জানেন কি পৃথিবী এত সুন্দর কেন? পৃথিবী এত সুন্দর তার প্রধান কারন এর বৈচিত্রতা। পরিবেশ, প্রকৃতি, মনুষ্যকুল, প্রাণিকুল সবকিছুতেই বিরাজ করে অনন্ত বৈচিত্র। আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্মেও নিহিত আছে অগনিত মত, পথ ও বৈচিত্র। এখানে কেউ বা শাক্ত, কেউ বা শৈব, কেউ গাণপত্যের অনুগামী আবার কেউ বা বৈষ্ণব। এরকম আরো হাজারো পথ ও মতের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের প্রিয় সনাতন ধর্ম। আর এটাই সনাতনের মূল সৌন্দর্য। তবে আপনি ঈশ্বর সাধনার যে পথই চয়ন করুন না কেন, আপনার গন্তব্য কিন্তু সেই নিরাকার পরম ব্রহ্ম। বর্তমান সনাতন সমাজের একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে বৈষ্ণব ধর্ম। এটিও সনাতন ধর্মের ঈশ্বরপ্রাপ্তির একটি অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ পথ। আপনাদেরকে সেই পথের দিশা দেখাতেই সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজন। ভিডিওটি শেষ অব্দি দেখলে বুঝতে পারবেন, শুধুমাত্র মস্তক মুন্ডন করলে, নিরামিষ আহার করলে, শরীরে তিলক ধারন করলেই কোন ব্যাক্তি বৈষ্ণব হতে পারেন না। বৈষ্ণব হতে হলে আপনাকে নানাবিধ নিয়ম নীতিমালা অনুসরন করে সুনির্দিষ্ট পথে জীবন যাপন করতে হবে। আর সেই সকল বৈষ্ণবীয় গুনাবলি সম্পর্কে আপনাদেরকে জ্ঞাত করাতেই এই আয়োজন।
বৈষ্ণব হচ্ছেন ভগবানের নিত্য দাস। আর এই জীবের স্বরূপ হচ্ছে এই ভগবানের নিত্য দাসত্ব লাভ করা। এই মতে ভগবান বিষ্ণু এবং তাঁর অবতারগণ তথা রাম ও কৃষ্ণ, আদি ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর রূপে পূজিত হন। তবে বৈষ্ণব মতে সনাতন হিন্দুদের অন্যান্য আরাধ্য দেবতাদেরও স্বীকার করে নেওয়া হয়। বর্তমানে বৈষ্ণবরা সনাতন হিন্দু সমাজের অন্যতম বৃহৎ অংশ। সাম্প্রতিককালে ধর্মসচেতনতা, স্বীকৃতি ও ধর্মপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের বাইরেওউল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বৈষ্ণবদের সংখ্যা । ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে বৈষ্ণবধর্মের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখাটি।
সনাতন ধর্মের অন্যান্য শাখাসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য যেখানে মোক্ষ লাভ বা পরমব্রহ্মের সঙ্গে মিলন, সেখানে বৈষ্ণবদের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিষ্ণু বা তাঁর কোনো অবতারের সেবায় মায়াময় জগতের বাইরে ‘বৈকুণ্ঠধামে’ অনন্ত আনন্দময় এক জীবনযাপন। বৈষ্ণবগণ সাধারণত গুরু কর্তৃক দীক্ষিত হয়ে তাঁর অধীনেই বৈষ্ণব ধর্মানুষ্ঠান শিক্ষা করেন। দীক্ষার সময় শিষ্যকে দান করা হয় একটি নির্দিষ্ট মন্ত্র । এই মন্ত্রটিকে পূজার অঙ্গ রূপে সোচ্চারে বা অনুচ্চারে বারংবার আবৃত্তি করতে হয় দীক্ষিত শিষ্যকে।এবং এই বারংবার মন্ত্র আবৃত্তিকে বলা হয় জপ ।
