কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার এক লেখায় বলেছিলেন, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে..’- আর বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, এ পৃথিবীতে যেকোনো প্রাণী কিংবা গাছপালা; এমনকি ছোট কীটপতঙ্গের- জন্ম হলেই তার মৃত্যু অবিশ্যম্ভাবী। অথচ চিরন্তন এই সত্য জানার পরেও মানুষ সারাজীবন ধরে অমরত্বের খোঁজ করে এসেছে। হিন্দু পুরাণ আর বিভিন্ন মহাকাব্যেও একাধিক মৃত্যুহীন ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। হিন্দু পুরাণে যে কজন অমরত্বের অধিকারী হয়েছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বর্ণময় এক চরিত্র হলেন পরশুরাম। রামায়ণ ও মহাভারতেও পরশুরামের ভুমিকা সমানভাবে গুরুত্বপুর্ণ। গরুড় পুরাণ মতে তিনি ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের ৬ষ্ঠ অবতার। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমাদের ধর্মচর্চার বাইরে থেকে যান তিনি। ঠিক এই কারনেই পরশুরাম অবতারকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
ঋষি জমদগ্নি ও তার স্ত্রী রেণুকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন কনিষ্ঠ । পরশুরামের জন্ম নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা কাহিনী । ভাগবত পুরাণ অনুসারে, একসময় সমাজে ক্ষত্রিয় রাজাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি মারাত্নকভাবে বৃধি পেতে থাকে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারন মানুষ তাদের উদ্ধারকল্পে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্তব করতে থাকেন । তখন সকলের আবেদনে সাড়া দিয়ে ক্ষত্রিয়দের শায়েস্তা করার জন্যই ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর বরে পরশুরাম জন্মগ্রহণ করেন। আবার অন্য একটি মতবাদ অনুসারে, পৃথিবী স্বয়ং একটি গাভীর রূপ ধারণ করে বিষ্ণুর কাছে নিজের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানিয়েছিলেন। তখন বিষ্ণু পরশুরাম হয়ে জন্মগ্রহণ করে এই দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন বলে পৃথিবীকে কথা দেন। তবে আসল ঘটনা যাই হোক না কেন পরশুরাম যে ভগবান বিষ্ণুর ৬ঠ অবতার সে বিষয়ে কোণ সন্দেহ নেই।
যাইহোক, মহর্ষি জমদগ্নির আশ্রমে তার সকল সন্তানরা যখন বেদ-বেদান্ত চর্চায় নিয়োজিত থাকতেন, পরশুরামের তাতে কোনো উৎসাহই ছিল না, বরং তীর-ধনুক চালনার কৌশল শিখতেই তিনি বেশি মনোযোগী ছিলেন। জন্মের পর থেকেই পরশুরাম জেনে এসেছেন ক্ষত্রিয়দের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যেই তার জন্ম হয়েছে। তাতেই যা সর্বনাশ হওয়ার, তা-ই হলো। অল্প বয়স থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন দাম্ভিক, রাগী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। কিছুকাল পর দেবতাদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন তিনি। এবং তপস্যায় সন্তুষ্ট করে তিনি ব্রহ্মার কাছ বেশ কয়েকটি মারণাস্ত্র আদায়ও করে নেন।
এছাড়াও মহাদেবকে তুষ্ট করে তিনি তার পরশু অর্থাৎ কুঠার অস্ত্রটি লাভ করেন। সেই থেকে তার নাম হয় পরশুরাম। মহাদেবের নির্দেশে এ অস্ত্র দিয়ে তিনি অনেক অসুর নিধন করেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন এক পরাক্রমশালী যোদ্ধা। তাই পরশুরাম ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও কর্মে তিনি হয়েছিলেন ক্ষত্রিয়। একদিন ঋষি জমদগ্নি যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন।সে সময় তার স্ত্রী রেণুকা জল আনতে গিয়েছিলেন প্বার্শবর্তী নদীতে। একই সময় সেই নদীতে চিত্ররথ নামক এক রাজা তার স্ত্রীদের সাথে জলবিহার করছিলেন। এই দৃশ্য দেখে রেণুকা আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এদিকে ঋষি জমদগ্নি বহুক্ষন যাবত তার স্ত্রীর গৃহে ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। রেণুকা তখনও কুটিরে ফিরে না আসায় চিন্তিত ঋষি ধ্যানযোগে স্ত্রীর ওই অবস্থা দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি তৎক্ষণাৎ পুত্রদেরকে মাতৃহত্যার আদেশ দেন । কিন্তু মাতৃহত্যা মহাপাপ। এ জন্য ঋষির প্রথম চার সন্তানই পিতার এ আদেশ পালন করতে রাজি হননি। তখন ঋষি তার চার সন্তানকে জড়ত্বের অভিশাপ দেন। শেষে ঋষি তার কনিষ্ঠ সন্তান পরশুরামকে একই আদেশ দিলে পরশুরাম তার কুঠার দিয়ে মায়ের শিরশ্ছেদ করেন।
