মৃত্যুর পর ৪৭ দিন পর্যন্ত আত্মার সাথে কি কি ঘটে? গরুড় পুরাণ || Garuda Purana Story ||

মানুষের জ্ঞানের গন্ডি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। তবে দেহের বিনাশ ঘটলেও আমাদের আত্মাকে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। জন্মের আগে বা মৃত্যুর পরেও আত্মার সাথে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমরা সচারচার জানতে পারি না। তবে মৃত্যুর পর আত্মার সাথে আসলে কি ঘটে তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে গরুড় পুরাণে। এবং মৃত্যু-পরবর্তী সেই ৪৭ দিনের কাহিনী জানতে আপনাদের সবাইকে সনাতন এক্সপ্রেসে স্বাগতম।

আপনারা জানেন গরুড় পুরাণের অধিষ্ঠাতা দেবতা হচ্ছেন স্বয়ং শ্রীহরি বিষ্ণু। তো একদা শ্রীহরির বাহন গরুড় তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “হে প্রভু, মৃত্যুর পর নরকে গমন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আত্মার সাথে আসলে কি ঘটে? এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চাই।”

উত্তরে ভগবান শ্রীহরি তাঁর বাহন গরুড়দেবকে ভীষন যন্ত্রনাময় ৪৭ দিনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এবং প্রত্যেক পাপী আত্মাকে এই ৪৭ দিন ধরে চূড়ান্ত ভোগান্তি সহ্য করেই যমলোকে পৌঁছাতে হয় বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না মৃত্যুর পর জীবাত্মার তিন প্রকারের গতি হয়ে থেকে। এগুলো হচ্ছে অর্চি মার্গ, ধুম মার্গ ও বিনাশ মার্গ। যিনি তাঁর জীবদ্দশায় কোন প্রকার পাপ করেননি, মিথ্যা বলেননি, কারও ক্ষতি করেননি, নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করেছেন ইত্যাদি কারনে তিনি অর্চি মার্গ প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। অর্চি মার্গ প্রাপ্ত হওয়ার ফলে জীবাত্মা সরাসরি ব্রহ্মলোক বা দেবলোকে গমন করেন এবং মোক্ষলাভ করে থাকেন।

জীবাত্মার তিন প্রকার গতির মধ্যে ২য় গতিটি হচ্ছে ধুম মার্গ। গরুড় পুরাণ অনুসারে জানা যায় জীবাত্মা তাঁর জীবদ্দশায় কৃত সকাম কর্মের ফল হিসেবে ধুম মার্গ প্রাপ্ত হয়। এই ধুম মার্গ প্রাপ্ত জীবাত্মারা সরাসরি পিতৃলোকে গমন করেন। এখানে আগত আত্মারা কর্মফল ও জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে বারংবার আবদ্ধ হয়ে থাকে।

জীবাত্মার তিন প্রকার গতির মধ্যে ৩য় গতিটি হচ্ছে বিনাশ মার্গ। এর নাম শুনেই বোঝা যায়, এই পথ জীবাত্মার পক্ষে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ও মারাত্মক। এবং জীবের এই গতিতেই রয়েছে ৪৭ দিন যাবত ভয়ানক পীড়া, কষ্ট ও যন্ত্রনার আয়োজন। তাহলে এবার আসুন বিনাশ মার্গ প্রাপ্ত জীবাত্মাদের মৃত্যুর পর থেকে কি কি ঘটতে থাকে তা জেনে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুনঃ  সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বা প্রবর্তক কে? || সনাতনের উৎপত্তি|| Who is the Pioneer of Hinduism?

যখন কোন ব্যক্তির মহাপ্রস্থানের সময় হয়, তখন সর্বপ্রথমে তাঁর কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। এসময় সেই ব্যক্তি নিজের সারা জীবনকে যেন চোখের সামনে ছবির মতো দেখতে পান। ঠিক এই সময় দুজন যমদূত তাঁর সামনে প্রকট হন তাঁর আত্মাকে যমলোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যমদূতদের দেখতে পেয়ে ভয়ে আত্মা দেহ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এবং আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে যমদূতগণ তাদের যমপাশ দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলেন। তবে তৎক্ষণাৎ তাকে যমলোকে নিয়ে যাওয়া হয় না। বরং পরবর্তী ১৩ দিন সদ্যমৃত আত্মাকে তাঁর পরিবার পরিজনের সাথে বসবাস করতে অনুমতি দেওয়া হয়। এই ১৩ দিন ধরে আত্মা তাঁর নিজের পারলোকিক ক্রিয়াকর্ম তথা অন্তেষ্টিক্রিয়া, ক্ষৌরকর্ম, শ্রাদ্ধকর্ম, পিণ্ডদান, ব্রাহ্মণ ভোজন ইত্যাদি অনুষ্ঠান নিজ চোখে অবলোকন করে থেকে। এবং এসকল ক্রিয়াকলাপ সমাপন হলে শুরু হয় আত্মার যমলোকে যাত্রা।

আপনারা অনেকেই কথাচ্ছলে বৈতরনী নদীর নাম শুনে থাকবেন। এ পর্যায়ে, আত্মাকে সেই বৈতরনী নদী পার হতে হয়। তবে এ নদী আমাদের পার্থীব নদীর মত টলমলে স্বচ্ছ জলে পরিপূর্ণ নয়। বরং রক্তিম বর্ণের এই নদী দেবী গঙ্গার এক ভয়ানক রূপ। এ নদীতে জলের পরিবর্তে রয়েছে উত্তপ্ত লাভা, নোংরা রক্ত-পুজ, উটকো দুর্গন্ধ, এবং বিভীষিকাময় লাল তরল। এখানেই শেষ নয়, এই নদীর জলে বসবাস করে বিকট দর্শন ও রক্তলোলুপ নানা রকমের প্রাণী, কৃমি ইত্যাদি। এই বিভীষিকাময় নদীর উপর দিয়ে যমদূতগণ টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন সদ্যমৃত জীবাত্মাকে। সেসময় আত্মা অনুভব করে, সে তীব্র জ্বালায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে, কেউ তাঁর শরীরকে চিরে ফেলছে, কোন ভয়ানক প্রানী তাকে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে, কেউবা তাঁর শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করছে, তাঁর শরীরে ঢুকে যাচ্ছে রক্ত-পুজ ও কৃমিযুক্ত লাল জল ইত্যাদি। আর ৪৭ দিন যাবত এই ভয়ানক যন্ত্রনা সহ্য করতে থাকে পাপাত্মা। এবং ৪৭ দিনের এই সফর শেষ করে জীবাত্মা পৌছে যায় যমলোকে। তবে সেই জীবাত্মা যদি তাঁর জীবদ্দশায় নূন্যতম পুণ্য করে থাকে তাহলে তাকে এত কষ্ট করে এই বৈতরনী নদী পার হতে হয় না। বরং একটি গাভীর লেজ ধরে তিনি অনায়াসেই বৈতরনী পার হতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ  যে কোন পূজায় মঙ্গল ঘট বসানোর রহস্য কি? পুজার ঘট স্থাপনের সহজ নিয়ম।

1/5 - (1 vote)

Leave a Comment

error: Content is protected !!