হিন্দু পুরান অনুযায়ী দক্ষ কন্যা দক্ষায়নী সতী তার পিতার অমতেই বিবাহ করেছিলেন মহাদেব শিবকে। সারা গায়ে ছাই ভষ্ম মাখা, জটাজুট ধারী, ও চালচুলোহীন শ্মশানচারী শিবকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি প্রজাপতি দক্ষ। তাই দক্ষরাজার আয়োজিত দক্ষযজ্ঞে আমন্ত্রন করেননি তার পুত্রী সতী ও জামাই ভোলানাথ শিবকে। কিন্তু নাছোড়বান্দা সতী মহাদেবের আজ্ঞা অমান্য করেই পিতার যজ্ঞে উপস্থিত নহয়েছিলেন বিনা নিমন্ত্রনে। সতীকে তার যজ্ঞে উপস্থিত দেখে পিতা দক্ষ তুমুল্ভাবে শিবের নিন্দা শুরু করেন। নিজের পিতার কাছ থেকে এরকম অপমান আর স্বামীর নিন্দা সহ্য করতে পেরে যেই যজ্ঞের আগুনে আত্মহুতি দেন দেবী সতী। এহেন পরিস্থিতে ভগবান শিব তীব্র ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে লন্ড ভন্ড করে দেন দক্ষ রাজার সেই যজ্ঞকে। এরপর দেবীর নিথর দেহ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। চিন্তিত হয়ে পড়লেন শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধারী শ্রী বিষ্ণু। তিনি তার মহা শক্তিশালী সুদর্শন চক্র দিয়ে ছিন ভিন্ন করে দেন দেবী সতীর প্রানহীন দেহটিকে। তার সুদর্শন চক্রের আঘাতে মাতা সতীর দেহটি একান্নটি খন্ডে খন্ডিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে। এই স্থানগুলো মাতা সতীর শরীরের অংশের পবিত্র স্পর্শ পেয়ে তীর্থভুমি হয়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে। এই তীর্থভুমীগুলো জাগ্রত শক্তিপীঠ নামে স্থান করে নিয়েছে আমাদের মনের গহীন অন্দরে। পাশাপাশি এই সকল শক্তিপীঠগুলোর রক্ষাকর্তা হিসেবে শিব তার নিজের অংশ ভৈরবের সৃষ্টি করেছেন যা এই শক্তিপীঠগুলোর আশে পাশেই দেখা যায়। এপর্যন্ত ঘটনা আমাদের সবারই কম বেশী জানা, তবে শক্তিপীঠ বলতে সাধারনভাবে কামাখ্যা, কালীঘাট বা বিমলা কে বোঝালেও ভারতের বাইরে তথা নেপাল, পাকিস্থান ও বাংলাদেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু শক্তিপীঠ। শুধু তাই নয়, এই পীঠস্থানগুলো আশ্চর্যজনকভাবে জাগ্রত ও বটে। প্রিয় দর্শক, আজ আমাদের গন্তব্য, ভারতের বাইরের ১০ টি শক্তিপীঠ যা আজও ধারন করে আছে মাতা সতীর শরীরের খন্ডিত অংশ। আশা করি এই শক্তি পীঠগুলো সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য জানতে আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকবেন।
ভারতের বাহিরের সতীপীঠ পরিক্রমায় আমাদের প্রথম গন্তব্য নেপালের গুহ্যেশ্বরী শক্তিপীঠ। সংস্কৃত শব্দ ‘গুহ্য’ ও ‘ঈশ্বরী’ সন্ধিযুক্ত হয়ে গুহ্যেশ্বরী নামটি গঠন করেছে। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ এর ললিতা সহস্রনাম অধ্যায়ের ললিতা দেবীর উল্লিখিত সহস্র নামের মধ্যে ৭০৭ তম নামটি হচ্ছে “গুহ্যরূপিণী” যার অর্থ যে দেবীর মাহাত্ম্য মানুষের উপলব্ধির বাইরে এবং যা গুপ্ত। মতান্তরে নামটি ষোড়শী মন্ত্রের ষোড়শ অক্ষর হতে উদ্ভূত।