তো প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বৈষ্ণবের সংজ্ঞা কিভাবে দেওয়া হয়েছে-
- পদ্মপুরাণ বলছে- “যিনি বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষিত হন এবং বিষ্ণুর পূজায় আত্মনিয়োগ করেন, তিনিই বৈষ্ণব। যিনি তা করেন না তিনি বৈষ্ণব নন।”
- গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মশাস্ত্রগুলিতেও বলা হয়েছে “যে বা যিনি বিষ্ণু বা কৃষ্ণের নামজপমাত্র পূজা করেন, তিনিই ধর্মানুশীলনের প্রশ্নে বৈষ্ণব বলে পরিগণিত হন।”
- চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে বলা হচ্ছে- “যিনি একবার মাত্র কৃষ্ণের পবিত্র নাম জপ করেছেন, তাঁকেই বৈষ্ণব বলা যায়। এই ধরনের ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ মানবীয় সত্ত্বা এবং পূজনীয়।”
- ভাগবত পুরাণঅনুসারে বৈষ্ণবদের সর্বোচ্চ সত্ত্বার তিন বৈশিষ্ট্য – ব্রহ্মণ, পরমাত্মা ও ভগবান – অর্থাৎ, যথাক্রমে, বিশ্বময় বিষ্ণু, হৃদয়যামী বিষ্ণু ও ব্যক্তিরূপী বিষ্ণু।
তবে বৃহন্নারদীয় পুরাণের ৫ম অধ্যায়ে বৈষ্ণবের প্রকৃত গুনাবলি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই বিশদ বর্ণনার সারমর্ম হচ্ছে-
- যাহারা সর্ব প্রাণীর হিতকারী, কাউকে হিংসা করেন না, জিতেন্দ্রিয় ও সব স্থানে শান্তি বজায় রাখেন,তাহারাই বৈষ্ণব।
- যাহারা কর্ম, মন এবং বাক্য দ্বারা কাউকে কষ্ট দেন না এবং কারো কাছে সাহায্য কামনা করেন না,তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহার ভগবানের গুণানুবাদ শ্রবণে সাত্ত্বিক বুদ্ধি হয় তিনি বিষ্ণু ভক্ত তথা বৈষ্ণব প্রধান।
- যাহারা সব সময় মাতাপিতার সেবা করেন, তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা ব্রহ্মচারী ও যতিগণের সেবা করেন এবং কখনোই পরনিন্দা করেন না, তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা সকলের মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করেন ও মানুষের কাজের প্রশংসা করেন, তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা সর্বভূতে আত্মবৎ দর্শন করেন এবং শত্রু মিত্রে সমদর্শী, তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা সত্যবাদী, সাধুসেবী, ধর্ম শাস্ত্র বক্তা, তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা গো-ব্রাহ্মণের সেবায় সর্বদা রত, তীর্থযাত্রা পরায়ণ, অন্যের শ্রীবৃদ্ধিদর্শনে প্রফুল্ল এবং হরিনাম কীর্তনে সর্বদা মগ্ন থাকেন তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা দেবগৃহ নির্মাণ করেন, কূপ, সরোবর প্রভৃতি খনন করিয়া দেন এবং যাহারা গায়ত্রী মন্ত্র নিষ্ঠার সাথে জপ করিয়া থাকেন তাহারা বৈষ্ণব।
