হিংসা সর্বদাই প্রেমের পরিপন্থী। চৈতন্যদেবের প্রেমধর্মে তাই হিংসার স্থান নেই। ভালোবেসে কাউকে যতটা আপন করে কাছে টেনে নেয়া যায়, হিংসার মাধ্যমে তা কখনোই সম্ভব নয়। আর এ কারণেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম প্রচারকারী অন্যতম সংস্থা ইসকনের জয়জয়কার আজ বঙ্গদেশের সীমা পেরিয়ে পৃথিবীজুড়ে পরিব্যাপ্ত।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের সময়কাল
পিতা জগন্নাথ মিশ্র তাঁর নাম রাখেন বিশ্বম্ভর। সুবর্ণ বর্ণ অঙ্গকান্তির জন্য তাঁকে গৌরাঙ্গ, গৌরহরি নামেও ডাকা হয়। আবার, দিগ্বজয়ীবিজিত নিমাই পন্ডিত নামে তিনি সকলের পান্ডিত্যের অহঙ্কার বিচূর্ণ করেছিলেন। হিংসা-দ্বেষ, জাতিভেদ ভুলিয়ে, অহিংসার বাণী শুনিয়ে, সাম্প্রদায়িকতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে, সকলের হৃদয় জয় করে চৈতন্যদেব প্রচার করেছিলেন বিশ্বমানবতার ধর্ম-প্রেমধর্ম, যা বৈষ্ণবধর্ম নামে সুবিদিত। বৈদিক শাস্ত্রে নির্দেশিত, শ্রীচৈতন্যদেবের প্রদর্শিত সেই বৈষ্ণব দর্শনই আজ প্রচারিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী, যার অপ্রতিরোধ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং- “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম। সর্বত্র প্রচার হেইবে মোর নাম।।”
এই বৈষ্ণবধর্ম তথা প্রকৃত সনাতন ধর্ম বিশ্বায়নে যে সংগঠনটি অর্ধশতাধিক বছর ধরে নিয়ত প্রগতিশীল, তা হলো আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) ১৯৮৬ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ভারতীয় সন্ন্যাসী কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেই ভবিষ্যদ্বাণী এবং নিজ গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করে পৃথিবীব্যাপী ভগবানের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। জগদ্ব্যাপী কৃষ্ণভক্তিরূপ প্রেমধর্ম প্রচার করার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাই এই সংস্থার মূল লক্ষ্য।
শ্রীচৈতন্যদেবের প্রদর্শিত বৈষ্ণব দর্শনের আদর্শ কীরূপ এবং ইসকন কীভাবে তা ধারণ ও প্রসারের মাধ্যমে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে, তারই একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো এই প্রবন্ধে।
বাঙালির হৃদয়ের ধন চৈতন্যদেব
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বাংলাভাষায় কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। তথাপি তিনি এমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁর নামানুসারে বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যযুগ নামে এক নবযুগের অভ্যুদ্বয় হয়। তাঁর অনিন্দ্য রূপমাধুরী, অমিয় বচন, অগাধ পান্ডিত্য এবং ধনী দরিদ্র, বিদ্ধান-মুর্খ, আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অপামর জনসাধারণের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং সকলকে প্রেমের শৃঙ্খলে বেঁধে মানবমুক্তির যে শান্তির পথ তিনি প্রদর্শন করেছেন- তা-ই সমগ্র বাংলার মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। তাঁকে নিয়ে নানা নামে, নানা ঢঙে রচিত হয়েছে বাংলাসাহিত্যের বিখ্যাত গ্রন্থসম্ভার- যেমন, চৈতন্যমঙ্গল, চৈতন্যভাগবত, ভক্তিরত্নাকর, অমিয় নিমাই চরিত ইত্যাদি।
সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীকৃত ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’। এতে চৈতন্যদেবের অনবদ্য জীবনীর পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত, তত্ত্ব, ও বৈষ্ণব দর্শনের সুবিস্তৃত চমৎমার বর্ণনা। এরও পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের আদর্শকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব কবিগণ রচনা করেছেন বহু গীতি।
আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিটি ইসকন কেন্দ্রে প্রতিদিন কয়েকবার করে গাওয়া হয় সেসকল বাংলা গীতি। সেগুলোর মর্মার্থ ও চৈতন্যমহাপ্রভুর জীবন-দর্শন উপলব্ধি করার অভিলাষে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বাংলা ভাষাকে আয়ত্ব করেছে। সুতরাং, বাঙালির বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর প্রতিটি দ্বারপ্রান্তে পৌছে দিতে যাঁর অবদান সর্বাগ্রে, তিনি আর কেউ নন, বাঙালি জাতির গর্ব শ্রীচৈতন্যদেব এবং তা সম্ভব হয়েছে ইসকন প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য শ্রীল প্রভুপাদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায়।
বাংলা সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যদেবের মাধ্যমেই প্রথম জীবনীসাহিত্যের প্রচলন শুরু হয়। বাংলাসাহিত্যের চৈতন্য-উত্তরযুগের বহু স্বনামধন্য সাহিত্যিক ছিলেন চৈতন্যগুণমুগ্ধ।
কাজী নজরুল ইসলাম চৈতন্যদেবের গুণ গেয়েছেন এভাবে-
শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “আমাদের বাঙালির মধ্য হইতেই তো চৈতন্য জন্মেছিলেন, তিনি তো বিঘা কাঠার মধ্যেই বাস করিতেন না, তিনি তো সমস্ত মানবকে আপনার করিয়াছিলেন, তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন।”
শ্রীচৈতন্যদেব প্রসঙ্গে শ্রীমৎ গৌররায় গোস্বামী তাঁর বৈদুর্য্য প্রবন্ধাবলীতে লিখেছেন- “ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকগণের বিপুল রচনা সম্ভারেও চৈতন্য চরিত, বৈষ্ণব দর্শন রসসাহিত্যের প্রভাব বহুলভাবে লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, কান্তকবি রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি শেখর কালিদাস রায়, বিদ্রোহী কবি নজরুল; সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র; অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র প্রভৃতির সাহিত্যকর্মে মহাপ্রভুর প্রেমধর্মের ও ভক্তিভাবের ভাবসম্মিলন লক্ষ্য করা যায় বিশেষভাবে।” বাঙালির হৃদয়ের ধন চৈতন্যদেব আজ শুধু বাঙালির নন, গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রাণপুরুষ।
বিদগ্ধজনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাব
শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব কেবল দীন-হীন, দরিদ্র মানুষের মধ্যেই পড়েছিল তা নয়। সমাজের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাও তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ঊড়িষ্যার মহারাজ প্রতাপরুদ্র, বিখ্যাত বেদান্ত-পন্ডিত শ্রী সার্বভৌম ভট্রাচার্য, দিগ্বিজয়ী পন্ডিত কেশব কাশ্মিরী, সপ্তগ্রামের জমিদার পুত্র রঘুনাথ দাস গোস্বামী, বিদ্যানগরের অধিকারী রায়রামানন্দ, গৌড়ের বাদশা হোসেন শাহ্ এর প্রধানমন্ত্রী শ্রী সনাতন গোস্বামী ও মন্ত্রী শ্রীরূপ গোস্বামী, চাঁদকাজী, হোসেন শাহের পূর্ববর্তী রাজা সুবুদ্ধি রায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে তাঁর প্রতি অনুরক্ত হন।
সকল জীবের প্রতি সম্মান দান
বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে, পরমেশ্বর ভগবান পরমাত্মারূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন (সর্বভূতান্তরাত্মা-কঠোপনিষদ-২.৯-১২); আবার, প্রতিটি জীব সেই পরমাত্মারই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ, যে কথা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূত সনাতনঃ। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষা দিয়েছেন-