You are currently viewing এত শক্তিশালী হয়েও বলরাম কেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি?

এত শক্তিশালী হয়েও বলরাম কেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি?

রাম ও কৃষ্ণ অবতার ধারণ করার সময় ভগবান বিষ্ণু সঙ্গে এনেছিলেন শেষনাগকে।  আজ্ঞে হ্যাঁ, যে নাগের উপরে ভগবান বিষ্ণু শায়িত থাকেন তিনিই শেষনাগ।  অর্থাৎ, শ্রীবিষ্ণু তাঁর শ্রীরাম অবতারে শেষ নাগকে এনেছিলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণ রূপে এবং দ্বাপরে তাঁর শ্রীকৃষ্ণ অবতারে শেষনাগকে এনেছিলেন জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা বলরাম রূপে।  সুতারাং বাস্তবে তেজদীপ্ত সর্প হওয়ার কারনে লক্ষ্মণ বা বলরাম অবতারেও তাঁদের সেই বল, তেজ ও ক্রোধের বহিপ্রকাশ আমরা দেখে থাকি।  তবে আমাদের আজকের আলোচনা লক্ষ্মণকে নিয়ে নয়।  আজ আমরা জানব মহাভারতের এক বিস্ময়কর চরিত্র বলরাম সম্পর্কে।  আপনারা নিশ্চই জানেন শ্রীবলরাম কি অতুলনীয় রকমের শক্তিশালী ছিলেন।  ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কানাইকে সাথে নিয়ে জয় করেছেন অগণিত যুদ্ধ সংগ্রাম।  বধ করেছেন অসংখ্য অত্যাচারী রাক্ষস, অসুর ও রাজাকে।  তাই বলাই বাহুল্য তাঁর সমসাময়িক সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাতীত তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করার ক্ষমতা আর কারো ছিল না।  তবে কেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করলেন না।  যেখানে ১৮ অক্ষৌহিনী সেনা এবং তাবড় তাবড় রথী মহারথীরা কুরুক্ষেত্রের মহারণে অংশ নিলেন, সেখানে তাঁর মত মহাবীর কিভাবে যুদ্ধ না করে নিজেকে গুটিয়ে রাখলেন? যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ছিলেনই বা কোথায়? তবে কি কুরুক্ষেত্রের যোদ্ধাদের মধ্যে এমন কেউ ছিল যাকে বলরাম ভয় পেতেন?  প্রিয় দর্শক, শ্রীবলরামের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগদান না করার পিছনে রয়েছে ৫টি অজানা কারন।  আর সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের জন্য আজ তুলে ধরা হল সেই বিষ্ময়কর কারনগুলো।  আশা করি এ আয়োজনে আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকবেন এবং ৪র্থ কারনটি মনোযোগের সাথে অনুধাবন করবেন।

১. শ্রীবলরামের নৈতিকতা

শ্রীবলরাম ছিলেন ভীম এবং দুর্যোধন এই দুজনেরই অস্ত্রবিদ্যার প্রশিক্ষক।  অর্থাৎ, শ্রীবলরাম তাঁর নিজের হাতে গদা চালনা এবং গদাযুদ্ধের নানাবিধ কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন এবং দুর্যোধনকে।  যখন তাঁর এই দুই শিষ্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিপরীত পক্ষভুক্ত হলেন, তখন গুরু হিসেবে কোন একজন শিষ্যের পক্ষাবলম্বন করা তিনি নীতিবহির্ভূত বলে মনে করেছিলেন।  আর শ্রীবলরামের এই ধর্মজ্ঞান এবং নৈতিকতা ছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তাঁর অংশগ্রহণ না করার প্রথম কারন।

আরও পড়ুনঃ  রামায়ণ থেকে মহাভারত পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এই ৬ জন || People Who Lived Across Treta to Dwapara Yuga ||

২. বলরামের নিরপেক্ষতা

সম্পূর্ণ মহাভারত জুড়ে শ্রীবলরাম চেষ্টা করেছিলেন নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে।  যদিও শ্রীবলরামের ভূমিকা কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ, তবুও নিরপেক্ষতা বজার রাখার স্বার্থে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন না।  আপনারা জানেন মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যে দুটি পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তারা হচ্ছে কৌরব ও পাণ্ডব।  এবং এই দুই পক্ষের সাথেই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল যদুবংশের।  তাই বলরামের কাছে কৌরব ও পাণ্ডবগণ উভয়েই ছিলেন সমান।  একারনে একদা দুর্যোধনকে শ্রীবলরাম কথা দিয়েছিলেন তিনি বা তাঁর ভাই কানাই কেউই এই যুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবেন না।  এবং তাঁর এই কথার সম্মানার্থে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষাবলম্বন করলেও অস্ত্র ধারণ করেন নি।

