You are currently viewing ঋষ্যশৃঙ্গঃ মাথায় শিং ওয়ালা এক মুনির কাহিনী || Life History of Rishyashringa Muni ||

ঋষ্যশৃঙ্গঃ মাথায় শিং ওয়ালা এক মুনির কাহিনী || Life History of Rishyashringa Muni ||

সনাতন এক্সপ্রেসের আগের ভিডিওগুলোতে আমরা আলোচনা করেছি অদ্ভুত দর্শণ, আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বিষ্ময়কর জন্মকথা সম্পন্ন বহু মুনি ঋষিদের কথা। অষ্টাবক্র ,দধিচী, অগস্ত্য, দুর্বাসা, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, ভৃগু, মার্কণ্ডেয়, এবং সপ্তর্ষিবৃন্দসহ অনেক ঋষিদের জীবন কাহিনী ও তাদের জীবনের সব অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন সনাতন এক্সপ্রেস চ্যানেল থেকে। তবে আজ আমরা যে মুনির জীবন কাহিনী বলতে চলেছি তা আরও বেশী রোমাঞ্চকর ও আশ্চর্যজনক। এই মুনির নামের সাথে জড়িয়ে আছে স্বর্গীয় অপ্সরা উর্বশী, কশ্যপ মুনির পুত্র বিভাণ্ডক ও রাজা দশরথ কন্যা তথা শ্রীরামচন্দ্রের দিদি শান্তার নাম। তাছাড়া পুত্রেষ্টি যজ্ঞের মাধ্যমে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম হওয়ার পিছনেও রয়েছে এই ঋষ্যশৃঙ্গের বিরাট ভূমিকা। তাহলে চলুন দর্শক মূল কাহিনীতে প্রবেশ করা যাক। তবে শুরু করার আগে আপনাদের কাছে অনুরোধ ভিভিওটি ভালো লাগলে কমেন্ট বক্সে একবার মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের নাম লিখে যাবেন।

পুরাকালের কথা, একদা মহর্ষি কশ্যপের পুত্র বিভাণ্ডক তাঁর নিবিড় তপোবনে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র বিভাণ্ডকের এই তপস্যায় কিছুটা বিচলিত হলেন। তিনি ভাবলেন তাঁর সিংহাসন দখল করার জন্যই হয়ত বিভাণ্ডক মুনি এই কঠিন তপস্যায় রত। তাই গতানুগতিকভাবে তিনি স্বর্গীয় অপ্সরা উর্বসীকে পাঠালেন মুনির তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য। ইন্দ্রের আদেশে উর্বশী নেমে এলেন মর্ত্ত্যে, উপবিষ্ট হলেন বিভাণ্ডক মুনির সামনে। আপনারা ইতিমধ্যেই জেনে থাকবেন স্বর্গীয় এই অপ্সরাগণ তাদের রূপ-যৌবনে প্রলুব্ধ করে ইন্দ্রের স্বার্থ হাসিল করেছেন বহুবার। এবারও তাঁর ব্যত্যয় হল না। উর্বশীর অপার্থিব রূপ-লাবন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন ঋষি বিভাণ্ডক। এবং তাদের মিলনে জন্ম নিল একটি পুত্র সন্তান। তার নাম ঋষ্যশৃঙ্গ। তবে ঋষ্যশৃঙ্গের জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আরও দুটি কাহিনী প্রচলিত। ২য় কাহিনীতে বলা হচ্ছে। উর্বশীর ছলা-কলায় শুক্র স্খলিত হয়েছিল ঋষি বিভাণ্ডকের। এবং পরবর্তীতে এক তৃষ্ণার্ত হরিণী জলের সাথে তা পান করার ফলে জন্ম হয়েছিল ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির। ৩য় কাহিনী অনুসারে জানা যায়, একদা এক স্বর্গীয় অপ্সরা অভিশপ্ত হয়ে হরিণীর রূপ প্রাপ্ত হয়ে মর্ত্ত্যে বিচরণ করছিলেন। এসময় বিভাণ্ডক মুনির আশ্রমের সামনে অপ্সরা উর্বশী উপস্থিত হয়েছিলেন মুনিকে প্রলুব্ধ করে ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য। এরপর স্নানরতা উর্বশীর দিকে বিভাণ্ডক মুনির দৃষ্টি পড়লে তাঁর শুক্র স্খলিত হয়ে নদীতে পতিত হয়। এরপর নদীতে জল্পান করতে গিয়ে হরিণীর রূপ পাপ্ত হওয়া সেই অপ্সরা জলের সাথে শুক্র পান করে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। ফলে জন্ম হয় ঋষ্যশৃঙ্গের। এবং হরিণীরূপী অপ্সরাটিও তাঁর অভিশাপ থেকে মুক্ত হন।

আরও পড়ুনঃ  কে এই আদ্যাশক্তি মহামায়া? কীভাবে তার শত সহস্র রূপে প্রকাশ? Who is Adyashakti Mahamaya?