- হরিনাম শ্রবণ করিলে আনন্দে যাহাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়, তাহারা বৈষ্ণব।
- তুলসী কানন দর্শন করিলে যাহারা প্রণাম করিয়া থাকেন এবং যাহাদের কন্ঠে তুলসী কাষ্ঠের মালা রয়েছে তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা আশ্রমচতুষ্টয় পালন করেন ও বেদ ব্যাখা করিয়া থাকেন তাহারা বৈষ্ণব।
- যিনি শিবে প্রীতি করেন, শিবে ভক্তি করেন, শিবের অর্চনা করেন, রুদ্রাক্ষ ও ত্রিপুণ্ড্র ধারন করেন, হরিনাম ও শিবনাম সংকীর্তন করেন তিনি বৈষ্ণব।
- যাহারা সকল বিষয়ে গুণধর তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা দেবাদিদেব শিব ও পরমাত্মা বিষ্ণুকে অভিন্ন ভাবেন তাহারা বৈষ্ণব।
- যাহারা শিবধ্যান, শিবকার্য্য, একাদশী ব্রত ও বিষ্ণু কার্য্য করেন তাহারা বৈষ্ণব।
- প্রিয় দর্শক, একজন বৈষ্ণব হতে হতে হলে কি পরিমান মানবীয়হ গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তা নিশ্চয় আপনারা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, বৈষ্ণব মানে কোন বিশেষ বেশভূষাধারী ব্যক্তি নন। অর্থাৎ, কোন ব্যাক্তির পোশাকের মাধ্যমে তিনি বৈষ্ণব নাকি বৈষ্ণব নন তা বোঝার কোন উপায় নেই। বরং কোন ব্যাক্তির আচার আচরন থেকেই প্রকাশ পায় তিনি বৈষ্ণব কি না।
যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে শত্রু সংহার করতে দেখে কি মনে হবে যে অর্জুন বৈষ্ণব?
যমরাজাকে দণ্ডদান করতে দেখে কি মনে হবে তিনি বৈষ্ণব?
আবার মহাদেবকে ভূত, প্রেত, পিশাচ পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে দেখে কি মনে হবে তিনি বৈষ্ণব?
অথচ এনারা সকলেই পরম বিষ্ণুভক্ত তথা বৈষ্ণব। এবং এই কারনেই বৈষ্ণবকে চেনা কঠিন। বৈষ্ণবের রূপটি তাঁর বাইরের বেশ নয়, তাঁর প্রকৃত রূপটি হচ্ছে তাঁর অন্তরের ভাব। তাই অনেক বৈষ্ণব আছেন যাদের আপাত দৃষ্টিতে বৈষ্ণব বলে চেনা যায় না। আবার অনেকে বৈষ্ণবের বেশভূষা ধারন করলেও সঠিক আচার আচরন ও মনোভাবের অভাবে বৈষ্ণব হয়ে উঠতে পারেন না।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে যেসকল বৈষ্ণব বিষ্ণুনামের প্রেমমাহাত্ম্য প্রচার ও বিষ্ণুভক্তি দান করে চলেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন নারদ। নারদমুনি যে বিষ্ণুভক্তি দান করেন, সেট হচ্ছে শুদ্ধ বৈষ্ণব ধর্ম। বিষ্ণুভক্তি তথা ভক্তির তিনটি স্তর তথা
- কর্মমিশ্রা ভক্তি,
- জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি
- এবং শুদ্ধভক্তি।