৩. শ্রীকৃষ্ণের  প্রতি বলরামের আনুগত্য ও মতবিরোধ

কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আনুগত্য ও মতবিরোধ ছিল বলরামের যুদ্ধ না করার অন্যতম কারন।  পার্থিব অবতারে বলরাম শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হলেও তিনি জানতেন বাস্তবে তিনি শ্রীকৃষ্ণের দাস ছাড়া আর কিছুই নন।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহে তিনি পূর্বজন্মে লক্ষ্মণ ও এ জন্মে বলরাম রূপে অবতার ধারণ করেছেন।  তবে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর আনুগত্য থাকলেও মতপার্থক্যও ছিল তুঙ্গে।  প্রথমত, বলরাম চেয়েছিলেন এই মহাযুদ্ধ যেন না ঘটে।  অন্যদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চেয়েছিলেন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে নতুন এক যুগের সূচনা।  আবার তিনি পাণ্ডবদের ন্যায্য রাজ্যাধিকারকে কখনোই স্বীকার করেননি।  এমনকি তিনি চাননি যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষাবলম্বন করুন।  তিনি বহুবার শ্রীকৃষ্ণকে যুদ্ধে পক্ষভুক্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানয়েছিলেন, তবে অর্জুনের প্রতি মিত্রসূলভ গভীর স্নেহের কারনে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন নি।  তাই একদিকে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আনুগত্য, অন্যদিকে মতবিরোধ।  এই দুই কারনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন তিনি।

৪. দুর্যোধনের প্রতি বলরামের পক্ষপাতিত্ব

দুর্যোধন ও কৌরবদের প্রতি পক্ষপাতিত্বও ছিল শ্রীবলরামের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার প্রধান কারণ।  আপনারা জানেন ভীম এবং দুর্যোধন দুজনেই বলরামের শিষ্য ছিলেন।  তবে মৌখিকভাবে বলরাম এই দুজনকেই সমান চোখে দেখতেন বলে দাবী করলেও, বাস্তবে তিনি ভীম অপেক্ষা দুর্যোধনকে বেশী স্নেহ করতেন।  সেইসাথে তিনি দুর্যোধনকে ভীমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং নিজের সমান গদাযোদ্ধা বলে মনে করতেন।  শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর নিজের বোন সুভদ্রার বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন দুর্যোধনের সাথে এবং পরবর্তীতে দুর্যোধনের কন্যা লক্ষ্মণার সাথে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র সাম্বের বিবাহ হওয়ার ফলে তিনি দুর্যোধনকে নিকট আত্মীয় বলে মনে করতেন।  দুর্যোধনের প্রতি তাঁর দূর্বলতা এতটাই তীব্র ছিল যে, দুষ্ট দুর্যোধন তাঁর নিজের ভ্রাতা শ্রীকৃষ্ণকে বন্দী করার প্রচেষ্টা করেছেন জেনেও তিনি কোন প্রতিবাদ করেননি।  এমনকি যুধিষ্ঠির ও শকুনির মধ্যকার পাশা খেলার ঘটনা ও পরিনামের জন্য তিনি যুধিষ্ঠিরকে অভিযুক্ত করেছিলেন।  এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ভরা রাজসভায় রজস্বলা দ্রৌপদীকে চূড়ান্ত রকমের অপমান করার সত্বেও তিনি কোন প্রতিবাদ বা প্রতিকার করেননি।  সবশেষে, কুরুক্ষেত্রের অন্তিম যুদ্ধে যখন শ্রীকৃষ্ণের ঈশারায় ভীম যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করে তাকে বধ করেছিলেন, তখন ভীমের উপরে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তিনি।  যদিও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যস্থতায় তিনি ভীমের উপরে কোন প্রহার করেননি, তবে কৌরবদের করা শত ছলনা, বঞ্চনা, নির্যাতন ও অপমান  উপেক্ষা করে ভীম কর্তৃক যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করাকে বড় করে দেখেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  রাম চরিত্রে অভিনয় করা ১৫ জন অভিনেতার আসল পরিচয় || 15 Actors Who Played The Character of Lord Rama ||

তো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হলে বলরামের পছন্দের পক্ষ ছিল কৌরবপক্ষ।  এবং তিনি যদি কৌরব পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তাহলে তাঁর প্রতিপক্ষে থাকবেন তাঁরই প্রভু জগতের প্রতিপালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।  একারনে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

৫. পূর্বনির্ধারিত ভবিষ্যৎ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আসল পরিচয় সম্পর্কে অন্য কেউ জানুক বা বা জানুক শ্রীবলরাম খুব নিবিড়ভাবে জানতেন।  তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু যেহেতু অবতার ধারণ করে এক বিশাল কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছেন সেহেতু ভবিষ্যতে কি ঘটবে বা এর চূড়ান্ত পরিনতি কি হবে তা শ্রীকৃষ্ণ আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।  সুতারাং শ্রীবিষ্ণুর রচিত এই বিশাল পরিকল্পনায় তিনি যুদ্ধ করুন বা না করুন চুড়ান্ত ফলাফলে তাঁর কোন প্রভাব পড়বে না।  আর তাই এসকল কারন বিবেচনা করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরুর প্রাক্বালে তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন তিনি।

বস্তুত শ্রীবলরামের চরিত্রের একদিকে ছিল অত্যন্ত সহজ সরল এক যদুবংশী অন্যদিকে তিনি ছিলে প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং ক্রোধ সম্পন্ন একটি চরিত্র।  একারনে দুর্যোধন তাঁর ছলনা দ্বারা এবং পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে বিষেদ্গার করে সহজেই বশে আনতে পেরেছিলেন বলরামকে।  তাই আপনি যত বেশি তাকে অধ্যয়ন করবেন তাকে বুঝে ওঠা তত বেশি কঠিন হয়ে পড়বে।

Rate this post

Leave a Reply