পিতৃ আজ্ঞা পালন করায় জমদগ্নি পুত্রের উপর বেশ সন্তুষ্ট হলেন। তারপর ঋষি জমদগ্নি পরশুরামকে যেকোনো বর চাইতে বললেন। পরশুরাম একসাথে মায়ের পুনর্জন্ম, ভাইদের জড়ত্বমুক্তি, নিজের দীর্ঘায়ু ও অজেয়ত্বের বর প্রার্থনা করেন। এর মধ্যে স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি ঋষির ক্রোধও কিছুটা প্রশমিত হওয়ায় জমদগ্নি পরশুরামের সবগুলো প্রার্থনাই পূর্ণ করলেন।
কিন্তু পরশুরামের হাতে ঐ কুঠারটি লেগেই থাকল। পিতার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে পিতা বলেন— ‘তুমি মাতৃহত্যা আর নারীহত্যা এই দ্বিবিধ পাপেই আক্রান্ত হয়েছো। আর জেনে রেখো, পাপ ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন কৃতকর্মীকে তা স্পর্শ করবেই।’ তার পরও পুত্রকে আশ্বস্ত করে তীর্থ পরিভ্রমণের উপদেশ দিয়ে বলেন— ‘যে তীর্থ গমনে বা স্নানে তোমার হাতের কুঠার স্খলিত হবে, জানবে যে ঐ পুণ্যস্থানই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র।’ পিতৃ আজ্ঞায় পরশুরাম তীর্থ পরিভ্রমণে বের হয়ে তীর্থ ভ্রমণ করতে লাগলেন। বহু তীর্থ ভ্রমণ করার পর একদিন ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করার সাথে সাথে তাঁর হাতের কুঠার স্খলিত হয়ে যায় এবং তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্তিলাভ করেন। তিথিটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি, বুধবার ও পুনর্বসু নক্ষত্র। পরে পরশুরাম চিন্তা করলেন— এমন সুমহান পুণ্যজনক জলকে সকলের সহজলভ্য করার জন্য এর ধারা পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন। পিতৃ আজ্ঞায় ব্রহ্মকুণ্ডের জলধারাকে এ পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য পরশুরাম, হাত থেকে স্খলিত কুঠার দিয়ে ব্রহ্মকুণ্ডের জলধারাকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত আনতে সক্ষম হন। তার পর লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার ‘লাঙ্গলবন্দ’ পর্যন্ত নিয়ে আসেন। সুদূর হিমালয় থেকে একাদিক্রমে হাল চালনায় ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম করার জন্য তিনি যেখানে লাঙ্গল বন্ধ রেখেছিলেন সে স্থানটির নাম হয় ‘লাঙ্গলবন্দ’।
এবার এই পরশুরাম কিভাবে ক্ষত্রিয়দের পরম শত্রু হয়ে উঠেছিলেন তা জেনে নেওয়া যাক। পুরাকালে কার্তবীর্য নামে এক রাজা ছিলেন। তার আসল নাম ছিল কার্তবীর্যার্জুন। একবার তিনি পুত্রদের নিয়ে মহর্ষি জমদগ্নির আশ্রম দর্শনে আসেন। সেখানে আশ্রমে থাকা কামধেনু গাভীকে দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, রাতের আঁধারে সেই কামধেনু চুরি করে রাজা তার রাজ্যে নিয়ে আসেন। বিষয়টি জানতে পেরে পরশুরাম রাজাকে হত্যা করে সেই কামধেনুটি আশ্রমে ফিরিয়ে আনেন। এদিকে কার্তবীর্যের পুত্ররা প্রতিশোধ নিতে রাতের আঁধারে জমদগ্নির আশ্রমে হানা দেয়। এরপর ধ্যানরত জমদগ্নিকে তারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। আশ্রম কুটিরে পিতার বীভৎস মরদেহ দেখে ক্ষুব্ধ পরশুরাম একাই কার্তবীর্যের সব পুত্রকে বধ করেন।
পরবর্তীকালে তিনি ক্ষত্রিয়দের উপর এতটাই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়েন যে একুশবার তিনি পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেন। প্রথমবার পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়শূন্য হওয়ার পর কীভাবে পরশুরাম আরও বিশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন, তা জানতে হলে সে সময়ের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে একটু ধারণা নিতে হবে। তৎকালীন সমাজে ব্যক্তির কর্মের ভিত্তিতে তার বর্ণ নির্ধারিত হতো। যারা রাজ্য পরিচালনা ও যুদ্ধের কাজে নিয়োজিত থাকতেন, তারাই ক্ষত্রিয় বলে বিবেচিত হতেন।
