নিয়তির অমোঘ নিয়মে মৃত্যুই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সত্য। ধনী- গরীব, ছোট-বড়, এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই গ্রহন করতে হবে। অর্থাৎ, এই নশ্বর পৃথিবী ও আমাদের নশ্বর দেহ ত্যাগ করে চলে যাওয়া আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক বিধির বিধান। কিন্তু তবুও যুগে যুগে কালে কালে মৃত্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে মানুষ সন্ধান করেছে অমরত্বের। এবং সেই অমৃতের একটি ফোঁটা পান করার তৃষ্ণা আজ অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগে এসেও মানুষ মেটাতে পারেনি। তবে সনাতন শাস্ত্রমতে ৭জন মহাবীর তাঁদের ভালো এবং খারাপ কাজের পুরষ্কার ও শাস্তি হিসেবে লাভ করেছিলেন অমরত্ব। কি ভাবছেন? খারাপ কাজ করেও কি অমরত্ব পাওয়া যায়? আসলে অমরত্ব সবসময় সৌভাগ্য বয়ে আনে না। আসুন জেনে নেওয়া যাক পুরাণে বর্ণিত সেই সাতজন চিরঞ্জীবীর কথা যাদের শ্বাস-প্রশ্বাস এখনো এই পৃথিবীর বুকে চলমান।
দৈত্যরাজ বলি
সপ্ত চিরঞ্জীবির মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন দৈত্যরাজ বলি যাকে মহাবলি, বলিরাজা এবং দৈত্যেন্দ্র নামেও আখ্যায়িত করা হয়। বলিরাজার পিতা ছিলেন বিরোচন, পিতামহ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ এবং প্রপিতামহ ছিলেন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু। বলিরাজা শাসক হিসাবে ছিলেন খুবই ধার্মিক, প্রজাহিতৈষী, ও দাতা। কিন্তু অসুরকূলে জন্মগ্রহনকারী প্রায় সকলেই স্বভাবগতভাবে হয়ে ওঠেন দেববিদ্বেষী। তাছাড়া বলিরাজার অহংবোধও ছিল প্রচন্ড। তিনি ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে তাঁর চেয়ে শক্তিতে দুর্বল ও শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেন। বিপরীতভাবে দেবতাগণও বরাবরই ছিলেন অসুরদের বিরুদ্ধাচারী। একবার তিনি চিরস্থায়ী ভাবে ইন্দ্রপদ প্রাপ্তির জন্য শতাশ্বমেধ যজ্ঞ’ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই যজ্ঞের প্রস্তুতি চলা কালীন তিনি বিষ্ণুর প্রতি হিংসাত্মক ও তাচ্ছিল্যভাবাপন্ন মানসিকতার জন্য তারই পিতামহ ভক্ত প্রহ্লাদ কর্তৃক অভিশপ্ত হয়েছিলেন।
বলিরাজাকে অভিশাপ দিয়ে পরম বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ বলেছিলেন, “যে শ্রীহরি সর্বশক্তিমান, যার ইচ্ছামাত্রে এ জগতের সৃষ্টি এবং বিনাশ হয় তার শক্তি নিয়ে তাচ্ছিল্য করা বা তাকে শত্রু মনে করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমার থেকে বহুগুণ শক্তিশালী রাজা হিরণ্যকশিপুকেও বধ করেছিলেন নৃশিংহরূপী শ্রীহরি। এমনকি আমি নিজেও আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে স্মরণ করি শ্রীহরির নাম। আমার আরধ্যকে হেয় করার জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি তোমার এই শতাশ্বমেধযজ্ঞ কখনো সম্পন্ন হবেনা। তোমার সম্পুর্ণ সাম্রাজ্যের পতন হবে। আর যতক্ষন না পর্যন্ত তোমার মনে বিষ্ণুভক্তি জাগ্ৰত হচ্ছে ততক্ষন তোমার কোনো উত্থান হবে না।”
