নারী কি আসলেই দেবী?
সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একটি অলিখিত ধারনা সর্বদাই বিদ্যমান। আর তা হচ্ছে নারী মাত্রই মাতা আদ্যাশক্তির রূপ। কিন্তু আপনি কি কখনো নিজের চোখে দেখেছেন কোনও নারীকে দেবীর মতো জীবনযাপন করতে? নাকি নারীর দেবী হওয়ার বচন শুধুমাত্র এক শাস্ত্রীয় অলঙ্কার মাত্র? চলুন, আজ একটু চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করি “নারী কি আসলেই দেবী?”
তো প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, নারীত্ব ও দেবীত্ব নিয়ে শাস্ত্র কি বলছে। শ্রীশ্রী চণ্ডিতে দেবতারা দেবী মহামায়াকে স্তুতি করে বলেছেন, “स्त्रियः समस्ताः सकला जगत्सु” অর্থাৎ, হে দেবী, জগতের সকল নারী আপনার বিভূতি। খোদ আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থগুলোতেই যখন নারীকে দেবীর রূপ বলা হয়েছে সেখানে আর তর্কের জায়গা কোথায়?
কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, যে নারী বিনা কারনে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে, যে নারী ব্যাভিচারে লিপ্ত থাকে, যে নারী সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীলতাকে উস্কে দেয়, যে নারী বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত থাকে অথবা স্বামীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী নারীও কি দেবী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের অপ্রিয়, অস্বস্থিকর। তবুও এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা জরুরী। আমাদের জানা প্রয়োজন, দেবী শক্তির প্রকাশ কি সকল নারীর মধ্যে দেখা যায়? অথবা দেবীত্ব কি নারীর জন্মগত গুণ নাকি কঠোর সাধনা করে অর্জন করতে হয় দেবীত্ব?
খেয়াল করে দেখবেন, দুর্গাপুজো এলেই মা দুর্গার মত সাজগোজ করে এবং কপালে ত্রিনয়ন অঙ্কন করে ফটোশুট বা ভিডিচিত্র নির্মানে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে বহু নারী। সেই ছবি বা রিল আপলোড করা হয়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে। লাইক, কমেন্ট বা শেয়ারের বন্যায় ভেসে যায় সেসকল ছবি- ভিডিয়ো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাহ্যিক সাজসজ্জার মাধ্যমেই কি অর্জিত হল দেবীত্ব?
মোটেও না। প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে দেবীত্ব অর্জন করতে হলে কি করতে হবে?
এই প্রশ্নের সবচেয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে, দেবী হতে হলে আপনাকে দেবীত্বের চর্চা করতে হবে।
যেমন ধরুন, আমাদের বিদ্যা, বুদ্ধি, সুর-সঙ্গীত ও কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন দেবী সরস্বতী। সুতারাং কোন নারী যদি নিজের মধ্যে মাতা সরস্বতীর প্রকাশ ঘটাতে চায় তাহলে তাকে মাতা সরস্বতীর গুনগুলো নিজের আয়ত্বে আনতে হবে বা অন্তত চর্চা করতে হবে। আর তাই দেবী সরস্বতীর প্রকাশ নিজের মধ্যে ঘটাতে হলে একজন নারীকে অর্জন করতে হবে বিদ্যা, বুদ্ধি, সঙ্গীত, এবং কলা।
আবার অনেকে বাড়ির মেয়েদেরকে ঘরের লক্ষ্মী বলে থাকেন। কিন্তু সকল নারীইই কি মাতা লক্ষ্মীর রূপ? আপনারা জানেন মাতা লক্ষ্মী ধন সম্পদের দেবী। কিন্তু ধন সম্পদ এমনি এমনি এসে ধরা দেয় না। তার জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা। সুতারাং আপনি যদি সত্যি আপনার ঘরের লক্ষ্মী হতে চান তাহলে আপনাকে হতে হবে কঠোর পরিশ্রমী, মিতব্যায়ী এবং অর্জন করতে হবে বিপুল কর্মশক্তি।
আবার দেখুন নারী শাররীরিকভাবে পুরুষের তুলনায় দূর্বল হলেও আমাদের সনাতন ধর্মে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী হিসবে স্থান দেওয়া হয়েছে একজন দেবীকে। কি আশ্চর্য লাগে না? একজন নারী শক্তিতে কিভাবে পুরুষের থেকে শ্রেষ্ঠ হতে পারে? হ্যাঁ, আমাদের সমাজে বহু মানুষ এই ধারনা নিয়ে বসে থাকেন বটে, তবে বাস্তবতা কিন্তু ঠিক তার উল্টো। একটু ভাবুন তো, শারীরিক শক্তিই যদি শক্তি পরিমাপের একমাত্র মাপকাঠি হত তাহলে আফ্রিকার দেশগুলোই হত পৃথিবীর সেরা শক্তিধর। কারন আফ্রিকার অধিবাসীরা আকার আকৃতি ও শক্তিতে পৃথিবীর যেকোন জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় শক্তিশালী রাষ্ট্র বলতে আমরা বুঝে থাকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে অথবা খর্বকায় মানুষের দেশ চীনকে। শারীরিক শক্তি দিয়েই যদি প্রকৃত শক্তিশালী হওয়া যেত তাহলে আমেরিকা বা চীন কিভাবে আফ্রিকাকে শক্তিতে হারিয়ে দিল?