যাইহোক, ক্ষত্রিয়দের হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে পরশুরাম পাঁচটি হ্রদ তৈরি করেন। কিন্তু তারপরই তার ভীষণ অনুশোচনা হয়। তিনি পিতৃপুরুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং অনুরোধ করেন, যাতে পাঁচটি হ্রদ পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। পরশুরামের পিতৃপুরুষ তাকে পাপমুক্ত করেন এবং পাঁচটি রক্ত হ্রদ একসাথে সমন্তপঞ্চক বা কুরুক্ষেত্র বলে পরিচিতি লাভ করে।
পরশুরাম ছিলেন কুরু পিতামহ ভীষ্ম ও কর্ণের অস্ত্রগুরু। একদা ভীষ্ম তার সৎ ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে আসেন। কাশীরাজের বড় মেয়ে অম্বা জানান যে, তিনি আগে থেকে শল্যরাজকে স্বামী হিসেবে মেনে নেয়ায় বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন ভীষ্ম অম্বাকে শল্যরাজের কাছ পাঠিয়ে দেন। কিন্তু শল্যরাজ অম্বাকে আর গ্রহণ না করায় অম্বা ভীষ্মের কাছে ফিরে আসেন এবং তাকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ জানান।
কিন্তু ভীষ্ম আজন্ম ব্রহ্মচারী থাকার প্রতিজ্ঞা করায় তার পক্ষে অম্বাকে বিয়ে করা সম্ভব নয় বলে জানান। অম্বা তখন পরশুরামের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। পরশুরাম এসেও ভীষ্মকে এই বিয়েতে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন। তখন পরশুরামের সাথে ভীষ্মের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়। ২৩ দিন যুদ্ধের পরও পরশুরাম ভীষ্মকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেন, জীবনে আর কোনো ক্ষত্রিয়কে অস্ত্রশিক্ষা দেবেন না। এরপর পরশুরাম মহেন্দ্র পর্বতে মহাদেবের কঠোর তপস্যায় ব্রতী হন।
এর কিছুকাল পরে মহাবীর কর্ণ অস্ত্রশিক্ষা লাভের জন্য পরশুরামের কাছে উপস্থিত হন। কর্ণ জানতেন যে, পরশুরাম ক্ষত্রিয়বংশজাত কোনো ব্যক্তিকে অস্ত্রশিক্ষা দেবেন না। তাই কর্ণ নিজের পরিচয় গোপন করে পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা নিতে থাকেন এবং নিজেকে একজন বড় ধনুর্বিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
গুরুর কাছ থেকে বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হন কর্ণ। কিন্তু একদিন পরশুরাম কর্ণের ছলনার কথা জানতে পারেন। মিথ্যে পরিচয় দিয়ে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করায় পরশুরাম কর্ণের ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। তিনি কর্ণকে অভিশাপ দেন যে, অন্তিম মুহূর্তে কর্ণ পরশুরামের কাছে পাওয়া বড় বড় অস্ত্রের ব্যবহারের কৌশল ভুলে যাবেন। এ কারণেই কুরুক্ষেত্রে কর্ণের করুণ মৃত্যু ঘটেছিল।
রামায়ণ ও মহাভারত দুইটি ভিন্ন যুগের কাহিনী হলেও এই দুই মহাকাব্যেই তার উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। মহেন্দ্র পর্বতে দীর্ঘদিন তপস্যা করার পর প্রচুর ব্রহ্মতেজ অর্জনের পর পরশুরাম পর্বত থেকে নেমে আসেন। সমতলে নেমেই প্রথমে তিনি অযোধ্যার রাজা রামের মুখোমুখি হলেন। রাম তখন সবে হরধনু ভঙ্গ করেছেন। এই হরধনুটি পরশুরাম জনক রাজাকে উপহার দিয়েছিলেন। জনকরাজ শর্ত রেখেছিলেন যে এই ধনুকে যে ব্যক্তি গুন পরাতে পারবেন, তার সঙ্গেই তিনি কন্যা সীতার বিয়ে দেবেন। রাম সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সীতাকে বিয়ে করেন। হরধনু ভঙ্গের কথাটি জানতে পেরে এমনিতেই পরশুরাম রামের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন।
রামকে দেখেই আবার সেই পুরনো অহংকারী পরশুরাম ফিরে এলেন। তিনি রামকে বললেন রামের যদি এতই শক্তি, তবে তিনি যেন তার বৈষ্ণবী ধনুকে গুন পরিয়ে দেখান। আর রাম যদি এতে ব্যর্থ হন তাহলে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে বলে চ্যালেঞ্জ করেন পরশুরাম। এরপর বৈষ্ণব ধনু নিয়ে পরশুরামের তপস্যার্জিত সমস্ত শক্তি বিনষ্ট করেন রাম। ফলে পরশুরামের তেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এরপর ইনি নির্বীর্য হয়ে রামচন্দ্রকে পূজা ও প্রদক্ষিণ করে মহেন্দ্র পর্বতে ফিরে যান।
আর এভাবে পরশুরাম না মরে বেঁচে রইলেন। পুরানমতে, পরে অবশ্য পূর্বপুরুষদের কাছে ক্ষমা স্বীকার করে মোক্ষলাভ করেন তিনি।