাধিপতি রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী। আর তাঁকে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। রামায়ণে অসুরকুলপতি রাবণের স্ত্রী হিসেবে আমরা যে মন্দোদরীকে আমরা দেখে থাকি সেটাই কি তাঁর আসল পরিচয়? নাকি তাঁর আরও কোন পরিচয় রয়েছে? কেন তিনি তাঁর পূর্বজন্মে দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রলুব্ধ করেছিলেন? কার অভিশাপে তাঁকে ব্যঙের রূপ ধারণ করতে হয়েছিল? রাম-রাবণের যুদ্ধের শেষে বিধবা মন্দোদরীর কি পরিণতি ঘটেছিল? এবং কিভাবেইবা তিনি স্বর্গীয় অপ্সরা থেকে রাক্ষসরাজের পত্নী বনে গেলেন? এসকল প্রশ্নের উত্তর থাকছে আমাদের আজকের বিশেষ পর্ব। আশা করি এ আয়োজনে আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকবেন এবং ভালো লাগলে কমেন্টে একবার রঘুকুলপতি শ্রীরামচন্দ্রের নাম লিখে যাবেন।
মন্দোদরীর জীবন কাহিনীর বর্ণনা পাওয়া যায় উত্তর রামায়ণ গ্রন্থে। একদা ঋষি কশ্যপের পুত্র মায়াসুর হেমা নামের এক স্বর্গীয় অপ্সরাকে বিবাহ করেছিলেন। এর কিছুকাল পর মায়াসুর ও হেমা দম্পতি মায়াবী ও দুন্দুভি নামক দুই বলশালী পুত্রের জন্ম দিয়ছিলেন। কিন্তু এই দম্পতি দীর্ঘদিন ধরে একটি কন্যা সন্তান প্রাপ্ত করার জন্য কামনা করছিলেন। তাই পরপর দুই পুত্রের জন্মের পর মায়াসুর ও হেমা উভয়েই কৈলাস পর্বত সংলগ্ন এলাকায় দেবাদিদেব মহাদেবের তপস্যায় রত হলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মহাদেবের কৃপালাভ করে একটি কন্যা সন্তান প্রার্থনা করা। তো এভাবেই কেটে যেতে লাগল সময়।
অন্যদিকে, মধুরা নামের এক অনিন্দ্য সুন্দরী অপ্সরা একদা কৈলাস পর্বত ভ্রমণে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের ভক্ত। তাই কৈলাস পর্বতে এসে শিবকে প্রসন্ন করার জন্য তিনি তাঁর সামনে প্রকট হলেন। সেসময় কৈলাস পর্বতে শিবজায়া পার্বতী উপস্থিত ছিলেন না। তাই অপ্সরা মধুরা শিবের উদ্দেশ্যে কোন পূজা, ধ্যান বা তপস্যায় রত হননি। বরং তিনি তাঁর গৌরবর্ণ কায়া, চপল চাহনি, সুমিষ্ট কণ্ঠ ও দীর্ঘ কেশরাশি দিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। কিছুক্ষণ পরে মাতা পার্বতী কৈলাসে ফিরে এসে খুব সহজেই বুঝে ফেললেন আসল ঘটনা। ফলে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মধুরাকে ১২ বছর ব্যাঙ হয়ে থাকার অভিশাপ দিলেন। দেবী পার্বতীর কাছে অভিশপ্ত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মধুরা। তবে মহাদেব সেই অভিশাপকে কিছুটা প্রশমিত করে দিলেন। তিনি মধুরাকে আশির্বাদ করে বললেন, ১২ বছর ব্যাঙ হয়ে কুয়োর মধ্যে থাকার পর তুমি এক সুন্দরী কন্যায় পরিণত হবে এবং এক জগদ্বিখ্যাত মহাবীরের সাথে তোমার বিবাহ হবে।
ফলে পার্বতীর অভিশাপে এক অন্ধকার কুয়োয় আবদ্ধ হয়ে রইলেন অপ্সরা মধুরা। এভাবেই কেটে গেল একে একে বারোটি বছর। ১২ বছরের অভিশপ্ত জীবন শেষে আবারও এক সুন্দরী কন্যায় পরিণত হলেন অপ্সরা মধুরা। কিন্তু তখনও তিনি কুয়োয় আবদ্ধ অবস্থায়ই ছিলেন। তাই সুন্দরী কন্যায় পরিণত হওয়ার স্বত্বেও তিনি কুয়োর বাইরে বের হতে পারছিলেন না। সেসময় সেই কুয়োর প্বার্শবর্তী স্থানে তপস্যা করছিলেন মায়াসুর ও অপ্সরা হেমা। তাঁরা তাঁর ক্রন্দন শুনে কুয়ো থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন এবং তাঁকে পালিত কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেন। মায়াসুর ও হেমার এই পালিত কন্যার নামকরণ করা হয় মন্দোদরী। এবং এই মন্দোদরী শব্দের অর্থ হচ্ছে কোমল উদর বিশিষ্ট।