সমস্ত ধর্ম আচরণের মধ্যে ভক্তিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ এবং ভগবানের প্রতি প্রেম অর্জন করাই ভক্তির একমাত্র উদ্দেশ্য । আবার ভক্তির মধ্যে শুদ্ধভক্তিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। শুদ্ধভক্তির মধ্যেও প্রেমভক্তি শ্রেষ্ঠ। ভক্তিপথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রদর্শিত যে প্রেমভক্তি সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। মহাপ্রভু সেই প্রেমভক্তি দয়া করে আমাদের প্রদান করেছেন। বলাই বাহুল্য প্রেমভক্তি লাভের জন্য মহাপ্রভু কর্তৃক প্রদর্শিত পথটি হচ্ছে শুদ্ধ চিত্তে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করা।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥
এই শুদ্ধভক্তি অত্যন্ত অপূর্ব বস্তু এবং এই শুদ্ধভক্তি যে কোন ব্যক্তি লাভ করতে পারেন। আর এই হচ্ছে একজন বৈষ্ণব এর অন্তরের সারতত্ত্ব।
যেই ভজে সেই বড় অভক্তহীন ছার।
কৃষ্ণভজনে নাহি জাতিকুলাদি বিচার ॥
কিবা বিপ্র, কিবা ন্যাসী, শুদ্র কেনে নয়।
যেই কৃষ্ণ তত্তববেত্ত্বা সেই গুরু হয় ॥
বলা হচ্ছে–যেই ভজে সেই বড়। এখানে কোন রকম উপাধির বিচার নেই। আমি ব্রাহ্মণ নই, ক্ষত্রিয় রাজা নই, বৈশ্য বা শুদ্র নই, ব্রহ্মচারী নই, গৃহস্থ নই, বানপ্রস্থ নই, সন্ন্যাসীও নই। আমার একমাত্র পরিচয় হচ্ছে গোপীভর্তা যে কৃষ্ণ, সেই গোপীজনবল্লভ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের দাসের অনুদাসের দাস। আর সেটিই হল বৈষ্ণবের প্রকৃত পরিচয়।
তাহলে প্রকৃত বৈষ্ণব বলতে যাকে বোঝায় তিনি হলেন-
যারে দেখ’ তারে কহ “কৃষ্ণ” – উপদেশ।
আমার আজ্ঞায় গুরুবাঞ্ছা তাঁর’ এই দেশ।।
উপাস্যের মধ্যে কোন উপাস্য প্রধান?
শ্রেষ্ঠ-উপাস্য-যুগল রাধাকৃষ্ণ-নাম।।
এক কৃষ্ণনামে করে সর্ব্ব-পাপ ক্ষয়।
নববিধা ভক্তি পুর্ণনাম হৈতে হয়।।
অতএব যার মুখে এক কৃষ্ণনাম।
সেই ত’ বৈষ্ণব, করিহ তাহার সম্মান।।
কৃষ্ণনাম নিরন্তর যাহার বদনে।
সেই বৈষ্ণব-শ্রেষ্ঠ, ভজ তাহার চরণে।।
যাহার দর্শনে মুখে আসে কৃষ্ণনাম।
তাহারে জানিও‘বৈষ্ণব-প্রধান।।
অন্তরে নিষ্ঠাকর, বাহ্যে লোকব্যবহার।
অচিরেতে কৃষ্ণ তোমায় করিবেন উদ্ধার।।
প্রভু কহে, – মায়াবাদী কৃষ্ণে অপরাধী।
“ব্রহ্ম”, ”আত্মা”, ”চৈতন্য” কহে নিরবধি।।
কোটিজ্ঞানী-মধ্যে হয় একজন ‘মুক্ত’।
কোটিমুক্ত-মধ্যে ‘দুর্লভ’ এক কৃষ্ণভক্ত।।
ব্রহ্মান্ড ভ্রমিতে কোন ভাগ্যবান জীব।
গুরু-কৃষ্ণ-প্রসাদে পায় ভক্তিলতা-বীজ।।
জীবের ‘স্বরুপ’ হয় –কৃষ্ণের ‘নিত্যদাস’।
কৃষ্ণের ‘তটস্থা-শক্তি,’ ‘ভেদাভেদ-প্রকাশ’।।
কৃষ্ণ ভুলি যেই জীব- অনাদি-বহির্মুখ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার-দুঃখ।।
কভু স্বর্গে উঠায়, কভু নরকে ডুবায়।
দন্ড্যজনে রাজা যেন নদীতে চুবায়।।
কৃষ্ণ-নিত্যদাস জীব তাহা ভুলি’ গেল।
এই দোষে মায়া তারে গলায় বান্ধিল।।
সেই সে পরমবন্ধু, সেই পিতামাতা।
শ্রীকৃষ্ণচরণে যেই প্রেমভক্তিদাতা।।
সকল জন্মে পিতামাতা সবে পায়।
কৃষ্ণ গুরু নাহি মিলে, ভজহে হিয়ায়।।