বলিরাজা তাঁর পিতামহ প্রহ্লাদের কথায় কর্ণপাত না করে শুরু করলেন শতাশ্বমেধ যজ্ঞ। সেখানে বেদজ্ঞ , শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ , দরিদ্র সকলেই এসে স্বীয় ইচ্ছা মতো দান নিয়ে বলিরাজেকে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। মহারাজ বলিও কার্পণ্য না করে সকলের ঈপ্সিত বস্তু দান করতে লাগলেন । এমন সময় সেখানে মাথায় ছাতাধারী এক খর্বকায় ব্যাক্তি উপস্থিত হলেন। বলিরাজা এই বামনের কাছে তাঁর কি চাওয়া তা জানতে চাইলেন। উত্তরে বামন চাইলেন তিনটি পা রাখার জায়গা। এই খর্বকায় তথা বামন ব্যাক্তিটি ছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীহরির বামন অবতার। বলিরাজা তাকে চিনতে না পারলেও অসুরগুরু শুক্রাচার্য তাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলিরাজাকে বামনদেবের কাঙ্ক্ষিত ত্রিপাদ ভূমি দান করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু বলিরাজা অসুরগুরুর পরামর্শ উপেক্ষা করে তাকে ত্রিপাদ ভূমি মঞ্জুর করলেন।
এবার খর্বকায় বামনদেবের শরীর অতিকায় হয়ে উঠল। তাঁর এক চরণ দ্বারা তিনি সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করলেন । দ্বিতীয় চরণ দ্বারা আবৃত্ত করলেন সমগ্র পৃথিবী। এরপর তাঁর শরীর থেকে তৃতীয় একটি পা বের করে বলিরাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর এক চরণ রাখি কোথায়? বলিরাজা এতক্ষণে বুঝতে পারলেন বামনদেব কোন সাধারন ভিক্ষুক নন। তিনি স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর অবতার। সেই মুহূর্তে তাঁর মনে উদয় হল বিষ্ণুভক্তির। তিনি পরম সমাদরে নিজের মস্তক পেতে দিয়ে বললেন, “হে প্রভু, আমার এই দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন মস্তকই হোক আপনার তৃতীয় চরণ রাখার স্থান”
বলিরাজার ইচ্ছানুযায়ী বামনদেব তাঁর মস্তকে তৃতীয় চরণ রেখে তাকে পাতাললোকে প্রেরণ করলেন। তবে বলিরাজার মনে উদিত হওয়া বিষ্ণুভক্তি এবং নিজের বিপদ জেনেও প্রতিশ্রুতি রক্ষার ধর্ম পালন করা দেখে ভগবান বিষ্ণু প্রসন্ন হয়ে তাকে ‘অমরত্ব’ প্রদান করলেন এবং সম্পুর্ণ ঐশর্য সহ সুতল লোক তথা চতুর্থ পাতালের রাজত্ব প্রদান করলেন। এছাড়াও এবং তিনি স্বয়ং বলিরাজার রাজপ্রাসাদের দ্বারপাল হয়ে সেখানে নিবাস করলেন। উপরন্তু, বিষ্ণুদেব বলিরাজাকে পরবর্তী সাবর্ণি মন্বন্তরে ইন্দ্র হওয়ারও বরদান দিলেন। সর্বস্ব হারিয়েও নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য দৈত্যরাজ বলি কে জগতের সবথেকে বড় দানবীর বলা হয়। এই মহাবলি দ্বাদশ বৈষ্ণব মহাজনের মধ্যে একজন বলে গণ্য হন। এবং বলাই বাহুল্য তিনি সনাতন শাস্ত্রে উল্লেখিত সাতজন চিরঞ্জীবীর মধ্যে অন্যতম।
পরশুরাম
সাতজন চিরঞ্জীবীর মধ্যে আরও একজন হচ্ছেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন ঋষি জামদগ্নি ও মাতা রেনুকার পঞ্চম সন্তান হিসবে। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল রাম। তিনি তাঁর আরধ্য মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে লাভ করেছিলেন এক অমোঘ অস্ত্র। এই অস্ত্রের নাম পরশু। এবং এই পরশুকে ধারন করার পর তাঁর নতুন নাম হয়েছিল পরশুরাম। একবার ঋষি জমদগ্নি তাঁর স্ত্রী রেনুকার চরিত্রে পরপুরুষের প্রতি কামাসক্তি আবিষ্কার করলেন এবং প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে রেনুকার মৃত্যদন্ড দিলেন। মৃত্যুদন্ড কর্যকর করার জন্য জমদগ্নি একে একে পরশুরামের অগ্রজ ভ্রাতাদের আদেশ করলেন। কিন্তু তারা কেউই মাতৃহত্যা করতে রাজি হলেন না। ফলে জমদগ্নি তাদেরকে অভিশাপ প্রদান