দুর্গাপুজো এলেই আমাদের মেয়েরা ভারী রকমের সাজসজ্জা করে মাতা আদ্যাশক্তির অনুরূপ রূপ ধারণ করার চেষ্টায় রত থাকেন। তাঁদের হাতে থাকা ত্রিশূল বা কপালে অঙ্কিত ত্রিনয়ণ দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে তিনি আসলে মানবী নাকি দেবী। কিন্তু বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনি যদি শক্তির দেবী দুর্গা বা কালী হতে চান তাহলে আপনার এসকল বাহ্যিক সাজসজ্জার কোনরকম প্রয়োজন নেই। শক্তির দেবী হতে হলে আগে নিজেকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে আপনাকে। আপনারা জেনে থাকবেন শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ, চণ্ড-মুণ্ডসহ অসংখ্য অসুর যখন দেবী কৌশিকীর উপরে আক্রমন করেছিলেন তখন তিনি কিন্তু শুধুমাত্র নিজের শারীরিক শক্তি দ্বারা তাদেরকে পরাজিত করেননি। তিনি একাধারে প্রয়োগ করেছেন শারীরিক শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা, সাহায্য নিয়েছিলেন দেবী সপ্তমাতৃকার এবং কৌশলে রক্তবীজের রক্ত পান করিয়েছিলেন দেবী চামুণ্ডাকে দিয়ে। সুতারাং শক্তি হচ্ছে বুদ্ধি, বল, সমন্বয় ও সাহসের একত্রিত রূপ।
তাই আপনি যদি নিজের মধ্যে দেবী দুর্গা বা কৌশিকী অথবা চামুণ্ডা বা কালীকে ধারণ করতে চান তাহলে আপনার উপরে আসা আঘাতকে রুখে দেওয়ার মত শক্তি আপনাকে নিজেকেই অর্জন করতে হবে। ঠিক যেমন রানী লক্ষ্মীবাই নিজের সন্তানকে পীঠে বেঁধে, হাতে তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ার পৃষ্ঠে চেপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন যুদ্ধভূমিতে।
তবে হ্যাঁ, প্রত্যেকটা নারীই কোন না কোন দেবীত্বের গুণ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। যেমন নিজের সন্তানের উপরে আসন্ন বিপদ দেখে নারী যে রূপ ধারণ করেন সেটিই দেবী চামুণ্ডার রূপ। একজন নারী যখন তার সন্তানকে শিক্ষা দেন তখন তিনি সরস্বতী, তিনি যখন পরিবারের সকলের জন্য ভোজন প্রস্তুত করেন তখন তিনি অন্নপূর্ণা, তিনি যখন অসুস্থ স্বামী-সন্তান বা শ্বশুর-শাশুড়িকে সেবাযত্ন করেন তখন তিনি দেবী শীতলা, তিনি যখন সংসারের আয়-ব্যায়ের মধ্যে সমন্বয় করে সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হন তখন তিনি মহালক্ষ্মী। আবার ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে এতসব গুরুদায়িত্ব সামলে নারীরা অনেকেই প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। নারীর এই বহুবিধ কর্ম যুগপৎভাবে সম্পাদন করার ক্ষমতা পরাজিত করেছে পুরুষের কর্মশক্তিকেও। আর একহাতে এতসব কাজের ভার নিজ কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্যই তিনি দশভূজা দেবী দুর্গার পার্থিব রূপ।
মনে রাখতে হবে নারী মাত্রই দেবী। কিন্তু তা শুধুমাত্র শাস্ত্রকথন বা সাজসজ্জায় নয়। মানবী দেবী হয়ে ওঠেন তার চেষ্টায়, সাধনায় ও চর্চায়। এবার আপনাকেই প্রশ্ন করি, আপনি প্রতিদিন একটু একটু করে দেবী হয়ে উঠছেন তো? কারন চারপাশের আসুরিক শক্তি যেভাবে দিন দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাতে কোন নারীর পক্ষেই সাধারণ নারী হয়ে থাকা নিরাপদ নয়। তাই প্রত্যেক নারীকে উন্নীত হতে হবে দেবীত্বে, বিনাশ করতে হবে সকল অন্ধকার ও অপশক্তিকে।
জয় নারীশক্তি, জয় মাতা আদ্যাশক্তি, জয় মা দুর্গা।