জটাটবীগলজ্জলপ্রবাহপাবিতস্থলে
গলেবলংব্য লংবিতাং ভুজংগতুংগমালিকাম্ ।
ডমড্ডমড্ডমড্ডমন্নিনাদবড্ডমর্বযং
চকার চংডতাংডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম্ ॥ 1 ॥
আজ্ঞে হ্যাঁ, এটাই সেই তুমুল জনপ্রিয় শিব তাণ্ডব স্তোস্ত্র। কিন্তু আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন না, এই অত্যন্ত জটিল এবং শ্রুতিমধুর স্তোত্রটি রচনা করেছিলেন স্বয়ং রাবণ। হ্যাঁ আমি সেই রাক্ষসরাজ বা লঙ্কাপতি রাবণের কথাই বলছি। তবে এই স্তোত্রের সাথেই জড়িয়ে আছে একটি মজার পৌরাণিক কাহিনী। আসুন সেই কাহিনীর মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাক দেবাদিদেব মহাদেব কেন রাবণকে লাথি মেরে কৈলাস পর্বত থেকে ফেলে দিয়েছিলেন এবং কৈলাসের দক্ষিণ দিকে যে কীলকের মত দাগ রয়ছে তাঁর বিস্তারিত কাহিনী।
আপনারা অনেকেই জানেন রাক্ষসপতি রাবণ ছিলেন শিবের পরম ভক্ত। তবে তাঁর ভক্তির মধ্যে সমর্পণের চেয়ে উগ্রতা ও অহংকারের পরিমান ছিল অনেক বেশী। একারনে শিব ও রাবণ সম্পর্কে অনেকগুলো পৌরাণিক কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়। তো একবার রাবণের ইচ্ছা হল তিনি তাঁর আরধ্য দেবাদিদেব মহাদেবের বাসস্থানে যাবেন। আপনারা অনেকেই জানেন হিন্দু পুরান ও সনাতন ধর্মশাস্ত্রে হর-পার্বতীর আবাসস্থল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে কৈলাস পর্বতকে। সুতারাং সুদূর লঙ্কা থেকে কৈলাসের দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করলেন তিনি। রাক্ষসরাজ্য পার হয়ে তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলেন মহা পবিত্র কৈলাস পর্বতের দিকে। তবে পদব্রজে বের হওয়ার আগে তিনি একটি জটিল এবং শ্রুতিমধুর স্তোত্র রচনা করেন এবং একইসাথে একটি রেবানা বা খঞ্জনী জাতীয় বাদ্যযন্ত্রও প্রস্তুত করেন।
অতঃপর, তিনি কৈলাসের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর বাদ্যযন্ত্রটি বাজিয়ে তারই রচিত শিব তাণ্ডব স্তোত্র গাইতে শুরু করলেন। আপনারা যারা শিব তাণ্ডব স্তোস্ত্রটি শুনেছেনে তাঁরা অবশ্যই জানেন, এই স্তোস্ত্রটি কতটা চিত্তাকর্ষক। যে কোন মানুষই তন্ময় হয়ে যান এই অসাধারন শিবের ভজন শুনে। তো এক পর্যায়ে ভোলানাথ শিবের দৃষ্টি-কর্ণের গোচরে আসলেন রাবণ। এরপর রাবণের কণ্ঠে সেই স্তোস্ত্র শ্রবণ করে মোহিত হলেন শিব। আপনারা জানেন, শিব অতি অল্পতে ক্রুদ্ধ হয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন, আবার তিনিই অতি অল্পতে সন্তুষ্ট হন ভোলানাথরূপে। তাই রাবণের বাদ্যযন্ত্রের সুর এবং ভজন গীতের মূর্ছনায় তন্ময় হয়ে গেলেন দেবাদিদেব। এক পর্যায়ে রাবণ পৌছে গেলেন কৈলাস পর্বতের পাদদেশে। তখনও তাঁর কণ্ঠে সেই সম্মোহনী সঙ্গীত এবং হাতে বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা। আর দেবাদিদেব মহাদেব কৈলাসের উপরে বসে রাবণের এই সঙ্গীত উপভোগ করছেন পুরোদমে। রাবণ বুঝতে পারলেন তাঁর আরধ্য শিব তাঁর ভজনে সম্মোহিত এবং সন্তুষ্ট। তাই তিনি এবার শুরু করলেন কৈলাসে আরোহন করা। কন্ঠে শিবের গীত ও হাতে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তিনি উঠে গেলেন কৈলাসের বেশ কিছুটা উপরে।
ঠিক এই সময়ে মাতা পার্বতীর নজরে আসে বিষয়টি। কেউ একজন শিবের তাণ্ডবীয় স্তোস্ত্র পাঠ করতে করতে কৈলাসের চুড়ায় উঠে আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ তো অসম্ভব। জগতের কোন প্রাণীরই এই শৃঙ্গে আরোহণ করার অধিকার নেই। এমনকি এই পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়াও নিষিদ্ধ। কিন্তু এই ব্যাক্তি কিভাবে এগুলো অমান্য করছেন? এতসব ভাবতে ভাবতে দেবী পার্বতী খেয়াল করলেন, দেবাদিদেব তখনও বুঁদ হয়ে বসে রাবণের সেই সঙ্গীত শ্রবণ করছেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেও মহাদেবকে চেতনায় আনতে পারলেন না। অন্যদিকে রাবণের সেই অবক্তব্য সঙ্গীত সমস্যা ক্রমে ক্রমে যেন বেড়েই চলেছে। এ যেন রীতিমত সুরেলা অত্যাচার। অবশেষে রাবণ যখন কৈলাস পর্বতের শীর্ষের একেবারে কাছে পৌঁছে গেলেন তখন দেবী পার্বতী অনেক চেষ্টা করে বাস্তবে ফেরালেন শিবকে। চৈতন্য ফিরে শিব যখন দেখলেন রাবণ তাঁর উগ্র ভক্তির আতিশয্যে হর-পার্বতীর আবাসস্থলে উঠে আসার উপক্রম করেছেন তখন তিনি তাঁর পা দিয়ে রাবণকে ঠেলে নিচে পাঠিয়ে দিলেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিচে পড়ে যাওয়ার সময়েও রাবণ তাঁর বাদ্যযন্ত্রটিকে তাঁর হাতে ধরে রেখেছিলেন। আর সেই কারনেই কৈলাস পর্বতের চুড়া থেকে নিচ পর্যন্ত একটি আঁচড়ের মত দাগের সৃষ্টি হয়। আপনারা যারা কৈলাস পর্বতকে ভালোভাবে খেয়াল করেছেন, তাঁরা হয়ত দেখে থাকবেন, কৈলাস পর্বতের দক্ষিন দিকে কীলকের মত একটি দাগ রয়েছে। মূলত রাবণের সেই বাদ্যযন্ত্রের আঁচড় থেকেই এই দাগের সৃষ্টি বলেই প্রমাণ দেয় সনাতন পুরাণ শাস্ত্র। তবে রাবণের রচিত শিব তাণ্ডব স্তোত্র নিয়ে আরও একটি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে পুরাণে। এ মতে কোইলাসের উপর দিয়ে পুষ্পক বিমান ওড়াতে না পেরে ক্রুদ্ধ রাবন কৈলাস পর্বতকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। এবং এই ঘনটার পরম্পরায় শিব তাণ্ডব স্তোত্র রচনা করেছিলেন তগিনি যা পরবর্তীতে রাবণানুগ্রহ নামে পরিচিতি পায়। আপনাদের আগ্রহ থাকলে আগামী কোন একদিন সেই কাহিনী নিয়ে হাজির হব আপনাদের সামনে। হর হর মহাদেব।