করে পাথরে পরিনত করলেন। এরপর এল পরশুরামের পালা। তবে তিনি তাঁর ভ্রাতাদের মত পিতার আজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারেননি। তাঁর কুঠার দিয়েই তিনি শিরোচ্ছেদ করেছিলেন তারই গর্ভধারিনী মাতাকে। এতে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ঋষি জমদগ্নি। তিনি খুশি হয়ে পুত্রকে বর চাইতে বললেন। পরশুরাম চাইলেন তার মাতা এবং অগ্ৰজদের জীবন ফিরিয়ে দেওয়া হোক। পুত্রের এমন মহানুভবতা দেখে ঋষি জমদগ্নি রেনুকা ও তাঁর পুত্রদের পুনরায় জীবন দান করেন এবং একইসাথে পরশুরামকেও চিরঞ্জীবি হওয়ার বরদান দিলেন। বলা হয় কলিযুগের শেষে ভগবান বিষ্ণু যখন কল্কি অবতাররূপে জন্মগ্রহণ করবেন তখন তিনি পরশুরামের শিষ্যত্ব বরণ করবেন।
বিভীষণ
সাতজন চিরঞ্জীবীর মধ্যে তৃতীয়জন হচ্ছে লঙ্কেশ রাবনের ভ্রাতা বিভীষণ। ঋষি বিশ্বস্রবা এবং রাক্ষসী নিকষার পুত্র ছিলেন বিভীষন। রাক্ষসী নিকষা তার স্বামীর কাছে অসময়ে সন্তান প্রার্থনা করেছিলেন, যার ফলে তার প্রথম দুই পুত্র রাবন এবং কুম্ভকর্ণ দুরাচারী চরিত্রসম্পন্ন হয়েছিল। নিকষা এতে দুঃখিত হলে ঋষি বিশ্বস্রবা বলেন, “তার কনিষ্ঠ পুত্র হবে অত্যন্ত ধার্মজ্ঞানি এবং ভগবত ভক্তি সম্পন্ন। সে সদা সত্য কথা বলবে, ন্যায় এবং ধর্মের পথে থাকবে এবং তার মাধ্যমেই সমগ্ৰ রাক্ষজাতির উদ্ধার হবে।” এই তৃতীয় সন্তানই ছিলেন বিভীষন।
বিভিষণের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মা তাকে সদা ধর্মপথ অনুসরন এবং ভগবানের দর্শন লাভেরও বরদান দিয়েছিলেন। ভগবান রামচন্দ্র এবং রাক্ষসরাজ রাবনের মধ্যকার দন্দ্বে বিভীষন তাঁর বিবেক বিসর্জন দিয়ে ভ্রাতার অনুগামী হতে পারেন নি। তাই তিনি পক্ষ নিয়েছিলেন ভ্রাতার শত্রু ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের। তিনি প্রভু রামচন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, “রাবনের অপরাধের শাস্তি যেন সমগ্ৰ লঙ্কাবাসী না পায়।” এই বিভীষণ অমরত্ব লাভ করেছিলেন স্বয়ং প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের কাছ থেকে। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র পৃথিবীর সমগ্র জীবজগতকে সত্য ও ধর্মের পথে পরিচালিত করার জন্য বিভীষণকে এই বরদান দিয়েছিলেন।
হনুমান
পবনপুত্র হনুমান হচ্ছেন সাতজন চিরঞ্জীবীর মধ্যে অন্যতম একজন। কোন কোন মতে তিনি স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের অবতার বলেও গণ্য হন। তবে তাঁর সবথেকে বড় পরিচয় তিনি রামভক্ত হনুমান। সম্পুর্ণ রামায়ন জুড়ে তিনি প্রভু রামের প্রতি ও মাতা সীতার প্রতি যে অপ্রতুল ভক্তি প্রদর্শন করেছেন তা জগতে অত্যন্ত বিরল। রাম সীতার জন্য তাঁর যে ত্যাগ তা কখোনই দু একটি বাক্যে বর্ননা করা সম্ভব নয়। সমগ্র বিশ্ববাসী তাঁর বীরত্ব, আনুগত্য ও ভক্তির অনুরাগী। বহুগুণে গুনান্বিত হনুমান মাতা সীতাকেও মাতৃজ্ঞান করতেন এবং হৃদয়সিংহাসনে আসীন করে রাখতেন। তাই মাতা সীতা তাঁর সন্তান হনুমান কে বরদান দিয়েছিলেন যে জগতে যতদিন রামনাম থাকবে ততদিন পর্যন্ত রামভক্ত হনুমান পৃথিবীতে থাকবেন। আবার মতান্ত্বরে, সরযূ নদীতে লীলা শেষ করার সময় স্বয়ং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র পৃথিবীকে সত্য, ন্যায় ও আদর্শের আলো প্রদর্শন করার জন্য তাঁর প্রিয় ভক্ত হনুমানকে অমরত্ব প্রদান করেছিলেন।