গুহ্যেশ্বরী মন্দির নেপালের কাঠমাণ্ডুতে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র মন্দিরগুলোর একটি। এটি আদিশক্তি বা মহাশক্তির মন্দির। পুরানমতে দেবী দক্ষ্যায়নী সতীর জানুদ্বয় পতিত হয়েছিল এই স্থানে। এবং পশুপতিনাথ মন্দিরের স্বয়ং পশুপতিনাথ মহাদেব এই মন্দিরের ভৈরব হিসেবে প্রচারিত। ১৭শ শতকে এই স্থানে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা প্রতাপ মল্ল । এই মন্দিরের দেবী গুহ্যকালী নামেও সুপরিচিতা। সাধারন পুর্নার্থী ও দর্শনার্থী ছাড়াও তন্ত্র সাধকদের কাছে এ এক মহা পবিত্র যজ্ঞভূমি।
উমা শক্তিপীঠ নেপাল
নেপালের আরও একটি অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ শক্তিপীঠ হল উমা শক্তিপীঠ যা নেপালের জনকপুর বা মিথিলায় অবস্থিত। ভোউগলিক অবস্থানের হিসেবে এই মহা শক্তিশালী শক্তিপীঠের অবস্থান ভারতের বিহার ও নেপালের সীমান্ত ঘেষে। এই পবিত্র শক্তিপীঠের সাথে জড়িয়ে আছেন দেবী শক্তি এবং শ্রীরামচন্দ্রের সহধর্মিনী মাতা সীতা । এখানে দেবী পুজিতা হন উমা বা মহাদেবী নামে। এ স্থানের ভৈরব মহোদর নামে সার্বক্ষনিক সুরক্ষা দিয়ে চলেছেন এই পবিত্র শক্তিপীঠকে। পুরান মতে দেবী দখ্যায়নীর বাম স্কন্ধ পতিত হয় মিথিলার এই স্থানে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও পর্যটক মাতা সীতা ও দেবী দক্ষ্যায়নীর স্মৃতিবিজড়িত এই তীর্থভুমিতে উপস্থিত হয়ে দেবীর কৃপা কামনা করেন এবং এর স্বর্গীয় স্থাপত্যশৈলী উপভোগে রত হন।
গন্ডকী চন্ডী শক্তিপীঠ নেপাল
নেপালের গন্ডকী নদীর পাদদেশে পতিত হয়েছিল দেবী গন্ডদেশ। এখানে মুক্তিনাথ মন্দিরে তিনি পুজিতা হন গন্ডকী চন্ডী রূপে। প্রকৃতির কোমল পরশে ঘেরা এই মন্দির ও তার আশেপাশের এলাকা শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণবদের কাছেও মহাপবিত্র এক পুন্যভুমী। বলা হয় এই গন্ডকী নদীর গর্ভে দেখা মেলে ভগবান শ্রীনারায়নের শালিগ্রাম শীলা। এই নদীতটেই মহাদেব শিব চক্রপানি নামে আবির্ভুত হয়ে দেবীপীঠের সুরক্ষা নিশ্চিত করে চলেছেন নিরন্তর। প্রতিবছর অগনিত মানুষ এই গন্ডকী চন্ডিদেবীর মুক্তিনাথ মন্দিরে যাত্রা করে থাকেন তাদের জীবনের সব বাধা বিপত্তি দূর করার জন্য। দেবী মাতাও তার ভক্তরুপী সন্তানদের মনোস্কামনা পুর্ণ করে চলেছেন অবিরামভাবে।
দক্ষায়নী শক্তিপীঠ তিব্বত
সতীপীঠ তীর্থগুলোর মধ্যে অন্যতম দুর্গম পীঠস্থান হচ্ছে। দক্ষায়নী শক্তিপীঠ যা তিব্বতের দুর্গম তুষারার্বৃত অঞ্চলে অবস্থিত। পুরানমতে এ স্থানে পতিত হয়েছিল দেবীর ডান হাত। ভগবান শিবের বাসস্থান কৈলাস পর্বতশৃঙ্গের পাদদেশে তথা মানস সরোবর সন্মগ্লগ্ন এলাকায় অবস্থিত দেবীর এই পুন্যধাম। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় এই পীঠস্থানে জনসাধারনের সমাগম কম হলেও এই দেবীর মাহাত্ম শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে অনস্বীকার্য।
হিংলাজ মন্দির পাকিস্থান