হরিণীর গর্ভে জন্ম হওয়ার দরুন তাঁর মাথায় ছিল হরিণের মত শৃঙ্গ বা শিং। এবং এই কারনেই তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল ঋষ্যশৃঙ্গ। তবে এই তিন কাহিনীতেই মূল প্রভাবকের কাজটি করেছেন অপ্সরা উর্বশী। ঋষ্যশৃঙ্গের জন্মের পর তাঁর কার্যসিদ্ধি ঘটলে উর্বশী ঋষ্যশৃঙ্গকে ফেলে ফিরে গিয়েছিলেন স্বর্গে। এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হন বিভাণ্ডক মুনি। প্রথমত রূপ-যৌবনের ফাঁদে ফেলে তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করা এবং দ্বিতীয়ত ঋষ্যশৃঙ্গকে ফেলে স্বর্গে ফিরে যাওয়া এই দু কারনে নারী জাতির প্রতি বিতৃষ্ণার্ত হলেন বিভাণ্ডক মুনি। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নিজেও তাঁর সারা জীবন নারী সংশ্রব থেকে পৃথক থাকবেন এবং তাঁর পুত্রের জীবনেও কোন নারীর আগমন ঘটতে দেবেন না। সুতারাং পুত্রকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন গভীর অরণ্যে। সেখানে নির্জন, নিস্তব্ধ পরিবেশে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। গহীন, নির্জন অরণ্যে প্রকৃতির কোলে দীর্ঘকাল তপস্যা করলেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। তাঁর জীবনে তিনি তাঁর পিতা বিভাণ্ডক ছাড়া আর কাউকেই কখনো দেখেননি। কোন নারীর ছায়াও কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি তাকে। এরকম কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করেই জীবন কাটছিল তাঁর।

এবার আসি রাজা দশরথের ঘটনায়। একদা রঘুবংশীয় রাজা দশরথের প্রথমা স্ত্রী মাতা কৌশল্যা সন্তানসম্ভবা হলেন। সমস্ত অযোধ্যায় তখন খুশির রোল। সবাই ভেবেছিলেন এ রাজ্যের ভাবী রাজা জন্ম নিতে চলেছেন। রাজা দশরথও কায়মনোবাক্যে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করছিলেন একটি পুত্র সন্তান লাভ করার জন্য। কিন্তু রানী কৌশল্যা জন্ম দিলেন একটি কন্যা সন্তানকে। ফলে নিরাশ হলেন সবাই। এসময় সেখানে উপস্থিত হন মাতা কৌশল্যার বোন ভার্ষিণী ও ভগ্নিপতি লোমপাদ। এই লোমপাদ বা মতান্তরে রোমপাদ ছিলেন অঙ্গ দেশের রাজা। তবে এই দম্পত্তি ছিল নিঃসন্তান। তাই তাঁরা এই শিশুকন্যাটিকে দত্তক নেন এবং নাম দেন শান্তা।

অঙ্গরাজ্যে পালক পিতা লোমপাদ ও পালিকা মাতা ভার্ষিণীর পরম আদরে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন শান্তা। সুজলা সুফলা অঙ্গরাজ্যে সমস্ত প্রজারাও প্রম সুখে বসবাস করছিলেন। এর মধ্যে একদিন ঘটে গেলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। একদিন রাজদরবারে এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ এসেছিলেন কোন একটি সমস্যা সমাধানের আবেদন নিয়ে। কিন্তু রাজা ও তাঁর সভাসদদের অন্য আলোচনার মাঝে সেই ব্রাহ্মণের কথা অনিচ্ছাকৃতভাবেই কর্ণগোচরে পৌঁছায়নি রাজা লোমপাদের। এতে রুষ্ট হন ব্রাহ্মণ তিনি ভেবেছিলেন রাজা হয় তাঁর কথা ইচ্ছা করেই কর্ণগোচর করেননি। তাই তিনি অভিশাপ দিলেন অঙ্গরাজ্যে বর্ষন থেমে যাবে। সমগ্র রাজ্য প্রচণ্ড খরায় ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। দেবরাজ ইন্দ্রও ব্রাহ্মণের অভিশাপ অনুসারে অঙ্গরাজ্যে বর্ষণ বন্ধ করে দেন। ১২ বছর ব্যাপী প্রচন্ড খরায় সুজলা সুফলা অঙ্গরাজ্য পরিণত হল মরুভূমিতে। প্রিয় রাজ্যের এমন দুর্দশা দেখে রাজা লোমপাদ শরনাপন্ন হলেন তাঁর রাজ্যের পণ্ডিতদের। পণ্ডিতগণ গননা করে বললেন, এমন একজন ব্রহ্মচারী মুনিকে খুজে বের করতে হবে যে এখনও পর্যন্ত কোন নারীকে দর্শন করেনি। অতঃপর তাঁর দ্বারা বৃষ্টি কামনা করে যজ্ঞ করলেই রাজ্যের এই খরা দূর হবে। তবে কীর্ত্তিবাসী রামায়ণে বলা হয়েছে, অঙ্গদেশের রাজকন্যা শান্তা ঋতুমতী হওয়ার সত্ত্বেও অনুঢ়া থাকার কারনেই দেশে অনাবৃষ্টি ঘটছে। তাই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির সাথে তাঁর বিবাহ দিলেই এই অনাবৃষ্টি নিরসন হবে।