ব্যাসদেব
সাতজন চিরঞ্জীবীর পঞ্চম হচ্ছেন ব্যাসদেব। ঋষি পরাশর এবং মাতা সত্যবতীর সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন এই মহাজ্ঞানী ঋষি। তাঁর জন্মের পূর্বে বেদ একটি ছিল এবং তিনি বেদকে মোট চারভাগে বিভক্ত করেছিলেন এই কারনে তাকে বেদব্যাস বলা হয়। তিনি ছিলেন কৃষ্ণ বর্ণের এবং যমুনার একটি দ্বীপে জন্মগ্ৰহন করার জন্য তার নাম হয় দ্বৈপায়ণ। এসকল কারনে জগতে তিনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন মহাভারত ও শ্রীমদভগবতগীতার তথা সর্বশাস্ত্রের রচয়িতা। কোন কোন মতে তিনি ভগবান বিষ্ণুর অংশাবতার বলেও গণ্য হয়ে থাকেন। পুরাণমতে তিনি বিঘ্নহর্তা গণেশের সাহায্যে মহাভারত লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই কারনে গণেশ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দীর্ঘায়ু তথা অমরত্বের বর দেন। অন্যমতে ভগবান বিষ্ণুও তাকে চিরঞ্জীবী হওয়ার বর দিয়েছিলেন।
কৃপাচার্য
ষষ্ঠ চিরঞ্জীবী হিসেবে যার নাম আসে তিনি হলেন কৃপাচার্য। শরদ্বান ঋষির ঔরসে জন্ম হয় কৃপ ও কৃপী নামক দুই ভাইবোনের। এর মধ্যে কৃপী ছিলেন হস্তিনাপুরের কুমারদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের স্ত্রী। এবং কৃপ তথা কৃপাচার্যকে পালিত পুত্র হিসেবে পালন করেছিলেন হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু। পরবর্তীতে তিনি কুরুবংশের কুলগুরু পদে নিযুক্ত হন। উল্লেখ্য, এই কৃপাচার্যের হাতেই অস্ত্রবিদ্যার হাতেখড়ি হয়েছিল কুরু ও পাণ্ডব কুমারদের। বলা হয় কৃপাচার্য এত বড় যোদ্ধা ছিলেন যে তিনি একবারে ষাট হাজার শত্রুকে পরাস্ত্র করতে পারতেন। সাহসিকতার বিচারে তিনি কেবল দেব সেনাপতি কার্তিকের সাথেই তুলনীয়।
কিন্তু কৌরব অন্নে প্রতিপালিত হওয়ার কারনে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করতে। তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃপাচার্য সত্য, ধর্ম এবং নিরপেক্ষতার মতো মহান গুণ প্রদর্শন করেছিলেন এবং অত্যন্ত মানসিক চাপের মধ্যেও তিনি তার মূল্যবোধের সাথে আপস করেননি। একারনে কৃপাচার্য সমগ্র মানব জাতির কাছে হয়ে উঠেছিলেন এক মহান দৃষ্টান্ত। যুদ্ধ শেষে কৌরবপক্ষীয় যে তিনজন মহারথী বেঁচেছিলেন, তাদের মধ্যে কৃপাচার্য ছিলেন একজন। বাকি দুজন হলেন কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কৃপাচার্যকে পরীক্ষিতের গুরু নিযুক্ত করে তাঁর হাতে পরিক্ষীতের সমস্ত শিক্ষার ভার দেন। এছাড়াও তাঁর গুণের মহিমায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে অমরত্বের বরও প্রদান করেছিলেন।
অশ্বত্থামা
সাতজন চিরঞ্জীবীর শেষজন হচ্ছেন অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামা ছিলেন কৌরব ও পান্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য ও মাতা কৃপীর পুত্র এবং আরেক চিরঞ্জীবী কৃপাচার্যের ভাগিনেয়। কোন কোন মতে অশ্বত্থামা ছিলেন মহাদেবের অবতার। অশ্বত্থামা তার জন্মের পর অশ্বের সমান উচ্চস্বরে চিৎকার করেছিলেন বলে তার নাম হয় অশ্বত্থামা। জন্মগতভাবে তিনি তার মাথায় এক দিব্য মনি লাভ করেছিলেন যার প্রভাবে তিনি চিরযৌবন এবং চিরআরোগ্য লাভ করেছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি পক্ষালম্বন করেছিলেন কৌরবদের। তবে তাঁর সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজটি ছিল, তিনি পান্ডবদের অনাগত ভনিষ্যতকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য, অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভে ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাত হেনেছিলেন গর্ভস্থ পরীক্ষিতকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে।
