একটা কাক পক্ষী সময়ের উর্দ্ধে উঠে ১১ বার অবলোকন করেছেন রামায়ণ, ১৬ বার অবলোকন করেছেন মহাভারত এবং দুবার অবলোকন করেছেন দক্ষযজ্ঞ। কিন্তু প্রতিবার কি একই ঘটনা ঘটতে দেখেছেন তিনি? সায়েন্স ফিকশনে টাইম ট্রাভেলিং এর ব্যাপারে তো আপনি নিশ্চই শুনেছেন। কিন্তু জানেন কি আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগেই টাইম ট্রাভেলিং বা সময়চক্রের উর্দ্ধে উঠে বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষন করেছেন কাকভূশুন্ডি নামের এক পক্ষী ঋষি। আজ জানাবো সেই কাকভূশুন্ডির কাহিনী। কিভাবে একটা সাধারন কাক পাখি এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন তার বিস্তারিত উপস্থাপন দেখতে পাবেন আমাদের আজকেরআয়োজনে।
কাকভূশুণ্ডি কে?
কাকভূশুন্ডি নামের যে কাক পাখির কাহিনী আজ আমরা বলতে চলেছি তিনি কিন্তু কোন সাধারন কাক নন। এমনকি প্রাথমিক অবস্থায় তিনি কাক ছিলেনও না। ত্রেতাযুগে অযোধ্যার কাছাকাছি একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভুশুণ্ডি নামের এক ব্রাহ্মণ। তার জীবন ছিল আরও দশটা ব্রাহ্মণ সন্তানের মত সহজ সরল। সারাদিন বেদ-উপনিষদের চর্চা আর ভগবান শিবের তপস্যা করেই কেটে যেত তার সময়। তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল সত্যকে উপলব্ধি করে মোক্ষলাভ করা। তবে নিয়তি বোধহয় তার জন্য অন্য কিছু লিখে রেখেছিল।
সেকালে লোমস মুনি নামে একজন শিবভক্ত ঋষি ছিলেন। এবং ভুশুণ্ডি নিজেও যেহেতু ভগবান শিবের ভক্ত ছিলেন, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন লোমস মুনির আশ্রমে গিয়ে তার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করবেন। তবে সেখানে ঘটে গেল এর ঠিক বিপরীত ঘটনা। লোমস মুনির ধ্যানভঙ্গ হওয়া বা অন্য কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভুশুন্ডির উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন লোমস মুনি। আর সেই ক্রোধে তিনি ভুশুন্ডিকে কাক হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দিয়ে বসেন। ফলে ততক্ষনাৎ ব্রাহ্মণ যুবক ভুশুণ্ডি পরিনত হলেন কদাকার কাক পক্ষীতে।
কাকভূশুণ্ডিকে ভগবান শিবের বরদান
তবে সাধারন ব্যাক্তির মত এই ঘটনায় হতাশায় নিমজ্জিত হননি ভুশুন্ডি। তিনি আরও কঠরভাবে শুরু করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের তপস্যা। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন ভগবান শিব। সেইসাথে তিনি ভুশুন্ডির মনের দুঃখও বুঝতে পারলেন। আর তাই তিনি তাকে আশির্বাদ করলেন, “হে পুত্র, তুমি কদাকার পক্ষীরূপ প্রাপ্ত হয়েছ বলে ব্যাথিত হয়ো না। আমি তোমাকে অমরত্ব, অসীম জ্ঞান ও সময়চক্রের উর্দ্ধে উঠে সৃষ্টিচক্র অবলোকন করার বর প্রদান করছি। যুগের পর যুগ ধরে জ্ঞান ও ভক্তির দিশারী হয়ে বিরাজ করবে তুমি।” তবে কোন কোন মতে ভগবান ব্রহ্মা বা ভগবান শ্রীরামচন্দ্র কাকভুশুন্ডিকে এই বরদান প্রদান করেছিলেন বলে জানা যায়। যাইহোক, লোমশ মুনির অভিশাপ যেমন অতি সাধারণ যুবক ভূশুন্ডির জীবন পাল্টে দিয়েছিল, তেমনি ভগবান শিবের বরদানও তার জীবনকে দান করল এক অন্য পথের দিশা।
শ্রীরামচন্দ্র ও কাকভূশুণ্ডি
এরপর রাজা দশরথের ঘরে যখন এক দিব্যশিশু জন্মগ্রহণ করলেন, তখন অযোধ্যাবাসীর মত তিনিও সেখানে হাজির হয়েছিলেন এই মহাজাগতিক ঘটনার আনন্দ আস্বাদন করার জন্য। বলা হয়, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র যে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর অবতার তা শুধুমাত্র গুটিকয়েক মহাত্মা জ্ঞাত ছিলেন। এবং এই মহাত্মাদের মধ্যে কাকভুশুন্ডিও ছিলেন অন্যতম। তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছিলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম রূপে ভগবান বিষ্ণুর জন্ম, বেড়ে ওঠা, বাজ্যপদ থেকে বঞ্চনা, মাতা সীতা ও লক্ষ্মনের সাথে মর্মান্তিক বনবাস, মাতা সীতার বিরহে প্রভু শ্রীরামের হাহাকার, রাবনের পরাজয় এবং অযোধ্যায় প্রতিষ্ঠিত রামরাজ্য। শুধু তাই নয়, শ্রীরামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিনি তার কাছ থেকে অর্জন করেছিলেন অসামান্য জ্ঞান। আর তাই তিনি তার দৃষ্টিকোণ থেকে রচনা করেছিলেন ভুশুণ্ডি রামায়ণ।
শ্রীকৃষ্ণ ও কাকভূশুণ্ডি
তবে শ্রীরামচন্দ্র তার পার্থিব লীলা শেষ করে বৈকুন্ঠে ফিরে গেলেও অমরত্বের বরে কাকভুশুন্ডি থেকে গেলেন মর্ত্যধামে। এল দ্বাপর যুগ। এযুগেও তিনি আবারও দেখা পেলেন ভগবানের। পরম সৌভাগ্যবান এই কাকপক্ষীটি আবারও দেখলেন ভগবান বিষ্ণু এলেন ব্রজের গোপাল হয়ে। উপভোগ করলেন এক দিব্য রাখাল বালকের মাখন চুরির লীলা, অসংখ্য অসুর ও রাক্ষস বধ, বৃন্দাবনের রাসলীলা এবং মহাভারতে তার অবদান। অর্জুনকে প্রদত্ব গীতার জ্ঞানও আহরণ করেছিলেন তিনি। শ্রীরামচন্দ্রের মত তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছেও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তার কাছ থেকেও অর্জন করেছিলেন আধ্যাত্মিক দর্শন, সময়চক্র, সৃষ্টিচক্র ও আত্ম-উপলব্ধির জ্ঞান।
গরুড়দেব ও কাকভূশুণ্ডি
কাকভুশুন্ডির জীবনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে গরুড়ের সাথে সাক্ষাৎ। তুলসী রামায়ণে বর্ণীত কাহিনী অনুসারে কাকভুশুন্ডি ছিলেন গরুড়দেবের উৎকৃষ্ট শিক্ষক। তিনি গরুড়দেবের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন শ্রীরামের তত্ব, ভক্তি ও জ্ঞানের পথ। তিনি তাকে শিখিয়েছিলেন ‘যোগবাশিষ্ঠ’ ও সময়ের চক্র।
তবে কাকভুশুন্ডির কাহিনী এখানেই শেষ নয়। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন প্রত্যেক কল্পে রামায়ণ ও মহাভারত একইভাবে পরিসমাপ্ত হয় কিনা। একারণে তিনি ১১ বার রামায়ণ ও ১৬ বার মহাভারত পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিবারই রামায়ণ ও মহাভারত শেষ হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা দিয়ে। অর্থাৎ, তার দেখা প্রতিবারের রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী এক ছিল না। তবে রামায়ন ও মহাভারতের বাইরে তিনি দুবার দক্ষযজ্ঞও পর্যবেক্ষন করেছেন। কিন্তু দক্ষযজ্ঞের ঘটনা প্রতিবার একইভাবে শেষ হওয়ার কারনে তিনি আর এই ঘটনা অবলোকন করার সিদ্ধান্ত নেন নি।
তবে আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না, আমাদের পৌরাণিক শাস্ত্র অনুসারে কাকভুশুন্ডি আজও জীবিত আছেন। আমাদের আশেপাশে কর্কশ শব্দ উৎপাদন করা অবহেলিত কাকপক্ষীদের মধ্যে কোন একটি পক্ষী হয়ত সেই মহাজ্ঞানী কাকভুশুন্ডি। আর তার নামানুসারেই দীর্ঘজীবী ব্যক্তিকে বাংলা বাগধারা নাম দিয়েছে ভূষণ্ডির কাক।
বাকী রইল টাইম ট্রাভেলিং এর কথা। বিজ্ঞান যেটাকে আজ কল্পনা করেছে মাত্র, তা আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে বাস্তবে ঘটিয়ে দেখিয়েছেন কাকভুশুন্ডি। সুতারাং অতীত বা ভবিষ্যতেও যে ভ্রমণ করা যায়, এই ধারনার কৃতিত্ব বিজ্ঞানের নয় বরং আমাদের সনাতন ধর্মের।
পরিশেষে আরেকটি কথা না বললেই নয়, আপনারা যারা ১১ বার রামায়ন ও ১৬ বার মহাভারত দর্শন কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন তারা আমাদের চ্যানেলের সপ্তর্ষিদের নিয়ে নির্মিত ভিডিওটি দেখতে পারেন। এর ফলে আপনি যুগ, মহাযুগ, মনন্ত্বর ও কল্প নিয়ে বিস্তারিত ধারনা প্রাপ্ত হবেন।