মায়ের কাছে তার সন্তানদের মধ্যে যেমন বিভেদ থাকে না। তেমনি হন্দু অধ্যুষ্যিত এলাকার বাইরেও কৃপাচিহ্ন একেছেন দেবী সতী। বলছি পাকিস্থানের হিংলাজ মাতা মন্দিরের কথা। এখানে পতিত হয়েছিল দেবী সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র। ধু ধু মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত এই পীঠস্থান করাচি থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই স্থানে শক্তির যে রূপের পুজা করা হয় তা হল কট্টারি। এবং এখানকার ভৈরব হলেন ভীমলোচন। এখানে হিংলাজ কথাটি স্থানীয় গ্রামের নামানুসসারেই এসেছে। তবে আসার কথা এখানে তিনি শুধুমাত্র কোন বিষেষ সম্প্রদায়ের মাতা নন, বরং জাতি ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই বাড়ী নানি বা বিনি নানি নামেই পরিচিতা।
সুগন্ধা শক্তিপীঠ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বরিশাল জেলার ১২ মাইল দুরত্বে উজির পুর থানার অন্তর গত শিকার পুর গ্রামে সুগন্ধা নদিতে পতিত হয়েছিল দেবী সতীর নাসিকা। সেহেতু এখানে দেবী পুজিতা হন সুগন্ধা নামেই। দেবীর মন্দিরটি স্থানীয়ভাবে তারাবাড়ি নামেই বহুল প্রচারিত। এখানে দেবী অধিষ্ঠিতা কালো পাথরের মূর্তিতে। ত্রিনয়না এই দেবীর দুটি চোখ রুপোর ও একটি সোনার । এই পিঠের ভৈরব ত্রয়ম্বক যার মন্দিরটি অবস্থিত শক্তি পিঠের অদূরে ঝালকাঠি বাস স্টান্ড থেকে ৫ মাইল দক্ষিণে পোনাবালিয়া নামকস্থানে। এখানে মুলত নদীভাঙ্গনের ফলেই দুররত্ব সৃষ্টি হয়েছে দেবী শক্তি ও তার রক্ষাকর্তা ভৈরবের।
অপর্না শক্তিপীঠ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বগুড়া জেলার শেরপুর উপজলে থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীতটে অবস্থিত অপর্ণা শক্তিপীঠ। জনশ্রুতি আছে একবার কোন এক শাখা চুড়ির ফেরিওয়ালা এই মন্দির সংলগ্ন জঙ্গল দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় কপালে লম্বা সিঁদুর অঙ্কিত একটি মায়াবী কন্যাশিশু তার সামনে হাজির হয়। মেয়েটি সেই ফেরিওয়ালাকে বলল নাটোরের মহারানী তাকে শাখা ও পলা নিয়ে যেতে বলেছেন। এবং এই শাখা ও পলার দাম রাজপ্রসাদের একটা নির্দিষ্ট স্থানে লুকানো একটি ঝুড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছে। ফেরিওয়ালাটি আশ্চর্য হলেও মেয়েটিকে তার শাখা পলা দিয়ে দিলেন এবং রাজপাসাদে হাজির হলেন। তিনি রানীমাকে সেই কন্যা শিশুটির কথা খুলে বললে, রানীমা তৎক্ষণাৎ তার লোকজন ও ফেরিওয়ালাকে নিয়ে সেই স্থানে হাজির হয়ে সেই ঝুড়ির খোজ করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে পাশে অবস্থিত একটি ছোট্ট পুকুর থেকে উত্তোলিত হল সেই শাখা পরা দেবী ভবানীর মুর্তি। আনন্দের আতিশয্যে ফেরিওয়ালাকে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন মহারানী । এভাবেই আবিষ্কৃত হল মাতা ভবানীর এই মন্দির। মন্দিরের পাশে বহমান সেই পুকুরের নাম হল শংখ পুকুর যেখানে আজও পুর্নার্থীরা স্নান করে দেবীর কৃপা লাভের আশায়। পুয়ারান অনুযায়ী এখানে পতিত হয়েছিলে দেবী সতীর বাম পায়ের গোড়ালী এবং এখানকার ভৈরব বামন নামে সর্বমহলে পরিচিত।