আরও পড়ুনঃ  পূর্ণিমা তালিকা ২০২৩ (১৪২৯-১৪৩০) || নিশিপালন ও উপবাসের তালিকা || ভারত ও বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী ||

যাইহোক, পণ্ডিতগনের গননা মোতাবেক ঋষ্যশৃঙ্গই ছিল সেই মুনি যে আজ পর্যন্ত কোন নারীর ছায়া স্পর্শও করেননি। কিন্তু তাকে অঙ্গরাজ্যে আনয়ন করার উপায় কি? তাঁর পিতা অমোঘবীর্য, তেজস্বী ও অত্যন্ত ক্রোধী বিভাণ্ডক মুনি কিছুতেই তার পুত্রকে অঙ্গরাজ্যে প্রেরণ করতে রাজি হবেন না। এমতাবস্থায় অঙ্গরাজ্যের কিছু অপরূপ সুন্দরী রারাঙ্গনারা দায়ীত্ব্ব নিলেন ঋষ্যশৃঙ্গকে অঙ্গরাজ্যে আনয়ন করার জন্য। তাঁরা ঋষি বিভাণ্ডকের অনুপস্থিতিতে উপস্থিত হলেন ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রমে। তাদেরকে দেখে তাঁর নিজের মত একজন মুনি মনে হলেও তাদের ছলাকলায় মোহাবিষ্ট হলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। এরপর তাদের সাথে পিতার বিনা অনুমতিতেই তিনি পৌছালেন অঙ্গরাজ্যে। তাঁর পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত হল অনাবৃষ্টি নিবারণার্থে যজ্ঞ। যজ্ঞ শেষে তুমুল বর্ষণে প্লাবিত হল অঙ্গরাজ্য। ধরিত্রী মাতা আবারও তাঁর করুনাধারা প্রবাহিত করে ফুল ফলে ভরে দিলেন রাজ্য। প্রজারা আনন্দে উল্লাস করতে লাগলেন এবং ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। আর রাজা লোমপাদ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর পরম স্নেহে পালিত কন্যা শান্তাকে তুলে দিলেন ঋষ্যশৃঙ্গের হাতে। এরপর ঋষ্যশৃঙ্গ তাঁর পত্নী শান্তাকে নিয়ে ফিরে গেলেন গহীন বনে অবস্থিত তাঁর ছোট্ট আশ্রম কুটিরে।

এদিকে রাজা দশরথ তখনও পুত্রহীন। তাঁর মৃত্যুর পর অযোধ্যার রাজ্যভার কে সামলাবে? সারাক্ষণ এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকতেন তিনি। এসময় তাঁর মন্ত্রী সুমন্ত্র তাকে মনে করিয়ে দিলেন সত্যযুগে ভগবান সনৎকুমারের ভবিষ্যৎবাণী। সনৎকুমার ঋষিদের বলেছিলেন যে, অপুত্রক দশরথ যদি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে দিয়ে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন তাহলে তিনি বীর্যবান পুত্র লাভ করবেন। মন্ত্রী সুমন্ত্রের এই সুমন্ত্রণায় যেন আশার আলো দেখতে পেলেন তিনি। তিনি তাঁর মিত্র রাজা লোমপাদকে অনুরোধ করলেন জামাতা ঋষ্যশৃঙ্গকে আনয়ন করার জন্য। এরপর যথাসময় ঋষ্যশৃঙ্গ অযোধ্যায় আগমন করে রাজা দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞের পৌরহিত্য করেন। সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে উত্থিত পায়েস সেবা করার ফলে ভগবান বিষ্ণু চার অংশে জন্ম নিয়েছিলেন রাজা দশরথের ঘরে। অবশ্য অন্য একটি মতে, সফলভাবে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ সম্পন্ন করার দক্ষিণা হিসেবে তিনি রাজকুমারী শান্তাকে স্ত্রী হিসেবে দাবী করেছিলেন রাজা দশরথের কাছে এবং রাজা দশরথ পুত্রপাপ্তির মনোষ্কামনা পূর্ণ হওয়ার ফলে ঋষ্যশৃঙ্গকে কন্যাদান করেছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  মহাভারতের যুদ্ধের সেরা ১০ জন যোদ্ধা কারা? এবং এদের মধ্যেই বা কে শ্রেষ্ঠ?

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply