সরস্বতী পূজার দিনে কি পড়াশোনা করা যাবে? এই প্রশ্ন শুধু সাধারন পড়ুয়াদের নয়, এ প্রশ্ন আমাদের সকলের। আমরা নিজেরাও ছোটবেলা থেকেই জিজ্ঞাসা করে এসেছি সরস্বতী পূজায় পড়াশোনা করা যাবে কি না। তবে সাধারণভাবে আমরা যে উত্তরটি পেয়েছি সেটি হচ্ছে এদিন বই-পুস্তক অধ্যয়ন করা বা লেখা-লেখি নিষিদ্ধ। এদিন যদি লেখাপড়া করা হয় তাহলে নাকি দেবী সরস্বতীর কোপানলে পড়তে হবে বা দেবী সরস্বতী আমাদের উপরে অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু আমাদের সনাতন ধর্ম কি এতটাই সংকীর্ণ? সরস্বতী পূজার পরেই যদি আমাদের কোন পরীক্ষা থাকে তাহলেও কি এদিন পড়াশোনা করা যাবে না? আবার যেসকল দেশে দেবী সরস্বতীর পূজা অর্চনা করা হয় না, সেসব দেশে নিশ্চই সরস্বতী পুজার দিনে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কেউ বসে থাকেন না? তাহলে তাঁরা কিভাবে জ্ঞান বিজ্ঞানে এত এগিয়ে যাচ্ছেন? তাছাড়া খোদ ভারতবর্ষেই বঙ্গভূমি ছাড়া অন্য কোথাও এই নিয়ম নেই কেন?
আসুন কুসংস্কারের আবরণ ভেদ করে শাস্ত্রীয় বিধানের ভিত্তিতে এই সংশয় দূর করা যাক। জেনে নেওয়া যাক সরস্বতী পূজার দিন পড়াশোনা করা যাবে নাকি যাবে না। সরস্বতী পূজায় পড়াশোনা করা যাবে না বলে যে মতবাদ আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা কি আদৌ শাস্ত্রসম্মত নাকি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা লোকাচারের আবরণে ঢাকা এক কুসংস্কার মাত্র? তবে শুরু করার আগে আপনাদের কাছে অনুরোধ, আলোচনাটি তথ্যপূর্ণ মনে হলে কমেন্ট বক্সে একবার জয় মাতা সরস্বতী লিখে যাবেন।
আমাদের এই বঙ্গদেশে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে বা দেবী সরস্বতীর পূজার দিনে বহুকাল ধরে চলে আসা দুটি ঐতিহ্য হল এদিন নতুন পড়ুয়াদের হাতেখড়ি দেওয়া হয় এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের এদিন বিদ্যা অধ্যয়ন বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু এটি কি আসলে আমাদের শাস্ত্র-অনুমোদিত নাকি নিছক লোকাচার।
তো প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক আমাদের বেদাদি শাস্ত্রে এটি নিয়ে কি বলা হচ্ছে। বৈদিক রীতি অনুসারে সরস্বতী পূজার দিনে প্রচলিত হাতেখড়ি বা বিদ্যারম্ভ নামক আচারের প্রকৃত রূপটি হল বেদারম্ভ সংস্কার। আপনারা অনেকেই জানেন আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে যে ষোড়শ সংস্কারের কথা বলে হয়েছে তাঁর মধ্যে দ্বাদশ বা বারোতম সংস্কার হচ্ছে এই বেদারম্ভ সংস্কার। প্রাচীনকালে যেহেতু বেদাদি শাস্ত্র দিয়েই শিক্ষার্থীদের বিদ্যাশিক্ষা শুরু হত তাই বিদ্যারম্ভের আরেক নামই ছিল বেদারম্ভ। বেদাদি শাস্ত্র অনুসারে যে কোন দিনে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দ্বারা যজ্ঞের আয়োজন করে নতুন শিক্ষার্থীর বিদ্যালাভের শুভারম্ভ বা বেদ শিক্ষার সূচনা ঘটত। এই অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থাকতেন গুরু, শিষ্যসহ জ্ঞানী-গুণী অনেক মানুষ। তাই যদি সরস্বতী পূজার দিনে বিদ্যার্জন নিষিদ্ধ হত তাহলে আমদের বৈদিক শাস্ত্রে সেটার উল্লেখ থাকত। কিন্তু সেরকম কোন কিছুর উল্লেখ থাকা তো দূরের কথা তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে “স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ” অর্থাৎ, অধ্যয়নে প্রমাদ করবে না।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে সরস্বতী পূজা তো পৌরাণিক স্মার্ত পূজা এখানে বেদের বিধান কিভাবে প্রযোজ্য? আজ্ঞে হ্যাঁ আমাদের বর্তমান সরস্বতী পূজা বেদ নয় বরং পুরাণের আলোকে সম্পাদিত হয়। তাই এ বিষয়ে পুরাণ কি বলছে সেটিই মুখ্য। তাহলে দেখা যাক আমাদের পৌরাণিক শাস্ত্রে সরস্বতী পূজার দিন অনধ্যয়ন বা লেখাপড়া না করার কি বিধান দেওয়া হয়েছে।
মূলত সরস্বতী পূজার বিস্তৃত বিধি বর্ণিত হয়েছে দেবীভাগবত পুরাণে। এই পুরাণমতে মাঘী শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠান, দেবীর উদ্দেশ্যে মন্ত্রপাঠ ও মাতৃ বন্দনার বিধান। এরপর পরবর্তী তিথি তথা ষষ্ঠীতে বিদ্যারম্ভ করার বিধান। কিন্তু ষষ্ঠী তিথিতে বিদ্যারম্ভ করার বিধান থাকলেও পঞ্চমী তিথিতে অনধ্যয়ন বা বিদ্যাশিক্ষা না করার কোন বিধান পাওয়া যায় না। এছাড়াও দেবীভাগবত পুরাণ ব্যাতীত অন্যান্য পৌরাণিক শাস্ত্রেও দেবী সরস্বতীর পূজাপদ্ধতিতে অনধ্যয়ন বা পড়াশোনা না করা সম্পর্কিত কোন নিষেধাজ্ঞা বা সতর্কবার্তা পাওয়া যায় না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরস্বতী পূজায় যে বিদ্যাশিক্ষা করা যাবে না এই প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত হল কিভাবে? আসলে এখানেই কবি নীরব। বেশিরভাগ মানুষেরই এই বিধানের উৎপত্তি বা সূত্র সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারনা নেই। তাহলে চলুন দেখা যাক কিভাবে এই সংস্কারের প্রচলন ঘটল আমাদের সমাজে।
মধ্যযুগীয় স্মার্ত-সংস্কারক শ্রী রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব থেকে জানা যায়, “মস্যাধারং লেখনীঞ্চ পূজয়েন্ন লিখেত্ততঃ।” অর্থাৎ, দোয়াত ও কলম দিয়ে পূজা করবে, কিন্তু লেখালেখি করবে না। এ থেকে বোঝা যায়, শ্রী রঘুনন্দন সরস্বতী পূজার দিনে বিদ্যার্থীদেরকে লেখা লেখি থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিয়েছেন।
আবার মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ তার ১৯০৯ সালে রচিত স্মৃতিচিন্তামণি গ্রন্থে লিখেছেন, “যথা শ্রীদত্তধৃতম, শ্রী পঞ্চম্যাং লিখেন্নৈব্য ন স্বাধ্যায়ং কদাচন। বাণীকোপমবাপ্নোতি লিখনে পঠনেহেপি চ।।”অর্থাৎ, শ্রীদত্ত বলেছেন, শ্রীপঞ্চমীতে স্বাধ্যায় করবে না, লিখবে না। ঐ তিথিতে অধ্যয়ন করলে সরস্বতীর কোপভাজন হতে হয়।
মধ্যযুগীয় স্মার্ত-সংস্কারক শ্রী রঘুনন্দন বা মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ এদিন পড়াশোনা বা লেখালেখি বন্ধ রাখার কথা বলেছেন বৈকি তবে কেন বা কোন শাস্ত্রের বুনিয়াদে তাঁরা এই বিধান দিয়েছেন তা আজও জানা যায়নি। অপরদিকে মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ এই বিধানের নির্দেশদাতা হিসেবে যে শ্রীদত্তের কথা উল্লেখ করেছেন সেই শ্রীদত্ত মহাশয়ের কোন হদিস আজও মেলে নি।
তবে সরস্বতী পূজার দিনে পড়াশোনা বা লেখা লেখি বন্ধ রাখার আরও একটা কারন থাকতে পারে। আর সেটি হচ্ছে সরস্বতী পূজার দিনে দেবী সরস্বতীর পদতলে আমাদের পাঠ্যপুস্তক, দোয়াত-কলম প্রভৃতি জমাদানের একটা প্রাচীন রীতি চালু রয়েছে। সম্ভবত এই বিদ্যার উপকরণগুলো দেবীর পূজায় আটকে থাকার কারনে এদিন অনেকেই পড়াশোনা করতে পারতেন না। আর এটা থেকেই ক্রমে ক্রমে চালু হয়ে গিয়েছে যে সরস্বতী পূজায় বিদ্যাশিক্ষা করা নিষিদ্ধ।
তাই যে কোন বিষয়ের যৌক্তিকতা বিচার করাটাও আমাদের একটি পবিত্র দায়ীত্ব। এজন্যই স্মৃতিশাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, “যুক্তিহীনে বিচারে তু ধর্মহানি প্রজায়তে। ” অর্থাৎ, যুক্তিহীন বিচারে ধর্মহানি ঘটে। সুতারাং সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। বেদ-স্মৃতি বা পুরাণ শাস্ত্রের বিধান কে পাশ কাটিয়ে আপনি যদি হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ বা শ্রী রঘুনন্দনের বিধানকে শাস্ত্রীয় বলে মানতে চান তাহলে সেটা আপনার একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তাই আসুন আমরা যুক্তিহীন বিচার অবলম্বন করে ধর্মহানি ঘটানোর চেয়ে আমাদের সমৃদ্ধ প্রাচীন শাস্ত্রাদির আলোকে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে আনন্দ উদযাপন করি এবং একইসাথে অধ্যয়নে মনোযোগ দিয়ে জ্ঞানার্জনে উদ্বুদ্ধ হই।