সনাতন হিন্দুদের প্রধান পুজ্য দেব দেবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন গনপতি গনেশ এবং সনাতন ধর্মের একটি বড় শাঁখা হচ্ছে গানপত্য যা মুলত দেব গনেশকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠিত। মানুষের শরীরের উপরে হস্তির মস্তক স্থাপন করে নির্মিত হয় গনপতির মুর্তি। আর গনেশকে কেন্দ্র করে মানুষের এত কৌতুহল মুলত এই হস্তিমুন্ডের জন্যই। অনেকে বলে থাকেন, আজকের যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্লাস্টিক সার্জারী বা কৃত্রিম উপায়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের একটা সুক্ষ্ম ইঙ্গিত হচ্ছে গনেশের পৌরাণিক চেহারা। বলা হয়ে থাকে পৌরাণিক যুগেই প্রচলন ঘটেছিল কসমেটিক সার্জারীর যা আজ আধুনিকতম রুপ ধারন করেছে একবিংশ শতাব্দীতে এসে। পৌরাণিক এই মূর্তির আড়ালে গণেশের বসার ভঙ্গি, শুঁড়, ভুঁড়ি, ছোট ছোট চোখ, দাত…প্রতিটি বিষয়েরই রয়েছে আলাদা আলাদা তাৎপর্য ।
গণেশের বড় মাথা নির্দেশ করে বড় মাপের ভাবনা, ও বড় চিন্তাকে৷এই কারনে গনেশের বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানের প্রমাণ মেলে পৌরাণিক বিভিন্ন আখ্যান ও উপাখ্যানে। তার ছোট ছোট চোখ আসলে দৃঢ়ভাবে মনঃসংযোগের প্রতীক ৷গণেশের শুঁড় আমাদেরকে শিক্ষা দেয় একই সাথে নমনীয় ও কঠিন হতে। এই শুড় দিয়েই হস্তি জলকেলী করে থাকে আবার প্রয়োজনে শুড় দিয়েই বাজাতে পারে প্রলয়ের দামামা। তার বড় কান হল ভাল করে শোনা আর অপ্রয়োজনীয় কথাকে বাতিল করে দেওয়ার চিহ্ন। গনেশের মোটা ভুঁড়ি জীবনকে উপভোগ করার প্রতীক৷তিনি বসেন এক পা ভাঁজ করা আর এক পা মাটিতে রেখে৷তার এই বিশেষ বসার ভঙ্গি নির্দেশ করে ওড়ার ইচ্ছে হোক আকাশ ছোঁয়া , কিন্তু পা থাকুক মাটিতে। তবে গনপতির শরীরের অন্যতম প্রধান আকর্ষনীয় অঙ্গ হল তার দুইটি দাত যা আসলে গজদন্ত। এই দুইএর মধ্যে আবার একটি দাত ভাঙা। বলা হয় মানুষকে সমস্ত রকম খারাপ চিন্তা ও ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেতার শক্তির প্রতীক গণেশের ভাঙা দাঁতটি ৷ তবে তার এই দাতটি ভাঙা কেন তার পিছনে রয়েছে দুটি পৌরাণিক কাহিনী। আসুন দর্শক জেনে নেওয়া যাক, সেই চমৎকার কাহিনী দুইটি।
গনেশের একদন্তী হওয়ার প্রথম কাহিনীটি মহাভারত কেন্দ্রিক। একসময় মহাঋষি বেদব্যাস স্থির করলেন তিনি রচনা করবেন মহাভারত | কিন্তু শ্লোক রচনা করে অত বড় মহাকাব্য লেখা তো কঠিন তাই, বেদব্যাস শরণাপন্ন হলেন ব্রহ্মার | প্রজাপতি ব্রহ্মা পরামর্শ দিলেন, গণেশের সাহায্য নিতে | সেইমতো তপস্যায় বসলেন বেদব্যাস | তার ভক্তিপুর্ণ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে আবির্ভূত হলেন মহাজ্ঞানী গণেশ | প্রার্থনা মোতাবেক বেদব্যাসকে সাহায্য করতে সম্মতও হলেন তিনি | কিন্তু শর্ত রাখলেন, বেদব্যাস এক লহমার জন্যও থামতে পারবেন না | থামলেই গণেশ বন্ধ করবেন রচনা লিখন|
বিপদ বুঝে পাল্টা শর্ত রাখলেন বেদব্যাসও | বললেন, তিনি থামবেন না | কিন্তু গণেশকেও সব শ্লোক বুঝে লিখতে হবে | আগে বুঝতে হবে | তারপর লিখতে হবে | তাতে সম্মত হলেন গণপতি | এরপর শুরু হল মহাভারত লেখা | বেদব্যাস ইচ্ছে করে জটিল শ্লোক রচনা করে বলতে লাগলেন | বুঝতে সময় নিলেন গণেশ | এতে বেদব্যাস যথেষ্ট সময় পেয়ে গেলেন পরবর্তী শ্লোক রচনার | এইভাবে একদিকে ব্যাস বলে চলেন | পার্বতী-পুত্র লিখে চলেন | লিখতে লিখতে পালকের কলম গেল ভেঙে | এ বার উপায় ? থামলে তো চলবে না | তাই গণেশ নিজের একটি দাঁত ভেঙে নিলেন | সেটাই হল মহাভারত লেখার কলম | যতই লেখো না কেন, গজদন্ত তো আর ভাঙবে না !
এভাবে লম্বোদরের দাঁত দিয়ে লেখা হল পৃথিবীর বৃহত্তম মহাকাব্য | মহাভারতে আছে হাজারের বেশি শ্লোক | শব্দসংখ্যা 1.8 মিলিয়নেরও বেশি | ভারতীয় পুরাণে এই আখ্যান আত্মত্যাগের এক বিরাট নজির যেখানে নিজ শরীরের অঙ্গের মায়া ত্যাগ করে মহাগ্রহন্থ লিপিবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় বদ্ধপরিকর ছিলেন গনেশজী | গণেশের দাঁত ভাঙা নিয়ে আছে আরও তত্ত্ব | তার সঙ্গেও জড়িত আত্মত্যাগ | কথিত আছে, শিবের বরে বলীয়ান হয়ে ২১টি বার ভগবান পরশুরাম ক্ষত্রিয় নিধন করেন | এরপর শিবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি পদার্পন করেন কৈলাস পর্বতে |
কিন্তু সেখানে ঢুকতে বাধা পান পরশুরাম | পাহারারত গণেশ জানান, শিব তখন নিদ্রামগ্ন | পরশুরামকে পরে আসতে হবে | এতে কুপিত পরশুরাম গণেশকে আক্রমণ করে বসেন | গণেশও সমানে সমানে লড়াই করতে থাকেন | কিন্তু শেষ অবধি পরশুরাম প্রয়োগ করেন নিজের কুঠার | কিন্তু এবার কোনও বাধা দেননি গণেশ | কারণ, কুঠারটি দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব | ফলে বিনা প্রত্যাঘাতে কুঠারাঘাতে ভেঙে পড়ল গণেশের একটি দাঁত | এখানেও আত্মত্যাগ | বাবার সম্মান ক্ষুণ্ণ না করতে প্রত্যাঘাতে বিরত থাকেন গণেশ | কার্যত উত্সর্গ করেন নিজের অঙ্গ |
সেই থেকে গণেশের নাম একোদন্ত | তবে প্রকৃত ঘটনা যাই হোক না কেন, গনেশের একটি দাত যে মহৎ উদ্দেশ্যে উতসর্গকৃত হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।