যাইহোক, কালক্রমে রাক্ষসপ্তি রাবণের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে অপরূপ রূপবতী মন্দোদরীর। তাঁর অতুল্য আবেদনময়ী অবয়ব ও স্বর্গীয় রূপমাধুর্যে মোহিত হলেন রাবণ। আর তাই অনতিবিলম্বে অগ্নি সাক্ষী করে এবং বৈদিক মন্ত্রোশ্চারণের মধ্য দিয়ে বিবাহ সুসম্পন্ন হল রাবণ ও মন্দোদরীর। মন্দোদরী এতটাই সুন্দরী ছিলেন যে, শ্রীহনুমান প্রথমে লঙ্কায় গিয়ে মন্দোদরীকেই সীতা ভেবে ভূল করেছিলেন। সাংসারিক জীবনে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন মেঘনাদ, অতিকায় ও অক্ষয়কুমার নামের তিন বলশালী পুত্রকে।
রাক্ষসরাজ রাবণ দুরাচারী, অত্যাচারী ও নীতিভ্রষ্ট হলেও তাঁকে স্বামীর প্রাপ্য স্মমান দিয়ে সর্বদাই উত্তম পতিব্রত পালন করতেন মন্দোদরী। ব্যাক্তিজীবনে তিনি ছিলেন ধার্মিক, নিরহংকারী ও দয়াশীলা।রাবণকে অন্যায় ও পাপের পথ থেকে ফিরে আসার জন্য বারবার আকুতি জানাতেন তিনি। কিন্তু রাবণ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি কখনো। রাবণ কর্তৃক নবগ্রহকে বন্দী করা, বেদবতীকে অপমান করা, সীতাকে হরণ করা এসকল কাজের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি, কিন্তু সবসময়ের মত রাবণ তাঁর পরামর্শকে উপেক্ষা করেছিলেন।
সর্বশেষ সীতাকে অপহরণ করার পর মন্দোদরী তাঁর স্বামীকে অনুরোধ করেছিলেন সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে শ্রীরামের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করার জন্য। এমনকি মন্দোদরীর প্রত্যক্ষ বাঁধার মুখে রাবণ সীতাকে হত্যা বা নিপীড়ন করতে পারেননি। তাছাড়া নিজের পুত্র অপরাজেয় মেঘনাদকেও তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন রামের সাথে যুদ্ধ না করার জন্য। কারণ তিনি জানতেন রাম-রাবণের এই যুদ্ধে একমাত্র তাকেই সর্বস্ব হারাতে হবে। কিন্তু পতি এবং পুত্র কেউই কখনো তাঁকে গুরুত্ত্ব দেননি। তা সত্তেও বাধ্য ও বিশ্বস্ত স্ত্রীর মতো রাবণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। যুদ্ধের ময়দানে পতি ও পুত্রের করুণ মৃত্যু দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন এই পঞ্চসতীর অন্যতমা সতী।
কিন্তু এবার কি হবে? যুদ্ধ শেষে বিধবা মন্দোদরীর দায়ীত্ত্ব নেবে কে? নাকি তাঁকে তাঁর মৃত স্বামীর সাথে চিতারোহণ করতে হবে? এসময় মর্যাদা পুরুষোত্তম বিভীষণকে আদেশ করেছিলেন রাবণের পত্নী মন্দোদরীকে বিবাহ করার জন্য। কিন্তু বিভীষণ পূর্বেই বিবাহিত ও তাঁর স্ত্রী বর্তমান থাকার সত্তেও কেন মন্দোদরীকে বিবাহ করেছিলেন তা নিয়ে দুটি মত প্রচলিত রয়েছে।
প্রথম মত অনুসারে, রাবণ মাতৃতান্ত্রিক জাতির প্রতিনিধি ছিলেন। অর্থাৎ রাবণের পিতা ব্রাহ্মণ হওয়ার সত্তেও মাতা কৈকেশী রাক্ষসী হওয়ার কারণে রাবণ রাক্ষস নামে পরিচিত হন। অনুরূপভাবে রাবণের মৃত্যুর পরেও রাক্ষসকুলের রাজমহিষী ছিলেন মন্দোদরী। তাই তার লংকা রাজ্যের শাসনক্ষমতা পাওয়ার জন্য বিভীষণ রাজমহিষীকে বিবাহ করতে বাধ্য হন।
অন্য একটি মত বলছে, রাজমহিষীকে বিবাহ করা সম্ভবত অনার্য সভ্যতার লক্ষণ। মন্দোদরী ও বিভীষণের বিবাহ ছিল “রাজনৈতিক কূটবুদ্ধিপ্রসূত”। এই বিবাহ কোনোভাবেই “পারস্পরিক দৈহিক আকর্ষণে”র ভিত্তিতে হয়নি। সম্ভবত রাজ্যের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এবং রাজকীয় ক্ষমতা ভোগ করতে মন্দোদরী বিভীষণকে বিবাহ করতে রাজি হয়েছিলেন।
আর মন্দোদরীর এই ঘটনাবহুল জীবনকে স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের সনাতন শাস্ত্র তাঁকে পঞ্চকন্যা বা পঞ্চসতীর অন্যতমা আসন দিয়ে সম্মানিত করেছে।