ভবানী শক্তিপীঠ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড সংলগ্ন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভবানী শক্তিপীঠ। চারপাশের প্রাকৃতিক মায়াজাল, দেবী সতীর ডান হাত ও ভৈরব চন্দ্রনাথ শিব মিলে মিশে এটিকে বাংলাদেশের অন্যতম মহাশক্তিপীঠে পরিনত করেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত ও পুর্ণার্থী এই চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাত্রা করেন দেবীকে দর্শনের নিমিত্তে। জনশ্রুতি বলে চন্দ্রনাথ পাহাড় দুর্গম হওয়ায় স্থানীয় রাজা ধন মানিক্য এই মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ ও দেবী ভবানীকে সরিয়ে নিজ রাজভবনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্রু দেবীর স্বপনাদেশের ফলে সে সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
জয়ন্তী শক্তিপীঠ সিলেট বাংলাদেশ
দেবী সতীর বাম জঙ্ঘা পতিত হয়েছিল বাংলাদেশের সিলেট শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে অর্থাৎ বর্তমান জয়ন্তী কালী মন্দিরে। এই স্থানের ভৈরবের নাম ক্রমাদিশ্বর। এবং এখানকার শক্তি ও ভৈরব একই মন্দিরেই অবস্থিত। হিন্দু জনসংখ্যার স্বল্পতা হেতু এই মন্দিরের দর্শনার্থী বা পুর্নার্থীদের ভীড় তেমন পরিলক্ষিত না হলেও স্থানীয় মানুষ পরম নিষ্ঠার সাথে মান্যতা প্রদান করে দেবী জয়ন্তিকে। এছারাও, বাতসাওরিক কালীপুজা, শিবরাত্রি প্রভৃতি অনুষ্ঠানে বিপুল জনসমাগম ঘটে এই মহাপবিত্র শক্তিপীঠে।
যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠ বাংলাদেশ
বাংলাদেশে অবস্থিত সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ শক্তিপীঠগুলোর মধ্যে অন্যতম যশোরেশ্বরী মাতা। রাজা প্রতাপাদিত্য যখন বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের ধার ঘেঁষে নিজের নতুন রাজ্য যশোহর নির্মান করেছিলেন, তখন তিনি মায়ের এই মন্দিরটি সংস্কার করে দেন এবং নিজের রাজ্যের নামে এর নাম দেন যশোরেশ্বরী, অর্থাৎ যশোরের ঈশ্বরী। যশোরেশ্বরী মাতাকে সন্মান জানিয়ে তিনি তার রাজধানী নির্মান করেন এই মন্দির সংলগ্ন ধুমঘাট এলাকায়। পুরানমতে দেবী সতীর হাতের ও পায়ের তালু পতিত হয়েছিল এই মন্দিরে। মন্দিরটি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় তথা সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অগনিত কাল ধরে। বর্তমান মন্দিরটি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ব বিভাগ অধিগ্রহন করলেও এর সংস্কার বা মেরামতির তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। তবে মন্দিরের অবস্থা যাই হোক না কেন, প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে এখানকার জনসমাগম চোখে পড়ার মত।