পরবর্তীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উত্তরার গর্ভস্থ শিশুটিকে পুনরায় জীবন্দান করেন এবং নাম দিয়েছিলেন পরীক্ষিত। এবং এই পাপের কারনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামার মাথা থেকে দিব্য মনি উপড়ে নিয়ে সেখানে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলেন। এই ক্ষতের নারকীয় যন্ত্রনায় যখন অশ্বত্থামা ছটফট করতে লাগলেন, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে অমরত্বের অভিশাপ দিলেন। অর্থাৎ এই তুমুল যন্ত্রনা নিয়েই অশ্বত্থামাকে বেঁচে থাকতে হবে চিরকাল। আর এটাই হল সেই উদাহরণ যেখানে অমরত্ব সবসময় আশির্বাদ হয় না বরং অভিশাপও হয়ে থাকে। বলা হয় পরবর্তী ২৯ তম দ্বাপরযুগের বেদব্যাস হবেন এই অভিশপ্ত অশ্বত্থামা।
এই ছিল সাতজন চিরঞ্জীবীর কাহিনী। তবে কোন কোন মতে মোট চিরঞ্জীবীর সংখ্যা ৮জনও বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ঋষি মার্কান্ডেয়কেও অমরত্বের বরপ্রাপ্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
ঋষি মার্কান্ডেয়
শিব এবং বিষ্ণুর উপাসক ঋষি মার্কান্ডেয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভৃগু বংশে। তাঁর পিতা ছিলেন মৃকান্ডু এবং মাতা মারুদমতি। ঋষি মার্কান্ডেয়র পিতা মাতা এক পুত্র সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে উপাসনা করেছিলেন ভগবান শিবের। এর ফল স্বরুপ ঋষি মৃকান্ডুকে দুটি বরের মধ্যে যেকোন একটি বর বেছে নিতে বলেছিলেন ভগবান শিব। প্রথম বরটি ছিল তিনি প্রচণ্ড বুদ্ধিমান এক পুত্র সন্তান লাভ করবেন যার জীবন কাল হবে অতি সামান্য এবং ২য় বরটি ছিল তিনি এক স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন সন্তান জন্ম দেবেন যার জীবনকাল হবে দীর্ঘ। পিতা মৃকান্ডু প্রথম বেছে নিয়েছিলেন প্রথম বরটিকে। এর ফলে জন্ম হয়েছিল ঋষি মার্কন্ডেয় এর। তার জীবনকাল স্থির করা হয়েছিল মাত্র ষোল বছর।
এই মার্কন্ডেয় শিবের এক মহান ভক্ত হিসাবে বড় হয়ে ওঠেন এবং তাঁর নির্ধারিত মৃত্যুর দিন তিনি শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরে নিরন্তর উপাসনা করতে থাকেন। যমরাজ তার জীবন কেড়ে নিতে এসে মার্কন্ডেয়র গলায় ফাঁস দিতে গেলে সেই ফাঁস গিয়ে পড়ে শিবলিঙ্গে। এতে ক্রুদ্ধ হন মহাদেব। তিনি তাঁর যমরাজকে হটিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন তাঁর বালক ভক্তের। এরপর মহাদেব তাকে ইচ্ছামৃত্যুর বর প্রদান করেছিলেন। এই ইচ্ছামৃত্যুর কারনে তাকে অমর বা চিরঞ্জীবী নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
শেষ হল ৮ জন চিরঞ্জীবীর কাহিনী। তবে এ প্রসঙ্গে বিষ্ণুপুরাণের ‘প্রাতঃস্মরণশ্লোকানি’ তে বলা হয়েছে-
অশ্বত্থামা, বলি, ব্যাস, হনুমান, বিভীষণ, কৃপাচার্য, পরশুরাম” – এই সপ্ত চিরঞ্জীব এবং অষ্টমে ‘ঋষি মার্কন্ডেয়’ -এর নাম যে প্রতিদিন সকালে স্মরণ করে তার মৃত্যুভয় দুর হয় এবং দীর্ঘায়ু লাভ হয়।